সরকার-ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা by শাহ্দীন মালিক
বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার কয়েকটি। বলা বাহুল্য, অন্য অনেকের চেয়ে আমি এখন বহুলাংশে ভীত। তাই ব্যাপারগুলো বয়ান করব মনের মাধুরী মিশিয়ে, রংচং মাখিয়ে। রংগুলো ব্যবহার করব কালো গোছের গাঢ়, গম্ভীর রং।
আগেভাগেই ‘ভীত’ হওয়ার কৈফিয়ত। আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারসংক্রান্ত পত্রপত্রিকার খবরে প্রায় সবাই ব্যবহার করেছে—‘একটা বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা’ শব্দগুলো। এই ‘বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা’ পত্রিকার মালিক বা কথিত মালিক/প্রকাশককে ধরে নিয়ে অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইত্যাদি।
ভাশুর বা স্বামীর নাম মুখে নিতে হয় না, বলতে হয় না। বউ যদি তাঁর ভাশুর বা স্বামীর নাম বলেন, সেটা অলক্ষুণে, এতে ভগবান-বিধাতা রুষ্ট হন, অনিষ্ট হবে। তাই সবাই লিখেছে, ‘বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা’। ডাকসাইটে পত্রিকাগুলোই যখন ভয় পাচ্ছে, পাছে কেউ রুষ্ট হয়, অনিষ্ট হয়—সেখানে এই অধম কোন ছার। অতএব ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত।
আরও একটা ‘সাইড-টক’। সাতসকালে শাহ্ আবদুল করিমের খুব চেনা গান শুনছিলাম। আমার ধারণা, বহু পাঠক-পাঠিকা গানটি শুনেছেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা আর খাটু গান গাইতাম...।’ ধারণা করছি, শাহ্ আবদুল করিম গানের কথাগুলো লিখেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্মৃতিচারণা থেকে। ‘বাউলা গান খাটু গান, আনন্দের কি তুফান’। সেই দিনগুলো শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়, সব ব্যাপারেই হারিয়ে যাচ্ছে। অতি দ্রুত, অতি আশঙ্কাজনকভাবে।
ব্যাপারগুলোতে ফিরে আসি। এক বন্ধু গল্প করছিল, এক গণ্যমান্য ব্যক্তি তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। আহামরি কোনো বড় অঙ্ক না। যা হয়, আজ দেব, কাল দেব বলে অনেক দিন কেটে গেছে। শেষতক ফয়সালা হয় যে, আগামী রোববার টাকা ফেরত দেবেন। রোববার এল, প্রায় চলেও যাচ্ছিল, ঋণগ্রহীতার কোনো খবর নেই। শেষে রাত ১০টার দিকে ফোন। অন্য প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল—‘আমি অমুক স্থান থেকে বলছি, আমার নাম অমুক।’ বন্ধুর প্রশ্ন—‘নাম শুনলাম, কিন্তু আপনি সেখানে কোন পদে আছেন, আর কেনই বা ফোন করেছেন।’ উত্তর—‘আমি কোন পদে আছি, সেটা বড় কথা নয়। অমুক ভদ্রলোক আপনাকে যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, সেটা উনি আজকে পারবেন না। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সম্ভবত দিয়ে যাবেন।’
আমার বন্ধুর মেজাজটা সম্ভবত তিরিক্ষি গোছের হয়ে গিয়েছিল। তার কথা মতে, ঠেসে ঝাড়ি মারলাম। অর্থাৎ ফোনকারীকে বেশ গালমন্দ শুনিয়ে দিয়েছিল। আপনি কে, আপনার পদ কী, রাত ১০টায় এক মোবাইল ফোন থেকে ফোন করে অমুক অফিসের কথা বলে হুমকি গোছের কথা বলছেন ইত্যাদি।
পরদিন সকালে ঋণগ্রহীতার সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হলো। আগের দিনের ওমুক অফিসের নামে করা ফোনের ব্যক্তিটির নাম উল্লিখিত হলো। ঋণগ্রহীতা কথাচ্ছলে জানালেন, ওই ব্যক্তিটি তাঁর খুবই পরিচিত আর তাঁর পরিচয় হলো—ওমুকের (আমিও ভাশুর-স্বামীর নাম উচ্চারণ করছি না) ওই গোছের পরম আত্মীয়। বলা বাহুল্য, আমার ধারণা বেচারা বন্ধুটি খুব শুষ্ক ঢোক গিলেছিল, যেটা সে আমাকে বলেনি। ঋণগ্রহীতাকে যা বলেছিল, সেটা আমাকে বলেছিল, ‘আরে ভাই, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আপনার সুবিধামতো টাকাটা ফেরত দিয়ে দিয়েন। যখন আপনার সুবিধা।’
দ্বিতীয় ব্যাপার—আরেকজন বন্ধু। এই বন্ধুটি বহু বছর ধরে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করছে। প্রবন্ধ-বই এন্তার। দেশে-বিদেশে ওই ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হলে প্রায়ই তার ডাক পড়ে। বহু দেশে বহুবার গেছে প্রবন্ধ পড়তে, বিদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষককে তালিম দিতে। তদুপরি পাঁচ-ছয় বছর ধরে বিভিন্ন সরকার—সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার, সচিব অনেকবার তার সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন। সেমিনার-ওয়ার্কশপে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা তার কথা শুনতে এসেছেন। সেই বন্ধুটি মাঝখানে পাঁচ-ছয় দিনের জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন পেরিয়ে প্লেনে ওঠার বোর্ডিং গেটে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখল মাঝেমধ্যে দু-চারজন করে বিমানবন্দরের সিকিউরিটি-কাস্টমস ইত্যাদি কর্মকর্তাদের পরম আদরযত্ন সোহাগে লাইনে না দাঁড়িয়ে লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে পাশ কাটিয়ে সোজা প্লেনে উঠে যাচ্ছে। মেজাজ তিরিক্ষি হতে হতে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে জোর গলায় একবার প্রতিবাদই করে ফেলল, ‘এরা কারা, লাইন ছাড়া প্লেনে উঠছে।’ উত্তর এল—ভিভিআইপি। বন্ধুর বর্ণনামতে সবই তো মনে হলো ২০-৩০ বছরের যুবক-যুবতী। এরা ভিভিআইপি কীভাবে হলো?
দিন পাঁচেক পর বন্ধুটি দেশের মাটিতে ফেরত-পদার্পণ। বরাবরের মতো ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দু-চার মিনিটে পাসপোর্ট পরীক্ষা করে সিল-ছাপ্পর মেরে ছেড়ে দেওয়ার কথা। এবার সেটি হলো না। ‘আপনি পাশে দাঁড়ান।’ তারপর হুকুম—‘ওই রুমে যান।’ এই অফিসার, এই অফিসার, সবাই অনেকক্ষণ ধরে বারবার পাসপোর্ট পরীক্ষা। কেন গিয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন, এত ঘন ঘন কেন বিদেশে যাওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক ধরে গলদঘর্ম হয়ে ছাড়া পেল। সুটকেস নিয়ে কাস্টমসের ঘাট পেরুতে গেলে তাকে আটকানো হলো। ‘সুটকেট খোলেন। সবকিছু বের করুন।’ সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা। বন্ধুর মন্তব্য, যেন একটা স্মাগলারকে হাতেনাতে ধরেছে। যা হোক শেষতক ছাড়া পেল। যখন সে সুটকেস বন্ধ করছিল, তখন কাস্টমস কর্মকর্তার মন্তব্য—‘খুব বিপ্লবী হয়ে গেছেন! জানেন, যাওয়ার সময় বোর্ডিং লাইনে কার সম্পর্কে আপনি প্রশ্ন তুলেছিলেন—উনারা ওমুকের (আবার আমার সেই ভাশুর/স্বামীর অজুহাত) আত্মীয়।’
আগে থেকেই স্থির করা ছিল, তাই বন্ধুটিকে আবার দিন পনেরো পর এয়ারপোর্টে যেতে হয়েছিল, বিদেশ যাওয়ার জন্য। ইমিগ্রেশন পেরুতে তাকে এ-ঘাট ও-ঘাট, এ-রুম, ও-রুম, এ-কর্মকর্তা ইত্যাদিতে ঘণ্টাখানেক। কেন যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন।
বৃত্তান্ত বলার পর আমার কাছে আইনি প্রশ্ন। ফিরে আসা বা যাওয়ার পথে আমার সুটকেসে মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাকে ভীষণভাবে আশ্বস্ত করলাম—অবশ্যই পারে। হাতেনাতে মাদকদ্রব্যসহ ধরা পড়লে আইনজীবী হিসেবে সাততাড়াতাড়ি বিশেষ কিছু করতে পারব না। বছর দুয়েক কারাবাসের পর হয়তো জামিন হবে। হাজার হলেও তুমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক। জামিন আগেও পেতে পার। অতএব আইনি উপদেশ দুটি—আপাতত মাস ছয়েক বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, সরকারি দলে ভিড়ে যাও।
২.
সত্য-মিথ্যা জানি না—লোকমুখে শুনেছি আমরা আর মাহমুদুর রহমান একই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। সে সুবাদে আমরা সমসাময়িক। ইদানীং দু-চারবার দেখা-সাক্ষাৎ, মোলাকাত হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে।
ভদ্রলোকের কাজকর্ম, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বা কোনো ঘটনাতে তাঁর বিশ্লেষণ আমার অপছন্দ। প্রায় ব্যাপারেই দ্বিমত আছে। একইভাবে আমি নিশ্চিত যে, আমার কথাবার্তায়ও তাঁর বিশেষ আপত্তি থাকবে, তাঁরও দ্বিমত থাকবে।
ভদ্রলোক আমি যত দূর বুঝি রাজনীতি করার জন্য সাংবাদিকতা করেন। বেশির ভাগ সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতার আড়ালে হয়তো রাজনীতি থাকে। কিন্তু সাংবাদিকতা তাঁদের পেশা। রাজনীতি নেশা হতে পারে। মাহমুদুর রহমান সাহেবের জন্য ব্যাপারটা বোধহয় উল্টো।
হোক, তাতে আমার-আপনার বাধা দেওয়ার কী আছে! আর পাঠকমাত্রই বাধার তরিকাটা দেখেছেন।
সরকার বোধহয় আমার ভীত অবস্থার চেয়ে বেশি ভীত। না হলে মাঝরাত নাগাদ ডজন ডজন পুলিশ কি পাঠাত? পত্রপত্রিকায় দেখলাম, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ। প্রতারণার মামলা প্রতিনিয়ত থানা/আদালতে ডজন ডজন হচ্ছে।
বন্ধুটিকে দেওয়া ‘আইনি’ উপদেশের মতো মাহমুদুর রহমানকে তো আর উপদেশ দিতে পারি না যে—ভাই, আপনি আওয়ামী লীগ না হলে অন্তত জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি তো থাকতে পারবেন।
কোন পত্রিকায় যেন দেখলাম আপনার বিরুদ্ধে নাকি ৩১টা মামলা আছে। ক্ষমতাসীন দলের এক মহারথীর বোধহয় শখানেক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। দলে যোগ দিন, আপনারও কপাল খুলে যাবে। আর বিরোধী/বিরোধী থাকলে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারবেন অচিরেই। সরকারের বদৌলতে। মাহমুদুর রহমান নামটা তো এখন ভাশুর/স্বামী পর্যায়ভুক্ত না, তাই এই নাম উচ্চারণে ভয় পাচ্ছি না।
৩.
নিকট অতীতের দু-একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে ওমুক-তমুক ব্যাপারে কোনো লেখালেখি চোখে পড়েনি। দু-চারজন বিরক্ত হয়ে দু-চারটি লেখা অর্থাৎ বইয়ের হদিস দিয়েছিলেন।
দু-চারটা বই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাপা হওয়া যথেষ্ট না। যেমন বাকশাল। বঙ্গবন্ধু কেন বাকশালের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তার বিশ্লেষণ—অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ সালের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং আনুষঙ্গিক কোনো বিষয় বা কারণ ছিল কি না, যার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ওই পথে যেতে হয়েছিল। রাজনীতির মাঠে তিন দশক ধরে বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই বাকশালের জন্য আওয়ামী লীগকে তুলাধোনা করেছে আর আওয়ামীপন্থীরা ‘বোবার শত্রু নাই’ পথ বেছে নিয়েছে। তাতে কারণ বিশ্লেষণ হয়নি, লেখালেখিও চোখে পড়েনি।
একটা কারণ কি হতে পারে যে ১৯৭৪-এর মাঝামাঝি বা শেষদিকে এসে খোদ বঙ্গবন্ধুই তাঁর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। দলের সবাই হালুয়া-রুটির ধান্দায় ব্যস্ত। তাই হয়তো বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছিল—কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই তাই দিন-তারিখ এর উদ্ধৃতি দিতে পারব না। অকাতরে স্বীকার করছি আমার স্মৃতিভ্রমও হতে পারে। যা হোক, যত দূর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, তাঁর দলের যেদিকেই তাকান, ডানে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে সবদিকেই চোর। কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধু তো নিজের দল বিলোপ করতে পারতেন না। বিলোপ না করে, ঢেলে সাজানোর জন্যই বাকশাল। নতুন আদলে আদর্শিক দল তৈরির সুযোগ তিনি পাননি।
এখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ এবং অগায়রা-অগায়রা ‘লীগ’-এর খবর মানেই টেন্ডার-চাঁদাবাজি-খুনোখুনির খবর। দল আর দল থাকছে না। যেটা বিএনপির শেষ আমলেও হয়েছিল। বিএনপি মানে হাওয়া ভবন। হাওয়া ভবন হয়ে গিয়েছিল দল।
দল যখন হয়ে যায় হালুয়া-রুটির বাহক, তখন নেতৃত্ব হয়ে পড়ে আমলা/উপদেষ্টা এবং বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থানির্ভর।
নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারার প্রবণতাটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। গতিশীল হয়। দলের জনপ্রিয়তা আরও কমে। আমলা-গোয়েন্দার ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ে। সংবাদমাধ্যম বন্ধ করা সেই প্রক্রিয়ার একটা অবশ্যম্ভাবী বহিঃপ্রকাশ।
সকাল থেকেই শাহ্ আবদুল করিমের গানের একটা সিডি বারবার শুনছি। রাজনীতিতে একটা সিডিই বারবার চলছে।
বিন্দু বিন্দু পানিকণা থেকে যেভাবে মহাসাগর হয়, হয়তো ঠিক তেমনি বিরাট বিশাল বাঁধে প্রথমে হয় ছোট্ট একটা চিড়। চুইয়ে চুইয়ে দু-চার ফোঁটা পানি বের হতে শুরু করে। এক ফোঁটা-দুই ফোঁটা পানি থেকে একটু ফাটল, একটু বেশি ফাটল আর তার থেকে হঠাৎ করে বড় ফাটল হয়ে বাঁধটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে অনেক ক্ষেত্রেই সময় লাগে খুব অল্প।
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে বাঁধের পানির তোড় বন্ধ করা যায় না।
শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
ভাশুর বা স্বামীর নাম মুখে নিতে হয় না, বলতে হয় না। বউ যদি তাঁর ভাশুর বা স্বামীর নাম বলেন, সেটা অলক্ষুণে, এতে ভগবান-বিধাতা রুষ্ট হন, অনিষ্ট হবে। তাই সবাই লিখেছে, ‘বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা’। ডাকসাইটে পত্রিকাগুলোই যখন ভয় পাচ্ছে, পাছে কেউ রুষ্ট হয়, অনিষ্ট হয়—সেখানে এই অধম কোন ছার। অতএব ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত।
আরও একটা ‘সাইড-টক’। সাতসকালে শাহ্ আবদুল করিমের খুব চেনা গান শুনছিলাম। আমার ধারণা, বহু পাঠক-পাঠিকা গানটি শুনেছেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা আর খাটু গান গাইতাম...।’ ধারণা করছি, শাহ্ আবদুল করিম গানের কথাগুলো লিখেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্মৃতিচারণা থেকে। ‘বাউলা গান খাটু গান, আনন্দের কি তুফান’। সেই দিনগুলো শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়, সব ব্যাপারেই হারিয়ে যাচ্ছে। অতি দ্রুত, অতি আশঙ্কাজনকভাবে।
ব্যাপারগুলোতে ফিরে আসি। এক বন্ধু গল্প করছিল, এক গণ্যমান্য ব্যক্তি তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। আহামরি কোনো বড় অঙ্ক না। যা হয়, আজ দেব, কাল দেব বলে অনেক দিন কেটে গেছে। শেষতক ফয়সালা হয় যে, আগামী রোববার টাকা ফেরত দেবেন। রোববার এল, প্রায় চলেও যাচ্ছিল, ঋণগ্রহীতার কোনো খবর নেই। শেষে রাত ১০টার দিকে ফোন। অন্য প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল—‘আমি অমুক স্থান থেকে বলছি, আমার নাম অমুক।’ বন্ধুর প্রশ্ন—‘নাম শুনলাম, কিন্তু আপনি সেখানে কোন পদে আছেন, আর কেনই বা ফোন করেছেন।’ উত্তর—‘আমি কোন পদে আছি, সেটা বড় কথা নয়। অমুক ভদ্রলোক আপনাকে যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, সেটা উনি আজকে পারবেন না। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সম্ভবত দিয়ে যাবেন।’
আমার বন্ধুর মেজাজটা সম্ভবত তিরিক্ষি গোছের হয়ে গিয়েছিল। তার কথা মতে, ঠেসে ঝাড়ি মারলাম। অর্থাৎ ফোনকারীকে বেশ গালমন্দ শুনিয়ে দিয়েছিল। আপনি কে, আপনার পদ কী, রাত ১০টায় এক মোবাইল ফোন থেকে ফোন করে অমুক অফিসের কথা বলে হুমকি গোছের কথা বলছেন ইত্যাদি।
পরদিন সকালে ঋণগ্রহীতার সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হলো। আগের দিনের ওমুক অফিসের নামে করা ফোনের ব্যক্তিটির নাম উল্লিখিত হলো। ঋণগ্রহীতা কথাচ্ছলে জানালেন, ওই ব্যক্তিটি তাঁর খুবই পরিচিত আর তাঁর পরিচয় হলো—ওমুকের (আমিও ভাশুর-স্বামীর নাম উচ্চারণ করছি না) ওই গোছের পরম আত্মীয়। বলা বাহুল্য, আমার ধারণা বেচারা বন্ধুটি খুব শুষ্ক ঢোক গিলেছিল, যেটা সে আমাকে বলেনি। ঋণগ্রহীতাকে যা বলেছিল, সেটা আমাকে বলেছিল, ‘আরে ভাই, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আপনার সুবিধামতো টাকাটা ফেরত দিয়ে দিয়েন। যখন আপনার সুবিধা।’
দ্বিতীয় ব্যাপার—আরেকজন বন্ধু। এই বন্ধুটি বহু বছর ধরে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করছে। প্রবন্ধ-বই এন্তার। দেশে-বিদেশে ওই ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হলে প্রায়ই তার ডাক পড়ে। বহু দেশে বহুবার গেছে প্রবন্ধ পড়তে, বিদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষককে তালিম দিতে। তদুপরি পাঁচ-ছয় বছর ধরে বিভিন্ন সরকার—সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার, সচিব অনেকবার তার সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন। সেমিনার-ওয়ার্কশপে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা তার কথা শুনতে এসেছেন। সেই বন্ধুটি মাঝখানে পাঁচ-ছয় দিনের জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন পেরিয়ে প্লেনে ওঠার বোর্ডিং গেটে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখল মাঝেমধ্যে দু-চারজন করে বিমানবন্দরের সিকিউরিটি-কাস্টমস ইত্যাদি কর্মকর্তাদের পরম আদরযত্ন সোহাগে লাইনে না দাঁড়িয়ে লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে পাশ কাটিয়ে সোজা প্লেনে উঠে যাচ্ছে। মেজাজ তিরিক্ষি হতে হতে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে জোর গলায় একবার প্রতিবাদই করে ফেলল, ‘এরা কারা, লাইন ছাড়া প্লেনে উঠছে।’ উত্তর এল—ভিভিআইপি। বন্ধুর বর্ণনামতে সবই তো মনে হলো ২০-৩০ বছরের যুবক-যুবতী। এরা ভিভিআইপি কীভাবে হলো?
দিন পাঁচেক পর বন্ধুটি দেশের মাটিতে ফেরত-পদার্পণ। বরাবরের মতো ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দু-চার মিনিটে পাসপোর্ট পরীক্ষা করে সিল-ছাপ্পর মেরে ছেড়ে দেওয়ার কথা। এবার সেটি হলো না। ‘আপনি পাশে দাঁড়ান।’ তারপর হুকুম—‘ওই রুমে যান।’ এই অফিসার, এই অফিসার, সবাই অনেকক্ষণ ধরে বারবার পাসপোর্ট পরীক্ষা। কেন গিয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন, এত ঘন ঘন কেন বিদেশে যাওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক ধরে গলদঘর্ম হয়ে ছাড়া পেল। সুটকেস নিয়ে কাস্টমসের ঘাট পেরুতে গেলে তাকে আটকানো হলো। ‘সুটকেট খোলেন। সবকিছু বের করুন।’ সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা। বন্ধুর মন্তব্য, যেন একটা স্মাগলারকে হাতেনাতে ধরেছে। যা হোক শেষতক ছাড়া পেল। যখন সে সুটকেস বন্ধ করছিল, তখন কাস্টমস কর্মকর্তার মন্তব্য—‘খুব বিপ্লবী হয়ে গেছেন! জানেন, যাওয়ার সময় বোর্ডিং লাইনে কার সম্পর্কে আপনি প্রশ্ন তুলেছিলেন—উনারা ওমুকের (আবার আমার সেই ভাশুর/স্বামীর অজুহাত) আত্মীয়।’
আগে থেকেই স্থির করা ছিল, তাই বন্ধুটিকে আবার দিন পনেরো পর এয়ারপোর্টে যেতে হয়েছিল, বিদেশ যাওয়ার জন্য। ইমিগ্রেশন পেরুতে তাকে এ-ঘাট ও-ঘাট, এ-রুম, ও-রুম, এ-কর্মকর্তা ইত্যাদিতে ঘণ্টাখানেক। কেন যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন।
বৃত্তান্ত বলার পর আমার কাছে আইনি প্রশ্ন। ফিরে আসা বা যাওয়ার পথে আমার সুটকেসে মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাকে ভীষণভাবে আশ্বস্ত করলাম—অবশ্যই পারে। হাতেনাতে মাদকদ্রব্যসহ ধরা পড়লে আইনজীবী হিসেবে সাততাড়াতাড়ি বিশেষ কিছু করতে পারব না। বছর দুয়েক কারাবাসের পর হয়তো জামিন হবে। হাজার হলেও তুমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক। জামিন আগেও পেতে পার। অতএব আইনি উপদেশ দুটি—আপাতত মাস ছয়েক বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, সরকারি দলে ভিড়ে যাও।
২.
সত্য-মিথ্যা জানি না—লোকমুখে শুনেছি আমরা আর মাহমুদুর রহমান একই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। সে সুবাদে আমরা সমসাময়িক। ইদানীং দু-চারবার দেখা-সাক্ষাৎ, মোলাকাত হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে।
ভদ্রলোকের কাজকর্ম, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বা কোনো ঘটনাতে তাঁর বিশ্লেষণ আমার অপছন্দ। প্রায় ব্যাপারেই দ্বিমত আছে। একইভাবে আমি নিশ্চিত যে, আমার কথাবার্তায়ও তাঁর বিশেষ আপত্তি থাকবে, তাঁরও দ্বিমত থাকবে।
ভদ্রলোক আমি যত দূর বুঝি রাজনীতি করার জন্য সাংবাদিকতা করেন। বেশির ভাগ সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতার আড়ালে হয়তো রাজনীতি থাকে। কিন্তু সাংবাদিকতা তাঁদের পেশা। রাজনীতি নেশা হতে পারে। মাহমুদুর রহমান সাহেবের জন্য ব্যাপারটা বোধহয় উল্টো।
হোক, তাতে আমার-আপনার বাধা দেওয়ার কী আছে! আর পাঠকমাত্রই বাধার তরিকাটা দেখেছেন।
সরকার বোধহয় আমার ভীত অবস্থার চেয়ে বেশি ভীত। না হলে মাঝরাত নাগাদ ডজন ডজন পুলিশ কি পাঠাত? পত্রপত্রিকায় দেখলাম, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ। প্রতারণার মামলা প্রতিনিয়ত থানা/আদালতে ডজন ডজন হচ্ছে।
বন্ধুটিকে দেওয়া ‘আইনি’ উপদেশের মতো মাহমুদুর রহমানকে তো আর উপদেশ দিতে পারি না যে—ভাই, আপনি আওয়ামী লীগ না হলে অন্তত জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি তো থাকতে পারবেন।
কোন পত্রিকায় যেন দেখলাম আপনার বিরুদ্ধে নাকি ৩১টা মামলা আছে। ক্ষমতাসীন দলের এক মহারথীর বোধহয় শখানেক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। দলে যোগ দিন, আপনারও কপাল খুলে যাবে। আর বিরোধী/বিরোধী থাকলে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারবেন অচিরেই। সরকারের বদৌলতে। মাহমুদুর রহমান নামটা তো এখন ভাশুর/স্বামী পর্যায়ভুক্ত না, তাই এই নাম উচ্চারণে ভয় পাচ্ছি না।
৩.
নিকট অতীতের দু-একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে ওমুক-তমুক ব্যাপারে কোনো লেখালেখি চোখে পড়েনি। দু-চারজন বিরক্ত হয়ে দু-চারটি লেখা অর্থাৎ বইয়ের হদিস দিয়েছিলেন।
দু-চারটা বই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাপা হওয়া যথেষ্ট না। যেমন বাকশাল। বঙ্গবন্ধু কেন বাকশালের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তার বিশ্লেষণ—অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ সালের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং আনুষঙ্গিক কোনো বিষয় বা কারণ ছিল কি না, যার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ওই পথে যেতে হয়েছিল। রাজনীতির মাঠে তিন দশক ধরে বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই বাকশালের জন্য আওয়ামী লীগকে তুলাধোনা করেছে আর আওয়ামীপন্থীরা ‘বোবার শত্রু নাই’ পথ বেছে নিয়েছে। তাতে কারণ বিশ্লেষণ হয়নি, লেখালেখিও চোখে পড়েনি।
একটা কারণ কি হতে পারে যে ১৯৭৪-এর মাঝামাঝি বা শেষদিকে এসে খোদ বঙ্গবন্ধুই তাঁর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। দলের সবাই হালুয়া-রুটির ধান্দায় ব্যস্ত। তাই হয়তো বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছিল—কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই তাই দিন-তারিখ এর উদ্ধৃতি দিতে পারব না। অকাতরে স্বীকার করছি আমার স্মৃতিভ্রমও হতে পারে। যা হোক, যত দূর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, তাঁর দলের যেদিকেই তাকান, ডানে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে সবদিকেই চোর। কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধু তো নিজের দল বিলোপ করতে পারতেন না। বিলোপ না করে, ঢেলে সাজানোর জন্যই বাকশাল। নতুন আদলে আদর্শিক দল তৈরির সুযোগ তিনি পাননি।
এখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ এবং অগায়রা-অগায়রা ‘লীগ’-এর খবর মানেই টেন্ডার-চাঁদাবাজি-খুনোখুনির খবর। দল আর দল থাকছে না। যেটা বিএনপির শেষ আমলেও হয়েছিল। বিএনপি মানে হাওয়া ভবন। হাওয়া ভবন হয়ে গিয়েছিল দল।
দল যখন হয়ে যায় হালুয়া-রুটির বাহক, তখন নেতৃত্ব হয়ে পড়ে আমলা/উপদেষ্টা এবং বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থানির্ভর।
নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারার প্রবণতাটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। গতিশীল হয়। দলের জনপ্রিয়তা আরও কমে। আমলা-গোয়েন্দার ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ে। সংবাদমাধ্যম বন্ধ করা সেই প্রক্রিয়ার একটা অবশ্যম্ভাবী বহিঃপ্রকাশ।
সকাল থেকেই শাহ্ আবদুল করিমের গানের একটা সিডি বারবার শুনছি। রাজনীতিতে একটা সিডিই বারবার চলছে।
বিন্দু বিন্দু পানিকণা থেকে যেভাবে মহাসাগর হয়, হয়তো ঠিক তেমনি বিরাট বিশাল বাঁধে প্রথমে হয় ছোট্ট একটা চিড়। চুইয়ে চুইয়ে দু-চার ফোঁটা পানি বের হতে শুরু করে। এক ফোঁটা-দুই ফোঁটা পানি থেকে একটু ফাটল, একটু বেশি ফাটল আর তার থেকে হঠাৎ করে বড় ফাটল হয়ে বাঁধটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে অনেক ক্ষেত্রেই সময় লাগে খুব অল্প।
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে বাঁধের পানির তোড় বন্ধ করা যায় না।
শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
No comments