ত্রাণকর্মীহত্যা-ইসরায়েলি প্রচারণার আড়ালে by রবার্ট ফিস্ক

আমি ক্রুদ্ধ হই, যখন একদল অস্ত্রবাজ আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকা জাহাজে উঠে পড়ে, যাত্রীরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তাদের হত্যা করে আর তারপর ছিনতাইকারীরা তাদের নিজেদের বন্দরে সেই জাহাজ নিয়ে যেতে বাধ্য করে। সোমালীয় জলদস্যুদের কথা বলছিলাম। তারা ভারতীয় মহাসাগরে পশ্চিমা জাহাজ লুট করে।


এসব সন্ত্রাসীর কত বড় সাহস যে তারা পশ্চিমাদের নিরস্ত্র জলযানে হাত দেয়? আর এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকানোর জন্য পশ্চিম যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে কত ন্যায্য কাজটাই না করছে।
কিন্তু আফসোস! ইসরায়েল তো অন্তত মুক্তিপণ দাবি করেনি। তারা শুধু চায় সাংবাদিকেরা তাদের হয়ে প্রচার-যুদ্ধে তাদের বিজয় এনে দিক। ইসরায়েলিরা যখন ‘কমান্ডোরা’ যখন গাজামুখী ত্রাণবাহী তুর্কি জলযানে উঠে পড়ল এবং নয়জন আরোহীকে গুলি করে হত্যা করল, তখন সপ্তাহের কেবল শুরু। আর সপ্তাহ শেষ হতে না-হতে গণমাধ্যমের কল্যাণে বিক্ষোভকারীরা হয়ে গেল ‘সশস্ত্র শান্তিবাদী কর্মী’, ইহুদি-বিদ্বেষী ‘যারা ঘৃণায় ফেটে পড়ছে অথচ মুখে বলছে শান্তির কথা এবং মানুষকে অনবরত ধাতব পাত দিয়ে পেটায়’। শেষাংশটি আমার বেশ লাগল। যে লোকটাকে পেটানো হচ্ছিল সে যে স্পষ্টত তখন গুলি করে আরেকজন মানুষ মারছিল সেটি এই ইসরায়েলের এই আজগুবি বয়ানে স্থান পায় না।
বিক্ষুব্ধ তুর্কি পরিবারগুলো বলছে, তাদের সন্তানেরা শহিদ হতে চেয়েছিল। কোনো তুর্কির কোনো আত্মীয় যদি ইসরায়েলিদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়, তাহলে অধিকাংশ তুর্কি পরিবারের সদস্যরা হয়তো এমন কথাই বলবে। জাহাজের আরোহীরা যে জিহাদি ছিল তা পাকাপোক্ত করতে এই কথাকেই উল্টো ব্যবহার করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার এক নাগরিক আমাকে বার্তা পাঠিয়েছেন, ‘আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভ্রাতুষ্পুত্র ও তার স্ত্রী সেই ত্রাণবাহী জাহাজে ছিল। আহমেদের (২০ বছর বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্র) পায়ে গুলি লেগেছে। এখন তাকে সামরিক হেফাজতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমি আপনাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করব।’ তিনি তা করেছিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর বাড়িতে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করে জানতে চান, আহমেদ জিহাদি কিংবা সম্ভাব্য আত্মঘাতী বোমাবাজ ছিল কি না। দেখতেই পারছেন, প্রপাগান্ডা কাজ হয়। বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে কোনো চিত্র আমরা দেখতে পাইনি, কারণ ইসরায়েলিরা সব চুরি করে নিয়ে গেছে। যদি তুর্কি জাহাজটির আরোহী এমন সব নির্দয় সন্ত্রাসবাদী হয়ে থাকে, যারা গাজার ‘সন্ত্রাসবাদী’দের সাহায্যের ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করছিল, তাহলে তুরস্ক থেকে তাদের লম্বা সফরের গোড়াতেই কেন তা কেন প্রকাশ করা হলো না? একথা কেউ আমাদের একবারও বলেনি। তারা তো অন্য বন্দরগুলোতেও যাত্রাবিরতি করেছে।
তুর্কি জাহাজে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বিন্দুমাত্র বিস্মিত করেনি। লেবাননে আমি দেখেছি, সেনাবাহিনীর এক বেপরোয়া অংশ এইভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের গুলি করেছে। আমি দেখেছি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) ঘিরে রাখা শিবিরে ঢুকে তাদের লেবাননীয় মিলিশিয়া মিত্ররা ১৯৮২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে সাব্রা ও শাতিলা গণহত্যা ঘটিয়েছে, আর তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলিদের দ্বারা সংঘটিত কানা হত্যাকাণ্ডের সময়ও আমি উপস্থিত ছিলাম। এক বন্দুকধারী নিহতের সংখ্যা বলেছিল ১০৬ জন, যার অর্ধেকেরও বেশি শিশু। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শিমন পেরেজের ইসরায়েলি সরকার তখন বলেছিল, নিহত বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীরা ছিল। এ কথা পুরোপুরি মিথ্যা, কিন্তু তাতে কী যায়-আসে? তারপর ২০০৬ সালে ঘটল দ্বিতীয় কানা হত্যাযজ্ঞ আর তারও পরে ২০০৮-০৯ সালে গাজায় এক হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি হত্যা, তাদের অধিকাংশ শিশু, আর তারও পরে...।
অতঃপর এল গোল্ডস্টোনের প্রতিবেদন। গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের (এবং হামাসের) যুদ্ধাপরাধ ঘটানোর প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু এই প্রতিবেদনের ভাগ্যে জুটল নিন্দা। বলা হলো, এটা ইহুদি-বিদ্বেষী। সম্মানিত গোল্ডস্টোনের ভাগ্য এতই করুণ, তিনি নিজে দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিশিষ্ট ইহুদি আইনজ্ঞ, আর তাঁর ওপরই কিনা ‘মন্দলোক’-এর কলঙ্ক চাপিয়ে দিলেন হার্ভার্ড ল স্কুলের আল ডেরশোবিৎজ। এবং নির্ভীক ওবামা প্রশাসন বলল, এই প্রতিবেদন ‘বিতর্কিত’।
আবার তাহলে আমরা কালানুক্রমিক বর্ণনায় ফিরে যাই। দুবাইয়ে এক হামাস নেতাকে হত্যা করল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এই হত্যার জন্য ব্রিটেন ও অন্য কয়েকটি দেশের মোট ১৯টি জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করা হলো। তখন কী মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখলাম ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ডের! এটাকে তিনি নিছক এক ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যায়িত করলেন। খেয়াল করুন, দুবাইয়ে এক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড নয় শুধু, যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট জাল করার ঘটনাটিকে তিনি বললেন এক অতি ‘বিতর্কিত’ ব্যাপার। আর তারপর... হ্যাঁ, এবার আরও কিছু ইসরায়েলি ‘বীর’ গুলি করে মারল ত্রানবাহী জাহাজের নয় আরোহীকে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এত বিপুলসংখ্যক পশ্চিমা সাংবাদিক এমন লেখা লিখছেন, যেন তাঁরা ইসরায়েলি সাংবাদিক (গাজার জন্য ত্রাণবাহী জাহাজের দুর্বল কাভারেজের জন্য আমি বিবিসিকেও এই তালিকায় রাখলাম), আর অন্যদিকে অনেক ইসরায়েলি সাংবাদিক এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এমন সাহসী লেখা লিখছেন যে সাহস পশ্চিমা সাংবাদিকদের দেখানো উচিত। হারেৎজ পত্রিকায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা যে অবস্থান থেকে সেনাবাহিনীতে আসেন তা বিশ্লেষণ করে আমোস হারেলের লেখাটি দেখুন। অতীতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেকেই আসতেন বাম ধারার কিব্বুৎজিম ঐতিহ্যের ভেতর থেকে, বৃহত্তর তেলআবিব অথবা শ্যারনের উপকূলীয় এলাকা থেকে। ১৯৯০ সালে মাত্র দুই শতাংশ আর্মি ক্যাডেট ছিলেন ধর্মীয় গোড়া ইহুদি। অথচ এখন এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশে। গোলানি ব্রিগেডের সাতজন লেফটেন্যান্ট-কর্নেলের ছয়জন ধার্মিক। অর্ধেকের বেশি স্থানীয় কমান্ডার ‘জাতীয়’ ধার্মিক।
ধার্মিক হওয়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু গোঁড়াদের অনেকে পশ্চিম তীরে উপনিবেশ স্থাপনের সমর্থক আর তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও বিরোধী। আর গোঁড়া উপনিবেশবাদী ইসরায়েলিরাই সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনিদের ঘৃণা করে। কিছু হামাস নেতা যেমন ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, এই গোঁড়ারাও তেমনি চায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যেকোনো সম্ভাবনাকে নিশ্চিহ্ন করতে। পরিহাসের ব্যাপার হলো, ইসরায়েলের ‘পুরাতন’ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গাজায় ‘সন্ত্রাসী’ হামাসকে মসজিদ বানাতে প্রথম উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে এমন এক সভার আমি সাক্ষী। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর তখন লক্ষ্য ছিল বৈরুতে ঘাঁটি গেড়ে বসা ‘সন্ত্রাসী’ ইয়াসির আরাফাতের বিপরীত-ভারসাম্য তৈরি করবে। এই একই পুরোনো কাসুন্দি চলতেই থাকবে যতদিন না বিশ্ববাসী জেগে ওঠে। আর কিনা ফরাসি দার্শনিক বারনার্ড হেনরি লেভি এই হত্যাযজ্ঞের কয়েক ঘণ্টা আগেই বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর মতো এমন গণতান্ত্রিক সেনাবাহিনী আমি আর একটিও দেখিনি।’
হ্যাঁ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুলনীয় কেউ নয়। এমন অভিজাত আর মানবিক আর বীরোচিত। সাবধান, একথাটা যেন সোমালীয় জলদস্যুদের না বলা হয়। তারা লজ্জা পাবে।
দি ইনডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.