মহড়াকক্ষ থেকে: মহাজনের নাও-একটি গীতল নাটক by জাহীদ রেজা নূর
চাইলেই নাটকে পশ্চিমা রীতি উপেক্ষা করা যায় না। কিংবা উপেক্ষা করতেই হবে, এ রকম আইনও কেউ করে দেয়নি। পশ্চিমা আর প্রাচ্য রীতির মিলনেও তো গড়ে উঠতে পারে অসাধারণ শিল্প, সে কথাই বা ভুলি কী করে। সুবচন নাট্য সংসদ যখন লোকশিল্পী শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে মঞ্চে নাটক আনতে চাইল, তখন এ প্রশ্নটিও তাদের মনে এসেছিল নিশ্চয়।
তাই নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী পড়েছিলেন দোটানায়। পথ খুঁজলে পথ বের হয়। লোকরীতি ও পাশ্চাত্য রীতির মিলনেই গড়ে ওঠে নাটকের শরীর। আরেকটু বলি, নাটকটা হচ্ছে লোকরীতিতেই, কিন্তু আলো, গিমিক ইত্যাদিতে নেওয়া হয়েছে পশ্চিমের সাহায্য।
সুবচনের সদস্যদের নিয়ে একটি কাজ করতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক সুদীপ দেখলেন, দলের প্রত্যেক সদস্যের কণ্ঠেই আছে সুর। ফলে দলপ্রধান আহম্মেদ গিয়াসকে বললেন, একটি গীতল নাটক করলে ভালো হয়। ‘গীতল’ শব্দটি ভালো লেগে যায় আমাদের। কান থেকে সরতেই চায় না। শব্দটি কানে থাকতে থাকতেই সাতমসজিদ রোডের গ্রাফিক্স আর্ট ইনস্টিটিউটের একটি ঘরে শুরু হয়ে যায় মহড়া। গীতল শব্দটিকে শব্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে কণ্ঠের কারুকাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মন সিক্ত হয় লোকজ আবহে।
নাটকের শুরুতেই একজনকে কেন্দ্র করে দুটো মানববৃত্ত তৈরি হয়। বাজতে থাকে বাদ্য। ঢোল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম ও তবলা বাজতে থাকে কখনো দ্রুত লয়ে, কখনো একটু ঢিমেতালে। বাদ্যের তালে তালে দুলতে থাকে কুশীলবদের শরীর।
‘এই দুনিয়ার মালিক মাওলা তুমি বিনে কে বা কার’—চলতে থাকে গান। গান চলতে চলতেই হঠাৎ নীরবতা, মুহূর্তের নীরবতা কাটতে না-কাটতেই আবার তুমুল গান। সেই নীরবতা ও সংগীতের মধ্যে যে অনির্বচনীয় ভাষা আছে, তা জানা যায়। একটু পর মাঝের মানবগোলকটি ফুলের মতো দাঁড়িয়ে গেল। শোনা গেল পুঁথিপাঠের সুর, ‘মনের দুঃখ কই না মানুষ বিনে’ দিয়ে শুরু হলো তা। এ সময় থাকল সিলেট অঞ্চলের স্বনামধন্য বাউল-কবিদের কীর্তির বয়ান।
মহড়ার মধ্যেই ক্যামেরা হাতে হাজির হন নাট্যকার শাকুর মজিদ। পেশায় তিনি স্থপতি। বললেন, ‘আমি নাটক লিখতে সম্মতি দিয়েছি কেবল, এরই মধ্যে ওরা বেশ কিছু গান তৈরি করে ফেলেছে।’
মহড়া চলতে থাকে। কিছু পরিচিত গান শোনা হয় নাটকের মধ্যে। ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল, কেমন দেখা যায়’, ‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া’...।
গানগুলো সিডির কল্যাণে ছেয়ে যাওয়া সুরে নয়, সুনামগঞ্জ থেকে শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে থাকা তিনজন বাউলকে নিয়ে এসে তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া সুরে গাওয়া হচ্ছে।
সুদীপ এক ফাঁকে জানিয়ে যান, সর্বজনীনতা দেওয়ার জন্যই নাটকে সুনামগঞ্জের ভাষা দেওয়া হয়নি। শাকুর মজিদ যোগ করেন, এটা প্রমিত বাংলা নয়, গাঁও-গেরামের ভাষা।
মহড়ার মধ্যেই জানা হয়ে যায়, নাটকে রয়েছে ২১টি গান। আছে লাঠিখেলা, হাডুডু। আর আছে মালজুড়া, যা বিচার গান নামেও পরিচিত। নাটকীয়তা নয়, শাহ আবদুল করিমের জীবনকে এ নাটকে তুলে আনা হয়েছে সহজ-সরল ভঙ্গিতে। গানপাগল মানুষটির জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত উঠে এসেছে নাটকে।
সুবচন নাট্য সংসদের সদস্যরা প্রতিদিনই বসলেন নাটকটি নিয়ে। প্রতিদিনই একটু একটু করে পরিবর্তিত হচ্ছে নাটকের আদল। ১৮ জুন প্রথম মঞ্চায়নের আগে কোনো খুঁত রাখতে চাইছেন না নির্দেশক। আহম্মেদ গিয়াস করছেন অকুণ্ঠ সহযোগিতা।
সুদীপ বলেন, ‘আমি তো বয়সে ছোট, নাট্যাঙ্গনে অনেক সিনিয়রই জুনিয়রদের খুব একটা দাম দিতে চান না। কিন্তু সুবচনের বড় ভাইয়েরাও আমাকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছেন, তাতে আমি অভিভূত।’
আমরা একটি ভালো নাটকের প্রত্যাশা করতেই পারি। ভাটি অঞ্চলের সরল মানুষটির অদম্য জীবনের নাট্যরূপ দেখার জন্য উন্মুখ হই। লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহারের একাগ্র আকাঙ্ক্ষা দেখে মন ভরে ওঠে আমাদের। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, এ নাটকপাগল ছেলেমেয়েরা আছে বলেই মঞ্চ এখনো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে পারছে।
ফিরে আসার সময় ‘আমরা বলি মানুষ বড় রে’ গানটির সুর লেগে থাকে কানে। মনে হয়, মানবতার আবহে স্নান করা হয়ে গেল আমাদের।
No comments