ঢাকার জীবন-আমাদের পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি by ফারুক ওয়াসিফ
জীবিতের থেকে মৃতের কদরই বেশি এই দেশে। ঘিঞ্জি খুপরির মতো ঘর-বাড়িতে যারা পয়-পরিজন নিয়ে তিলে তিলে সংসার সাজিয়েছিলেন, সেই সংসারসহ স্বপরিবারেই তাঁদের অনেকে পুড়ে কয়লা হয়ে গেলেন। যেমন জীবন তেমন মৃত্যুই তাঁদের হয়েছে। জীবনে যা তাঁরা পাননি মৃত্যু তাঁদের দিয়েছে সেই স্বীকৃতি, সমবেদনা ও সম্মান।
পালিত হয়েছে জাতীয় শোক। পোড়া দেহগুলো পেয়েছে যত্নের কাফন ও আজিমপুর গোরস্থানের দুর্লভ কবর। সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সবাই স্বীকার করছে, এভাবে চলতে পারে না। কিন্তু এত দিন চলল কেন? ঢাকা মহানগর নিজেই যে এক ‘গণবিধ্বংসী মৃত্যুফাঁদ’ হয়ে আছে তা কে জানতো না? জানা সত্যই এখন ১১৭টি পোড়া দেহ আর ২৫টি থেঁতলানো জীবনের মূল্যে স্বীকৃত পেলো। যাঁরা বহুকাল থেকে করি করি করছেন, তাঁরাও বলছেন কিছু একটা ‘করতে’ হবে। প্রতিটি বিপর্যয়ের পর মানুষের হুতাশন ঠাণ্ডা করতে এরকম বিবেকী কণ্ঠ বাতাস ভারি করে। গণহারে মৃত্যু কি তাহলে আমাদের বোধোদয়ের টনিক?
কিন্তু এ দেশে প্রতিটি বিপর্যয় কেবল পরের বিপর্যয়েরই পদধ্বনি। জীবনের মতো মৃত্যুও এখানে সুলভ, সহজ ও তুচ্ছ। আগুনে পুড়ে, লঞ্চ ডুবে, ভবন ধসে, বিষক্রিয়াসহ কত তুচ্ছ কারণেই না দফায় দফায় মানুষ মরে যায়। মহিমাহীন এসব মৃত্যুতে কিছুই কি তবু বদলায়? বদলাবে? মৃত্যুর রাজত্বে জীবনের গান গাওয়ার অসম্ভব কসরতে আমরা জর্জরিত। তবু প্রতিদিনকার জীবনের পিছু ধাওয়া করতে করতে সম্ভাব্য সব বিপদের ভয়কে আমরা হজম করে ফেলি। ঢাকাবাসীর থেকে তাই সাহসী ও অদূরদর্শী আর কে আছে? কিন্তু ‘দিনে দিনে যত বাড়িয়াছে দেনা’, একদিন তার ‘শুধিতে হইবে ঋণ’। তারপর একদিন বেগুনবাড়ি বা নিমতলীর মতো দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা সবার উদাসীনতার ঋণ পরিশোধ করে। আগেকার যুগে ডুবন্ত জাহাজের ওজন কমাতে গরিব যাত্রী ও খালাসিদের সাগরে ফেলা হতো। সমস্যার ভারে ডুবতে থাকা ঢাকায় সবার আগে তেমনি খরচ হয়ে যায় ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পবিত্ত মানুষের জীবন। বাকিরা মৃতের তালিকায় নিজেদের নাম না ওঠায় ভাবে, যাক আমি তো নিরাপদ! আমাদের শোকগুলো তাই মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতো হয়ে যায়। বঙ্গজননীর তো ১৬ কোটি সন্তান। তার কটি বাঁচল আর কটি মরল তার হিসাব তাই কে রাখে?
মাঝে-মধ্যে আমরা শোকে পাথর হই বটে, কিন্তু পাথরের মতো কঠিন সংকল্প জাগে না আমাদের। কপট আশ্বাস আর মিথ্যা আশায় বুঁদ হয়ে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, সরকার যদি থাকবে তবে মানুষ বারবার এমন অকাতরে মরবে কেন? যা নিয়মিত ভাবে হয় তা দুর্ঘটনা নয়, তার দায় শোকের বন্যায়হালকা হবার নয়। কবির সেই কথাই তাই সত্য হয়, ‘সুখেরও লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু,/ অনলে পুড়িয়া গেল।/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে,/সকলই গরলই ভেল।’
সরকার নিয়ম মানাতে বাধ্য করতে পারেনি সত্য, ভবনমালিকেরাও ঠিক করেছেন তাঁরা নিয়ম মানবেন না। কেউ টাকা বানাতে আর কেউ টাকা বাঁচাতে চালিয়ে যাচ্ছে এমন সর্বনাশা কারবার। তাহলে কে কাকে দোষ দেব? সাধারণ মানুষও অধিকার নিয়ে যেমন অসচেতন, দায়িত্ব নিয়েও তেমন। যা করা উচিত আর যা করা হয়, তার মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল— কোথাও নিয়মনীতির বালাই নেই। সমস্ত মনোযোগ যার যার নাকের ডগায় রাখতে গিয়ে সামনের অতল খাদটি কেউ দেখছি না। কথায় বলে, যেমন জনগণ তেমন সরকারই তারা পায়। আমরা যেমন আমাদের সরকার তেমন এবং আমাদের এই সাধের ঢাকা শহর আমাদের নৈরাজ্যিক মানসিকতারই দর্পণ।
দায় তাই দু’দিকেই। তাই ঢাকাবাসী এবং সরকার উভয়কেই ঠিক করতে হবে, এ শহর কি বাজার হবে না বসতি থাকবে? আবাসিক এলাকা আর বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে ভেদ রাখিনি আমরা। বাড়ির নিচে দোকান, পাশে কারখানা, ওপরে গুদাম। লাগামহীনভাবে চলছে প্রতিটি ইঞ্চি কংক্রিটে ভরিয়ে ফেলার উন্নয়ন। এই উন্নয়নের মানদণ্ডে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল আর বাজারের গুরুত্বই প্রথমে। এসবের খোরাক মিটবার পরে যা থাকবে তা পাবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা। ব্যবসা আর বসতি এ শহরের জমি ও সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ে টানাটানিতে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্বই আমরা দেখি বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়ায়, দেখি বাসকর্মচারী আর যাত্রীতে, দেখি সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবনের আড়ালে চাপা পড়া আবাসিক ভবনগুলোর কোণঠাসা দশায়, দেখি খেলার মাঠ আর নদী-জলাশয় দখল করে গড়ে ওঠা শপিং মলের দাপটের মধ্যে। মানুষের জন্য আর এই শহর নয়।
অন্যদিকে, দেশের সব ব্যবসাবাণিজ্য, সব প্রশাসনিক কেন্দ্র, সব সরকারি-আধাসরকারি এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় দপ্তর, দেশের সব নিরাপত্তা বাহিনীর সদরদপ্তর ও আবাসন, দেশের প্রধান প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোসহ সবকেই গাদাগাদি করে ঢোকানো হয়েছে এই ঢাকায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের ঢাকায় থাকলে কাজের অসুবিধা হওয়ার কথা, কর্তাদের সুবিধার জন্য সেসবকেও টেনে আনা হয়েছে এখানে। এত কিছুর চাপে নির্ভার নাগরিক জীবন প্রায় অসম্ভব। এত চাপে কেবল অবকাঠামোই ভেঙে পড়ে না, সামাজিক বয়ন ফেঁসে যায়, জীবনে নৈরাজ্য বাড়ে আর মনস্তত্ত্বে দেখা দেয় হাইপারটেনশন; অপরাধপ্রবণতা এবং নেশা হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণহীন। অন্যদিকে শহরের কিছু অভিজাত এলাকা তুলনামূলক সুরক্ষিত থাকলেও বাকিরা আগুন, ধস, ভূমিকম্প আর জলাবদ্ধতার ঝুঁকির মধ্যে দিনগুজরান করতে বাধ্য হয়। এই বাস্তবতা যেকোনো মহামারি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার উপযোগী। মানুষের তৈরি এই বাস্তবতারই শিকার নিমতলী বা বেগুনবাড়ির নিহতেরা। তারা আমাদের সম্মিলিত বেকুবির শহীদ।
এভাবেই এই শহরকে বানানো হয়েছে জতুগৃহ। মহাভারতের কাহিনিতে পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসে জতুগৃহ নামে এক ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেটা আসলে ছিল ফাঁদ। মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটা মোড়া ছিল দাহ্যবস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে নিমেষে পুড়িয়ে মারা যায়। পাণ্ডবকুলের পাঁচ ভাই সেই ষড়যন্ত্র বুঝে কয়েকজন আদিবাসীকে কৌশলে সেই ঘরে ঢুকিয়ে নিজেরা প্রাণে বাঁচেন। পুড়ে মরে সেই নিরীহ মানুষগুলো, যারা জানত না জতুগৃহ বাঁচার আশ্রয় নয়, দহনের ফাঁদ। আজ উন্নতি আর সুখের স্বপ্নে ভীড় জমানো ঢাকাবাসীর সেরকম ফাঁদে পড়ার দশা হয়েছে।
ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলেক্সেই ডি তকুইভিল বলেছিলেন, দীর্ঘদিন যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা মানুষ বিকল্পের সন্ধান পাওয়া মাত্রই সমস্যাগুলোকে অসহনীয় মনে করতে থাকে এবং তাকে বদলানোর জন্য কোমর কষে নামে। আমাদের এখানে হয়েছে উল্টোটা, দীর্ঘদিন অসুবিধার মধ্যে থাকতে থাকতে, পরিবর্তনের আশা ধূলিস্যাত হতে দেখতে দেখতে আমরা এখন সব সওয়া মহাশয়ে পরিণত হয়েছি। আশার মৃত্যু হলে ব্যক্তিগত সুবিধাবাদ জন্ম নেয়। সার্বিক সমস্যা থেকে মন সরিয়ে আমরা অনেকেই যেভাবে একা একা সুখে থাকার ইঁদুর দৌড়ে নেমেছি, তাতে পতনই বরং ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ রকম সুবিধাবাদী পরিবেশেই অচলাবস্থা আর নৈরাজ্য খুুঁটি পোক্ত করে বসে। কারণ, সরকার দায়িত্বশীল নয়, আর জনগণ নয় সোচ্চার।
সভ্যতার ইতিহাসে নগরের আবির্ভাব হয়েছিল নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার কেন্দ্র হিসেবে। আজ ঢাকায় জীবন অনিরাপদ, নাগরিক জীবন নানা অসুবিধার জালে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। ঢাকারই যখন এই অবস্থা তখন বাদবাকি দেশের অব্যবস্থার কথা আর না-ই বা বলি। বছরের পর বছর উপযুক্ত প্রতিকার না হওয়ায় গতকাল যা ছিল সমস্যা, আজ তা সংকট এবং পরশু বিপর্যয় আসন্ন। তাই সভ্যতা কোথাও থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু কোটি মানুষের দুর্ভোগ আর অজস্র মানুষের অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই শহরে প্রতিনিয়ত তার কবর খোঁড়া হচ্ছে। আমরা কি তবে এই ‘ঢাকাই সভ্যতা’র বিলয়ের জন্য অপেক্ষা করছি? আগুন, ধস, ভূমিকম্পের আতংক আর পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ সভ্যতার সব নিয়ামক বঞ্চিত হয়ে আমরা কি তাহলে আমাদের বিপর্যয়ের পূর্বঘোষিত দিনপঞ্জি রচনা করে যাচ্ছি?
রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কিছুমাত্র অগ্রগতি যারা ঘটাতে পারে না তারা কেমন সরকার? আমরা চাই শোকের উৎসাহে ঢাকাকে বাসযোগ্য করবার দায় ভেসে না যাক। এ শহর আর এর জীবন বাঁচানোর বিরাট উদ্যোগ হাতে নিয়ে সরকার যে আছেন, তাঁরা যে পারেন, তার দৃষ্ঠান্ত রাখুন। সরকার প্রমাণ করুন, কথায় নয় টাকায় নয় দায়বদ্ধতার মাধ্যমে জীবনের কিছুমাত্র দাম তাঁরা দিতে পারেন। এক আমলে এটুকুও করা গেলে সেটাই হবে এ সরকারের অবিষ্মরণীয় অবদান।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
কিন্তু এ দেশে প্রতিটি বিপর্যয় কেবল পরের বিপর্যয়েরই পদধ্বনি। জীবনের মতো মৃত্যুও এখানে সুলভ, সহজ ও তুচ্ছ। আগুনে পুড়ে, লঞ্চ ডুবে, ভবন ধসে, বিষক্রিয়াসহ কত তুচ্ছ কারণেই না দফায় দফায় মানুষ মরে যায়। মহিমাহীন এসব মৃত্যুতে কিছুই কি তবু বদলায়? বদলাবে? মৃত্যুর রাজত্বে জীবনের গান গাওয়ার অসম্ভব কসরতে আমরা জর্জরিত। তবু প্রতিদিনকার জীবনের পিছু ধাওয়া করতে করতে সম্ভাব্য সব বিপদের ভয়কে আমরা হজম করে ফেলি। ঢাকাবাসীর থেকে তাই সাহসী ও অদূরদর্শী আর কে আছে? কিন্তু ‘দিনে দিনে যত বাড়িয়াছে দেনা’, একদিন তার ‘শুধিতে হইবে ঋণ’। তারপর একদিন বেগুনবাড়ি বা নিমতলীর মতো দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা সবার উদাসীনতার ঋণ পরিশোধ করে। আগেকার যুগে ডুবন্ত জাহাজের ওজন কমাতে গরিব যাত্রী ও খালাসিদের সাগরে ফেলা হতো। সমস্যার ভারে ডুবতে থাকা ঢাকায় সবার আগে তেমনি খরচ হয়ে যায় ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পবিত্ত মানুষের জীবন। বাকিরা মৃতের তালিকায় নিজেদের নাম না ওঠায় ভাবে, যাক আমি তো নিরাপদ! আমাদের শোকগুলো তাই মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতো হয়ে যায়। বঙ্গজননীর তো ১৬ কোটি সন্তান। তার কটি বাঁচল আর কটি মরল তার হিসাব তাই কে রাখে?
মাঝে-মধ্যে আমরা শোকে পাথর হই বটে, কিন্তু পাথরের মতো কঠিন সংকল্প জাগে না আমাদের। কপট আশ্বাস আর মিথ্যা আশায় বুঁদ হয়ে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, সরকার যদি থাকবে তবে মানুষ বারবার এমন অকাতরে মরবে কেন? যা নিয়মিত ভাবে হয় তা দুর্ঘটনা নয়, তার দায় শোকের বন্যায়হালকা হবার নয়। কবির সেই কথাই তাই সত্য হয়, ‘সুখেরও লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু,/ অনলে পুড়িয়া গেল।/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে,/সকলই গরলই ভেল।’
সরকার নিয়ম মানাতে বাধ্য করতে পারেনি সত্য, ভবনমালিকেরাও ঠিক করেছেন তাঁরা নিয়ম মানবেন না। কেউ টাকা বানাতে আর কেউ টাকা বাঁচাতে চালিয়ে যাচ্ছে এমন সর্বনাশা কারবার। তাহলে কে কাকে দোষ দেব? সাধারণ মানুষও অধিকার নিয়ে যেমন অসচেতন, দায়িত্ব নিয়েও তেমন। যা করা উচিত আর যা করা হয়, তার মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল— কোথাও নিয়মনীতির বালাই নেই। সমস্ত মনোযোগ যার যার নাকের ডগায় রাখতে গিয়ে সামনের অতল খাদটি কেউ দেখছি না। কথায় বলে, যেমন জনগণ তেমন সরকারই তারা পায়। আমরা যেমন আমাদের সরকার তেমন এবং আমাদের এই সাধের ঢাকা শহর আমাদের নৈরাজ্যিক মানসিকতারই দর্পণ।
দায় তাই দু’দিকেই। তাই ঢাকাবাসী এবং সরকার উভয়কেই ঠিক করতে হবে, এ শহর কি বাজার হবে না বসতি থাকবে? আবাসিক এলাকা আর বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে ভেদ রাখিনি আমরা। বাড়ির নিচে দোকান, পাশে কারখানা, ওপরে গুদাম। লাগামহীনভাবে চলছে প্রতিটি ইঞ্চি কংক্রিটে ভরিয়ে ফেলার উন্নয়ন। এই উন্নয়নের মানদণ্ডে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল আর বাজারের গুরুত্বই প্রথমে। এসবের খোরাক মিটবার পরে যা থাকবে তা পাবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা। ব্যবসা আর বসতি এ শহরের জমি ও সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ে টানাটানিতে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্বই আমরা দেখি বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়ায়, দেখি বাসকর্মচারী আর যাত্রীতে, দেখি সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবনের আড়ালে চাপা পড়া আবাসিক ভবনগুলোর কোণঠাসা দশায়, দেখি খেলার মাঠ আর নদী-জলাশয় দখল করে গড়ে ওঠা শপিং মলের দাপটের মধ্যে। মানুষের জন্য আর এই শহর নয়।
অন্যদিকে, দেশের সব ব্যবসাবাণিজ্য, সব প্রশাসনিক কেন্দ্র, সব সরকারি-আধাসরকারি এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় দপ্তর, দেশের সব নিরাপত্তা বাহিনীর সদরদপ্তর ও আবাসন, দেশের প্রধান প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোসহ সবকেই গাদাগাদি করে ঢোকানো হয়েছে এই ঢাকায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের ঢাকায় থাকলে কাজের অসুবিধা হওয়ার কথা, কর্তাদের সুবিধার জন্য সেসবকেও টেনে আনা হয়েছে এখানে। এত কিছুর চাপে নির্ভার নাগরিক জীবন প্রায় অসম্ভব। এত চাপে কেবল অবকাঠামোই ভেঙে পড়ে না, সামাজিক বয়ন ফেঁসে যায়, জীবনে নৈরাজ্য বাড়ে আর মনস্তত্ত্বে দেখা দেয় হাইপারটেনশন; অপরাধপ্রবণতা এবং নেশা হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণহীন। অন্যদিকে শহরের কিছু অভিজাত এলাকা তুলনামূলক সুরক্ষিত থাকলেও বাকিরা আগুন, ধস, ভূমিকম্প আর জলাবদ্ধতার ঝুঁকির মধ্যে দিনগুজরান করতে বাধ্য হয়। এই বাস্তবতা যেকোনো মহামারি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার উপযোগী। মানুষের তৈরি এই বাস্তবতারই শিকার নিমতলী বা বেগুনবাড়ির নিহতেরা। তারা আমাদের সম্মিলিত বেকুবির শহীদ।
এভাবেই এই শহরকে বানানো হয়েছে জতুগৃহ। মহাভারতের কাহিনিতে পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসে জতুগৃহ নামে এক ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেটা আসলে ছিল ফাঁদ। মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটা মোড়া ছিল দাহ্যবস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে নিমেষে পুড়িয়ে মারা যায়। পাণ্ডবকুলের পাঁচ ভাই সেই ষড়যন্ত্র বুঝে কয়েকজন আদিবাসীকে কৌশলে সেই ঘরে ঢুকিয়ে নিজেরা প্রাণে বাঁচেন। পুড়ে মরে সেই নিরীহ মানুষগুলো, যারা জানত না জতুগৃহ বাঁচার আশ্রয় নয়, দহনের ফাঁদ। আজ উন্নতি আর সুখের স্বপ্নে ভীড় জমানো ঢাকাবাসীর সেরকম ফাঁদে পড়ার দশা হয়েছে।
ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলেক্সেই ডি তকুইভিল বলেছিলেন, দীর্ঘদিন যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা মানুষ বিকল্পের সন্ধান পাওয়া মাত্রই সমস্যাগুলোকে অসহনীয় মনে করতে থাকে এবং তাকে বদলানোর জন্য কোমর কষে নামে। আমাদের এখানে হয়েছে উল্টোটা, দীর্ঘদিন অসুবিধার মধ্যে থাকতে থাকতে, পরিবর্তনের আশা ধূলিস্যাত হতে দেখতে দেখতে আমরা এখন সব সওয়া মহাশয়ে পরিণত হয়েছি। আশার মৃত্যু হলে ব্যক্তিগত সুবিধাবাদ জন্ম নেয়। সার্বিক সমস্যা থেকে মন সরিয়ে আমরা অনেকেই যেভাবে একা একা সুখে থাকার ইঁদুর দৌড়ে নেমেছি, তাতে পতনই বরং ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ রকম সুবিধাবাদী পরিবেশেই অচলাবস্থা আর নৈরাজ্য খুুঁটি পোক্ত করে বসে। কারণ, সরকার দায়িত্বশীল নয়, আর জনগণ নয় সোচ্চার।
সভ্যতার ইতিহাসে নগরের আবির্ভাব হয়েছিল নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার কেন্দ্র হিসেবে। আজ ঢাকায় জীবন অনিরাপদ, নাগরিক জীবন নানা অসুবিধার জালে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। ঢাকারই যখন এই অবস্থা তখন বাদবাকি দেশের অব্যবস্থার কথা আর না-ই বা বলি। বছরের পর বছর উপযুক্ত প্রতিকার না হওয়ায় গতকাল যা ছিল সমস্যা, আজ তা সংকট এবং পরশু বিপর্যয় আসন্ন। তাই সভ্যতা কোথাও থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু কোটি মানুষের দুর্ভোগ আর অজস্র মানুষের অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই শহরে প্রতিনিয়ত তার কবর খোঁড়া হচ্ছে। আমরা কি তবে এই ‘ঢাকাই সভ্যতা’র বিলয়ের জন্য অপেক্ষা করছি? আগুন, ধস, ভূমিকম্পের আতংক আর পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ সভ্যতার সব নিয়ামক বঞ্চিত হয়ে আমরা কি তাহলে আমাদের বিপর্যয়ের পূর্বঘোষিত দিনপঞ্জি রচনা করে যাচ্ছি?
রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কিছুমাত্র অগ্রগতি যারা ঘটাতে পারে না তারা কেমন সরকার? আমরা চাই শোকের উৎসাহে ঢাকাকে বাসযোগ্য করবার দায় ভেসে না যাক। এ শহর আর এর জীবন বাঁচানোর বিরাট উদ্যোগ হাতে নিয়ে সরকার যে আছেন, তাঁরা যে পারেন, তার দৃষ্ঠান্ত রাখুন। সরকার প্রমাণ করুন, কথায় নয় টাকায় নয় দায়বদ্ধতার মাধ্যমে জীবনের কিছুমাত্র দাম তাঁরা দিতে পারেন। এক আমলে এটুকুও করা গেলে সেটাই হবে এ সরকারের অবিষ্মরণীয় অবদান।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments