শ্রদ্ধাঞ্জলি- ‘তিনি হুজুগে ছিলেন না’ by খান সারওয়ার মুরশিদ
২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে মানিক মিয়া স্মৃতিপদক দেওয়া হয়। সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ।
আজ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকীতে সদ্য প্রয়াত খান সারওয়ার মুরশিদের বক্তব্যটি ছেপে তাঁদের দুজনের প্রতিই শ্রদ্ধা জানাচ্ছি
সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। তাঁর সম্পর্কে আমার প্রথম ভাবনাটা ছিল, মানুষটি সহজে খুব কাছে আসার পাত্র নন। এই একটা দিক আছে, যেটি আমার বিবেচনায়, খুবই সুউচ্চ—তাঁর জীবনে এমন একটা মুহূর্তও নেই, যেটা তিনি হেলায় হারিয়ে ফেলতে চান। অর্থাৎ পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ আছেন—থাক না; এক কোণে তাঁর যে টেবিল আছে, তাতে বসে লিখে চলেছেন। টেবিলে বসে তিনি যে আমাদের খুব একটা নোটিশ করলেন, তা মনে হলো না। তিনি তাঁর কাজ করেই গেলেন এবং সম্পাদক আমাদের সময় দিলেন। সিরাজ সাহেব কলমটা একটু থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন শুধু। আমরা সম্পাদকের সঙ্গে আমাদের কথা বলে চলে এলাম।
আমি তাঁরই পৃথিবীতে বাস করছি, আজও, তাঁর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার বহুকাল পরও। এটাকে আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বলব জানি না।
আমার আরেকটি কথা মনে আসছে, সেটি হলো, সিরাজুদ্দীন সাহেব সেই শ্রেণীভুক্ত মানুষ ছিলেন, যাঁকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। আপনাকে একটু ভাবাবে। এ ধরনের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, তা আপনাকে জানাবে।
যা-ই হোক, একদিকে আমি একটু পীড়িত বোধ করছিলাম যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু পরিচয় হলো না। তবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর লেখার মাধ্যমে। তিনি যে কত খাঁটি ও মার্জিতমনা লেখক, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাকে কেউ একজন একটি বই দিয়ে থাকবেন, যেখানে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর একটা লেখা ছিল। সেখানে তিনি সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘তরুণ সাহিত্যিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি একটি সুন্দর মেটাফোর ব্যবহার করেছেন। ‘কোনো কোনো তারা প্রতি রাতের আকাশে ফোটে। এদের সহজেই লোকে চিনে ফেলে। আবার কতগুলো তারা অনেক দিন পর পর দেখা দেয়। তা-ও বেশিক্ষণ তারা দৃষ্টিপথে থাকে না। দু-চারটি ঝিলিক দিয়ে সে তারা নীল দরিয়ায় ডুবে যায়। তারাবিলাসীরা অমন তারার স্বল্পকালের সাক্ষাতেও শুকরিয়া আদায় করে। সুধী সিরাজুদ্দীন হোসেন আমার কাছে এই শেষোক্ত তারাতুল্য বন্ধু ছিলেন।’
সিরাজুদ্দীন হোসেনের ব্যক্তিত্বে একটা বিশেষ সুলক্ষণ আমাদের আকর্ষণ করে। তাঁর অবয়বে, তাঁর মুখে-চোখে যে দাঢ্য আমি দেখেছিলাম, সে মুখের ভাষা ছিল—সংযত হও। খুব মেপে কথা বলেন। সুচিন্তিত ও সংক্ষিপ্ত মতামত দেন। আমাদের বাঙালি জাতির একটি সুনাম আছে যে তারা কথা বলার সুযোগ পেলে সহজে সে সুযোগটি হারাতে চান না।
যে ব্যক্তিটিকে আমরা অনেক দিন পরে আজ স্মরণ করছি, তাঁর ছেলে সবার সামনে যে শোক প্রকাশ করলেন, তা থেকে স্পষ্ট, তিনি কোনো কোনো হূদয়ে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী হয়ে বেঁচে আছেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির বিষয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, এই মেধাবী পুরুষ অনেক মূল্যবান ইতিহাস গড়ে গেছেন। আমরা খবরের কাগজকে কিংবা অন্য কোনো গণমাধ্যমকে আর খানিকটা অতীত জানা মানুষের চোখ দিয়ে দেখি, ওই কাগজটি তো অমন কথাই বলবে, এই লেখকটির কাছ থেকে তো আমরা এমন লেখাই আশা করব। এ ধরনের একটা আবরণ দিয়ে আমরা মানুষকে ঢেকে দিই। একজন মানুষের চিন্তার যে অভিঘাত, সেটা আমরা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে চাই না, দূরে সরিয়ে দিই। মানুষের স্পষ্ট চিন্তার প্রতি আমরা খুব বেশি মনোযোগী নই। একটা কথা বলতেই হবে, আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায়, আমার স্বজাতি সম্পর্কে এ কথা অবশ্যই বলতে হয়, বাঙালি হয়েও, বাঙালি সাংবাদিক হয়েও সিরাজুদ্দীন হোসেনের মধ্যে যে সংযম ছিল, সেটা আজও আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
আমাদের ইতিহাস নিয়ে বলতে গিয়ে আমি বলেছি, আমাদের স্বাধীনতা আমরা সহজে পাইনি। এই স্বাধীনতা প্রাপ্তিটা তাঁর জন্য যতটা বাস্তব ছিল, তিনি স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য দিয়ে গেছেন, সেটা আমি দিতে পারিনি।
আমার সৌভাগ্য, আজ এখানে এসে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সহধর্মিণীকে নিজ চোখে দেখতে পেলাম। তাঁর যে দুই ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, যাঁদের একজনের সঙ্গে পেশাগত কারণে, অন্যজনের সঙ্গে আদর্শগত কারণে পরিচয় হয়েছিল, সেই দুটো পরিচয়ই খুব আনন্দদায়ক ও প্রীতিকর হয়েছিল আমার জন্য। এই শহীদ পরিবারটিকে আমি আমার শ্রদ্ধা জানাই। যাঁরা শহীদ পরিবারের তরুণ সভ্য, তাঁদের আমার আশীর্বাদ জানাই। তাঁদের একটা দায় আছে। তাঁদের পিতা একজন বড় মাপের অবাঙালি, বাঙালি শহীদ। আমি দেখছি আপনারা প্রভোক্টড হলেন, কেউ আপত্তি করলেন না। কেন বললাম অবাঙালি বাঙালি শহীদ? কারণ হলো, তাঁর চরিত্রে কতগুলো অতি অবশ্য অবাঙালি গুণ ছিল। তিনি হুজুগে ছিলেন না। তিনি চিন্তাপ্রবণ ছিলেন। তিনি একটি কথা ১০০ বার ভেবে তারপর লিখতেন। এগুলো বাঙালিসুলভ গুণ নয়। সেদিক থেকে তিনি অতি নিপুণ একজন অবাঙালি বাঙালি। দারুণ দেশপ্রেমী। তাঁর জীবন থেকে যদি আমি একটা কিছু বেছে নিতে আদিষ্ট হই, তবে আমি তাঁর এই গুণগুলোই বেছে নেব।
সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। তাঁর সম্পর্কে আমার প্রথম ভাবনাটা ছিল, মানুষটি সহজে খুব কাছে আসার পাত্র নন। এই একটা দিক আছে, যেটি আমার বিবেচনায়, খুবই সুউচ্চ—তাঁর জীবনে এমন একটা মুহূর্তও নেই, যেটা তিনি হেলায় হারিয়ে ফেলতে চান। অর্থাৎ পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ আছেন—থাক না; এক কোণে তাঁর যে টেবিল আছে, তাতে বসে লিখে চলেছেন। টেবিলে বসে তিনি যে আমাদের খুব একটা নোটিশ করলেন, তা মনে হলো না। তিনি তাঁর কাজ করেই গেলেন এবং সম্পাদক আমাদের সময় দিলেন। সিরাজ সাহেব কলমটা একটু থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন শুধু। আমরা সম্পাদকের সঙ্গে আমাদের কথা বলে চলে এলাম।
আমি তাঁরই পৃথিবীতে বাস করছি, আজও, তাঁর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার বহুকাল পরও। এটাকে আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বলব জানি না।
আমার আরেকটি কথা মনে আসছে, সেটি হলো, সিরাজুদ্দীন সাহেব সেই শ্রেণীভুক্ত মানুষ ছিলেন, যাঁকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। আপনাকে একটু ভাবাবে। এ ধরনের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে, তা আপনাকে জানাবে।
যা-ই হোক, একদিকে আমি একটু পীড়িত বোধ করছিলাম যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হলো, কিন্তু পরিচয় হলো না। তবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর লেখার মাধ্যমে। তিনি যে কত খাঁটি ও মার্জিতমনা লেখক, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাকে কেউ একজন একটি বই দিয়ে থাকবেন, যেখানে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর একটা লেখা ছিল। সেখানে তিনি সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘তরুণ সাহিত্যিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি একটি সুন্দর মেটাফোর ব্যবহার করেছেন। ‘কোনো কোনো তারা প্রতি রাতের আকাশে ফোটে। এদের সহজেই লোকে চিনে ফেলে। আবার কতগুলো তারা অনেক দিন পর পর দেখা দেয়। তা-ও বেশিক্ষণ তারা দৃষ্টিপথে থাকে না। দু-চারটি ঝিলিক দিয়ে সে তারা নীল দরিয়ায় ডুবে যায়। তারাবিলাসীরা অমন তারার স্বল্পকালের সাক্ষাতেও শুকরিয়া আদায় করে। সুধী সিরাজুদ্দীন হোসেন আমার কাছে এই শেষোক্ত তারাতুল্য বন্ধু ছিলেন।’
সিরাজুদ্দীন হোসেনের ব্যক্তিত্বে একটা বিশেষ সুলক্ষণ আমাদের আকর্ষণ করে। তাঁর অবয়বে, তাঁর মুখে-চোখে যে দাঢ্য আমি দেখেছিলাম, সে মুখের ভাষা ছিল—সংযত হও। খুব মেপে কথা বলেন। সুচিন্তিত ও সংক্ষিপ্ত মতামত দেন। আমাদের বাঙালি জাতির একটি সুনাম আছে যে তারা কথা বলার সুযোগ পেলে সহজে সে সুযোগটি হারাতে চান না।
যে ব্যক্তিটিকে আমরা অনেক দিন পরে আজ স্মরণ করছি, তাঁর ছেলে সবার সামনে যে শোক প্রকাশ করলেন, তা থেকে স্পষ্ট, তিনি কোনো কোনো হূদয়ে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী হয়ে বেঁচে আছেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির বিষয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, এই মেধাবী পুরুষ অনেক মূল্যবান ইতিহাস গড়ে গেছেন। আমরা খবরের কাগজকে কিংবা অন্য কোনো গণমাধ্যমকে আর খানিকটা অতীত জানা মানুষের চোখ দিয়ে দেখি, ওই কাগজটি তো অমন কথাই বলবে, এই লেখকটির কাছ থেকে তো আমরা এমন লেখাই আশা করব। এ ধরনের একটা আবরণ দিয়ে আমরা মানুষকে ঢেকে দিই। একজন মানুষের চিন্তার যে অভিঘাত, সেটা আমরা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে চাই না, দূরে সরিয়ে দিই। মানুষের স্পষ্ট চিন্তার প্রতি আমরা খুব বেশি মনোযোগী নই। একটা কথা বলতেই হবে, আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায়, আমার স্বজাতি সম্পর্কে এ কথা অবশ্যই বলতে হয়, বাঙালি হয়েও, বাঙালি সাংবাদিক হয়েও সিরাজুদ্দীন হোসেনের মধ্যে যে সংযম ছিল, সেটা আজও আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
আমাদের ইতিহাস নিয়ে বলতে গিয়ে আমি বলেছি, আমাদের স্বাধীনতা আমরা সহজে পাইনি। এই স্বাধীনতা প্রাপ্তিটা তাঁর জন্য যতটা বাস্তব ছিল, তিনি স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য দিয়ে গেছেন, সেটা আমি দিতে পারিনি।
আমার সৌভাগ্য, আজ এখানে এসে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সহধর্মিণীকে নিজ চোখে দেখতে পেলাম। তাঁর যে দুই ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, যাঁদের একজনের সঙ্গে পেশাগত কারণে, অন্যজনের সঙ্গে আদর্শগত কারণে পরিচয় হয়েছিল, সেই দুটো পরিচয়ই খুব আনন্দদায়ক ও প্রীতিকর হয়েছিল আমার জন্য। এই শহীদ পরিবারটিকে আমি আমার শ্রদ্ধা জানাই। যাঁরা শহীদ পরিবারের তরুণ সভ্য, তাঁদের আমার আশীর্বাদ জানাই। তাঁদের একটা দায় আছে। তাঁদের পিতা একজন বড় মাপের অবাঙালি, বাঙালি শহীদ। আমি দেখছি আপনারা প্রভোক্টড হলেন, কেউ আপত্তি করলেন না। কেন বললাম অবাঙালি বাঙালি শহীদ? কারণ হলো, তাঁর চরিত্রে কতগুলো অতি অবশ্য অবাঙালি গুণ ছিল। তিনি হুজুগে ছিলেন না। তিনি চিন্তাপ্রবণ ছিলেন। তিনি একটি কথা ১০০ বার ভেবে তারপর লিখতেন। এগুলো বাঙালিসুলভ গুণ নয়। সেদিক থেকে তিনি অতি নিপুণ একজন অবাঙালি বাঙালি। দারুণ দেশপ্রেমী। তাঁর জীবন থেকে যদি আমি একটা কিছু বেছে নিতে আদিষ্ট হই, তবে আমি তাঁর এই গুণগুলোই বেছে নেব।
No comments