বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৬০২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। তৌহিদ, বীর বিক্রম কয়েকটি গুলি লাগে তাঁর বুকে
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে রাধাকান্তপুরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক ঘাঁটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্গত রাধাকান্তপুর।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে রাধাকান্তপুরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক ঘাঁটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্গত রাধাকান্তপুর।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার সেখানে আক্রমণ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিবারই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তানিদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তৌহিদসহ (তৌহিদ আলী) একদল মুক্তিযোদ্ধা পুনরায় সমবেত হন রাধাকান্তপুরের পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির কাছে। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি উপদলে (প্লাটুন) বিভক্ত। প্রত্যেক দলে ২৪-২৫ জন। কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে স্টেনগান। এ ছাড়া ছিল গ্রেনেড। তাঁদের লক্ষ্য ছিল আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঘাঁটি থেকে একেবারে উচ্ছেদ করা।
তৌহিদ ও তাঁর সহযোদ্ধা এবং অন্যান্য উপদলের মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। গুলি ও গোলার শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে পড়ে। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা সুরক্ষিত বাংকারে আশ্রয় নিয়ে ব্যাপক গোলাগুলির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।
পাকিস্তানি সেনারা মাটি কামড়ে ঘাঁটিতে পড়ে থাকে। কোনোভাবেই তাদের হটানো সম্ভব হয় না। তখন মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধকৌশল পাল্টাতে হয়। অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানিদের সুরক্ষিত বাংকারে ঝটিকা আক্রমণের। এ জন্য মনোনীত হন তৌহিদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা সহযোদ্ধাদের কাভারিং ফায়ারিংয়ের ছত্রচ্ছায়ায় প্রত্যেকে কয়েকটি গ্রেনেডসহ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যান পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে।
তৌহিদ অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এক বাংকারের কাছে পৌঁছেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখতে পায়নি। তিনি বাংকারে দুটি গ্রেনেড ছোড়েন। নিখুঁত নিশানায় তা ভেতরে পড়ে। বাংকার প্রায় ধ্বংস ও সেখান থেকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এই সাফল্য ও জয়ে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। অদম্য জয়ের নেশায় বাকি গ্রেনেডসহ আরেকটি বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য। পাকিস্তানিরা তাঁকে দেখে ফেলে। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলি শুরু করে।
অসংখ্য গুলি ছুটে আসে তৌহিদের দিকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। সে সুযোগও ছিল না। কয়েকটি গুলি সরাসরি আঘাত করে তাঁর শরীরে। ঢলে পড়েন তিনি। রক্তে ভেসে যায় মাটি। শহীদ হন তিনি। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যোগ হয় আরেকটি নাম।
এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তৌহিদসহ কয়েকজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা তৌহিদসহ শহীদ সহযোদ্ধাদের মরদেহ সমাহিত করেন রাধাকান্তপুরে। তাঁর সমাধি তাঁরা তখন চিহ্নিত করে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর অস্তিত্ব নেই।
তৌহিদ চাকরি করতেন পুলিশ বাহিনীতে। ১৯৭০ সালে যোগ দেন। নবীন সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন রাজশাহী পুলিশ লাইনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য শহীদ তৌহিদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৭। তাঁর প্রকৃত নাম তৌহিদ আলী।
শহীদ তৌহিদের পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার (পোস্ট: কৈলাস) মুখিতলা গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মিছির আলী, মা মুল্লুকচান বিবি।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তৌহিদসহ (তৌহিদ আলী) একদল মুক্তিযোদ্ধা পুনরায় সমবেত হন রাধাকান্তপুরের পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির কাছে। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি উপদলে (প্লাটুন) বিভক্ত। প্রত্যেক দলে ২৪-২৫ জন। কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে স্টেনগান। এ ছাড়া ছিল গ্রেনেড। তাঁদের লক্ষ্য ছিল আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঘাঁটি থেকে একেবারে উচ্ছেদ করা।
তৌহিদ ও তাঁর সহযোদ্ধা এবং অন্যান্য উপদলের মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। গুলি ও গোলার শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে পড়ে। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা সুরক্ষিত বাংকারে আশ্রয় নিয়ে ব্যাপক গোলাগুলির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।
পাকিস্তানি সেনারা মাটি কামড়ে ঘাঁটিতে পড়ে থাকে। কোনোভাবেই তাদের হটানো সম্ভব হয় না। তখন মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধকৌশল পাল্টাতে হয়। অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানিদের সুরক্ষিত বাংকারে ঝটিকা আক্রমণের। এ জন্য মনোনীত হন তৌহিদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা সহযোদ্ধাদের কাভারিং ফায়ারিংয়ের ছত্রচ্ছায়ায় প্রত্যেকে কয়েকটি গ্রেনেডসহ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যান পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে।
তৌহিদ অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এক বাংকারের কাছে পৌঁছেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখতে পায়নি। তিনি বাংকারে দুটি গ্রেনেড ছোড়েন। নিখুঁত নিশানায় তা ভেতরে পড়ে। বাংকার প্রায় ধ্বংস ও সেখান থেকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এই সাফল্য ও জয়ে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। অদম্য জয়ের নেশায় বাকি গ্রেনেডসহ আরেকটি বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য। পাকিস্তানিরা তাঁকে দেখে ফেলে। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলি শুরু করে।
অসংখ্য গুলি ছুটে আসে তৌহিদের দিকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। সে সুযোগও ছিল না। কয়েকটি গুলি সরাসরি আঘাত করে তাঁর শরীরে। ঢলে পড়েন তিনি। রক্তে ভেসে যায় মাটি। শহীদ হন তিনি। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যোগ হয় আরেকটি নাম।
এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তৌহিদসহ কয়েকজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা তৌহিদসহ শহীদ সহযোদ্ধাদের মরদেহ সমাহিত করেন রাধাকান্তপুরে। তাঁর সমাধি তাঁরা তখন চিহ্নিত করে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর অস্তিত্ব নেই।
তৌহিদ চাকরি করতেন পুলিশ বাহিনীতে। ১৯৭০ সালে যোগ দেন। নবীন সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন রাজশাহী পুলিশ লাইনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সাত নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য শহীদ তৌহিদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৭। তাঁর প্রকৃত নাম তৌহিদ আলী।
শহীদ তৌহিদের পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার (পোস্ট: কৈলাস) মুখিতলা গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম মিছির আলী, মা মুল্লুকচান বিবি।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments