চিরকুট-এ শহর প্রান্ত by শাহাদুজ্জামান
এস্কিমোরা শুধু বরফের ঘর ইগলুই বানায় না, কবিতাও লেখে। একটি এস্কিমো কবিতা পড়েছিলাম এ রকম, ‘ধু ধু তুষার প্রান্তরে আমার স্লেজ গেল ভেঙে/মন তুমি হাস কেন?’ একজন এস্কিমোর জন্য দিগন্তব্যাপী তুষারপথে স্লেজ ভেঙে যাওয়ার চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে?
আর গভীরতর দুঃখ আর অসহায়ত্বে মন হেসে উঠতেই পারে। ঠিক যেমন গভীর আনন্দে কান্না পায় মানুষের।
সন্ধ্যারাতে টিপ টিপ বৃষ্টির ভেতর শাহবাগের মোড়ে দাঁড়াই উত্তরায় যাওয়ার একটি যানবাহনের আশায়। ছায়া ছায়া রাস্তা, ফুটপাতে আরও অগণিত ভেজা ভেজা ক্লান্ত নাগরিক। বিশ্বখ্যাত তারকার মতো হঠাৎ হঠাৎ মঞ্চে আবির্ভূত হন চৌকস ট্যাক্সি, লাস্যময়ী সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রহস্যময় মিশুক। ভক্তের দল হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। কিন্তু সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর মতো উপেক্ষায় চলে যান তাঁরা। কোন নক্ষত্রে যে তাঁদের গন্তব্য, শুধু তাঁরাই জানেন। আসেন জনগণতান্ত্রিক বাস। কিন্তু দশ গ্রামের নামজাদা খাদকের মতো ইতিমধ্যেই পেট পুরে উপচে পড়ছে তাঁর খাদ্য, মানুষ। তাঁর উদরের সামান্য ফাঁকফোকরে জায়গা করে নেওয়ার ধুন্ধুমার লড়াইয়ে পরাজিত হই। ব্যর্থ খেলোয়াড়ের মতো কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসি, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ভিজি। এ রকম ইঁদুর-বিড়াল খেলায় প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। প্রায় বছর ঘুরে প্রবাস থেকে ঢাকায় ফিরেছি তখন। সঙ্গে সেই মুহূর্তে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। হিম হিম বাতাসে জনতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকি আলো-আঁধারিতে। এ সময় দেবদূতের মতো সেখানে উপস্থিত হয় একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, চালক চিৎকার করে ডাকেন—উত্তরা, উত্তরা। মালিককে ফাঁকি দিয়ে বাড়তি উপার্জনের মোক্ষম সুযোগ নিচ্ছেন তিনি। টাইটানিকের শেষ লাইফবোটটিতে ওঠার সৌভাগ্যের মতো গাড়িটিতে একটি সিট পেয়ে যাই। কিন্তু গাড়ি কিছু দূর গিয়ে আদিম এক পাথরের মতো স্থবির হয়ে থাকে। গাড়ির জানালার কাচে সারা গায়ে জরুলভরা কিম্ভূত এক ভিক্ষুকের মুখ ভেসে ওঠে। কোনো আদিভৌতিক জগতে আছি মনে হয়। বাস, কার, ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা সবই একটা স্থির চিত্র হয়ে লেপ্টে থাকে শহরের গায়ে। এখানে কেউ খরগোশ নয়, সবাই কাছিম।
এবার এসে শুনি, এক অনুজ বন্ধুর স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবছে। সকালের প্রথম যানজটটি এড়াতে অনেক ভোরে বাড়ি থেকে রওনা দেয় সেই বন্ধু। মতিঝিল থেকে অফিস শেষে পথে গাড়ির জট ঠেলে শ্যামলী ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১০টা। ক্লান্ত বন্ধুটির কোনো রকম দাম্পত্য কর্মকাণ্ডে আর আগ্রহ, শক্তি থাকে না। এভাবে একটা সংসার চলতে পারে না। পৃথিবীর এই এক শহর, যেখানে যানজটের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যায়। এক পুরোনো সহকর্মী বলেন, এক ঘণ্টার মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পথে দুই ঘণ্টার নরকযন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এখন আর তাঁরা অন্য অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে মুখোমুখি মিটিং করেন না, টেলিকনফারেন্সের আয়োজন করেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে শুনি, পথের আতঙ্কের কথা ভেবে পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ এড়িয়ে চলেন তাঁরা। এই এক শহর, যেখানে পথের বিভীষিকা মানুষের মুখোমুখি বসার স্পৃহার মৃত্যু ঘটায়। আমার দেবদূত গাড়ি উজান ঠেলে ঠেলে মহাখালী পেরোয়, পথের দুই পাশে তখনও ঘরের পথ চাওয়া বৃষ্টিতে জুবুথুবু অসংখ্য মানুষ। পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত বহু শহরে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, কিন্তু এ রকম অভিভাবকহীন, এতটা নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত কোনো জনপদ আমার চোখে পড়েনি। জিম্বাবুয়ের হারারেতে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি, শুনেছি আমাদের দ্বিতীয় স্থানে ফেলে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরের চ্যাম্পিয়নশিপটি কব্জা করেছে তারা।
একটি শহর যদি তার নাগরিকদের প্রাণশক্তি এভাবে তিল তিল করে লুট করতে থাকে, তাহলে সেখানে বাণিজ্য, সংস্কৃতি, সম্পর্ক কেবলই অধঃপতিত হতে বাধ্য। ঢাকায় একজন উন্মাদকে একবার দেখেছিলাম আইল্যান্ডের এ পাশ থেকে ও পাশে পায়চারী করে বিড় বিড় করে বলছে, ‘এইভাবে আর চলে ক্যামনে?’ উন্মাদের মনের দুঃখ জানার উপায় নেই, কিন্তু টের পাই—প্রতিটি ঢাকাবাসী গোমড়ানো ক্ষোভ নিয়ে নিরন্তর জপ করছেন, ‘এভাবে আর চলতে পারে না।’ পথ, পানি ও আলোর বঞ্চনায় বিত্তবান, নিঃস্ব সবার জন্য এ শহর হয়ে উঠছে অবাসযোগ্য। ইতিহাসের অনেক লুপ্ত, পরিত্যক্ত শহরের মতো পরিণতি হওয়ার আগে নগরসরকার, পৃথক প্রশাসনিক রাজধানী ইত্যাকার সাহসী, যুগান্তকারী পদক্ষেপে বাঁচিয়ে তোলা যাবে কী এই লাখো মানুষের স্মৃতির শহরকে?
বনানীর জট ছাড়িয়ে এয়ারপোর্ট রোডে উঠেই আমাদের গাড়িটি হঠাৎ রাস্তার পাশে অন্ধকার একটি জায়গায় দাঁড়ায়। চালক বলেন, গাড়ি যাবে না, ইঞ্জিন সমস্যা দিচ্ছে। আমি বিপদের আশঙ্কা করি। পুরো ব্যাপারটি কোনো ছিনতাই পরিকল্পনার অংশ নয় তো? আমার সঙ্গের বাকি যাত্রীসহ বাদানুবাদ চলে চালকের সঙ্গে। চালক অবিচল, সবাইকে তিনি নেমে যেতে বলেন এবং ভাড়া ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আমরা গাড়ি থেকে নামতেই ধাঁ করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান। বোঝা যায়, তিনি সন্ত্রাসী নন, বরং ছোটখাটো প্রতারক। আমাদের পথে ফেলে সামনে আরও গুটিকয় যাত্রী নিয়ে আরও খানিকটা বাড়তি উপার্জন করতে চান তিনি। আবার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজি। এয়ারপোর্ট রোডের ওই বিরাণ জায়গায় আবার আরেকটি দেবযান পাওয়ার অলীক আশায় দাঁড়িয়ে থাকি। অসহায় বোধ করি। আমার সামনে আলো-আন্ধকারে ভেজা ভেজা ব্যস্ত এক শহরের প্রান্ত। শহরটির দিকে তাকিয়ে গভীর বেদনা বোধ করি এবং তখন আমার খুব হাসি পায়। এস্কিমো কবিকে মনে পড়ে, ‘ধু ধু তুষার প্রান্তরে আমার স্লেজ গেল ভেঙে/মন তুমি হাস কেন?’
শাহাদুজ্জামান : কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
সন্ধ্যারাতে টিপ টিপ বৃষ্টির ভেতর শাহবাগের মোড়ে দাঁড়াই উত্তরায় যাওয়ার একটি যানবাহনের আশায়। ছায়া ছায়া রাস্তা, ফুটপাতে আরও অগণিত ভেজা ভেজা ক্লান্ত নাগরিক। বিশ্বখ্যাত তারকার মতো হঠাৎ হঠাৎ মঞ্চে আবির্ভূত হন চৌকস ট্যাক্সি, লাস্যময়ী সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রহস্যময় মিশুক। ভক্তের দল হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। কিন্তু সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর মতো উপেক্ষায় চলে যান তাঁরা। কোন নক্ষত্রে যে তাঁদের গন্তব্য, শুধু তাঁরাই জানেন। আসেন জনগণতান্ত্রিক বাস। কিন্তু দশ গ্রামের নামজাদা খাদকের মতো ইতিমধ্যেই পেট পুরে উপচে পড়ছে তাঁর খাদ্য, মানুষ। তাঁর উদরের সামান্য ফাঁকফোকরে জায়গা করে নেওয়ার ধুন্ধুমার লড়াইয়ে পরাজিত হই। ব্যর্থ খেলোয়াড়ের মতো কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসি, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ভিজি। এ রকম ইঁদুর-বিড়াল খেলায় প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। প্রায় বছর ঘুরে প্রবাস থেকে ঢাকায় ফিরেছি তখন। সঙ্গে সেই মুহূর্তে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। হিম হিম বাতাসে জনতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকি আলো-আঁধারিতে। এ সময় দেবদূতের মতো সেখানে উপস্থিত হয় একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, চালক চিৎকার করে ডাকেন—উত্তরা, উত্তরা। মালিককে ফাঁকি দিয়ে বাড়তি উপার্জনের মোক্ষম সুযোগ নিচ্ছেন তিনি। টাইটানিকের শেষ লাইফবোটটিতে ওঠার সৌভাগ্যের মতো গাড়িটিতে একটি সিট পেয়ে যাই। কিন্তু গাড়ি কিছু দূর গিয়ে আদিম এক পাথরের মতো স্থবির হয়ে থাকে। গাড়ির জানালার কাচে সারা গায়ে জরুলভরা কিম্ভূত এক ভিক্ষুকের মুখ ভেসে ওঠে। কোনো আদিভৌতিক জগতে আছি মনে হয়। বাস, কার, ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা সবই একটা স্থির চিত্র হয়ে লেপ্টে থাকে শহরের গায়ে। এখানে কেউ খরগোশ নয়, সবাই কাছিম।
এবার এসে শুনি, এক অনুজ বন্ধুর স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবছে। সকালের প্রথম যানজটটি এড়াতে অনেক ভোরে বাড়ি থেকে রওনা দেয় সেই বন্ধু। মতিঝিল থেকে অফিস শেষে পথে গাড়ির জট ঠেলে শ্যামলী ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১০টা। ক্লান্ত বন্ধুটির কোনো রকম দাম্পত্য কর্মকাণ্ডে আর আগ্রহ, শক্তি থাকে না। এভাবে একটা সংসার চলতে পারে না। পৃথিবীর এই এক শহর, যেখানে যানজটের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যায়। এক পুরোনো সহকর্মী বলেন, এক ঘণ্টার মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পথে দুই ঘণ্টার নরকযন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এখন আর তাঁরা অন্য অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে মুখোমুখি মিটিং করেন না, টেলিকনফারেন্সের আয়োজন করেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে শুনি, পথের আতঙ্কের কথা ভেবে পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ এড়িয়ে চলেন তাঁরা। এই এক শহর, যেখানে পথের বিভীষিকা মানুষের মুখোমুখি বসার স্পৃহার মৃত্যু ঘটায়। আমার দেবদূত গাড়ি উজান ঠেলে ঠেলে মহাখালী পেরোয়, পথের দুই পাশে তখনও ঘরের পথ চাওয়া বৃষ্টিতে জুবুথুবু অসংখ্য মানুষ। পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত বহু শহরে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, কিন্তু এ রকম অভিভাবকহীন, এতটা নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত কোনো জনপদ আমার চোখে পড়েনি। জিম্বাবুয়ের হারারেতে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি, শুনেছি আমাদের দ্বিতীয় স্থানে ফেলে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরের চ্যাম্পিয়নশিপটি কব্জা করেছে তারা।
একটি শহর যদি তার নাগরিকদের প্রাণশক্তি এভাবে তিল তিল করে লুট করতে থাকে, তাহলে সেখানে বাণিজ্য, সংস্কৃতি, সম্পর্ক কেবলই অধঃপতিত হতে বাধ্য। ঢাকায় একজন উন্মাদকে একবার দেখেছিলাম আইল্যান্ডের এ পাশ থেকে ও পাশে পায়চারী করে বিড় বিড় করে বলছে, ‘এইভাবে আর চলে ক্যামনে?’ উন্মাদের মনের দুঃখ জানার উপায় নেই, কিন্তু টের পাই—প্রতিটি ঢাকাবাসী গোমড়ানো ক্ষোভ নিয়ে নিরন্তর জপ করছেন, ‘এভাবে আর চলতে পারে না।’ পথ, পানি ও আলোর বঞ্চনায় বিত্তবান, নিঃস্ব সবার জন্য এ শহর হয়ে উঠছে অবাসযোগ্য। ইতিহাসের অনেক লুপ্ত, পরিত্যক্ত শহরের মতো পরিণতি হওয়ার আগে নগরসরকার, পৃথক প্রশাসনিক রাজধানী ইত্যাকার সাহসী, যুগান্তকারী পদক্ষেপে বাঁচিয়ে তোলা যাবে কী এই লাখো মানুষের স্মৃতির শহরকে?
বনানীর জট ছাড়িয়ে এয়ারপোর্ট রোডে উঠেই আমাদের গাড়িটি হঠাৎ রাস্তার পাশে অন্ধকার একটি জায়গায় দাঁড়ায়। চালক বলেন, গাড়ি যাবে না, ইঞ্জিন সমস্যা দিচ্ছে। আমি বিপদের আশঙ্কা করি। পুরো ব্যাপারটি কোনো ছিনতাই পরিকল্পনার অংশ নয় তো? আমার সঙ্গের বাকি যাত্রীসহ বাদানুবাদ চলে চালকের সঙ্গে। চালক অবিচল, সবাইকে তিনি নেমে যেতে বলেন এবং ভাড়া ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আমরা গাড়ি থেকে নামতেই ধাঁ করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান। বোঝা যায়, তিনি সন্ত্রাসী নন, বরং ছোটখাটো প্রতারক। আমাদের পথে ফেলে সামনে আরও গুটিকয় যাত্রী নিয়ে আরও খানিকটা বাড়তি উপার্জন করতে চান তিনি। আবার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজি। এয়ারপোর্ট রোডের ওই বিরাণ জায়গায় আবার আরেকটি দেবযান পাওয়ার অলীক আশায় দাঁড়িয়ে থাকি। অসহায় বোধ করি। আমার সামনে আলো-আন্ধকারে ভেজা ভেজা ব্যস্ত এক শহরের প্রান্ত। শহরটির দিকে তাকিয়ে গভীর বেদনা বোধ করি এবং তখন আমার খুব হাসি পায়। এস্কিমো কবিকে মনে পড়ে, ‘ধু ধু তুষার প্রান্তরে আমার স্লেজ গেল ভেঙে/মন তুমি হাস কেন?’
শাহাদুজ্জামান : কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments