তৈরি পোশাকশিল্প- সংখ্যা নয়, মানুষ by আনু মুহাম্মদ
আশুলিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। ক্ষোভের কারণ বহু। সর্বশেষ তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি সব শ্রমিককেই তাড়া করছে, সমাজকেও নাড়া দিয়েছে। এই ভয়ংকর স্মৃতি শ্রমিকদের ঠান্ডা মাথায় শান্তভাবে কাজ করতে দেয় না।
উপরন্তু তা টেনে আনে আরও অনেক বঞ্চনা, নির্যাতন, অপমান আর নিরাপত্তাহীনতার স্মৃতি। শ্রমিকেরা এখন দাবি করছেন উৎপাদন চলাকালে কারখানার তালা খোলা রাখতে হবে, দায়ী মালিককে গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে, বকেয়া পরিশোধ করতে হবে, আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা করতে হবে, নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সংগঠনের অধিকার দিতে হবে। এগুলো সবই আইনানুগ দাবি, প্রচলিত আইন বাস্তবায়নের দাবি। আইনের কথা বলছেন শ্রমিকেরা আর এসব দাবির দিকে নজর না দিয়ে সরকারের পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাঁদের ওপর। নিশ্চিন্তপুরের ভয়ংকর ঘটনার পরও সরকারসহ মালিকপক্ষের কথা ও কাজের কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এ ছাড়া নিহত ও নিখোঁঁজ শ্রমিকদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশও তাঁদের অন্যতম দাবি। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, ১১১ জন নিহত হওয়ার কথা ওই কারখানার বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা কেউ বিশ্বাস করেন না। তাঁদের বক্তব্য, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাঁদের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাও আছে এই অবিশ্বাসের পেছনে। নিখোঁজ শ্রমিকদের, অজানা নিহতদের শনাক্ত করার জন্যও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। কারখানার শ্রমিকদের পুরো তালিকা প্রকাশ করলেই বিষয়টি খোলাসা হতে পারে। এ তালিকা প্রকাশ করতে মালিকের বা তাঁদের সংগঠন বিজিএমইএর কী সমস্যা?
৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর মধ্যে ৪৩টি পরিবারকে ছয় লাখ টাকা করে চেক তুলে দিয়েছেন। এই ছয় লাখ টাকার মধ্যে বিজিএমইএ এক লাখ, একটি বিদেশি বায়িং হাউস এক লাখ, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন এক লাখ, শ্রম মন্ত্রণালয় এক লাখ, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই লাখ। সরকার যে টাকা দিচ্ছে, তা তো জনগণেরই টাকা। কিন্তু যে মালিকের দায়, ‘ক্ষতিপূরণের’ জন্য তাঁর টাকা কোথায়? বাকি নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারগুলোর মধ্যে শোকের সঙ্গে অনিশ্চয়তা, আহত ব্যক্তিদের অনেকে চিকিৎসা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত। অনেকে কর্মক্ষমতা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। কে চালাবে তাঁদের? মালিক কেন নয়?
১৮৫৫ সালের ‘মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন’ অনুযায়ী ‘নিহত ব্যক্তির যত দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল (গড় আয়ু) এবং তিনি ওই সময়ে যা আয় করতেন, তা হিসাব কষে বের করে তার দ্বিগুণ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ’ হতে পারে। এই আইন অনুযায়ী তাহলে ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত? যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। গড় বয়স ২৫ ধরলে বাংলাদেশের গড় আয় অনুযায়ী অন্তত আরও ৪০ বছর তাঁদের কাজ করার কথা। সর্বশেষ তাঁরা যা আয় করতেন, বেঁচে থাকলে তা আরও অনেক বাড়ত। এখনকার গড় আয়ই যদি ধরি পাঁচ হাজার টাকা, তাহলে তাঁদের জীবনকালের আয় দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকা, অর্থাৎ আইন অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কমপক্ষে ৪৮ লাখ টাকা। যদি মুদ্রাস্ফীতি ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য আয়বৃদ্ধি হিসাব করা হয়, তাহলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। এবং এটা দিতে হবে মালিককে বা সেই প্রতিষ্ঠানকেই।
মালিক দেলোয়ার হোসেন এখন কোথায়? সংবাদপত্র বলছে, ‘জানা গেল, বিজিএমইএর পরামর্শে দেলোয়ার হোসেন আড়ালে থাকছেন। কথা বলতে নিষেধ করেছেন বিজিএমইএর নেতারা। এটা বিজিএমইএর পুরোনো কৌশল।...এ কাজে আবার বিজিএমইএকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার’ (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০১২)। নাশকতা নিয়ে গল্প আর প্রচারণা দিয়ে মালিকের অপরাধ ঢেকে ফেলার চেষ্টা এবারও চলছে। এগুলো অপরাধীদের জন্য খুবই স্বস্তিকর। প্রধানমন্ত্রী বারবার নাশকতার কথাই বলছেন। একবারও বললেন না কারখানাগুলোর মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়ার কথা। একবারও বললেন না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকর হয়ে থাকার কথা।
দেশে তৈরি পোশাক খাতে এখন সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান সচল। বিজিএমইএ দাবি করে, ‘এর মধ্যে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের রয়েছে শতভাগ কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন কারখানা। অন্যদিকে বাংলাদেশ সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ইনিশিয়েটিভের (বিএসসিআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৩০০-৫০০ কারখানা কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন।’ (বণিক বার্তা, ২৮ নভেম্বর, ২০১২)। ওয়েবসাইটে প্রদত্ত প্রোফাইল তথ্য অনুযায়ী, ‘তাজরীন ফ্যাশনস কারখানা আইএলও ও দেশের শ্রম আইন কঠোরভাবে পালন করে। অগ্নিনির্বাপণের সব ব্যবস্থা আছে, সবার জন্য ফ্রি চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর টয়লেট।’ বিজিএমইএর সভাপতিও দাবি করেছেন, এই কারখানা সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরি। কিন্তু সাংবাদিকসহ কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যে কারখানার উপরোক্ত বর্ণনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক অগ্রগতি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ‘নিচতলার ওয়্যারহাউসে আগুন লাগায় এর অগ্নিদাহ্য সিনথেটিক-জাতীয় সুতা, কাপড়ের বিশাল মজুদ থাকায় আগুন লাগার পরপরই পুরো ভবনটি ইটভাটার মতো রূপ নেয় এবং সিঁড়িগুলো হয়ে ওঠে উত্তপ্ত চিমনি। নিচতলার ভয়াবহ আগুনের তাপ, শিখা ও কালো ধোঁয়া তিনটি সিঁড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। ফলে শত শত কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা প্রচণ্ড কালো ধোঁয়ার বহির্গমনের কোনো পথ না পেয়ে দমবন্ধ ও পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।’ প্রতিবেদনে পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে, ‘কারখানাটি কোনোভাবেই শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উপযোগী বা যথাযথ মান পরিপালনকারী (কমপ্লায়েন্ট) নয়। কারখানার ভবন তৈরিতেও ন্যূনতম ‘ভবন নির্মাণ বিধিমালা’ অনুসরণ করা হয়নি। কর্মক্ষেত্রের উপযোগী ন্যূনতম শর্তগুলো মানা হলে এত বেশি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না’ (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০১২)।
ফায়ার সার্ভিসের শর্ত অনুযায়ী, কারখানার চারদিক খোলা থাকতে হবে। কিন্তু ‘তাজরীন ফ্যাশনসের সামনের দিকে ৮ থেকে ১০ ফুট পিচের রাস্তা ছাড়া বাকি তিন দিকেই লাগোয়া বাড়িঘর আছে।’ প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে (৩ ডিসেম্বর, ২০১২) ফায়ার সার্ভিস অপারেশনের পরিচালক মুহম্মদ মাহবুব বলেছেন, ‘প্রথম গাড়ি যখন পৌঁছায়, তখন দোতলাসহ তিনতলা পোড়া শুরু করেছে। উদ্ধারযান পৌঁছামাত্র ছাদে সিঁড়ি দিই। সেখানে কাউকে পাইনি। অন্যান্য তলায় খোঁজ করেও কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি।...সম্পূর্ণ অনিয়ম করে গুদাম করা হয়েছে। তার পরও গুদামে ছিল খুব শক্তিশালী দাহ্য বস্তু। যে কারণে আগুন মুহূর্তের মধ্যে একতলা, দোতলা, তিনতলায় ছড়িয়ে যায়।’
১৯৯০ থেকে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাবলির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর একটিরও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। একটির জন্যও দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। শিল্প পুলিশ গঠন করা হয়েছে শ্রমিকদের সম্ভাব্য বিক্ষোভ মোকাবিলার জন্য। কিন্তু উৎপাদনের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর, কারখানায় আগুন বা দুর্ঘটনা মোকাবিলা শক্তিশালী করার জন্য বরাদ্দ অপ্রতুলই থাকছে।
একই বৈঠকে শ্রমসচিব মাইকেল শিপার বলেছেন, ‘শ্রমিককল্যাণ ও শিল্পের বিভিন্ন বিষয় দেখার জন্য সিআইএফ (চিফ ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ) নামে একটি আলাদা বিভাগ আছে। ১৯৬২ সালের কমিশনে ৩১৪ জনের কথা বলা হয়েছিল। সে সময়ের তুলনায় আজকে কয়েক গুণ বেশি শিল্প গড়ে উঠেছে। ৩১৪ জনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কর্মরত আছেন মাত্র ১৮৩ জন।’ আর ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর কজন? তাঁঁদের পরিদর্শন রিপোর্টগুলো কোথায়? ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরের সংখ্যা ১১ জন। তাঁদের যাতায়াত বা কাজের জন্য যে বরাদ্দ তা হাস্যকর রকম তুচ্ছ। তার মানে শ্রমিক তথা জনস্বার্থ দেখার বিষয় কোনো সরকারের কাছেই গুরুত্ব পায় না।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, বাংলাদেশের পা কি এখন ভূতের মতো পেছন দিকে, যত ‘দেশ এগিয়ে যায়’ ততই কি আমরা পেছন দিকে যাচ্ছি? নইলে আগে বড় শিল্পকারখানা মানেই সেখানে খোলা জায়গা, শ্রমিকদের বসতি, স্কুলসহ বিবিধ আয়োজন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ছিল। কিন্তু এখন যে পোশাক কারখানাগুলো বাংলাদেশের শিল্পায়নের প্রধান ভিত্তি, দু-একটি বাদে সেগুলোতে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাসস্থান, নিয়োগপত্র, চাকরির নিরাপত্তা, বাঁচার মতো মজুরি, চিকিৎসা এগুলো সবই কাগজে-কলমে। কোথাও কোথাও অবস্থার যতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণেই।
ট্রাকচালক যখন মানুষের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেন, বাসচালক যখন বাস নিয়ে খাদে ফেলেন, তখন তা ইচ্ছা করে করেন না, এটা ঘটে হয় খারাপ রাস্তার কারণে বা গাড়ির ফিটনেস না থাকলে বা বেশি ট্রিপ দিতে গিয়ে দায়িত্বহীনভাবে গাড়ি চালালে। এবং এ জন্য তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়, সমাজও তাঁকে ঘাতক বা খুনি বলেই অভিহিত করে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে, খরচ বাঁচাতে গিয়ে মালিক অনুপযুক্ত ভবনে কারখানা বসিয়েছেন, সিঁড়িঘরকে গুদাম বানিয়েছেন, প্রতিটি তলা তালাবদ্ধ করে জেলখানা বানিয়েছেন, মিডলেভেল কর্মকর্তাদের যেকোনো মূল্যে বাড়তি কাজ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পদে পদে আইন ভেঙেছেন আরও বেশি টাকার জন্য। তাহলে একই যুক্তিতে তাঁকেও ঘাতক বলা হবে না কেন? দুর্ঘটনা যখন অবহেলা, লোভ, মিথ্যাচার, জানা ব্যবস্থাদি না রাখা, খরচ বাঁচিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কারণে ঘটে, তখন তা আর দুর্ঘটনা থাকে না, সেটা হয় হত্যাকাণ্ড, সর্বোচ্চ অপরাধ।
আমাদের দেশে শিশু থেকে শুরু করে অসংখ্য গরিব নারী-পুরুষ তো এভাবেই মরেন। ফিটনেস ছাড়া লঞ্চ ডোবে, বাস খাদে পড়ে, নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ভবন ধসে, ছোট টুকরি নিয়ে দোকান দিয়ে পেট চালাতে গিয়ে ফ্লাইওভার ভেঙে, পুলিশ-র্যা ব ক্রসফায়ারে-নির্যাতনে, বাড়িতে, হোটেলে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনে, তৈরি পোশাক ভবন ধসে, আগুন লেগে, প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে গুলিতে-নির্যাতনে, প্রবাসপথে সমুদ্রে ডুবে মানুষ মরে। মনে হয় না, মানুষ মরে। মনে হয় সংখ্যা তৈরি হয়, সংখ্যা বাড়ে। সংখ্যার মধ্যে যে প্রাণ আছে, সেই উপলব্ধি সমাজে তৈরি হলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। শ্রমিকদের সরব কণ্ঠ সেই প্রাণেরই জানান দেবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এ ছাড়া নিহত ও নিখোঁঁজ শ্রমিকদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশও তাঁদের অন্যতম দাবি। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, ১১১ জন নিহত হওয়ার কথা ওই কারখানার বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা কেউ বিশ্বাস করেন না। তাঁদের বক্তব্য, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাঁদের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাও আছে এই অবিশ্বাসের পেছনে। নিখোঁজ শ্রমিকদের, অজানা নিহতদের শনাক্ত করার জন্যও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। কারখানার শ্রমিকদের পুরো তালিকা প্রকাশ করলেই বিষয়টি খোলাসা হতে পারে। এ তালিকা প্রকাশ করতে মালিকের বা তাঁদের সংগঠন বিজিএমইএর কী সমস্যা?
৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর মধ্যে ৪৩টি পরিবারকে ছয় লাখ টাকা করে চেক তুলে দিয়েছেন। এই ছয় লাখ টাকার মধ্যে বিজিএমইএ এক লাখ, একটি বিদেশি বায়িং হাউস এক লাখ, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন এক লাখ, শ্রম মন্ত্রণালয় এক লাখ, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই লাখ। সরকার যে টাকা দিচ্ছে, তা তো জনগণেরই টাকা। কিন্তু যে মালিকের দায়, ‘ক্ষতিপূরণের’ জন্য তাঁর টাকা কোথায়? বাকি নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারগুলোর মধ্যে শোকের সঙ্গে অনিশ্চয়তা, আহত ব্যক্তিদের অনেকে চিকিৎসা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত। অনেকে কর্মক্ষমতা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। কে চালাবে তাঁদের? মালিক কেন নয়?
১৮৫৫ সালের ‘মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন’ অনুযায়ী ‘নিহত ব্যক্তির যত দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল (গড় আয়ু) এবং তিনি ওই সময়ে যা আয় করতেন, তা হিসাব কষে বের করে তার দ্বিগুণ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ’ হতে পারে। এই আইন অনুযায়ী তাহলে ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত? যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। গড় বয়স ২৫ ধরলে বাংলাদেশের গড় আয় অনুযায়ী অন্তত আরও ৪০ বছর তাঁদের কাজ করার কথা। সর্বশেষ তাঁরা যা আয় করতেন, বেঁচে থাকলে তা আরও অনেক বাড়ত। এখনকার গড় আয়ই যদি ধরি পাঁচ হাজার টাকা, তাহলে তাঁদের জীবনকালের আয় দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকা, অর্থাৎ আইন অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কমপক্ষে ৪৮ লাখ টাকা। যদি মুদ্রাস্ফীতি ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য আয়বৃদ্ধি হিসাব করা হয়, তাহলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। এবং এটা দিতে হবে মালিককে বা সেই প্রতিষ্ঠানকেই।
মালিক দেলোয়ার হোসেন এখন কোথায়? সংবাদপত্র বলছে, ‘জানা গেল, বিজিএমইএর পরামর্শে দেলোয়ার হোসেন আড়ালে থাকছেন। কথা বলতে নিষেধ করেছেন বিজিএমইএর নেতারা। এটা বিজিএমইএর পুরোনো কৌশল।...এ কাজে আবার বিজিএমইএকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার’ (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০১২)। নাশকতা নিয়ে গল্প আর প্রচারণা দিয়ে মালিকের অপরাধ ঢেকে ফেলার চেষ্টা এবারও চলছে। এগুলো অপরাধীদের জন্য খুবই স্বস্তিকর। প্রধানমন্ত্রী বারবার নাশকতার কথাই বলছেন। একবারও বললেন না কারখানাগুলোর মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়ার কথা। একবারও বললেন না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকর হয়ে থাকার কথা।
দেশে তৈরি পোশাক খাতে এখন সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান সচল। বিজিএমইএ দাবি করে, ‘এর মধ্যে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের রয়েছে শতভাগ কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন কারখানা। অন্যদিকে বাংলাদেশ সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ইনিশিয়েটিভের (বিএসসিআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৩০০-৫০০ কারখানা কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন।’ (বণিক বার্তা, ২৮ নভেম্বর, ২০১২)। ওয়েবসাইটে প্রদত্ত প্রোফাইল তথ্য অনুযায়ী, ‘তাজরীন ফ্যাশনস কারখানা আইএলও ও দেশের শ্রম আইন কঠোরভাবে পালন করে। অগ্নিনির্বাপণের সব ব্যবস্থা আছে, সবার জন্য ফ্রি চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর টয়লেট।’ বিজিএমইএর সভাপতিও দাবি করেছেন, এই কারখানা সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরি। কিন্তু সাংবাদিকসহ কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যে কারখানার উপরোক্ত বর্ণনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক অগ্রগতি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ‘নিচতলার ওয়্যারহাউসে আগুন লাগায় এর অগ্নিদাহ্য সিনথেটিক-জাতীয় সুতা, কাপড়ের বিশাল মজুদ থাকায় আগুন লাগার পরপরই পুরো ভবনটি ইটভাটার মতো রূপ নেয় এবং সিঁড়িগুলো হয়ে ওঠে উত্তপ্ত চিমনি। নিচতলার ভয়াবহ আগুনের তাপ, শিখা ও কালো ধোঁয়া তিনটি সিঁড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। ফলে শত শত কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা প্রচণ্ড কালো ধোঁয়ার বহির্গমনের কোনো পথ না পেয়ে দমবন্ধ ও পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।’ প্রতিবেদনে পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে, ‘কারখানাটি কোনোভাবেই শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উপযোগী বা যথাযথ মান পরিপালনকারী (কমপ্লায়েন্ট) নয়। কারখানার ভবন তৈরিতেও ন্যূনতম ‘ভবন নির্মাণ বিধিমালা’ অনুসরণ করা হয়নি। কর্মক্ষেত্রের উপযোগী ন্যূনতম শর্তগুলো মানা হলে এত বেশি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না’ (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০১২)।
ফায়ার সার্ভিসের শর্ত অনুযায়ী, কারখানার চারদিক খোলা থাকতে হবে। কিন্তু ‘তাজরীন ফ্যাশনসের সামনের দিকে ৮ থেকে ১০ ফুট পিচের রাস্তা ছাড়া বাকি তিন দিকেই লাগোয়া বাড়িঘর আছে।’ প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে (৩ ডিসেম্বর, ২০১২) ফায়ার সার্ভিস অপারেশনের পরিচালক মুহম্মদ মাহবুব বলেছেন, ‘প্রথম গাড়ি যখন পৌঁছায়, তখন দোতলাসহ তিনতলা পোড়া শুরু করেছে। উদ্ধারযান পৌঁছামাত্র ছাদে সিঁড়ি দিই। সেখানে কাউকে পাইনি। অন্যান্য তলায় খোঁজ করেও কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি।...সম্পূর্ণ অনিয়ম করে গুদাম করা হয়েছে। তার পরও গুদামে ছিল খুব শক্তিশালী দাহ্য বস্তু। যে কারণে আগুন মুহূর্তের মধ্যে একতলা, দোতলা, তিনতলায় ছড়িয়ে যায়।’
১৯৯০ থেকে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাবলির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর একটিরও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। একটির জন্যও দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। শিল্প পুলিশ গঠন করা হয়েছে শ্রমিকদের সম্ভাব্য বিক্ষোভ মোকাবিলার জন্য। কিন্তু উৎপাদনের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর, কারখানায় আগুন বা দুর্ঘটনা মোকাবিলা শক্তিশালী করার জন্য বরাদ্দ অপ্রতুলই থাকছে।
একই বৈঠকে শ্রমসচিব মাইকেল শিপার বলেছেন, ‘শ্রমিককল্যাণ ও শিল্পের বিভিন্ন বিষয় দেখার জন্য সিআইএফ (চিফ ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ) নামে একটি আলাদা বিভাগ আছে। ১৯৬২ সালের কমিশনে ৩১৪ জনের কথা বলা হয়েছিল। সে সময়ের তুলনায় আজকে কয়েক গুণ বেশি শিল্প গড়ে উঠেছে। ৩১৪ জনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কর্মরত আছেন মাত্র ১৮৩ জন।’ আর ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর কজন? তাঁঁদের পরিদর্শন রিপোর্টগুলো কোথায়? ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরের সংখ্যা ১১ জন। তাঁদের যাতায়াত বা কাজের জন্য যে বরাদ্দ তা হাস্যকর রকম তুচ্ছ। তার মানে শ্রমিক তথা জনস্বার্থ দেখার বিষয় কোনো সরকারের কাছেই গুরুত্ব পায় না।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, বাংলাদেশের পা কি এখন ভূতের মতো পেছন দিকে, যত ‘দেশ এগিয়ে যায়’ ততই কি আমরা পেছন দিকে যাচ্ছি? নইলে আগে বড় শিল্পকারখানা মানেই সেখানে খোলা জায়গা, শ্রমিকদের বসতি, স্কুলসহ বিবিধ আয়োজন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ছিল। কিন্তু এখন যে পোশাক কারখানাগুলো বাংলাদেশের শিল্পায়নের প্রধান ভিত্তি, দু-একটি বাদে সেগুলোতে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাসস্থান, নিয়োগপত্র, চাকরির নিরাপত্তা, বাঁচার মতো মজুরি, চিকিৎসা এগুলো সবই কাগজে-কলমে। কোথাও কোথাও অবস্থার যতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণেই।
ট্রাকচালক যখন মানুষের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেন, বাসচালক যখন বাস নিয়ে খাদে ফেলেন, তখন তা ইচ্ছা করে করেন না, এটা ঘটে হয় খারাপ রাস্তার কারণে বা গাড়ির ফিটনেস না থাকলে বা বেশি ট্রিপ দিতে গিয়ে দায়িত্বহীনভাবে গাড়ি চালালে। এবং এ জন্য তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়, সমাজও তাঁকে ঘাতক বা খুনি বলেই অভিহিত করে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে, খরচ বাঁচাতে গিয়ে মালিক অনুপযুক্ত ভবনে কারখানা বসিয়েছেন, সিঁড়িঘরকে গুদাম বানিয়েছেন, প্রতিটি তলা তালাবদ্ধ করে জেলখানা বানিয়েছেন, মিডলেভেল কর্মকর্তাদের যেকোনো মূল্যে বাড়তি কাজ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পদে পদে আইন ভেঙেছেন আরও বেশি টাকার জন্য। তাহলে একই যুক্তিতে তাঁকেও ঘাতক বলা হবে না কেন? দুর্ঘটনা যখন অবহেলা, লোভ, মিথ্যাচার, জানা ব্যবস্থাদি না রাখা, খরচ বাঁচিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কারণে ঘটে, তখন তা আর দুর্ঘটনা থাকে না, সেটা হয় হত্যাকাণ্ড, সর্বোচ্চ অপরাধ।
আমাদের দেশে শিশু থেকে শুরু করে অসংখ্য গরিব নারী-পুরুষ তো এভাবেই মরেন। ফিটনেস ছাড়া লঞ্চ ডোবে, বাস খাদে পড়ে, নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ভবন ধসে, ছোট টুকরি নিয়ে দোকান দিয়ে পেট চালাতে গিয়ে ফ্লাইওভার ভেঙে, পুলিশ-র্যা ব ক্রসফায়ারে-নির্যাতনে, বাড়িতে, হোটেলে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনে, তৈরি পোশাক ভবন ধসে, আগুন লেগে, প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে গুলিতে-নির্যাতনে, প্রবাসপথে সমুদ্রে ডুবে মানুষ মরে। মনে হয় না, মানুষ মরে। মনে হয় সংখ্যা তৈরি হয়, সংখ্যা বাড়ে। সংখ্যার মধ্যে যে প্রাণ আছে, সেই উপলব্ধি সমাজে তৈরি হলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। শ্রমিকদের সরব কণ্ঠ সেই প্রাণেরই জানান দেবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments