ঋতু-বন্দনা- টুপটুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির... by মাহবুব আলম
পৃথিবীজুড়েই আবহাওয়ার তাল কেটে গেছে। তালভাঙা এই পরিবেশে আমাদের চিরচেনা ঋতুদের মেজাজ-মর্জিই যেন ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। এদের যাওয়া-আসার অনিয়মই এখন নিয়ম। সুখের বিষয়, এবার শীত এসেছে সেই পুরোনো দিনের নিয়ম মেনে। তবে এখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময় হয়নি।
সদ্য সমাপ্ত দোহা সম্মেলনে বহু বাগিবতণ্ডার পর কিয়োটো প্রটোকলের আয়ু বাড়ানো হয়েছে মাত্র। কিন্তু প্রধান পরিবেশদূষণকারী দেশগুলো এখনো এই প্রটোকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। দূষণযজ্ঞের নায়কদের কুম্ভকর্ণ ঘুম আর কবে ভাঙবে? বৈশ্বিক উষ্ণতার কুফলের দায় টেনে চলেছে বাংলাদেশ-মালদ্বীপের মতো তৃতীয় বিশ্বের নিরপরাধ দরিদ্র মানুষেরা। এই ভুবন গ্রামের গরিব পাড়ায় দুর্যোগের ঢেউ লাগলে তা বড়লোকের পাড়ায়ও ছড়িয়ে যেতে সময় নেয় না। হালে মহা শক্তিধর ঝড় স্যান্ডি চোখে আঙুল দিয়ে সেটা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে।
ঋতু নিয়ে সামান্য কিছু লিখতে হলেও কবি কালিদাসকে স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই। তার ‘ঋতুসংহার’-এ ষড়্ঋতুর বন্দনায় শীতের প্রসঙ্গ শুরু করেছেন কবি এমনই ভাষায়, ‘হে সুন্দরী, এবার শীত ঋতুর কথা শ্রবণ করো। এই ঋতু শালিধানের প্রাচুর্যে মনোহর। এখানে-ওখানে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চের নিনাদ এখন মধুর। এই ঋতুতে কাম রক্ত প্রবল। এ কাল রমণীদের বড় প্রিয়।’
কালিদাসের সহস্র বছর পর লেখা রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান-এ প্রকৃতি পর্যায়ে অসাধারণ ঋতু-বন্দনা রয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও বসন্তের বর্ণনায় তাঁর জাদু-কলম উচ্ছ্বসিত। কিন্তু শীতের বর্ণনায় সেই লেখনী স্তিমিত। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্র-এ শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের মুগ্ধ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। শীতের পদ্মায় জেগে ওঠা ভূমির শূন্যতা তাঁর প্রীতিকর বলে মনে হয়নি। এর শস্যতৃণবিহীন রূপকে তিনি বলেছেন, ‘উদাস কঠিন বৈধব্যের বন্ধ্যাদশা।’ শীতের পদ্মায় নৌকা ভ্রমণে কবির মন তৃপ্তি খুঁজে পায়নি। কারণ হিসেবে লিখেছেন, শীতের সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত প্রকৃতিকে বাইরে ফেলে, দরজা-জানালা বন্ধ করে বোটের ছোট পরিসরে নিজের মনটাকে মেলে ধরা যায় না। তখন ‘নিজের সঙ্গে নিজেকে বড়ো বেশি ঘেঁষাঘেঁষি-ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, রবীন্দ্রনাথ শীত নিয়ে গীতবিতান-এ কেন গান লিখেছেন সবচেয়ে কম। মাত্র ১২টি।
২. শীত নিয়ে বেশি গান না বাঁধলেও এর সবচেয়ে মিঠে আগমন বারতা কিন্তু রবীন্দ্রনাথই লিখে গেছেন একটি মাত্র ম্যাজিক লাইনে: ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।’ এই শহরটিতে এখন আর আমলকীগাছ চোখে পড়ে না—কিন্তু তাই বলে শীতের পৌঁছ-সংবাদ পেতে নগরবাসীর অসুবিধা নেই। রোদের চাঁপা ফুলের রং আর মিঠে কুসুম কুসুম আঁচ থেকেই বোঝা যায়, শীত এসেছে। ঘাসের ডগায় আর টিনের চালে শিশিরের শব্দ। কুয়াশার ঘেরাটোপে কিছু অস্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও এর রহস্যমাখা রোমান্টিকতার ছোঁয়া মন্দ লাগে না। শহরে এখানে-সেখানে দু-একটি খেজুরগাছ খুঁজে পাওয়া যায়। শীতে মানুষের দেওয়া গভীর ক্ষতের চিহ্ন এদের সর্বাঙ্গে, লকেটের মতো ছোট মেটেহাঁড়ি গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। কুয়াশা আর হিমে ভিজে সারা রাত অপেক্ষা করে কখন ভোর হবে, কখন গলার কলসি নামবে। শীতের সকালে পত্রিকার রঙিন আলোকচিত্র চোখ টানে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলে দলে দলে লাল শাপলা ফুটে রয়েছে অতিথি পাখিদের স্বাগত জানাতে; খাদ্য, আশ্রয় আর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এখন প্রকৃতিজুড়ে উত্তাপহীন স্নিগ্ধতা, পুকুরের কিনারে ঘন লাল সর জমা বাঁধা, মাছরাঙাদের ওড়াউড়ি, মানুষের মন পার্বণের আনন্দে বিভোর। এমন করেই প্রকৃতি নিজের ভাষায় শীতের বার্তা পৌঁছে দেয় মানুষের কাছে।
শীতের সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে এর একটি অকরুণ কঠিন রূপ। দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষের কাছে এই ঋতু চরম কষ্টের। শিশু, বৃদ্ধ আর রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শীতের আক্রমণে অসহায়। শীত ঋতুতে আমাদের প্রমোদ বিলাসের ব্যয়ের একটি ভগ্নাংশ এদের কাছে পৌঁছে দিলে আমাদের আনন্দ উপভোগে ঘাটতি পড়বে না। শীতকালকে নানাজনে নানাভাবে দেখতে অভ্যস্ত। কারও চোখে শীত আসলে এক নগরনন্দিনী। আধুনিক জীবনযাত্রা এবং বাঙালির ঐতিহ্য দুই প্রান্তে নিজের চিহ্ন ছড়িয়ে যায় সে। জিনস ডেনিম জ্যাকেটের পাশাপাশি দেশজ শাল বা আলোয়ান চাপিয়ে এই সময়ে দিব্যি ঘোরাঘুরি করা যায়। কেউ বা মনে করেন বিনোদনের ভাষা জানে বলে শীত এত উজ্জ্বল। এত উৎসব-অনুষ্ঠান, টিভি চ্যানেলে এত রকমারি প্রোগ্রাম—এ সবই আংশিক সত্য। শীত আসলে নিজেই এক উৎসব।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সকল বয়সেরই একটা কাল আছে...। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। কবি শীতের উল্লেখ করেননি। শীত তাঁর কাছে বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেল। জীবনানন্দ কিন্তু শীতকে আদর করে আপন ভেবে কাছে টেনেছেন। বারবার বলেছেন, কার্তিকের নীল কুয়াশা, শিশিরের জল, ফসল কাটা মাঠ, চালতার পাতা থেকে টুপটুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির,/ কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান ধানসিড়ি নদীটির তীর। সবশেষে লিখেছেন, ‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে—কোনদিন আর জাগব না জেনে—’ জীবনানন্দ ছাড়া আর কোন কবি শীতকে এমন নিবিড় করে অনুভব করেছেন? এই শীতে বাঙালির বিশুদ্ধতম ও আধুনিকতম কবি জীবনানন্দ, আর কেউ নন।
৩. রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে বলতে ইচ্ছে হয়, সব কালের যদি একটা ঋতু থাকে, তবে শীতের বাল্য ও কৈশোরের ঋতু হতে বাধা কী? শীত এলেই পলিত কেশ, জীবনের হেমন্ত বেলায় পৌঁছে যাওয়া সব মানুষের কম বয়সের শীতের কথাই মনে পড়ে প্রথম। সেই শীতের ভোরের ফিনফিনে ধোঁয়া ওঠা মুখ, পরীক্ষার শেষে ছুটির দিনের খিল-খোলা আনন্দ, দেশি সার্কাস আর যাত্রা-থিয়েটার দেখার প্রথম উত্তেজনার স্মৃতি মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটে। এককথায়, নতুন নতুন বিস্ময় আর সব ভালো লাগার ঠাস বুনটে তৈরি একখানা ঝলমলে আলোয়ান ছেলেবেলার শীতকাল। শীত শুধু ফুল, গান আর আলো-হাসির ঋতু নয়। আজ থেকে ৪১ বছর আগে এক শীতবিকেল বয়ে এনেছিল আমাদের বহু প্রতীক্ষিত মুক্তির আনন্দ। বিজয়ের গৌরব। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এই ঋতু। বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রু আর শহীদের মহান আত্মোৎসর্গের স্মৃতি তর্পণের ঋতু এই শীতকাল। এর এক চোখে কান্না আরেক চোখে সাফল্যের হাসি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে বিনম্র শ্রদ্ধায় বরণ করার ঋতু এই শীতে সমগ্র জাতি শোক আর শক্তিকে জড়িয়ে থাকে নিবিড় মমতায়, অশেষ কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে থাকবে চিরদিন।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
mahboob1122@hotmail.com
ঋতু নিয়ে সামান্য কিছু লিখতে হলেও কবি কালিদাসকে স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই। তার ‘ঋতুসংহার’-এ ষড়্ঋতুর বন্দনায় শীতের প্রসঙ্গ শুরু করেছেন কবি এমনই ভাষায়, ‘হে সুন্দরী, এবার শীত ঋতুর কথা শ্রবণ করো। এই ঋতু শালিধানের প্রাচুর্যে মনোহর। এখানে-ওখানে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চের নিনাদ এখন মধুর। এই ঋতুতে কাম রক্ত প্রবল। এ কাল রমণীদের বড় প্রিয়।’
কালিদাসের সহস্র বছর পর লেখা রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান-এ প্রকৃতি পর্যায়ে অসাধারণ ঋতু-বন্দনা রয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও বসন্তের বর্ণনায় তাঁর জাদু-কলম উচ্ছ্বসিত। কিন্তু শীতের বর্ণনায় সেই লেখনী স্তিমিত। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্র-এ শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের মুগ্ধ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। শীতের পদ্মায় জেগে ওঠা ভূমির শূন্যতা তাঁর প্রীতিকর বলে মনে হয়নি। এর শস্যতৃণবিহীন রূপকে তিনি বলেছেন, ‘উদাস কঠিন বৈধব্যের বন্ধ্যাদশা।’ শীতের পদ্মায় নৌকা ভ্রমণে কবির মন তৃপ্তি খুঁজে পায়নি। কারণ হিসেবে লিখেছেন, শীতের সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত প্রকৃতিকে বাইরে ফেলে, দরজা-জানালা বন্ধ করে বোটের ছোট পরিসরে নিজের মনটাকে মেলে ধরা যায় না। তখন ‘নিজের সঙ্গে নিজেকে বড়ো বেশি ঘেঁষাঘেঁষি-ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, রবীন্দ্রনাথ শীত নিয়ে গীতবিতান-এ কেন গান লিখেছেন সবচেয়ে কম। মাত্র ১২টি।
২. শীত নিয়ে বেশি গান না বাঁধলেও এর সবচেয়ে মিঠে আগমন বারতা কিন্তু রবীন্দ্রনাথই লিখে গেছেন একটি মাত্র ম্যাজিক লাইনে: ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।’ এই শহরটিতে এখন আর আমলকীগাছ চোখে পড়ে না—কিন্তু তাই বলে শীতের পৌঁছ-সংবাদ পেতে নগরবাসীর অসুবিধা নেই। রোদের চাঁপা ফুলের রং আর মিঠে কুসুম কুসুম আঁচ থেকেই বোঝা যায়, শীত এসেছে। ঘাসের ডগায় আর টিনের চালে শিশিরের শব্দ। কুয়াশার ঘেরাটোপে কিছু অস্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও এর রহস্যমাখা রোমান্টিকতার ছোঁয়া মন্দ লাগে না। শহরে এখানে-সেখানে দু-একটি খেজুরগাছ খুঁজে পাওয়া যায়। শীতে মানুষের দেওয়া গভীর ক্ষতের চিহ্ন এদের সর্বাঙ্গে, লকেটের মতো ছোট মেটেহাঁড়ি গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। কুয়াশা আর হিমে ভিজে সারা রাত অপেক্ষা করে কখন ভোর হবে, কখন গলার কলসি নামবে। শীতের সকালে পত্রিকার রঙিন আলোকচিত্র চোখ টানে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলে দলে দলে লাল শাপলা ফুটে রয়েছে অতিথি পাখিদের স্বাগত জানাতে; খাদ্য, আশ্রয় আর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এখন প্রকৃতিজুড়ে উত্তাপহীন স্নিগ্ধতা, পুকুরের কিনারে ঘন লাল সর জমা বাঁধা, মাছরাঙাদের ওড়াউড়ি, মানুষের মন পার্বণের আনন্দে বিভোর। এমন করেই প্রকৃতি নিজের ভাষায় শীতের বার্তা পৌঁছে দেয় মানুষের কাছে।
শীতের সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে এর একটি অকরুণ কঠিন রূপ। দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষের কাছে এই ঋতু চরম কষ্টের। শিশু, বৃদ্ধ আর রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শীতের আক্রমণে অসহায়। শীত ঋতুতে আমাদের প্রমোদ বিলাসের ব্যয়ের একটি ভগ্নাংশ এদের কাছে পৌঁছে দিলে আমাদের আনন্দ উপভোগে ঘাটতি পড়বে না। শীতকালকে নানাজনে নানাভাবে দেখতে অভ্যস্ত। কারও চোখে শীত আসলে এক নগরনন্দিনী। আধুনিক জীবনযাত্রা এবং বাঙালির ঐতিহ্য দুই প্রান্তে নিজের চিহ্ন ছড়িয়ে যায় সে। জিনস ডেনিম জ্যাকেটের পাশাপাশি দেশজ শাল বা আলোয়ান চাপিয়ে এই সময়ে দিব্যি ঘোরাঘুরি করা যায়। কেউ বা মনে করেন বিনোদনের ভাষা জানে বলে শীত এত উজ্জ্বল। এত উৎসব-অনুষ্ঠান, টিভি চ্যানেলে এত রকমারি প্রোগ্রাম—এ সবই আংশিক সত্য। শীত আসলে নিজেই এক উৎসব।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সকল বয়সেরই একটা কাল আছে...। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। কবি শীতের উল্লেখ করেননি। শীত তাঁর কাছে বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেল। জীবনানন্দ কিন্তু শীতকে আদর করে আপন ভেবে কাছে টেনেছেন। বারবার বলেছেন, কার্তিকের নীল কুয়াশা, শিশিরের জল, ফসল কাটা মাঠ, চালতার পাতা থেকে টুপটুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির,/ কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান ধানসিড়ি নদীটির তীর। সবশেষে লিখেছেন, ‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে—কোনদিন আর জাগব না জেনে—’ জীবনানন্দ ছাড়া আর কোন কবি শীতকে এমন নিবিড় করে অনুভব করেছেন? এই শীতে বাঙালির বিশুদ্ধতম ও আধুনিকতম কবি জীবনানন্দ, আর কেউ নন।
৩. রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে বলতে ইচ্ছে হয়, সব কালের যদি একটা ঋতু থাকে, তবে শীতের বাল্য ও কৈশোরের ঋতু হতে বাধা কী? শীত এলেই পলিত কেশ, জীবনের হেমন্ত বেলায় পৌঁছে যাওয়া সব মানুষের কম বয়সের শীতের কথাই মনে পড়ে প্রথম। সেই শীতের ভোরের ফিনফিনে ধোঁয়া ওঠা মুখ, পরীক্ষার শেষে ছুটির দিনের খিল-খোলা আনন্দ, দেশি সার্কাস আর যাত্রা-থিয়েটার দেখার প্রথম উত্তেজনার স্মৃতি মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটে। এককথায়, নতুন নতুন বিস্ময় আর সব ভালো লাগার ঠাস বুনটে তৈরি একখানা ঝলমলে আলোয়ান ছেলেবেলার শীতকাল। শীত শুধু ফুল, গান আর আলো-হাসির ঋতু নয়। আজ থেকে ৪১ বছর আগে এক শীতবিকেল বয়ে এনেছিল আমাদের বহু প্রতীক্ষিত মুক্তির আনন্দ। বিজয়ের গৌরব। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এই ঋতু। বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রু আর শহীদের মহান আত্মোৎসর্গের স্মৃতি তর্পণের ঋতু এই শীতকাল। এর এক চোখে কান্না আরেক চোখে সাফল্যের হাসি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে বিনম্র শ্রদ্ধায় বরণ করার ঋতু এই শীতে সমগ্র জাতি শোক আর শক্তিকে জড়িয়ে থাকে নিবিড় মমতায়, অশেষ কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে থাকবে চিরদিন।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
mahboob1122@hotmail.com
No comments