ঝুঁকিপূর্ণ সব স্থাপনা সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিন-আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা

একটি আধুনিক নগর গড়ে তুলতে যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন, সে কথা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু স্বাধীন দেশের রাজধানী ও ৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকায় তার কোনো লক্ষণ নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিমতলীর আবাসিক ভবনের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডই তার একমাত্র উদাহরণ নয়।


এর আগেও অসংখ্য দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে সেই সত্য দেখিয়ে দিলেও সরকার, তথা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর টনক নাড়াতে পারেনি। ফলে প্রায় দেড় কোটি লোকের আবাসস্থল ঢাকা মহানগর পরিণত হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গলে; ঘিঞ্জি গলি ও অপরিসর সড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। আবাসিক এলাকা বলে কার্যত কোনো স্থানকে এখন আর চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। আবাসিক ভবনগুলোও এখন আর আবাসিক নেই। আবাসিক ভবনের নিচে মজুদ রাসায়নিক পদার্থই নিমতলীর দুর্ঘটনার ভয়াবহতার কারণ বলে জানা গেছে।
প্রতিটি নগরে আবাসিক এলাকার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। গত শতকের ষাটের দশকে পরিকল্পিত ঢাকা মহানগর গড়ে তুলতে নেওয়া হয়েছিল মহাপরিকল্পনা, গড়ে তোলা হয়েছিল ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। পরবর্তীকালে সেই সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে উন্নীত হলেও পরিকল্পিত মহানগর প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একশ্রেণীর বাড়ির মালিক, অতিলোভী রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ করে চলেছে। আবাসিক এলাকায় অবাধে বানানো হচ্ছে মার্কেট, বাণিজ্যিক ভবন ও ছোট-বড় কলকারখানা। এসব তদারক বা বেআইনি কাজ রোধ করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা কি কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন? তাঁরা অন্ধ হলেও প্রলয় যে বন্ধ থাকে না, নিমতলী বা বেগুনবাড়ির দুর্ঘটনাই তার বড় প্রমাণ।
কেবল পুরান ঢাকা নয়, নতুন ঢাকায়ও এ ধরনের বহু বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং দোকানপাট গড়ে উঠেছে। বেগুনবাড়ির ভেঙে পড়া ভবন সম্পর্কে রাজউকের চেয়ারম্যান যে কৈফিয়ত দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিনা অনুমতিতে ভবন নির্মাণের পরও মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া গর্হিত অপরাধ। তাঁরা কি এতই শক্তিশালী যে সরকারও তাঁদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারছে না। আসলে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার পদাধিকারীরা এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন বলেই মালিকেরা অবৈধ ভবন নির্মাণ করতে পারছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যায় এবং অব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এখানে যাঁরা আইন প্রণয়ন করেন, তাঁরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান। অন্যকে আইন মানার সুপরামর্শ দিলেও নিজেরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অবৈধ সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত থাকেন। জনগণের অর্থে ও নামে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা নিয়োজিত থাকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে। সে ক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরও হবে না, মৃত্যুর ঝুঁকিও কমবে না।
আমরা আশা করি, নিমতলী ও বেগুনবাড়ির দুর্ঘটনার পর সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিদের চৈতন্যোদয় হবে। আবাসিক এলাকা থেকে সব বাণিজ্যিক, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ও দোকানপাট অবিলম্বে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় নিমতলীর মতো মানবসৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

No comments

Powered by Blogger.