গুরু-শিষ্যের আড্ডায় by কবির বকুল
সকাল ১০টা। সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যশালা। সাধারণত বিকেলে এই এলাকাটা থাকে উৎসবমুখর। সকাল বলেই এখন বেশ ফাঁকা। ১৭ বছর আগে এই শিল্পকলা একাডেমীতেই মামুনুর রশীদের সঙ্গে পরিচয় চঞ্চল চৌধুরীর। এখন তাঁরা গুরু-শিষ্য। সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করতেই পাবনার নাজিরহাটের কামারগঞ্জের ছেলে চঞ্চল ফিরে যান পেছনে।
‘১৯৯৩ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছি মাত্র। একদিনের কথা। শিল্পকলা একাডেমীতে শিল্পী শাহাবুদ্দীন আহমদের একক চিত্র প্রদর্শনী হবে। গিয়েছি সেই উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে। আমি একটি চেয়ারে বসে আছি। হঠাৎ ঘাড় ঘোরাতেই দেখি, পাশের চেয়ারটায় সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক এসে বসলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম, ইনি নাট্যজন মামুনুর রশীদ। আমার চোখেমুখে বিস্ময়! সেদিন গুরুর সঙ্গে চোখাচোখি পর্যন্তই। কোনো কথা হয়নি।’ চঞ্চল থামেন।
আমরা মামুনুর রশীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। মুঠোফোনে জানা যায়, তিনি তখন পথে। চঞ্চল আবার শুরু করেন।
‘১৯৯৫ সালে আমি অভিনয়ের পরীক্ষা দিয়ে আরণ্যক নাট্যদলে ঢুকি। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নটা ইতিমধ্যেই আমার ভেতরে ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে।’ চঞ্চল বলতে শুরু করেন।
‘মঞ্চনাটক সম্পর্কে তখন আমার কোনো ধারণাই নেই। বন্ধুবান্ধব সবাই বলত, বেইলি রোডে মঞ্চনাটক দেখতে যাব। ওদের মুখে শুনতাম হুমায়ুন ফরীদি, বিপাশা হায়াত, আলী যাকের—বিভিন্নজনের নাম। শুনে বলতাম, এঁরা তো টেলিভিশনে নাটক করেন। এঁরা আবার কেমন করে মঞ্চে নাটক করেন। গ্রামেগঞ্জে যখন থাকতাম, তখন জানতাম, মঞ্চে যাত্রা হয়। সেই যাত্রা আমি অনেক দেখেছি।
‘আমার ভাই ডাক্তার অচিন্ত্য চৌধুরী একদিন আমাকে একটি টিকিট দিয়ে বললেন, “যা, বেইলি রোডে গিয়ে নাটক দেখে আয়।” সেই প্রথম আমার দেখা। মঞ্চনাটক কঞ্জুস। এর পর থেকে সময় পেলেই মহিলা সমিতিতে গিয়ে নাটক দেখতাম। ধীরে ধীরে মঞ্চনাটকের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হলো। যেহেতু ঢাকায় প্রথম মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, তাই চিন্তা করলাম, মামুন ভাইয়ের সঙ্গে অভিনয় করব। তখন মামুন ভাইয়ের কোন দল, সেটা জানতাম না। পরে জানলাম, আরণ্যক এবং তিনিই দলের অধিকর্তা। ওই সময় আরণ্যকে আজিজুল হাকিম, তমালিকা কর্মকার, মোমেনা চৌধুরী, তুষার খান—তাঁরা কাজ করেন। চারুকলার বন্ধু রাহুল আনামের সহযোগিতায় আরণ্যকে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং আরণ্যকে নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলাম।’
ততক্ষণে গুরু মামুনুর রশীদ চলে এসেছেন। তাঁর কাছে শিষ্য চঞ্চল চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাই।
‘ও দীর্ঘদিন ধরে আরণ্যক নাট্যদলে। তবে চঞ্চলের দিকে আমার চোখ পড়েছে বেশ পরেই। ও চারুকলার ছাত্র। এটা একটা অতিরিক্ত গুণ। আবার গানও করে। জয় জয়ন্তি নাটকে প্রথম ও একটি ছোট চরিত্রে (লাল চান) কাজ করে। তবে মঞ্চে ওর প্রথম বড় কাজ সঙক্রান্তিতে—কর্নেট বাদক চরিত্রে। ও কর্নেট বাজাতে পারত না। চরিত্রটি পাওয়ার পর অল্প সময়ে কর্নেট বাজানোটা শিখে ফেলল ও। বেশ কঠিন একটি কাজ। বিষয়টি আমাকে খুব মুগ্ধ করল।’
চঞ্চল কথা টেনে নেন।
‘আমি যখন আরণ্যকে ঢুকি, তখন জয় জয়ন্তি নাটকের কাজ চলছিল। শুরু থেকেই কাজ থাকুক আর না থাকুক, মহড়ার সময় গিয়ে বসে থাকতাম। তখন দলের নবীন সদস্যদের কাজ ছিল ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করা। এটাই বাধ্যবাধকতা, এটাই ঐতিহ্য। মহড়ার বিরতিতে চা-ও বানিয়ে দিতাম। তখন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে কাজগুলো করতাম। হঠাৎ একদিন মামুন ভাই বললেন, গান গাইতে পারে কে? বাবু (ফজলুর রহমান বাবু) ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছুটা ভালো সম্পর্ক ছিল। দুজনের বাসা ছিল খুব কাছাকাছি। তিনি জানেন, আমি টুকটাক গান করি। তখন বাবু ভাই মামুন ভাইকে বললেন, এই ছেলেটা গান জানে। মামুন ভাই তখন আমাকে লাল চানের চরিত্রটা দিলেন। সেই থেকে শুরু হলো মঞ্চে অভিনয়। এরপর করলাম ময়ূর সিংহাসন। সেটিও উল্লেখ করার মতো কাজ নয়। সঙক্রান্তি আমার প্রথম বড় কাজ। নাটকে তিনটি মূল চরিত্রের একটি আমি। এ নাটকেই সরাসরি মামুন ভাইয়ের সঙ্গে অভিনয়। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু।’
মামুনুর রশীদ কি শুধুই আপনার গুরু?
চঞ্চল উত্তর দিতে দেরি করেন না, ‘তাঁর সঙ্গে আমার সব ধরনের সম্পর্ক। কখনো তিনি পিতার মতো, কখনো তিনি শিক্ষক, কখনো বন্ধু। বলতে পারেন ঢাকা শহরে তিনিই আমার বড় অভিভাবক। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রথম পরামর্শটা আমি গুরুর কাছ থেকেই নেওয়ার চেষ্টা করি।’
মামুন ভাই, আপনার কাছে অভিনয়ের দীক্ষা নিয়েছেন সালাহউদ্দিন লাভলু, আজিজুল হাকিম, ফজলুর রহমান বাবু, তুষার খান—অনেকেই। তাঁদের প্রতি আপনার দৃষ্টিকোণটা কেমন?
‘আমার বয়স এখন ৬৩। আর চঞ্চলের মনে হয় আমার অর্ধেক হবে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনো বিষয় নয়। বন্ধুত্বপূর্ণ হলেই ভালো। আমি সব সময় ওদের বন্ধু ভাবি। বন্ধু না হলে কাজ আদায় করা যায় না। তা ছাড়া আমরা থিয়েটার করছি। এটা একটি স্বেচ্ছাশ্রমের মতো। সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে না উঠলে কাজটা ভালো হবে না। যে ছেলেটির সঙ্গে আমি কাজ করছি, তাঁর কাছ থেকেও আমার অনেক কিছু শেখার আছে। আমি সব সময় কো-অর্ডিনেটর (সমন্বয়কারী) হিসেবে ওঁদের সঙ্গে কাজ করে গেছি।’ বলছিলেন মামুনুর রশীদ।
আজকাল অনেকে অল্পতেই জনপ্রিয় হতে চান। একটা-দুটো কাজ করার পরই অনেকের গায়ে ‘তারকা’ তকমাটা লেগে যায়। কিন্তু অভিনয়ের যে শিক্ষাটা, সেটা তাঁদের অনেকেরই নেই।
কথা টেনে নেন মামুনুর রশীদ, ‘এটা আমাদের একটা বড় সমস্যা। একেবারেই অভিনয়ের “অ” জানা নেই; চেহারাসর্বস্ব—তারাই হঠাৎ এসে একটু কাজ করেই জনপ্রিয়। পরিচালক হয়তো চাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁদের নিয়েই শুরু হয় চ্যানেল, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান—সবার টানাটানি। আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয়, সবাইকে আবার নতুনভাবে কর্মশালা করিয়ে নিয়ে আসি।’
কথায় যোগ দেন চঞ্চল, ‘যাদের নিয়ে এমন টানাটানি, তাদের নিয়ে কিছুদিন বাড়াবাড়ি চলে। তারপর একটা সময় গিয়ে আটকে যায়। দর্শক আর তাদের নেয় না। কারণ, তারা আর নতুন কিছু দিতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, দর্শক পর্দায় তাকেই দেখতে চায়, যে সত্যিকার অভিনয়শিল্পী। আমরা দর্শকের সেই ভালো লাগাটা বুঝেই অভিনয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
দূর থেকে আপনার গুরুকে দেখে মনে হয়, তিনি অনেক রাগী। আপনি অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার কাছে কী মনে হয়? চঞ্চলের কাছে জানতে চাই।
‘যখন প্রথম আরণ্যকে যোগ দিই, তখন মামুন ভাইকে বাঘের মতো ভয় পেতাম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কাজ করতে করতে দেখলাম, তিনি অনেক মজা করে কাজটি করেন। সহশিল্পীর সঙ্গে খুব একটা দূরত্ব রাখেন না। দলের যে সবচেয়ে বড় এবং যে সবচেয়ে ছোট, সবার সঙ্গে সমানভাবে মেশার চেষ্টা করেন। তবে হয়তো দেখা যায়, একদিন মহড়ায় আসতে পারিনি। পরদিন আসার পর তিনি প্রচণ্ড রাগ দেখালেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই রাগ পানি। কখনো কখনো তিনি একদম শিশুর মতো।’
মামুন ভাইয়ের কাছে শেষ প্রশ্ন, নাট্যকর্মীদের প্রতি আপনার কোনো উপদেশ?
‘আমি সব সময় রবীন্দ্রনাথের গানের একটা চরণ মনে করি—আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
‘আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি ধূলিকণার সমানও নই। আমাদের যত খ্যাতি আসুক, মানুষের প্রশংসা আসুক, কোনো অবস্থাতেই আমরা যেন নিজেকে একটা গ্রহের সমান মনে না করি। সব সময় বালুকণার চেয়ে ছোট ভাবতে হবে। একদিন সব ধুলোয় মিশে যাবে।’ শেষ করলেন মামুনুর রশীদ।
আমরা মামুনুর রশীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। মুঠোফোনে জানা যায়, তিনি তখন পথে। চঞ্চল আবার শুরু করেন।
‘১৯৯৫ সালে আমি অভিনয়ের পরীক্ষা দিয়ে আরণ্যক নাট্যদলে ঢুকি। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নটা ইতিমধ্যেই আমার ভেতরে ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে।’ চঞ্চল বলতে শুরু করেন।
‘মঞ্চনাটক সম্পর্কে তখন আমার কোনো ধারণাই নেই। বন্ধুবান্ধব সবাই বলত, বেইলি রোডে মঞ্চনাটক দেখতে যাব। ওদের মুখে শুনতাম হুমায়ুন ফরীদি, বিপাশা হায়াত, আলী যাকের—বিভিন্নজনের নাম। শুনে বলতাম, এঁরা তো টেলিভিশনে নাটক করেন। এঁরা আবার কেমন করে মঞ্চে নাটক করেন। গ্রামেগঞ্জে যখন থাকতাম, তখন জানতাম, মঞ্চে যাত্রা হয়। সেই যাত্রা আমি অনেক দেখেছি।
‘আমার ভাই ডাক্তার অচিন্ত্য চৌধুরী একদিন আমাকে একটি টিকিট দিয়ে বললেন, “যা, বেইলি রোডে গিয়ে নাটক দেখে আয়।” সেই প্রথম আমার দেখা। মঞ্চনাটক কঞ্জুস। এর পর থেকে সময় পেলেই মহিলা সমিতিতে গিয়ে নাটক দেখতাম। ধীরে ধীরে মঞ্চনাটকের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হলো। যেহেতু ঢাকায় প্রথম মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, তাই চিন্তা করলাম, মামুন ভাইয়ের সঙ্গে অভিনয় করব। তখন মামুন ভাইয়ের কোন দল, সেটা জানতাম না। পরে জানলাম, আরণ্যক এবং তিনিই দলের অধিকর্তা। ওই সময় আরণ্যকে আজিজুল হাকিম, তমালিকা কর্মকার, মোমেনা চৌধুরী, তুষার খান—তাঁরা কাজ করেন। চারুকলার বন্ধু রাহুল আনামের সহযোগিতায় আরণ্যকে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং আরণ্যকে নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলাম।’
ততক্ষণে গুরু মামুনুর রশীদ চলে এসেছেন। তাঁর কাছে শিষ্য চঞ্চল চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাই।
‘ও দীর্ঘদিন ধরে আরণ্যক নাট্যদলে। তবে চঞ্চলের দিকে আমার চোখ পড়েছে বেশ পরেই। ও চারুকলার ছাত্র। এটা একটা অতিরিক্ত গুণ। আবার গানও করে। জয় জয়ন্তি নাটকে প্রথম ও একটি ছোট চরিত্রে (লাল চান) কাজ করে। তবে মঞ্চে ওর প্রথম বড় কাজ সঙক্রান্তিতে—কর্নেট বাদক চরিত্রে। ও কর্নেট বাজাতে পারত না। চরিত্রটি পাওয়ার পর অল্প সময়ে কর্নেট বাজানোটা শিখে ফেলল ও। বেশ কঠিন একটি কাজ। বিষয়টি আমাকে খুব মুগ্ধ করল।’
চঞ্চল কথা টেনে নেন।
‘আমি যখন আরণ্যকে ঢুকি, তখন জয় জয়ন্তি নাটকের কাজ চলছিল। শুরু থেকেই কাজ থাকুক আর না থাকুক, মহড়ার সময় গিয়ে বসে থাকতাম। তখন দলের নবীন সদস্যদের কাজ ছিল ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করা। এটাই বাধ্যবাধকতা, এটাই ঐতিহ্য। মহড়ার বিরতিতে চা-ও বানিয়ে দিতাম। তখন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে কাজগুলো করতাম। হঠাৎ একদিন মামুন ভাই বললেন, গান গাইতে পারে কে? বাবু (ফজলুর রহমান বাবু) ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছুটা ভালো সম্পর্ক ছিল। দুজনের বাসা ছিল খুব কাছাকাছি। তিনি জানেন, আমি টুকটাক গান করি। তখন বাবু ভাই মামুন ভাইকে বললেন, এই ছেলেটা গান জানে। মামুন ভাই তখন আমাকে লাল চানের চরিত্রটা দিলেন। সেই থেকে শুরু হলো মঞ্চে অভিনয়। এরপর করলাম ময়ূর সিংহাসন। সেটিও উল্লেখ করার মতো কাজ নয়। সঙক্রান্তি আমার প্রথম বড় কাজ। নাটকে তিনটি মূল চরিত্রের একটি আমি। এ নাটকেই সরাসরি মামুন ভাইয়ের সঙ্গে অভিনয়। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু।’
মামুনুর রশীদ কি শুধুই আপনার গুরু?
চঞ্চল উত্তর দিতে দেরি করেন না, ‘তাঁর সঙ্গে আমার সব ধরনের সম্পর্ক। কখনো তিনি পিতার মতো, কখনো তিনি শিক্ষক, কখনো বন্ধু। বলতে পারেন ঢাকা শহরে তিনিই আমার বড় অভিভাবক। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রথম পরামর্শটা আমি গুরুর কাছ থেকেই নেওয়ার চেষ্টা করি।’
মামুন ভাই, আপনার কাছে অভিনয়ের দীক্ষা নিয়েছেন সালাহউদ্দিন লাভলু, আজিজুল হাকিম, ফজলুর রহমান বাবু, তুষার খান—অনেকেই। তাঁদের প্রতি আপনার দৃষ্টিকোণটা কেমন?
‘আমার বয়স এখন ৬৩। আর চঞ্চলের মনে হয় আমার অর্ধেক হবে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনো বিষয় নয়। বন্ধুত্বপূর্ণ হলেই ভালো। আমি সব সময় ওদের বন্ধু ভাবি। বন্ধু না হলে কাজ আদায় করা যায় না। তা ছাড়া আমরা থিয়েটার করছি। এটা একটি স্বেচ্ছাশ্রমের মতো। সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে না উঠলে কাজটা ভালো হবে না। যে ছেলেটির সঙ্গে আমি কাজ করছি, তাঁর কাছ থেকেও আমার অনেক কিছু শেখার আছে। আমি সব সময় কো-অর্ডিনেটর (সমন্বয়কারী) হিসেবে ওঁদের সঙ্গে কাজ করে গেছি।’ বলছিলেন মামুনুর রশীদ।
আজকাল অনেকে অল্পতেই জনপ্রিয় হতে চান। একটা-দুটো কাজ করার পরই অনেকের গায়ে ‘তারকা’ তকমাটা লেগে যায়। কিন্তু অভিনয়ের যে শিক্ষাটা, সেটা তাঁদের অনেকেরই নেই।
কথা টেনে নেন মামুনুর রশীদ, ‘এটা আমাদের একটা বড় সমস্যা। একেবারেই অভিনয়ের “অ” জানা নেই; চেহারাসর্বস্ব—তারাই হঠাৎ এসে একটু কাজ করেই জনপ্রিয়। পরিচালক হয়তো চাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁদের নিয়েই শুরু হয় চ্যানেল, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান—সবার টানাটানি। আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয়, সবাইকে আবার নতুনভাবে কর্মশালা করিয়ে নিয়ে আসি।’
কথায় যোগ দেন চঞ্চল, ‘যাদের নিয়ে এমন টানাটানি, তাদের নিয়ে কিছুদিন বাড়াবাড়ি চলে। তারপর একটা সময় গিয়ে আটকে যায়। দর্শক আর তাদের নেয় না। কারণ, তারা আর নতুন কিছু দিতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, দর্শক পর্দায় তাকেই দেখতে চায়, যে সত্যিকার অভিনয়শিল্পী। আমরা দর্শকের সেই ভালো লাগাটা বুঝেই অভিনয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
দূর থেকে আপনার গুরুকে দেখে মনে হয়, তিনি অনেক রাগী। আপনি অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার কাছে কী মনে হয়? চঞ্চলের কাছে জানতে চাই।
‘যখন প্রথম আরণ্যকে যোগ দিই, তখন মামুন ভাইকে বাঘের মতো ভয় পেতাম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কাজ করতে করতে দেখলাম, তিনি অনেক মজা করে কাজটি করেন। সহশিল্পীর সঙ্গে খুব একটা দূরত্ব রাখেন না। দলের যে সবচেয়ে বড় এবং যে সবচেয়ে ছোট, সবার সঙ্গে সমানভাবে মেশার চেষ্টা করেন। তবে হয়তো দেখা যায়, একদিন মহড়ায় আসতে পারিনি। পরদিন আসার পর তিনি প্রচণ্ড রাগ দেখালেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই রাগ পানি। কখনো কখনো তিনি একদম শিশুর মতো।’
মামুন ভাইয়ের কাছে শেষ প্রশ্ন, নাট্যকর্মীদের প্রতি আপনার কোনো উপদেশ?
‘আমি সব সময় রবীন্দ্রনাথের গানের একটা চরণ মনে করি—আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
‘আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি ধূলিকণার সমানও নই। আমাদের যত খ্যাতি আসুক, মানুষের প্রশংসা আসুক, কোনো অবস্থাতেই আমরা যেন নিজেকে একটা গ্রহের সমান মনে না করি। সব সময় বালুকণার চেয়ে ছোট ভাবতে হবে। একদিন সব ধুলোয় মিশে যাবে।’ শেষ করলেন মামুনুর রশীদ।
No comments