স্বাধীনতার মাসে প্রারম্ভভাবনা by রণজিৎ বিশ্বাস
এত কেন ফুল্ল তুমি! এত কেন প্রফুল্ল! প্রাণে তোমার কিসের এত বান ডেকেছে!_সময় কখনো কখনো এমন আসে, যখন নিজের কাছে প্রশ্ন রাখি, নিজেই আবার উত্তর মেলাই_আমার অন্তরতলে আজ সন্তোষসৌরভ, আমার প্রাণেমনে আজ আনন্দভৈরবী, আমার অনুভবের সর্বত্র আজ পরিতোষগুচ্ছ।
এত পরিতোষের কারণ_এ বিশ্বের ধূলিপরে ও আকাশতলে আমার দেশের চেয়ে সুন্দর দেশ নেই, আমার জাতির চেয়ে সংগ্রামদৃঢ় ও গৌরবদীপ্ত জাতি বিশ্বভুবনে মেলে না।
মেলে না কেন? মেলে না, কারণ স্বাধীনতার জন্য এত বেশি আত্মবলি আর কোথাও হয়নি, বীরের রক্ত ও মাতার অশ্রু মানুষ এত বেশি কোথাও ঝরায়নি, জায়া-জননী-কন্যা-ভগিনীর এমন লাঞ্ছনা আর কোথাও হয়নি। পাশবেতর প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ে চলার শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধপাগল ভূমিপুত্ররা এত বেশি কখনো কাঁপেনি।
এক পক্ষে তখন অস্ত্রের আড়ম্বর, হিংসার হিসহিসে নিঃশ্বাস, মানবদলনের থকথকে উল্লাস; আরেক পক্ষে মাতৃভূমির কলঙ্কমোচনের অঙ্গীকার : 'আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা মানুষ আমরা নহিত মেষ! দেবী আমার জননী আমার স্বর্গ আমার, আমার দেশ' [ডি এল রায়]। সেই অঙ্গীকার যারা পূরণ করেছে, সেই শপথকে যারা প্রাণে নিয়েছে, আমিও তাদের পঙ্ক্তিভুক্ত। তো হবেই আমার! আনন্দের অশ্রুপাথারে খুঁজে তো তুমি পাবেই আমায়!
সেদিন অন্তরে একেকটি শার্দূল চাগিয়ে আমরা শত্রুর অশ্লীল আস্ফালন স্তব্ধে দিয়েছি একটি মাত্র অস্ত্রের জোরে। দেশপ্রেম, মাতৃভূমির জন্য প্রাণপাতের প্রণোদনা, স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষার সম্মিলনে অস্ত্রটি আমরা খুঁজে নিয়েছিলাম। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিজের ভাষায় স্বপ্ন দেখার জন্য ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক খণ্ড মুক্ত ও সুবাসিত মাটি। সুতীব্র ব্যগ্রতায় ও রক্তচোয়ানো হৃদযন্ত্রণায় আমরা তার জন্য অপেক্ষার কাল গুনেছি।
এ অস্ত্রের শক্তিতে আমরা কুসংস্কার, একনায়কত্ব, স্বৈরতন্ত্র, মানবহননের উল্লাস ও সম্ভ্রমলাঞ্ছনার পাশবিকতা পায়ে দলতে দলতে শত্রুকে পরাজিতই শুধু নয়, ধ্বস্তবিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত করেছি এবং ঘৃণায় ও হেলায় অবহেলায় বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করেছি। নিক্ষেপ করতে করতে গ্রন্থির পেশি বিকশিত করে সম্মেলক এ গলা মিলিয়েছি_'বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ন কর চিত্ত। বাঙলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।'
দুর্বৃত্তের সর্বনাশ ঘটিয়ে পাওয়া এ দেশে; পরীক্ষার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে বলেই, মানবের বিরুদ্ধে পাশবের বিজয় কখনো যে নিশ্চিত হয় না_তা প্রমাণ করতে হবে বলেই; পরীক্ষার পর পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। আমারাতের পর আমারাত আমাদের পার করতে হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে ও কাঁটায় কাঁটায় রক্ত ঝরাতে ঝরাতে যে সোপানে আমরা এখন উপস্থিত, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা এখন স্ফীতবক্ষ ও স্ফুটিতচিত্ত। আমরা এখন বলতে পারি_যে দেশের ধরিত্রী সোনা উগলে দেয় ও উগলে দেয় হীরামতি, আমি সে দেশের সন্তান, আমি সে জাতির গর্বিত অংশ। যত ক্ষুদ্রই হই, আমাকে নিয়েই আমার জাতির পূর্ণতা।
আমার জীবন বর্ণভরা ও আমার জীবন অর্থধরা, কারণ যে দেশে আমার হারাহারি মালিকানা, সে দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কোনো গৌরব নেই, স্বাধীনতার চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি নেই, জাতীয় সংগীতের চেয়ে সুন্দর কোনো গান নেই, আপন গৃহকোণের চেয়ে শান্তির কোনো ঠিকানা নেই, জন্মভূমির চেয়ে পবিত্র কোনো মৃত্তিকা নেই, লাল-সবুজের চেয়ে প্রিয় কোনো রং নেই, মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই এবং বিকৃতির চেয়ে ঘৃণ্য কোনো অপরাধ নেই। মনের এমন স্থিতি নিয়ে আমি আজ কিছু স্বপ্নের কথা বলব। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আজ আমি স্বপ্নের ডালা সাজাব।
আমরা যারা স্বাধীনতাকে ভালোবাসি ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরব খুঁজি তারা সবকিছু ছাপিয়ে ও সব ভিন্নতা তুচ্ছ মেনে একটি প্রশ্নে সমান্তর ও যূথবদ্ধ। এ প্রশ্ন আমাদের ভবিষ্যতের, এ প্রশ্ন আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির, এ প্রশ্ন আমাদের জীবনের সুন্দর যাপনের এবং এ প্রশ্ন আমাদের অনুবর্তী প্রজন্মের বিকশিত উত্থানের। এ দেশে কামধেনুর মতো আমাদের দিয়ে যায় বলেই এর কাছে আরো দেওয়ার দাবি আমাদের মনে বেড়ে বেড়ে ওঠে, আরো কিছু পাওয়ার স্বপ্ন আমাদের অন্তরে লতিয়ে ও লকলকিয়ে ওঠে।
আমাদের স্বপ্ন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর ও মহার্ঘ অনেক ত্যাগের পর সত্য, স্বাধীনতা, সুশিক্ষা, সুরুচি, আধুনিকতা ও মানবতার পক্ষে যে সময় আমরা হাতে পেয়েছি, তার সর্বোত্তম ব্যবহার আমরা করব।
আমাদের নিত্যদিনের শুচিশুদ্ধ ও পবিত্র স্বপ্নের এ ভূগোলখণ্ডে আমাদের সন্তানরা পাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি সমৃদ্ধ অঙ্গন। আমরা পাব ক্লান্তির পরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিঃশ্বাস নেওয়ার এক কাঙ্ক্ষণীয় ফুরসত। আমরা আমাদের সন্তানদের দেশের অবিকৃত ইতিহাস ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা বলব, অপার সম্ভাবনার কথা শোনাব এবং আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মাননা ও মানবতার গান গাওয়াব এবং 'পঠন' ও 'ঘোষণ'-এর পার্থক্য বুঝিয়ে দেব। আমরা তাদের ভাবাব কেন বলা হয়, ভ্রাতৃত্বের চেয়ে বড় বন্ধন নেই, বন্ধুত্বের চেয়ে বড় ভরসা নেই; আমরা তাদের বোঝাব কেন বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের প্রশ্নে পরিচয়ভেদ তুচ্ছই শুধু নয়, তুচ্ছাতিতুচ্ছ; আমরা তাদের বোঝাব_উন্নত ও আধুনিক সমাজ কেন চায় 'মানুষের বাগান', কেন এক ফুলে বাগান হাসে না, কেন সমৃদ্ধ এক উদ্যানে সব প্রজাতির ফুল ফুটতে দিতে হয়। আমরা তাদের সুস্বাস্থ্য ও আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ুর সন্ধান দেব এবং বয়সের বলিরেখাকে উপেক্ষা করে আমরা আপন জীবনের যাপন অর্থবহ করে তুলব, আপন অন্তরকন্দরে একটি করে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দৃঢ়পণ হব_চারপাশের মণ্ডূকতা, অসাম্য ও অন্ধকার বিদূরণে 'আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি'।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments