এভারেস্ট চূড়ায় এবার নাজরীন

সপ্তাহ না পেরোতেই এভারেস্ট চূড়া পদানত হলো আরেক বাংলাদেশি নারীর। দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে গতকাল শনিবার বিশ্বের এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করলেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ওড়ালেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। সকাল ৬টা ৪১ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখার খবরটি জানিয়েছে তাঁর এক সহযোগী প্রতিষ্ঠান।


গত ২৬ মার্চ তিনি এ অভিযান শুরু করেন। এভারেস্টে উঠতে থাকেন হিমালয়ের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ দিক দিয়ে। চূড়ার অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে তুষারঝড় ও দমকা বাতাসের কবলে পড়ে তাঁকে আটকে থাকতে হয় বেশ কয়েক দিন।
ওয়াসফিয়া তাঁর এ জয়কে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের নারীদের প্রতি, যারা স্বাধীনতা, শান্তি ও সমতার জন্য প্রতিনিয়ত লড়ছে।
ওয়াসফিয়া নাজরীন বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট জয় করলেন। তাঁর বয়স ২৯ বছর। এর আগে ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশের মুসা ইব্রাহীম, ২০১১ সালের ২১ মে এম এ মুহিত এবং মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত শনিবার নিশাত মজুমদার এভারেস্ট জয় করেন। নিশাতের সঙ্গী হয়ে মুহিত দ্বিতীয়বার এভারেস্টে ওঠেন।
লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকলে তুষারঝড় আর দমকা বাতাসকেও হার মানিয়ে জয় করা যায় এভারেস্ট_এরই দৃষ্টান্ত রাখলেন বাংলাদেশের এই দুঃসাহসী মেয়ে। এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার পথে একবার তুষারঝড়ের কারণে এবং আরেকবার দমকা বাতাসের তোড়ে তাঁর যাত্রা বিলম্বিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত দমাতে পারেনি ওয়াসফিয়াকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীনকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এভারেস্ট চূড়ায় পা রেখেই ওয়াসফিয়া স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে 'বাংলাদেশ অন সেভেন সামিটস' দলকে বলেছেন, 'আমাদের দেশ স্বাধীন হলেও আমরা নারীরা এখনো স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। এ জয় বাংলাদেশের নারীদের জন্য, যারা স্বাধীনতা, শান্তি ও সমতার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করছে।'
সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ সাত শৃঙ্গ জয়ে ওয়াসফিয়ার প্রচারসঙ্গী 'বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট' তাদের ফেসবুক পাতায় দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারীর এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণের খবর প্রচার করে। তারা বলেছে, কোনো সঙ্গী না নিয়ে একাই এভারেস্ট চূড়ায় ওঠেন ওয়াসফিয়া। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আমেরিকার গাইড ক্রিস ক্লিংকে এবং দুজন শেরপা নিমা গুরমে দর্জি ও কুসাং।
ওয়াসফিয়া নাজরীন গত বছর পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি চূড়া আরোহণে 'বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট' কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এভারেস্ট জয়ের মধ্য দিয়ে সাতটি পর্বত চূড়ার তিনটিই জয় করে ফেললেন ওয়াসফিয়া। এর আগে গত বছরের ২ অক্টোবর তিনি আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারো এবং ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আগঙ্কাওয়া জয় করেন।
এভারেস্ট যাত্রায় ওয়াসফিয়া নাজরীনের মূল স্পন্সর ছিল বাংলাদেশের সিটি ব্যাংক এবং সহযোগী স্পন্সর ছিল রেনেটা লিমিটেড ও কাজী ফার্মস। তাঁর এ যাত্রায় আরো সহযোগিতা করে নেপালের হিমালয়ান ক্লাইমেট ইনিশিয়েটিভস (এইচসিআই), নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড (এনটিবি) এবং এভারেস্ট উইমেনস সেভেন সামিটস ইকো অ্যাকশন দল।
ওয়াসফিয়া নাজরীনের এভারেস্ট জয়ের খবর নিশ্চিত করে রেনেটা লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কায়সার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা খবর পেয়েছি নাজরীন এবং তাঁর সহযোগী তিনজন শেরপা সবাই নিরাপদে আছেন। তাঁরা অবতরণ করছেন। আজ রাতে তাঁদের সাউথ কোলে অবস্থান করার কথা। আগামী পরশু (সোমবার) নাগাদ তাঁদের বেইস ক্যাম্পে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।'
'বাংলাদেশ অন সেভেন সামিটস'-এর সদস্য অভিনেতা ইরেশ যাকের কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত কয়েক দিন আমরা আশঙ্কা ও উত্তেজনার দোলাচলে সময় কাটিয়েছি। আজ (শনিবার) সকালে বন্ধু ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট জয়ের খবর পেয়ে দারুণ আনন্দিত হয়েছি। ওয়াসফিয়া অনেক পরিশ্রম করত। প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা ট্রেনিং করত সে।'
ইরেশ যাকের বলেন, 'এভারেস্ট যাত্রায় অনেক খরচ। অথচ এর জন্য সরকারি কোনো ফান্ড বা অনুদান নেই। তাই বেসরকারিভাবে স্পন্সর নিয়ে এভারেস্ট যাত্রার টাকা-পয়সা জোগার করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় এ দেশের পর্বতারোহীদের। এত পরিশ্রম করে আর অর্থকড়ির বাধা পেরিয়ে যারা এভারেস্ট জয় করে তারা প্রকৃতপক্ষেই আমাদের হিরো বা হিরোইন। তাদের স্যালুট।'
ওয়াসফিয়া নাজরীনের জন্ম ১৯৮৩ সালে ফেনী জেলার মাসিমপুরে তাঁর দাদার বাড়িতে। এরপর ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোটবেলাতেই তাঁর প্রথম পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরপর ২০০০ সালে পড়াশোনার জন্য তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায়। সেখানে তিনি ইরাক যুদ্ধবিরোধী প্রচারণাসহ মানবতার পক্ষে নানা আন্দোলনে অংশ নেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি 'সামাজিক মনোবিজ্ঞান ও স্টুডিও আর্ট' বিষয়ে পড়তে যান স্কটল্যান্ডে।
এরপর ভারত, ভুটান, নেপাল ও তিব্বতের বিভিন্ন পাহাড় ও পর্বতে উঠতে থাকেন তিনি। ২০০৯ সালে নেপালের লু রি এবং ২০১০ সালে আইল্যান্ড পিক জয় করেন তিনি। এ দুটি পর্বতের উচ্চতা ছয় হাজার মিটারের বেশি। গত বছর ২ অক্টোবর জয় করেন আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো। একই বছর ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আগঙ্কাওয়া চূড়ায় পা রাখেন ওয়াসফিয়া।
হাসিনা ও খালেদার অভিনন্দন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এক অভিনন্দন বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে ওয়াসফিয়ার বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর জন্য দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গর্ববোধ করছি এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি। দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন অনেক বাধা অতিক্রম করে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রেখে বাঙালির সাহসের প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর এই সাফল্য পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে।
খালেদা জিয়া শুভেচ্ছা বার্তায় ওয়াসফিয়া নাজরীনের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ যুব মৈত্রীও এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীনকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.