সাহিত্য ও সামাজিক দায়বদ্ধতা by মীর আশফাকুর রহমান তানিম
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বাংলা সাহিত্য। প্রাচীন যুগের চর্যাপদ, মধ্যযুগের বর্ণময় অনুবাদ সাহিত্য, আর আধুনিক যুগের কাব্য ও গদ্য সাহিত্য স্বমহিমায় দীপ্তমান।
লোকসাহিত্য, পুঁথিসাহিত্য, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, প্রহসন ইত্যাকার শাখার বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার। বাঙালি সংকর জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শ্রেষ্ঠত্ব, স্বকীয়তার উদ্ঘাটন, ধারক ও বহিঃপ্রকাশে বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য।
সাহিত্যকে বলা হয় গরৎৎড়ৎ ড়ভ ঃযব ঝড়পরবঃু বা সমাজের দর্পণ। সমাজের শৃঙ্খলাবিধ্বংসী অসঙ্গতি, উৎকর্ষের উপায়, দিকনির্দেশনামূলক মন্তব্য উঠে আসে সাহিত্যের দর্পণে। যদিও প্রমথ চৌধুরী তার 'সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে নিজস্ব মতাদর্শ ব্যক্ত করে বলেছেন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য সবাইকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। তিনি বিভিন্ন যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে সাহিত্য ও শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন।
সাহিত্য কি সত্যিই শিল্পীমনের আনন্দ থেকে উৎসারিত আনন্দদানের নিমিত্তেই সৃষ্ট? যদি তাই হয়, তাহলে জাতীয় কবি নজরুলের লেখনী ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কেন? কেনইবা তিনি 'বিদ্রোহী কবি' উপাধিতে অলঙ্কৃৃত হয়েছিলেন? শুধু আনন্দ দান করাই যদি সাহিত্যের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বেইজিংয়ের আপসহীন ঔপন্যাসিক মো ইয়ান চলতি বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতেন কি? কেননা, কমিউনিজম ধারার কুফল, মানব প্রকৃতির কুৎসিত দিক, সরকারি দুর্নীতি, সমাজের অন্ধকার দিক তার লেখনীতে স্থান পাওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। নিছক আনন্দদানের জন্য নয়।
বাংলা সাহিত্যের চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত ইস্যুতে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞান, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি সমাজের অপরিহার্য ইস্যু। সাহিত্য সমাজে বসবাসকারী সামাজিক মানুষ কর্তৃক সৃষ্টিকর্ম। তাই সাহিত্য বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তির জ্ঞান সমৃদ্ধ করণার্থে যেমন কার্যকরী, তেমনি জনমত গঠন ও সচেতনতা তৈরিতেও সমান সচেষ্ট। তাই সাহিত্য ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বিষয় দুটি ঘনিষ্ঠ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সাহিত্যিকের দায়মুক্তি ঘটে তার সমাজ সংস্কারমূলক অমীয় কীর্তি সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।
আনন্দ দান করাও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ আনন্দ-বেদনা সমাজের মানুষের দ্বারাই উপভোগ্য ও অনুভূত হয়ে থাকে। আনন্দ-বেদনার সমন্ব্বয়েই জীবন। তাই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের আনন্দ-বেদনা সাহিত্যের বিষয়বস্তু।
সাহিত্য একটি শিল্প। একটি রচনা যখন হৃদয়গ্রাহী ও শিল্পসম্মত রূপ পরিগ্রহ করে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়, তখন তা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে। এ শিল্পে শিল্পী যত দক্ষ ও মৃত্তিকাপ্রেমিক হন, শিল্পকর্ম ততই সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় এবং সমাজের ইতিবাচক অবদানে হয় ততটাই কার্যকরী।
একটি নির্দিষ্ট দেশের সাহিত্যে নিত্যনতুন শাখা বা রচনাশৈলী বৈচিত্র্যের মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। তবে তাকে অবশ্যই মৌলিকত্ব ধারণ করতে হবে। আর এ কারণেই নতুন অথচ ব্যতিক্রমধর্মী সাহিত্যকর্মকে যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে। সাহিত্য এবং সাহিত্যিক ইদানীং আগের মতো তেমন সমাদৃত হচ্ছে না। সাহিত্যিক ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সাদামাটা। একজন পিতা কবি ও সাহিত্যিকের চেয়ে একজন ব্যাংকার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের অভিভাবক হতে ইচ্ছুক। তাই সন্তান সাহিত্যে আগ্রহ দেখালেও তাকে অভিভাবক কর্তৃক এ পরিমণ্ডলে নিরুৎসাহিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা অকাট্য না হলেও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। অর্থ-প্রতিপত্তিকেন্দ্রিক ও বেগ দিয়ে আবেগ কেড়ে নেওয়া বিজ্ঞানের এ যুগে সৃষ্ট জটিলতর জীবনধারায় সাহিত্য তার আবেদন হারাচ্ছে ক্রমাগত। চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে পুস্তকাবদ্ধ সাহিত্য যেন সেকেলে। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সক্ষম সাহিত্য ও চিত্তাকর্ষক প্রযুক্তির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনপূর্বক প্রযুক্তিকে বাংলা সাহিত্যের সংরক্ষণ, ক্রমবিকাশের মাধ্যম হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকার কর্তৃক উৎসাহব্যঞ্জক ব্যবস্থা গ্রহণ, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সাহিত্যকর্মগুলো ই-বুকে পঠনযোগ্য ও অনলাইনে উন্মুক্তকরণ ইত্যাদি হতে পারে যুগোপযোগী পদক্ষেপের উদাহরণ। আঞ্চলিক সংস্কৃতি লালনকারী অঞ্চলভিত্তিক সাহিত্যকর্মগুলো যথাযথ পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যকেন্দ্রসহ অন্য সংগঠনগুলোকে এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া অপরিহার্য। তাহলে সাহিত্য সমাজে সমাদৃত হবে। স্বরূপে বিকশিত হওয়ার একটি ক্ষেত্র পাবে। আর সাহিত্য যখন সমাজে মূল্যায়িত হবে, সমাদৃত হবে, স্বরূপে বিকশিত হওয়ার একটি মর্যাদাকর ক্ষেত্র পাবে, তখনই সামাজিক দায়বদ্ধতায় সাহিত্য হবে আরও সমৃদ্ধ।
য়মীর আশফাকুর রহমান তানিম :এলএলবি (সম্মান) তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাহিত্যকে বলা হয় গরৎৎড়ৎ ড়ভ ঃযব ঝড়পরবঃু বা সমাজের দর্পণ। সমাজের শৃঙ্খলাবিধ্বংসী অসঙ্গতি, উৎকর্ষের উপায়, দিকনির্দেশনামূলক মন্তব্য উঠে আসে সাহিত্যের দর্পণে। যদিও প্রমথ চৌধুরী তার 'সাহিত্যে খেলা' প্রবন্ধে নিজস্ব মতাদর্শ ব্যক্ত করে বলেছেন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য সবাইকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। তিনি বিভিন্ন যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে সাহিত্য ও শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন।
সাহিত্য কি সত্যিই শিল্পীমনের আনন্দ থেকে উৎসারিত আনন্দদানের নিমিত্তেই সৃষ্ট? যদি তাই হয়, তাহলে জাতীয় কবি নজরুলের লেখনী ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল কেন? কেনইবা তিনি 'বিদ্রোহী কবি' উপাধিতে অলঙ্কৃৃত হয়েছিলেন? শুধু আনন্দ দান করাই যদি সাহিত্যের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বেইজিংয়ের আপসহীন ঔপন্যাসিক মো ইয়ান চলতি বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতেন কি? কেননা, কমিউনিজম ধারার কুফল, মানব প্রকৃতির কুৎসিত দিক, সরকারি দুর্নীতি, সমাজের অন্ধকার দিক তার লেখনীতে স্থান পাওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। নিছক আনন্দদানের জন্য নয়।
বাংলা সাহিত্যের চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত ইস্যুতে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞান, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি সমাজের অপরিহার্য ইস্যু। সাহিত্য সমাজে বসবাসকারী সামাজিক মানুষ কর্তৃক সৃষ্টিকর্ম। তাই সাহিত্য বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তির জ্ঞান সমৃদ্ধ করণার্থে যেমন কার্যকরী, তেমনি জনমত গঠন ও সচেতনতা তৈরিতেও সমান সচেষ্ট। তাই সাহিত্য ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বিষয় দুটি ঘনিষ্ঠ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সাহিত্যিকের দায়মুক্তি ঘটে তার সমাজ সংস্কারমূলক অমীয় কীর্তি সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।
আনন্দ দান করাও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ আনন্দ-বেদনা সমাজের মানুষের দ্বারাই উপভোগ্য ও অনুভূত হয়ে থাকে। আনন্দ-বেদনার সমন্ব্বয়েই জীবন। তাই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের আনন্দ-বেদনা সাহিত্যের বিষয়বস্তু।
সাহিত্য একটি শিল্প। একটি রচনা যখন হৃদয়গ্রাহী ও শিল্পসম্মত রূপ পরিগ্রহ করে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়, তখন তা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে। এ শিল্পে শিল্পী যত দক্ষ ও মৃত্তিকাপ্রেমিক হন, শিল্পকর্ম ততই সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় এবং সমাজের ইতিবাচক অবদানে হয় ততটাই কার্যকরী।
একটি নির্দিষ্ট দেশের সাহিত্যে নিত্যনতুন শাখা বা রচনাশৈলী বৈচিত্র্যের মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। তবে তাকে অবশ্যই মৌলিকত্ব ধারণ করতে হবে। আর এ কারণেই নতুন অথচ ব্যতিক্রমধর্মী সাহিত্যকর্মকে যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে। সাহিত্য এবং সাহিত্যিক ইদানীং আগের মতো তেমন সমাদৃত হচ্ছে না। সাহিত্যিক ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সাদামাটা। একজন পিতা কবি ও সাহিত্যিকের চেয়ে একজন ব্যাংকার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের অভিভাবক হতে ইচ্ছুক। তাই সন্তান সাহিত্যে আগ্রহ দেখালেও তাকে অভিভাবক কর্তৃক এ পরিমণ্ডলে নিরুৎসাহিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা অকাট্য না হলেও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। অর্থ-প্রতিপত্তিকেন্দ্রিক ও বেগ দিয়ে আবেগ কেড়ে নেওয়া বিজ্ঞানের এ যুগে সৃষ্ট জটিলতর জীবনধারায় সাহিত্য তার আবেদন হারাচ্ছে ক্রমাগত। চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে পুস্তকাবদ্ধ সাহিত্য যেন সেকেলে। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সক্ষম সাহিত্য ও চিত্তাকর্ষক প্রযুক্তির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনপূর্বক প্রযুক্তিকে বাংলা সাহিত্যের সংরক্ষণ, ক্রমবিকাশের মাধ্যম হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকার কর্তৃক উৎসাহব্যঞ্জক ব্যবস্থা গ্রহণ, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সাহিত্যকর্মগুলো ই-বুকে পঠনযোগ্য ও অনলাইনে উন্মুক্তকরণ ইত্যাদি হতে পারে যুগোপযোগী পদক্ষেপের উদাহরণ। আঞ্চলিক সংস্কৃতি লালনকারী অঞ্চলভিত্তিক সাহিত্যকর্মগুলো যথাযথ পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যকেন্দ্রসহ অন্য সংগঠনগুলোকে এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া অপরিহার্য। তাহলে সাহিত্য সমাজে সমাদৃত হবে। স্বরূপে বিকশিত হওয়ার একটি ক্ষেত্র পাবে। আর সাহিত্য যখন সমাজে মূল্যায়িত হবে, সমাদৃত হবে, স্বরূপে বিকশিত হওয়ার একটি মর্যাদাকর ক্ষেত্র পাবে, তখনই সামাজিক দায়বদ্ধতায় সাহিত্য হবে আরও সমৃদ্ধ।
য়মীর আশফাকুর রহমান তানিম :এলএলবি (সম্মান) তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments