মেঘদল শহরবন্দী মেঘ by আলতাফ শাহনেওয়াজ
নাট্য নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন একসময় প্রতিদিন মিরপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে আসতেন ক্লাস করতে। সে সময় লোকাল বাসে চেপে পথ চলতে প্রায়ই বাদুড়ঝোলা হতে হতো তাঁকে। আর তাঁর বন্ধু চারুকলাপড়ুয়া শিবু কুমার শীল আসতেন পুরান ঢাকার নারিন্দা থেকে।
আসা-যাওয়ার পথে নিয়মিত তাঁর সঙ্গী কালো ধোঁয়া ও যানজট। পরে এই সুমন এবং শিবুরা মিলে যখন গানের দল ‘মেঘদল’ হয়ে উঠলেন তখন তাঁদের গিটারে বাজল লোকাল বাসে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে রোজ রোজ কালো ধোঁয়ার মুখোমুখি হওয়ার নাগরিক গল্পগুলো।
কদিন আগে, ডিসেম্বরের শীত-বিকেল। চারুকলা চত্বর। গানের দল মেঘদলের সঙ্গে আমাদের আড্ডা জমে উঠেছে ততক্ষণে। একটু দূরে মজা পুকুর। আর সুমন, শিবু, শোয়েব ও দলের অন্য সদস্যদের চোখে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলতে গিয়ে, মেঘের মতো ঝমঝমিয়ে গিটারে কীভাবে বাজল সেই জীবন, কী করে গান হয়ে উঠল—আড্ডায় একে একে হাজির হলো সেসব বিষয়ও। এরই ফাঁকে খালি গলায় শিবু গেয়ে উঠলেন তাঁদের প্রথম অ্যালবাম দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসার ‘চেনা-অচেনা’ শিরোনামের গানটি—‘চেনা-অচেনা আলো-আঁধারে চলতি পথে কোন বাসের ভিড়ে, কালো ধোঁয়া খাওয়ার এই শহরে হাঁটছি আমি একা রোদ্দুরে—আমি এক দিগ্ভ্রান্ত পথিক...।’
ভেবেছিলাম অন্য সবাই সময়মতো এলেও সুমনের ঠিকই খানিকটা দেরি হবে। এখন বেশ ব্যস্ত নির্মাতা তিনি—কত কাজ তাঁর! কিন্তু মেঘদলের বর্তমান ছয় সদস্যের মধ্যে মেজবাউর রহমান সুমন, শিবু কুমার শীল, এম জি কিবরিয়া ও তানভীর দাউদ—এই চারজন যথাসময়ে এলেও রাশিদ শরীফের আসতে কিছুটা সময় লাগল। ফটোসেশন ততক্ষণে শেষ। ওদিকে দলের আরেক সদস্য ড্রামার আমজাদ হোসেন আসতেই পারলেন না শেষ পর্যন্ত। আড্ডায় তবু গল্পগুজব কম হয়নি।
আড্ডার শুরুটা করলেন সুমন, ‘প্রথমে শুরু করেছিলাম আমরা তিনজন। ২০০০ সালে সবে চারুকলায় ভর্তি হয়েছি। গান-বাজনার বাতিক ছিল আগে থেকেই। তাই আমি, শিবু ও আমাদের আরেক বন্ধু মাসুদ হাসান (উজ্জ্বল)—এই তিনজনের এককাট্টা হতে খুব বেশি সময় লাগল না। এরপর সোয়েব আর জয়কে পেয়ে আমরা তখন রীতিমতো পঞ্চপাণ্ডব! সে সময় আজিজ সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়মিত আড্ডা জমাতাম আমরা। দলবদ্ধভাবে গান শুরু হলো এই আড্ডা থেকে। তখনো আমাদের দলের কোনো নাম ছিল না।’
বন্ধুত্বের দাবিতে এবার সুমনের কথার বাকি অংশ বলে গেলেন শিবু কুমার শীল, ‘যেকোনো প্রতিবাদেই তখন অংশ নিই আমরা। এভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পাশাপাশি গানের সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদের মতো কবিতা পড়ি—এই জীবনানন্দ দাশ আচ্ছন্ন করে রাখেন তো ওই আমাদের ওপর ভর করেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী। একসময় মনে হলো, কলকাতার গানে তাদের নাগরিকজীবন যেভাবে উঠে এসেছে, আমাদের এখানে তেমনভাবে আসেনি। এবার নিজেরা গান লিখে তাতে সুর দিতে শুরু করলাম। গানের মাধ্যমে প্রথমত বিভিন্ন সামাজিক অসংগতির প্রতিবাদ করতে চাইলাম। বাঁধতে চাইলাম নিজেদের জীবনের গান—জীবনটা যেভাবে যাপন করি, যেভাবে জীবনের মুখোমুখি হই—এসব নিয়ে গান। এর মধ্যে পয়লা বৈশাখে বোমা হামলা থেকে শুরু করে শামসুন্নাহার হলে পুলিশি নিপীড়ন—সব ক্ষেত্রে চলতে থাকে আমাদের প্রতিবাদ।’
‘গানও কিন্তু থেমে ছিল না। বোমা হামলা আর ধর্মান্ধতার প্রতিবাদেই তো গাইলাম “ওঁম”। একবার এক অনুষ্ঠানে এই গান গেয়ে কিছু ধর্মান্ধ মানুষের তোপের মুখেও পড়েছি। বাড়ি ফিরতে হয়েছিল পুলিশ পাহারায়।’— সুমন কথা শুরু করলে থামলেন শিবু। এর পরেরটুকু বন্ধু বললেও তো ক্ষতি নেই। আবার সুমনের গলা, ‘গানের দলটি এত দিন চলছিল নাম ছাড়া। ২০০৩-এর ২২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে মেঘদল গঠন করলাম আমরা। সে হিসেবে আগামী বছর ১০ বছর পূর্ণ হবে আমাদের।’
‘মেঘদলের সব সদস্যেরই মেঘফোবিয়া আছে।’—এতক্ষণে মজা করে বেশ উচ্চ স্বরে কথা বললেন রাশিদ শরীফ। কথার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় চলছে হা হা-হি হি—ভাবটা এমন যেন নিজেদের বাড়ির উঠোনে আসর বসেছে। এক অর্থে চারুকলা মেঘদলের কাছে বাড়ির উঠোনের মতোই। ‘এখানকার মজা পুকুরেই তো আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান।’—আলাপে আলাপে এই তথ্য যখন জানাচ্ছেন রাশিদ, তখন কিবরিয়া এবং তানভীর দাউদ বললেন, ‘দলে আমরা পরে যুক্ত হয়েছি কিন্তু আমাদের সবার রুচি-পছন্দই এক।’
২০০৫ সালে মেঘদলের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর দল ছেড়ে চলে যান উজ্জ্বল ও জয়। তাঁদের শূন্যস্থানে পরে যোগ দিয়েছেন কিবরিয়া ও তানভীর দাউদ। ২০০৯-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় অ্যালবাম শহরবন্দী থেকেই সঙ্গী তাঁরা। এবার ১০ বছর পূর্তিতে ২০১৩ সালে তৃতীয় অ্যালবাম প্রকাশ করবে মেঘদল। এ ছাড়া একটি প্রকাশনা ও ডকুমেন্টারি করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁদের।—আড্ডায় এসব কথা জানা শেষ হলে তার পরও কিছু টুকরো কথা থেকে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ঢাকা শহরের সন্ধ্যায় মেঘদলের আড্ডাবন্দী কথাগুলো হয়তো গান হয়ে উঠবে এখনই। নতুন কোনো সুরে হয়তো বলা হবে ‘শহরবন্দী মেঘ ঘুরে ঘুরে একা আমাদের এই সুবর্ণনগরে...।’
মেঘদলের সদস্য
মেজবাউর রহমান সুমন, ভোকাল
শিবু কুমার শীল, ভোকাল
রাশিদ শরীফ সোয়েব, লিড গিটার
এম জি কিবরিয়া, বেইজ গিটার
তানভীর দাউদ, কী বোর্ড
আমজাদ হোসেন, ড্রামস
কদিন আগে, ডিসেম্বরের শীত-বিকেল। চারুকলা চত্বর। গানের দল মেঘদলের সঙ্গে আমাদের আড্ডা জমে উঠেছে ততক্ষণে। একটু দূরে মজা পুকুর। আর সুমন, শিবু, শোয়েব ও দলের অন্য সদস্যদের চোখে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলতে গিয়ে, মেঘের মতো ঝমঝমিয়ে গিটারে কীভাবে বাজল সেই জীবন, কী করে গান হয়ে উঠল—আড্ডায় একে একে হাজির হলো সেসব বিষয়ও। এরই ফাঁকে খালি গলায় শিবু গেয়ে উঠলেন তাঁদের প্রথম অ্যালবাম দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসার ‘চেনা-অচেনা’ শিরোনামের গানটি—‘চেনা-অচেনা আলো-আঁধারে চলতি পথে কোন বাসের ভিড়ে, কালো ধোঁয়া খাওয়ার এই শহরে হাঁটছি আমি একা রোদ্দুরে—আমি এক দিগ্ভ্রান্ত পথিক...।’
ভেবেছিলাম অন্য সবাই সময়মতো এলেও সুমনের ঠিকই খানিকটা দেরি হবে। এখন বেশ ব্যস্ত নির্মাতা তিনি—কত কাজ তাঁর! কিন্তু মেঘদলের বর্তমান ছয় সদস্যের মধ্যে মেজবাউর রহমান সুমন, শিবু কুমার শীল, এম জি কিবরিয়া ও তানভীর দাউদ—এই চারজন যথাসময়ে এলেও রাশিদ শরীফের আসতে কিছুটা সময় লাগল। ফটোসেশন ততক্ষণে শেষ। ওদিকে দলের আরেক সদস্য ড্রামার আমজাদ হোসেন আসতেই পারলেন না শেষ পর্যন্ত। আড্ডায় তবু গল্পগুজব কম হয়নি।
আড্ডার শুরুটা করলেন সুমন, ‘প্রথমে শুরু করেছিলাম আমরা তিনজন। ২০০০ সালে সবে চারুকলায় ভর্তি হয়েছি। গান-বাজনার বাতিক ছিল আগে থেকেই। তাই আমি, শিবু ও আমাদের আরেক বন্ধু মাসুদ হাসান (উজ্জ্বল)—এই তিনজনের এককাট্টা হতে খুব বেশি সময় লাগল না। এরপর সোয়েব আর জয়কে পেয়ে আমরা তখন রীতিমতো পঞ্চপাণ্ডব! সে সময় আজিজ সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়মিত আড্ডা জমাতাম আমরা। দলবদ্ধভাবে গান শুরু হলো এই আড্ডা থেকে। তখনো আমাদের দলের কোনো নাম ছিল না।’
বন্ধুত্বের দাবিতে এবার সুমনের কথার বাকি অংশ বলে গেলেন শিবু কুমার শীল, ‘যেকোনো প্রতিবাদেই তখন অংশ নিই আমরা। এভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পাশাপাশি গানের সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদের মতো কবিতা পড়ি—এই জীবনানন্দ দাশ আচ্ছন্ন করে রাখেন তো ওই আমাদের ওপর ভর করেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী। একসময় মনে হলো, কলকাতার গানে তাদের নাগরিকজীবন যেভাবে উঠে এসেছে, আমাদের এখানে তেমনভাবে আসেনি। এবার নিজেরা গান লিখে তাতে সুর দিতে শুরু করলাম। গানের মাধ্যমে প্রথমত বিভিন্ন সামাজিক অসংগতির প্রতিবাদ করতে চাইলাম। বাঁধতে চাইলাম নিজেদের জীবনের গান—জীবনটা যেভাবে যাপন করি, যেভাবে জীবনের মুখোমুখি হই—এসব নিয়ে গান। এর মধ্যে পয়লা বৈশাখে বোমা হামলা থেকে শুরু করে শামসুন্নাহার হলে পুলিশি নিপীড়ন—সব ক্ষেত্রে চলতে থাকে আমাদের প্রতিবাদ।’
‘গানও কিন্তু থেমে ছিল না। বোমা হামলা আর ধর্মান্ধতার প্রতিবাদেই তো গাইলাম “ওঁম”। একবার এক অনুষ্ঠানে এই গান গেয়ে কিছু ধর্মান্ধ মানুষের তোপের মুখেও পড়েছি। বাড়ি ফিরতে হয়েছিল পুলিশ পাহারায়।’— সুমন কথা শুরু করলে থামলেন শিবু। এর পরেরটুকু বন্ধু বললেও তো ক্ষতি নেই। আবার সুমনের গলা, ‘গানের দলটি এত দিন চলছিল নাম ছাড়া। ২০০৩-এর ২২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে মেঘদল গঠন করলাম আমরা। সে হিসেবে আগামী বছর ১০ বছর পূর্ণ হবে আমাদের।’
‘মেঘদলের সব সদস্যেরই মেঘফোবিয়া আছে।’—এতক্ষণে মজা করে বেশ উচ্চ স্বরে কথা বললেন রাশিদ শরীফ। কথার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় চলছে হা হা-হি হি—ভাবটা এমন যেন নিজেদের বাড়ির উঠোনে আসর বসেছে। এক অর্থে চারুকলা মেঘদলের কাছে বাড়ির উঠোনের মতোই। ‘এখানকার মজা পুকুরেই তো আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান।’—আলাপে আলাপে এই তথ্য যখন জানাচ্ছেন রাশিদ, তখন কিবরিয়া এবং তানভীর দাউদ বললেন, ‘দলে আমরা পরে যুক্ত হয়েছি কিন্তু আমাদের সবার রুচি-পছন্দই এক।’
২০০৫ সালে মেঘদলের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর দল ছেড়ে চলে যান উজ্জ্বল ও জয়। তাঁদের শূন্যস্থানে পরে যোগ দিয়েছেন কিবরিয়া ও তানভীর দাউদ। ২০০৯-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় অ্যালবাম শহরবন্দী থেকেই সঙ্গী তাঁরা। এবার ১০ বছর পূর্তিতে ২০১৩ সালে তৃতীয় অ্যালবাম প্রকাশ করবে মেঘদল। এ ছাড়া একটি প্রকাশনা ও ডকুমেন্টারি করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁদের।—আড্ডায় এসব কথা জানা শেষ হলে তার পরও কিছু টুকরো কথা থেকে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ঢাকা শহরের সন্ধ্যায় মেঘদলের আড্ডাবন্দী কথাগুলো হয়তো গান হয়ে উঠবে এখনই। নতুন কোনো সুরে হয়তো বলা হবে ‘শহরবন্দী মেঘ ঘুরে ঘুরে একা আমাদের এই সুবর্ণনগরে...।’
মেঘদলের সদস্য
মেজবাউর রহমান সুমন, ভোকাল
শিবু কুমার শীল, ভোকাল
রাশিদ শরীফ সোয়েব, লিড গিটার
এম জি কিবরিয়া, বেইজ গিটার
তানভীর দাউদ, কী বোর্ড
আমজাদ হোসেন, ড্রামস
No comments