আসুন, দেশকে নিররতামুক্ত করি অধ্যাপক by মোঃ আনিসুর রহমান
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মদান থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও দেশের অর্ধেকেরও বেশি বয়স্ক, ১৫ বছরের উর্ধে পাঁচ কোটির কাছাকাছি মানুষ লিখতে পড়তে পারে না।
গণশিা যে কোন দেশের উন্নয়নের একটি প্রধান ভিত্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে দণি-পূর্ব এশিয়ায় একটার পর একটা দেশে উন্নয়নের যে অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছে, যে জন্য এই দেশগুলোকে 'টাইগার' দেশ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে_ জাপান, দণি কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এই সব দেশেই শতকরা নব্বই ভাগের উপরে মানুষ সারতা অর্জন করেছে। আর আমরা শুধু ফুটবল-ক্রিকেটের বিশ্বকাপেই 'টাইগার' দলে যোগ দিতে পেরে আনন্দ করছি। দেশ থেকে নিররতা দূর তথা উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় টাইগার হবার স্বপটুকুও দেখছি না। আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের পূর্ণ মর্যাদা দেবার কথা আজও চিন্তা করছি না।দেশ স্বাধীন হবার পর কিন্তু দেশের নানা স্থানে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে দেশপ্রেমিক ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুণীরা দেশের নিরর জনগণকে সার করে তোলার আন্দোলনে নেমে গিয়েছিল। এ খবর সবাই জানেন। এদের মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী-কৃষ্ণপুর গ্রামের বিখ্যাত 'টিপ্ সই ছি ছি' আন্দোলনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এই আন্দোলনে গ্রামের শিশু-কিশোরদের সম্মিলিত দাবিতে ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারী কর্মচারীরাও এই গ্রামের সার হতে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীদের বিভিন্ন সরকারী কাগজপত্রে টিপ্ সই-এর পরিবর্তে নাক-সই দিতে বলা শুরু করেছিলেন। এর ফলে এই গ্রামের সবাই সার হবার জন্য শিশু-কিশোরদের দ্বারা পরিচালিত সারতা কেন্দ্রে ভিড় করে আসতে শুরু করেছিল (রহমান ১৯৯৭: ৪২-৪৯)। এই আন্দোলন অন্যান্য গ্রামেও ছড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের রাজনৈতিক প্রোপট বদলে যাওয়ায় এই আন্দোলন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। এর ফলে আমরা যে সারতার দিক দিয়ে এবং এই কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়নের দিক দিয়ে পূর্ব এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি_ এ তো খুব একটা গর্বের কথা নয়।
গত ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের মধ্যে আমাদের এই সোনার বাংলা থেকে নিররতা সম্পূর্ণ দূর করবেন। এটি অত্যন্ত অনুপ্রেরণাময় প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়নের পথে এগোবার জন্য তেমন পদপে দেখা যাচ্ছে না। গতানুগতিক 'অ-আ-ই-ঈ' শেখা ও পরে বাক্য রচনা শিাদানের পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং তার জন্য শিক নিয়োগ করে এই ল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এই গতানুগতিক পদ্ধতিতে এক কাস ছাত্রকে শেখাতে নূ্যনতম ছয় মাস লাগে। আর তা ছাড়া শিকের জন্য বিরাট খরচ তো আছেই। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ল্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জন করতে হলে ভাষা পরিচয়ের অনেক দ্রুততর পদ্ধতি প্রয়োজন, আর দেশের ছাত্র/তরুণ সমাজকে শিাদানের কাজে নামানো প্রয়োজন।
আজকে বিশ্বের নানান্ দেশে লিখতে-পড়তে শেখানোর দ্রুততর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। আনন্দের কথা, আমাদের দেশেও এ রকম একটি পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে_ অধ্যাপক আহসানুল হকের 'ছবি দিয়ে পড়া শিখি' পদ্ধতি। এই পদ্ধতি দিয়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের ষোলোটি জেলায় বিভিন্ন হাইস্কুল ও কলেজের দেশপ্রেমিক ছাত্র-ছাত্রীরা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিরর মানুষ-তেমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, গৃহস্ত্রী, ফেরিওয়ালাদের দিনে দু'ঘণ্টা এক মাস থেকে দুই মাসের মধ্যে লিখতে-পড়তে শেখাচ্ছে। এ খবর পত্র-পত্রিকা ও সংবাদপত্রে বেরোচ্ছে (টুটুল ২০০৯; রকিব ২০১০)। এর জন্য 'ছবি দিয়ে পড়া শিখি' বইটি শিার্থীরা প্রত্যেকেই দশ টাকা দামে কিনে নিচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় খাতা-পেন্সিলও তারা নিজেরাই যোগাড় করছে। যার ফলে এই পদ্ধতিতে শেখার জন্য বাইরে থেকে খরচ মূলত ভলান্টিয়ারদের মধ্যে শিা-ম্যানুয়ালটি বিতরণ এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যা খুব সামান্যই।
দেশপ্রেমিক এই তরুণ-তরুণীদের পথ অনুসরণ করে আজকে তাই সুযোগ এসেছে সারাদেশের তরুণ সমাজ-ছাত্র-ছাত্রছাত্রীদের দেশব্যাপী সারতা আন্দোলনে নামিয়ে দিয়ে খুব অল্প সময়ে এবং অল্প খরচে দেশের সবাইকে সার করে তোলার। সারাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা এই আন্দোলনে নেমে গেলে আমরা বছর দুইয়ের মধ্যেই এ দেশকে সম্পূর্ণ সার করে তুলে পূর্ব এশিয়ার 'টাইগার' দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিতে পারি এবং আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ শুধু প্রতিবছর স্মরণ নয়, তাকে সার্থক করে তুলতে পারি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সরকারের কাছে আমার আবেদন, এটিকে আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে ঘোষণা করুন_ নিররতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম মুক্তিযুদ্ধের জন্য বঙ্গবন্ধু যেমন দেশের নিরস্ত্র জনগণকে শুধু বাঁশের লাঠি হাতেই নামতে আহ্বান করেছিলেন, সে রকম দেশের নিরর জনগণকে শুধু পেন্সিল/কলম-খাতা হাতে রণেেত্র নামতে আহ্বান করুন, বাকি কাজ করবে দেশের দেশপ্রেমিক ছাত্র-তরুণ সমাজ। এর জন্য সরকার থেকে শুধু স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নীতিগত ঘোষণা ও 'ছবি দিয়ে পড়া শিখি' পুস্তিকাটি প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ছাপিয়ে বন্টনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও প্রাক্তন সদস্য, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন।
No comments