মা ও মেয়ের দ্বন্দ্ব
মা ও মেয়ের মধ্যে কোন সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও হয়। কারণ, মানবিক সম্পর্ক মানেই মানসিক অবস্থার নানা জটিলতা। আর এই সম্পর্কের জটিলতা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে জীবনে আধুনিকতার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে।
কোন একটি সাধারণ নিয়ম বা সমাধান এর জন্য কার্যকর নয়। মানুষ যেহেতু প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা তাদের সম্পর্কের চরিত্র ভিন্ন। আর এ কারণেই তা মোড় নেয় অজানা সব বাঁকে। যেমন অবন্তিকার হীনম্মন্যতার কারণ তার রূপসী মায়ের ঠিকরানো সৌন্দর্য। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে শুনতে শুনতে বড় হতে হলো যে তার মার রূপের ছিটেফোঁটাও সে পায়নি। আত্মীয়স্বজনদের এই কা-জ্ঞানহীনতা যে শিশুর কোমল মনে কতটা আঘাত হানে তা তারা কোন দিনই বুঝবে না। তা বুঝতে হবে প্রধানত তার মাকেই। যখনই মেয়ের সামনে কেউ মায়ের প্রশংসা গাইতে বসবে মা যেন তখনই তা মেয়ের সামনে নস্যাত করে দেন বা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন মেয়েকে বোঝান যে, বাইরের চেহারার তারতম্যটা নয়, বড় কথা হলো গুণ আর স্বভাবের সৌন্দর্য। মেয়ের গুণের প্রশংসা করে মা একই সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস যেন ফিরিয়ে আনতে পারেন তেমনই পারেন মেয়ের মন থেকে এই হীনম্মন্যত্যা এবং তা থেকে তৈরি হওয়া যাবতীয় জটিলতা মুছে দিতে। তবে তার জন্য মাকে বিসর্জন দিতে হবে স্তুতির মোহ, অন্তত সন্তানের সুস্থ মানসিক স্থিতির স্বার্থে। নইলে এ জন্য পরে অনেক বড় মাসুল গুনতে হতে পারে।কেবল চেহারা নয়, জনপ্রিয়তা, সাফল্যও মা-মেয়ের মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই বড় বিভেদ রচনা করে প্রিয়াঙ্কার মতো আরও অনেকের জীবনেই। তার মা যে যোগ্যতা, তা বার বার নানাভাবে উচ্চারিত হয়। মায়ের সমান সফল হওয়াটা যেন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তাদের সামনে। এক্ষেত্রেও মাকেই তার মেয়েকে বোঝাতে হবে যে, সফলতাটাই জীবনে সব থেকে মূল্যবান নয়। ভাল মানুষ হওয়াটাই জীবনের শেষ কথা। সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব তো মা-বাবারই কিন্তু ওভার-প্রোটেকটিভনেস বা পজিসিভনেস অনেক সময়ই স্বাভাবিক সম্পর্কের পথে হয়ে ওঠে অন্তরায়। দু’টি গাছের মধ্যে যেমন আলো-হাওয়ার জন্য যথেষ্ট স্পেস দরকার তেমনি ব্রিদিং স্পেস দরকার মা-মেয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। মা-বাবা অভিভাবক হিসেবে সর্বদাই চেষ্টা করা দরকার বাড়ন্ত মেয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর দূরত্বটা বজায় রাখা। অনেক মা এ ব্যাপারে একেবারেই অপারগ হন, সেক্ষেত্রে নিজেকে পুরোদস্তুর পাল্টাতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিংও নিতে পারে।
আবার এর ঠিক উল্টোদিকেই আছে ব্যস্ততার জন্য মায়ের মেয়েকে সময় না দিতে পারা। মা ব্যস্ত থাকতে পারেন, কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কেবল সন্তানের জন্ম দেয়া মানেই মা হওয়া নয়; মা হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত সন্তানকে মানসিক নিরাপত্তা প্রদান। আর এই নিরাপদ আশ্রয়ের আধারটি তো স্নেহময় সান্নিধ্য দিয়েই তৈরি হয়। মেয়েকে আপনি কতটা সময় দিচ্ছেন, তার পরিমাপ ঘড়ির কাঁটা দিয়ে হবে না। মেয়ে যেন অনুভব করে, ব্যস্ততার মধ্যেও মায়ের সবটুকু মনোযোগ, স্নেহ তার দিকেই। তাহলেই সে তার মায়ের ব্যস্ততাকেও সম্মান করতে শিখবে, একই সঙ্গে নিজেকেও অবহেলিত, অনাদৃত মনে করবে না। মা-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হলেই দু’জনের সম্পর্কে অবাঞ্ছিত জটিলতা প্রবেশাধিকার পাবে না।
সুলেখা মৌমিতা
No comments