নিজাম, বাহার ও রুদ্ধশ্বাসের কয়টি ঘণ্টা by রহমান মাসুদ
চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি। হাতিয়া পৌঁছাই দুইদিন হয়। এর আগেই সন্দ্বীপ থেকে জাহাইজ্জার চরে গিয়ে নিজামের সঙ্গীদের ধাওয়া খেয়ে কোনরকম জীবন নিয়ে পালিয়ে ফিরেছিলাম সন্দ্বীপে। বাংলানিউজের চট্টগ্রাম ব্যুরোর সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধরও সে অভিযানে।
জাহাইজ্জার চরে পৌঁছে নিজাম ডাকাতের সাক্ষাৎকার না নিয়ে ফিরতে মন টানছিলো না। দুজনই অপেক্ষা করছিলাম নিজামের সাক্ষাতকার নেওয়ার। বিভিন্ন পথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কোন নেটওয়ার্কই কাজ করছিলো না। রাজি হচ্ছিলেন না দস্যু স¤্রাট।
২৭ ফেব্রুয়ারির সকাল বেলা নাস্তা সারলাম ওছাখালির হোটেল সিঙ্গাপুরে। নলচিরা ঘাটে গিয়ে ক্যারিংচরের নৌকা ভাড়া করার চেষ্টা করি। ওরে বাব্বা! ৫০ হাজার টাকায়ও কেউ নাকি যাবেনা ওই চরে। মাঝিদের কথা, ওই পথে কোন নৌকা গেলে তা আটকিয়ে রাখে নিজাম ডাকাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কি আর করা! বসে আছি ঘাটে। হঠাৎ একটা স্পিড বোট ঘাটে ভিড়লো। জানলাম এসেছে ভোলার মনপুরা থেকে। টোপ ফেললাম। যাবে নাকি ক্যারিংচর। বোটের চালক রাজী হলেন বটে, কিন্তু ১০ হাজার টাকায় ২৬ কিলোমিটার নদী পাড়ি দেওয়ার সামর্থ নিয়ে হাতিয়া যাইনি সে কথা বলাই বাহুল্য। বসে থাকি। বিভিন্ন সোর্সে চলতে থাকে নৌকা সংগ্রহের চেষ্টা।
“আপনারা ক্যারিংচরে যাবেন?” একটি প্রশ্ন বেজে ওঠে কানে। তাকিয়ে দেখি মলিন মুখ, ভয়ার্ত চাহনি। যেনো জোর করে সাগরে ফেলা হচ্ছে তাকে। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই দেখিয়ে দিলেন দুরের একটি ইঞ্জিন নৌকা। আমি উজ্জ্বলের মুখের দিকে তাকাই। মনে হলো তিনিও খুশি। ঘাট ছেড়ে উঠে পড়ি। কদ্দুর খানেক হেঁটে নৌকায় চড়ে বসি। পেছন পেছন আসেন নৌকার তিন মাঝি।
হাতিয়ায় যে ক’টি সূত্র কিছু অসম্ভব কাজ সম্ভব করতে সাহায্য করেছিলো তাদেরই কেউ একজন জনৈক উকিল সাহেব ও একজন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সদিচ্ছায় আমাদের জন্য এই ইঞ্জিন নৌকার ব্যবস্থা করেন। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো। নাম জানিনা, চেহারা দেখিনি এমনই কেউ গোপনে ক্যারিং চরে যেতে এই সহযোগিতা করলেন আমাদের।
নৌকা ঘণ্টা খানেক চলার পর মোবাইল ফোনে কল করি হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তার হোসেনকে। তার কন্ঠে উৎকণ্ঠা। জানতে চাইলেন, কোথায়? ছলনার আশ্রয় নিলাম। ঘন্টা খানেক যেখানে আরো লাগবে ক্যারিংচরে নামতে সেখানে বললাম ৫ মিনিটের মধ্যে নামব। তিনি বললেন, সাবধানে থাকবেন। ভয়ঙ্কর জায়গা। বাথানখালি ফাড়িঁর পুলিশকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু রিস্ক আপনার। পরের ফোনটি করলাম হাতিয়া কোস্টগার্ড কমান্ডার মিল্টনকে।
মিল্টন জানালেন, কোস্টগার্ডের একটি উচ্চগতির বোট আছে। যা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলে। আমি যদি বিপদে পড়ার পর কল করার সুযোগ পাই, তাহলে আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার করতে পারবেন। কথাগুলোই ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো। কল ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। উজ্জলের চোখে প্রশ্ন জাগানো চাহনি। আমি কিছু না বলে তাকে সামনের চরে হাজার হাজার মহিষ ও ভেড়ার পাল দেখিয়ে ছবি তুলতে বললাম।
নৌকা থেকে নামার সময় মাঝিরা জানালেন ভাড়া নেওয়া নিষেধ। ৫০০ টাকা চা খেতে দিলাম। তাও নেবন না। কেউ জানবে না, নিশ্চয়তায় টাকা নিয়ে চলে গেলেন দ্রুত। তীরে নেমে ধুধু ঘাসবনে মহিষের পাল দেখছি আর হাটছি। দুরে বাথানখালি বাজারের টিনের চালা ও ভূমীহীন চরবাসীর বিক্ষিপ্ত কুড়ে ঘর। উজ্জল একটার পর একটা ছবি তুলে চলছেন।
হটাৎ বাশিঁর ফুঁ। তাকিয়ে দেখি জনা ১৫ লুঙ্গীপরা মানুষ। তবে চরের নয় বলেই মনে হলো। এরা পরিস্কার জামা-কাপড় পরে আছে। এতোক্ষণ মহিষের পালের মধ্যে ছিলেন। আমাদের ঘিরে ধরলেন সবাই। একজন জানতে চাইলেন, আমরা সাংবাদিক কিনা। হ্যাঁ সূচক উত্তরেই তিনি জানালেন আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন।
ভয় পাবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সবার সঙ্গে হাত মেলালাম। কোলাকুলিও সারলাম। জানতে চাইলাম বাহার কেরানীর খোঁজ। দলটি আমাদের বাথানখালি বাজারে নিয়ে চলল।
বাথানখালি বাজারে গিয়ে দেখি পুলিশ ফাড়িঁ সংলগ্ন চায়ের দোকানে ফাড়িঁর আইসিসহ বসে আছেন নিজাম চৌধুরীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী। যার নামে পুলিশের গ্রেফতারি পারওয়ানা জারি। উপকূলীয় পাঁচ জেলায় যার নামে হত্যা, খুন, গুম, অগ্নি সংযোগ, ডাকাতি, ধর্ষণসহ কমপক্ষে ৫০ মামলা। এমন আসামির পুলিশকর্তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ চা খেতে দেখে কিছুটা ভয়ও পেলাম। কিছুটা বিষ্ময়।
বাহার কেরানী উঠে আসলেন। হাত মেলালেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তখনও সাহস জোগাড়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবকিছুই যেনো ঘটছে ঘোরের মধ্যে। চা খাওয়ার পর বাহার কেরানিকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো মনে হতে শুরু করলো। আমাদের কাছে ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন, তারা চরে কত কত ভালো কাজ করেন। স্কুল করেছেন, বাজার বসিয়েছেন। অথচ মানুষ তাদের দস্যু বলে!
এর পর নিয়ে বের হলেন চর দর্শনে। একে একে, মুজিব বাজার, হাসিনা বাজার, রেহানা বাজার, রাসেল বাজার, জামাল বাজার, কামাল বাজার, জয় বাজার, ফখরুদ্দীন বাজার, শাবনাজ বাজার ঘুরে দেখালেন। অবাক করা সব নাম। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নামে সব বাজার। এরই একটি বাজারে দেখা হলো প্রায়ত দস্যু স¤্রাট বাশার মাঝির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। আমাকে বাশার মাঝির মাছের প্রজেক্ট (ছয়টি বড় পুকুর) কম টাকায় কিনে নিতে অনুরোধ জানালেন। আমি তাকে বললাম চৌধুরীসাবকে একবার দেখতে চাই। কথা বলতে চাই।
বাহার কেরানী মোবাইল ফোনে কল দিলেন নিজাম চৌধুরীকে। জানালেন, আমার ইচ্ছার কথা। নিজাম ডাকাত ওপাশ থেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আমাকে মোবাইল ফোন এগিয়ে দিলেন। কার সঙ্গে কথা বলছি সে কথা মনে করে শিউরে উঠলেও সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এরপর প্রায় আধাঘণ্টা আমাদের কথা হলো। পুরো কথা রেকর্ড করে নিলাম। আমি অবশেষে আবারো তাকে দেখার ইচ্ছা জানালাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে জানালেন একদিন পর দেখা হবে, বাথানখালি বাজারে। ওইদিন সকালে নলচিরার ঘাটে সকালেই অপেক্ষায় থাকবে দস্যু নৌকা। তার হেড কোয়ার্টার জাহাইজ্জার চর থেকে সবার নজর এড়িয়ে আসতে এই টুকু সময় লাগবেই!
আমরা আবার ফিরলাম বাথান খালি। তখন প্রায় সন্ধা হতে চলেছে। সারাদিন চরের ২৫/৩০ কিলো রাস্তা ঘুরেছি চরে থাকা মাত্র ২টি বাইকে, রাস্তা বিহিন আলপথে। সকালে যখন বাথানখালি বাজার ছেড়েছিলাম, তখন যেমন ভয়ার্ত মুখ দেখেছিলাম আইসির, এখন তার অবস্থা আরো খারাপ। বেচারা আমাদের দেখে যেনো হাফ ছেড়ে বাচঁলেন।
সারাদিন আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে অর্ধশতাধিক জলদস্যুর। যেখানেই দাড়িয়েছি, শতশত ভূমিহীন মানুষ জড়ো হয়ে ভয়ার্ত চোখে আমাদের কাছে দস্যুদের গুনকীর্তন করেছে। তবে অনেকেই আবার গোপনে বলে চলেছেন নির্যাতনের করুন ইতিহাস। কেউ কেউ গোপনে সংগ্রহ করেছেন আমার ভিজিটিং কার্ড। দস্যুরা আপ্যায়ন করেন গরম গরম মহিষের দুধ দিয়ে।
ততক্ষণে কিন্তু প্রশাসন জেনে গেছে আমরা নিজামের সক্ষাতকার নেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা তা সহ্য করল না। চরে একটার পর একটা অভিযান শুরু করল। নিজাম বের হতে পারলেন ননা। আমাকে কল করে জানতে চাইলেন, আমি আর কি কি জানতে চাই। ফোনেই দিয়ে দিলেন সাক্ষাতকার। আমার দেখা হলো না নিজাম ডাকাতকে।
সাক্ষাতে হয়ত জানা যেতো তার দস্যুতার আরো কিছু গোপন অধ্যায়। যা হয়ত পাখা মেলত রাজধানী ঢাকার পরাক্রমশালীদের প্রাসাদ পর্যন্ত। হয়ত তাই সক্রিয় হয়েছিল প্রশাসন। যাতে কোনক্রমে দেখা না হয় আমাদের।
নিজাম ডাকাত আজ নিহত। বৃহস্পতিবার ঘুম ভেঙ্গেছে র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক উর্ধবতনদের টেলিফোন পেয়ে। অভিনন্দিত হয়েছি সহকর্মীদের ফোনেও। কেউ কেউ আমাকে দায়ী করেছেন এ ঘটনার জন্য। নিজামের ‘জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন‘ করছি শিরোনামে বাংলানিউজে প্রকাশিত রিপোর্ট অপরাধ বিষয়ক শ্রেষ্ট অনুসন্ধানী প্রতিবেদক পুরস্কারও এনে দিয়েছে। কিন্তু আজ বার বার মনে হচ্ছে নিজামের মৃত্যুতে অনেক পরাক্রমশালী হয়তো নিরাপদই হলেন। তার গড ফাদাররা আড়ালেই থেকে গেলেন।
“আপনারা ক্যারিংচরে যাবেন?” একটি প্রশ্ন বেজে ওঠে কানে। তাকিয়ে দেখি মলিন মুখ, ভয়ার্ত চাহনি। যেনো জোর করে সাগরে ফেলা হচ্ছে তাকে। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই দেখিয়ে দিলেন দুরের একটি ইঞ্জিন নৌকা। আমি উজ্জ্বলের মুখের দিকে তাকাই। মনে হলো তিনিও খুশি। ঘাট ছেড়ে উঠে পড়ি। কদ্দুর খানেক হেঁটে নৌকায় চড়ে বসি। পেছন পেছন আসেন নৌকার তিন মাঝি।
হাতিয়ায় যে ক’টি সূত্র কিছু অসম্ভব কাজ সম্ভব করতে সাহায্য করেছিলো তাদেরই কেউ একজন জনৈক উকিল সাহেব ও একজন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সদিচ্ছায় আমাদের জন্য এই ইঞ্জিন নৌকার ব্যবস্থা করেন। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো। নাম জানিনা, চেহারা দেখিনি এমনই কেউ গোপনে ক্যারিং চরে যেতে এই সহযোগিতা করলেন আমাদের।
নৌকা ঘণ্টা খানেক চলার পর মোবাইল ফোনে কল করি হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোক্তার হোসেনকে। তার কন্ঠে উৎকণ্ঠা। জানতে চাইলেন, কোথায়? ছলনার আশ্রয় নিলাম। ঘন্টা খানেক যেখানে আরো লাগবে ক্যারিংচরে নামতে সেখানে বললাম ৫ মিনিটের মধ্যে নামব। তিনি বললেন, সাবধানে থাকবেন। ভয়ঙ্কর জায়গা। বাথানখালি ফাড়িঁর পুলিশকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু রিস্ক আপনার। পরের ফোনটি করলাম হাতিয়া কোস্টগার্ড কমান্ডার মিল্টনকে।
মিল্টন জানালেন, কোস্টগার্ডের একটি উচ্চগতির বোট আছে। যা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলে। আমি যদি বিপদে পড়ার পর কল করার সুযোগ পাই, তাহলে আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার করতে পারবেন। কথাগুলোই ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো। কল ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। উজ্জলের চোখে প্রশ্ন জাগানো চাহনি। আমি কিছু না বলে তাকে সামনের চরে হাজার হাজার মহিষ ও ভেড়ার পাল দেখিয়ে ছবি তুলতে বললাম।
নৌকা থেকে নামার সময় মাঝিরা জানালেন ভাড়া নেওয়া নিষেধ। ৫০০ টাকা চা খেতে দিলাম। তাও নেবন না। কেউ জানবে না, নিশ্চয়তায় টাকা নিয়ে চলে গেলেন দ্রুত। তীরে নেমে ধুধু ঘাসবনে মহিষের পাল দেখছি আর হাটছি। দুরে বাথানখালি বাজারের টিনের চালা ও ভূমীহীন চরবাসীর বিক্ষিপ্ত কুড়ে ঘর। উজ্জল একটার পর একটা ছবি তুলে চলছেন।
হটাৎ বাশিঁর ফুঁ। তাকিয়ে দেখি জনা ১৫ লুঙ্গীপরা মানুষ। তবে চরের নয় বলেই মনে হলো। এরা পরিস্কার জামা-কাপড় পরে আছে। এতোক্ষণ মহিষের পালের মধ্যে ছিলেন। আমাদের ঘিরে ধরলেন সবাই। একজন জানতে চাইলেন, আমরা সাংবাদিক কিনা। হ্যাঁ সূচক উত্তরেই তিনি জানালেন আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন।
ভয় পাবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সবার সঙ্গে হাত মেলালাম। কোলাকুলিও সারলাম। জানতে চাইলাম বাহার কেরানীর খোঁজ। দলটি আমাদের বাথানখালি বাজারে নিয়ে চলল।
বাথানখালি বাজারে গিয়ে দেখি পুলিশ ফাড়িঁ সংলগ্ন চায়ের দোকানে ফাড়িঁর আইসিসহ বসে আছেন নিজাম চৌধুরীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী। যার নামে পুলিশের গ্রেফতারি পারওয়ানা জারি। উপকূলীয় পাঁচ জেলায় যার নামে হত্যা, খুন, গুম, অগ্নি সংযোগ, ডাকাতি, ধর্ষণসহ কমপক্ষে ৫০ মামলা। এমন আসামির পুলিশকর্তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ চা খেতে দেখে কিছুটা ভয়ও পেলাম। কিছুটা বিষ্ময়।
বাহার কেরানী উঠে আসলেন। হাত মেলালেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তখনও সাহস জোগাড়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবকিছুই যেনো ঘটছে ঘোরের মধ্যে। চা খাওয়ার পর বাহার কেরানিকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো মনে হতে শুরু করলো। আমাদের কাছে ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন, তারা চরে কত কত ভালো কাজ করেন। স্কুল করেছেন, বাজার বসিয়েছেন। অথচ মানুষ তাদের দস্যু বলে!
এর পর নিয়ে বের হলেন চর দর্শনে। একে একে, মুজিব বাজার, হাসিনা বাজার, রেহানা বাজার, রাসেল বাজার, জামাল বাজার, কামাল বাজার, জয় বাজার, ফখরুদ্দীন বাজার, শাবনাজ বাজার ঘুরে দেখালেন। অবাক করা সব নাম। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নামে সব বাজার। এরই একটি বাজারে দেখা হলো প্রায়ত দস্যু স¤্রাট বাশার মাঝির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। আমাকে বাশার মাঝির মাছের প্রজেক্ট (ছয়টি বড় পুকুর) কম টাকায় কিনে নিতে অনুরোধ জানালেন। আমি তাকে বললাম চৌধুরীসাবকে একবার দেখতে চাই। কথা বলতে চাই।
বাহার কেরানী মোবাইল ফোনে কল দিলেন নিজাম চৌধুরীকে। জানালেন, আমার ইচ্ছার কথা। নিজাম ডাকাত ওপাশ থেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আমাকে মোবাইল ফোন এগিয়ে দিলেন। কার সঙ্গে কথা বলছি সে কথা মনে করে শিউরে উঠলেও সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এরপর প্রায় আধাঘণ্টা আমাদের কথা হলো। পুরো কথা রেকর্ড করে নিলাম। আমি অবশেষে আবারো তাকে দেখার ইচ্ছা জানালাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে জানালেন একদিন পর দেখা হবে, বাথানখালি বাজারে। ওইদিন সকালে নলচিরার ঘাটে সকালেই অপেক্ষায় থাকবে দস্যু নৌকা। তার হেড কোয়ার্টার জাহাইজ্জার চর থেকে সবার নজর এড়িয়ে আসতে এই টুকু সময় লাগবেই!
আমরা আবার ফিরলাম বাথান খালি। তখন প্রায় সন্ধা হতে চলেছে। সারাদিন চরের ২৫/৩০ কিলো রাস্তা ঘুরেছি চরে থাকা মাত্র ২টি বাইকে, রাস্তা বিহিন আলপথে। সকালে যখন বাথানখালি বাজার ছেড়েছিলাম, তখন যেমন ভয়ার্ত মুখ দেখেছিলাম আইসির, এখন তার অবস্থা আরো খারাপ। বেচারা আমাদের দেখে যেনো হাফ ছেড়ে বাচঁলেন।
সারাদিন আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে অর্ধশতাধিক জলদস্যুর। যেখানেই দাড়িয়েছি, শতশত ভূমিহীন মানুষ জড়ো হয়ে ভয়ার্ত চোখে আমাদের কাছে দস্যুদের গুনকীর্তন করেছে। তবে অনেকেই আবার গোপনে বলে চলেছেন নির্যাতনের করুন ইতিহাস। কেউ কেউ গোপনে সংগ্রহ করেছেন আমার ভিজিটিং কার্ড। দস্যুরা আপ্যায়ন করেন গরম গরম মহিষের দুধ দিয়ে।
ততক্ষণে কিন্তু প্রশাসন জেনে গেছে আমরা নিজামের সক্ষাতকার নেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা তা সহ্য করল না। চরে একটার পর একটা অভিযান শুরু করল। নিজাম বের হতে পারলেন ননা। আমাকে কল করে জানতে চাইলেন, আমি আর কি কি জানতে চাই। ফোনেই দিয়ে দিলেন সাক্ষাতকার। আমার দেখা হলো না নিজাম ডাকাতকে।
সাক্ষাতে হয়ত জানা যেতো তার দস্যুতার আরো কিছু গোপন অধ্যায়। যা হয়ত পাখা মেলত রাজধানী ঢাকার পরাক্রমশালীদের প্রাসাদ পর্যন্ত। হয়ত তাই সক্রিয় হয়েছিল প্রশাসন। যাতে কোনক্রমে দেখা না হয় আমাদের।
নিজাম ডাকাত আজ নিহত। বৃহস্পতিবার ঘুম ভেঙ্গেছে র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক উর্ধবতনদের টেলিফোন পেয়ে। অভিনন্দিত হয়েছি সহকর্মীদের ফোনেও। কেউ কেউ আমাকে দায়ী করেছেন এ ঘটনার জন্য। নিজামের ‘জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন‘ করছি শিরোনামে বাংলানিউজে প্রকাশিত রিপোর্ট অপরাধ বিষয়ক শ্রেষ্ট অনুসন্ধানী প্রতিবেদক পুরস্কারও এনে দিয়েছে। কিন্তু আজ বার বার মনে হচ্ছে নিজামের মৃত্যুতে অনেক পরাক্রমশালী হয়তো নিরাপদই হলেন। তার গড ফাদাররা আড়ালেই থেকে গেলেন।
No comments