এখনো অবহেলিত হকি-মেজর চাকলাদার (অব.)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং সমুদ্রজয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি মাত্র শেষ হলো। এই অনুষ্ঠানে আমাদের ক্রিকেট ও ফুটবল দল উপস্থিত ছিল, সঙ্গে ছিলেন আমাদের প্রথম এভারেস্টজয়ী বীর মুসা ইব্রাহীমও। উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। নিশাত মজুমদার বাংলাদেশের প্রথম মহিলা হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছেন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর শুভেচ্ছা পেয়েছেন, যা আমাদের ক্রীড়াঙ্গনকেও সমৃদ্ধ করেছে।
এই দেশকে ক্রীড়াঙ্গন কখনোই বিমুখ করেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের ফুটবল খেলোয়াড়েরা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানবিরোধী জনমত গঠন করেছিলেন। সেই দেশের জনতার কাছে হকিও একটি পরিচিত খেলা। মাত্র মাস খানেক আগে ব্যাংককে বাংলাদেশ এক এক করে চায়নিজ তাইপে, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডকে হারানোর পর সেমিফাইনাল ও ফাইনালে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ওমানকে। এএইচএফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশিয়া কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে এই বিজয়ীরা দেশে ফেরেন। আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এই হকি দলটিও আমন্ত্রণ পাবে—পায়নি। শুভেচ্ছাও নয়। একাত্তর সালের যুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের ঠকাচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল এই হকি খেলাটিই। ১৯৭০ সালে বিশ্বজয়ী পাকিস্তান দল ঢাকা স্টেডিয়ামে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের মুখোমুখি হয়েছিল এক প্রদর্শনী খেলার জন্য। আবদুস সাদেকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের হকি দলটি সেদিন প্রমাণ করেছিল—পাকিস্তান দলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের তোমরা অন্যায়ভাবে বাদ দিচ্ছ। ওরা জিতেছিল বিশ্বের সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শর্ট কর্নার স্পেশালিস্ট তানভির দারের দেওয়া একমাত্র গোলে। মাঠের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আবদুস সাদেকের হাতেই। জনগণ সোচ্চার হয়েছিল— বলেছিল এখানেও বৈষম্য।
স্বাধীনতার পরও হকির শৈলী হারিয়ে যায়নি। ১৯৮৫ সালে এশিয়া কাপে এই ঢাকা স্টেডিয়ামেই আবারও পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। উপচে পড়া দর্শক দেখেছিল বাংলাদেশ দলের হকি-ছন্দ। খেলার অন্তিম সময়ে কোনোক্রমে এক গোল করে পাকিস্তান জয়লাভ করলেও বিশ্বের বহু নামীদামি পত্রিকার সম্পাদকীয় হয়েছিল, ‘হকি জগতের উঠতি শক্তি বাংলাদেশ হকি দল।’ কর্তৃপক্ষের উপেক্ষা, অসহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ১৯৮৫ সালে ওঠা হকির উদ্দীপনার ঢেউ হারিয়ে যায়। নির্বাচিত কিছু অ-হকি খেলোয়াড় এবং গদি সন্তুষ্ট ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতায় হকি প্রায় ধ্বংসের শেষ সীমায় চলে আসে। অবশেষে আসে ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি—সাধারণ সম্পাদক হয়ে খাজা রহমতউল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পর মনে হয় হকির পালে আবার উদ্দীপনার হাওয়া লেগেছে। মাঠে হকি এসেছে। অনেক বছর পর মহিলা হকি হলো, সামনে ক্লাব কাপ, সিনিয়র ডিভিশন হকিসহ বহু প্রতিযোগিতার ঠাস বুননে হকি সরগরম হচ্ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আছে এফআইএইচ ওয়ার্ল্ড কাপ লিগ। হকি ফেডারেশন যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তা সফল করার জন্য প্রয়োজন স্পনসরের। আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে হকির মতো খেলাতে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
এই দেশে হকি প্রথম আসে ১৯০৬ সালে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কলকাতার হোয়াইট ওয়েজ ডিপার্টমেন্টাল শপে হকিস্টিক দেখে নবাববাড়ির উঠতি ছেলেদের জন্য নিয়ে আসেন। আজ ২০১২। অন্য কোনো দেশে হকি আগমনীর শতবর্ষ উদ্যাপনে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হতো, কিন্তু আমাদের হকি ফেডারেশনের আর্থিক সমস্যার কারণেই সেটি হয়নি। তবে খাজা রহমতউল্লাহ একজন উদ্যোগী পুরুষ, সঙ্গে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে আছে এ দেশের হকির শ্রেষ্ঠ সন্তান আবদুস সাদেক। তাঁরা একটা বড় মাপের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করার ভাবনা করতে পারেন।
আগেই বলেছি, হকি অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলা। আজকাল যে কৃত্রিম মাঠে হকি খেলা হয় (যার মাত্র দুটি আছে বাংলাদেশে), সেটির মূল্য ১০ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষে শুধু একটি ফেডারেশনের জন্য এত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া কষ্টকর। বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতেই হবে। সেনাবাহিনী দল এ দেশের ঐতিহ্যবাহী হকি দল এবং বর্তমান জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়ন। তারা একটি কৃত্রিম হকি মাঠ আর্মি স্টেডিয়ামে সংযোজন করলে মাঠটির মাধ্যমে সারা দেশের হকি খেলোয়াড়েরা উপকৃত হবে।
আমাদের হকি খেলোয়াড়েরা বহু ধরনের বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এখনো মাথা উঁচু করে আছে। এদের শুধু দরকার সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সঙ্গে একটু সম্মান—যা এমনই অনুপ্রেরণা যা সামনের দিনগুলোতে অনেক গৌরবের অধ্যায় লিখবে বাংলাদেশের হকিতে।
লেখক: সাবেক জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হকি তারকা।
এই দেশকে ক্রীড়াঙ্গন কখনোই বিমুখ করেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের ফুটবল খেলোয়াড়েরা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানবিরোধী জনমত গঠন করেছিলেন। সেই দেশের জনতার কাছে হকিও একটি পরিচিত খেলা। মাত্র মাস খানেক আগে ব্যাংককে বাংলাদেশ এক এক করে চায়নিজ তাইপে, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডকে হারানোর পর সেমিফাইনাল ও ফাইনালে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ওমানকে। এএইচএফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশিয়া কাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে এই বিজয়ীরা দেশে ফেরেন। আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এই হকি দলটিও আমন্ত্রণ পাবে—পায়নি। শুভেচ্ছাও নয়। একাত্তর সালের যুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের ঠকাচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল এই হকি খেলাটিই। ১৯৭০ সালে বিশ্বজয়ী পাকিস্তান দল ঢাকা স্টেডিয়ামে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের মুখোমুখি হয়েছিল এক প্রদর্শনী খেলার জন্য। আবদুস সাদেকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের হকি দলটি সেদিন প্রমাণ করেছিল—পাকিস্তান দলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানিদের তোমরা অন্যায়ভাবে বাদ দিচ্ছ। ওরা জিতেছিল বিশ্বের সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শর্ট কর্নার স্পেশালিস্ট তানভির দারের দেওয়া একমাত্র গোলে। মাঠের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আবদুস সাদেকের হাতেই। জনগণ সোচ্চার হয়েছিল— বলেছিল এখানেও বৈষম্য।
স্বাধীনতার পরও হকির শৈলী হারিয়ে যায়নি। ১৯৮৫ সালে এশিয়া কাপে এই ঢাকা স্টেডিয়ামেই আবারও পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। উপচে পড়া দর্শক দেখেছিল বাংলাদেশ দলের হকি-ছন্দ। খেলার অন্তিম সময়ে কোনোক্রমে এক গোল করে পাকিস্তান জয়লাভ করলেও বিশ্বের বহু নামীদামি পত্রিকার সম্পাদকীয় হয়েছিল, ‘হকি জগতের উঠতি শক্তি বাংলাদেশ হকি দল।’ কর্তৃপক্ষের উপেক্ষা, অসহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ১৯৮৫ সালে ওঠা হকির উদ্দীপনার ঢেউ হারিয়ে যায়। নির্বাচিত কিছু অ-হকি খেলোয়াড় এবং গদি সন্তুষ্ট ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতায় হকি প্রায় ধ্বংসের শেষ সীমায় চলে আসে। অবশেষে আসে ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি—সাধারণ সম্পাদক হয়ে খাজা রহমতউল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পর মনে হয় হকির পালে আবার উদ্দীপনার হাওয়া লেগেছে। মাঠে হকি এসেছে। অনেক বছর পর মহিলা হকি হলো, সামনে ক্লাব কাপ, সিনিয়র ডিভিশন হকিসহ বহু প্রতিযোগিতার ঠাস বুননে হকি সরগরম হচ্ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আছে এফআইএইচ ওয়ার্ল্ড কাপ লিগ। হকি ফেডারেশন যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তা সফল করার জন্য প্রয়োজন স্পনসরের। আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে হকির মতো খেলাতে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
এই দেশে হকি প্রথম আসে ১৯০৬ সালে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কলকাতার হোয়াইট ওয়েজ ডিপার্টমেন্টাল শপে হকিস্টিক দেখে নবাববাড়ির উঠতি ছেলেদের জন্য নিয়ে আসেন। আজ ২০১২। অন্য কোনো দেশে হকি আগমনীর শতবর্ষ উদ্যাপনে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হতো, কিন্তু আমাদের হকি ফেডারেশনের আর্থিক সমস্যার কারণেই সেটি হয়নি। তবে খাজা রহমতউল্লাহ একজন উদ্যোগী পুরুষ, সঙ্গে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে আছে এ দেশের হকির শ্রেষ্ঠ সন্তান আবদুস সাদেক। তাঁরা একটা বড় মাপের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করার ভাবনা করতে পারেন।
আগেই বলেছি, হকি অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলা। আজকাল যে কৃত্রিম মাঠে হকি খেলা হয় (যার মাত্র দুটি আছে বাংলাদেশে), সেটির মূল্য ১০ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষে শুধু একটি ফেডারেশনের জন্য এত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া কষ্টকর। বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতেই হবে। সেনাবাহিনী দল এ দেশের ঐতিহ্যবাহী হকি দল এবং বর্তমান জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়ন। তারা একটি কৃত্রিম হকি মাঠ আর্মি স্টেডিয়ামে সংযোজন করলে মাঠটির মাধ্যমে সারা দেশের হকি খেলোয়াড়েরা উপকৃত হবে।
আমাদের হকি খেলোয়াড়েরা বহু ধরনের বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এখনো মাথা উঁচু করে আছে। এদের শুধু দরকার সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সঙ্গে একটু সম্মান—যা এমনই অনুপ্রেরণা যা সামনের দিনগুলোতে অনেক গৌরবের অধ্যায় লিখবে বাংলাদেশের হকিতে।
লেখক: সাবেক জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হকি তারকা।
No comments