বাঁচার মতো বেতনের নিশ্চয়তার দায়িত্ব সরকারের-পোশাকশিল্পে মজুরি-পরিহাস

যে পোশাকশিল্প দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল শিল্প খাত, সেই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরিই সবার থেকে কম—এমনকি দিনমজুরদের থেকেও কম! শুধু তা-ই নয়, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক অন্য দেশগুলো থেকেও আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয়।


যেখানে বিদেশি ক্রেতারাও ন্যায্য মজুরি দেওয়ার পক্ষে এবং পোশাকশিল্প একটি লাভজনক খাত, সেখানে এর থেকে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কী হতে পারে? বিপুল লাভের বিপরীতে বিপুল শোষণের এই বাস্তবতা অমানবিক, অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
পাটচাষি আর পাটকলের শ্রমিকেরা একসময় যেমন অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিলেন, আজ সেই ভূমিকা নিয়েছে পোশাকশিল্প। লাভজনক এ খাতে সরকারি সহযোগিতা ও ভর্তুকিরও কোনো তুলনা হয় না। সেই রকম একটি শিল্পের শ্রমিককে কীভাবে মাত্র এক হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সায় জীবনধারণে বাধ্য করা হয়, তা বোধগম্য নয়! ২০০৬ সালে সরকার-নির্ধারিত ওই মজুরি থেকে বর্তমানে মালিকেরা মাত্র ৩২৭ টাকা বেশি, অর্থাত্ এক হাজার ৯৮৯ টাকার বেশি দিতে নারাজ। এ হিসাবে দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ৬৬ টাকা মাত্র। মাত্র দুই কেজি চালের মূল্যে একজন শ্রমিক কীভাবে একটি পরিবারের ভরণপোষণের ভার বহন করবেন পৃথিবীর কোনো অঙ্ক কষেই তা বোঝা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে গৃহপরিচারিকারাও এর থেকে বেশি বেতন পান। অথচ ২০০৬ সালের পর চালের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনধারণের প্রতিটি উপাদানেরও দাম বাড়তির দিকে। ১৯৯৮ সালের নিম্নতম মজুরি ৯৩০ টাকা হিসাবে বর্তমান বাজারমূল্যে তা হওয়ার কথা দুই হাজার ৫৫১ টাকা। এটুকু বেতনও মালিকপক্ষ দিতে চাইছে না।
এই দুর্মূল্যের বাজারে মজুরি না বাড়ানো মানে প্রকৃত মজুরি আরও কমে যাওয়া। অর্থাত্ শ্রমিকদের দাসের থেকে বেশি মর্যাদা মালিকদের থেকে পাচ্ছেন না। এই সীমাহীন বঞ্চনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে নিয়মিত শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যে। কিন্তু মালিকদের আচরণে মনে হচ্ছে, সবই পাথরে অশ্রুবর্ষণ।
পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি, গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, একজন শ্রমিকের জীবনধারণের জন্য মাসিক এক হাজার ৯৮৯ টাকার বেশি দরকার নেই। একজন শ্রমিকের আয়ে যেখানে চার-পাঁচ সদস্যের পরিবার নির্ভরশীল, সেখানে বাকিদের পরিণতি কি না খেয়ে থাকা?
পোশাকশ্রমিকদের দাবি, ন্যূনতম মজুরি ৯০ ডলার বা ছয় হাজার ২০০ টাকা করতে হবে। সরকারের উচিত মালিকপক্ষকে যৌক্তিক মাত্রা পর্যন্ত নিম্নতম বেতন বাড়াতে বাধ্য করা। দীর্ঘদিন এ ধরনের পরিস্থিতি বজায় রাখা তৈরি পোশাকশিল্পের জন্যই বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। সরকারও প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিকের এত বড় খাত নিয়ে দিনের পর দিন উদাসীন থাকতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.