সময়ের প্রতিধ্বনি-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অদূরদর্শী মন্তব্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক by মোস্তফা কামাল

বিশ্বের সব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই অন্য মন্ত্রীদের চেয়ে আলাদা। আলাদা এই অর্থে, তাঁকে অনেক ভেবেচিন্তে, বিচার-বিশ্বেষণ করে কথা বলতে হয়। তাঁর বেফাঁস কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আবার অনেক সত্য কথাও তিনি সহজে বলতে পারেন না। তাঁকে হতে হয় অনেক বেশি কৌশলী।
তাঁর কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের কারণে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে না। তিনি তো সম্পর্কে জো ড়া লাগাবেন এবং শীতল সম্পর্ককে উষ্ণ করবেন! অন্য মন্ত্রীরা বেফাঁস কথা বলে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেফাঁস কথায় একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙেও যেতে পারে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তাঁকে মনে রাখতে হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের মুখপাত্র। তিনি যা বলবেন সেটা পুরো দেশের বক্তব্য। তাঁর কারণে দেশের মুখ উজ্জ্বল হতে পারে, আবার তাঁর কারণেই দেশের মুখে কালিমা লেগে যেতে পারে।
বৃহত্তর শক্তির দেশ থেকে ক্ষুদ্র দেশ_সবার সঙ্গেই সম্পর্ক অটুট রাখতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের হতে হয় অনেক বেশি সাবধানী। তাঁকে সব সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে কথা বলতে হয়। আমরা দেখছি, বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং প্রবীণ রাজনীতিকরা। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে। তার পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টিকে সামগ্রিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়। ভারতে এখন এস এম কৃষ্ণা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বয়সে যেমন প্রবীণ, তেমনি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সাবেক ফার্স্টলেডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। ব্রিটেনে অবশ্য অপেক্ষাকৃত তরুণ রাজনৈতিক নেতারা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশে গুরুত্ব বিবেচনা করেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
তবে এসব দেশের রাজনীতিকদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি আমাদের দেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে তুলনা করে তাঁদের খাটো করতে চাই না। বেশির ভাগ দেশেই দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থান। কোনো কোনো দেশে অর্থমন্ত্রী থাকেন দ্বিতীয় স্থানে। তারপরের অবস্থানেই থাকেন পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমাদের দেশেই এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়।
ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো এতই মজবুত যে, সেখানে যে কাউকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে বসানো যেতে পারে। তাতে নীতিগত কোনো সমস্যা হয় না। ভারতের 'সাউথ ব্লক', যুক্তরাষ্ট্রের 'স্টেট ডিপার্টমেন্ট' কিংবা যুক্তরাজ্যের 'পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিস' যা বলে দেবে তার বাইরে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না ওইসব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তার পরও ওইসব দেশে অনেক চিন্তাভাবনা করেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে আবদুস সামাদ আজাদ এবং ড. কামাল হোসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সামাদ আজাদ বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। সাবেক সেনা কর্মকতা মোস্তাফিজ পাঁচ বছরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁর সময়কালে অনেক দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল শীতল। সামাদ আজাদের সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো ছিল, যদিও ব্যক্তি সামাদ আজাদকে অনেকেই পছন্দ করতেন না।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হলে প্রথমে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মোরশেদ খান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। রাজনীতিকের চেয়ে তাঁর বড় পরিচয় একজন সফল ব্যবসায়ী। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সফল হয়েছেন এ কথা বলা যাবে না।
আমাদের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বয়সে নবীন। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন। তখন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহভাজন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর অনেক সমালোচনা হয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এত অল্প বয়সী_এটা অনেকেই মানতে পারেননি। সমালোচকরা বলতেন, যতই যোগ্যতাসম্পন্ন হোক বয়সও একটা ব্যাপার। আমরা শুরুতে তাঁর কথাবার্তা শুনে ভেবেছিলাম, হয়তো তিনি ভালো করবেন। তা ছাড়া শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে শুরুতে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছিলেন। কিন্তু সেটা তিনি ধরে রাখতে পারছেন না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল কাজটাই হচ্ছে, সব কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়। কিন্তু তিনি কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। যদিও জাহান মনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্ত হওয়া এবং লিবিয়ায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশিদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আরো কিছু সাফল্য আছে; তা ধরে রাখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। অন্য মন্ত্রীদের মতো তিনিও এখন বেফাঁস কথা বলতে শুরু করেছেন। আর তাঁর কারণে সরকারকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। তিনি গত ১২ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে বলে বসলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো দেশের প্রতিক্রিয়ায় সরকার বিচলিত নয়। কোন দেশ কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না।' পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আমরা আশা করিনি। কোন দেশের সঙ্গে 'ডিলিংটা' কী রকম হবে তা তাঁর বোঝা উচিত। সব দেশকে একই পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না।
আমরা জানি, ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সরকার যা করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র বিচলিত। ইউনূস হিলারি ক্লিনটনের পারিবারিক বন্ধু। তিনি তাঁকে ফোন করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে আছেন বলে জানিয়েছেন। এরপর এ বিষয়ে সরকারের আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলার দরকার ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়-ই, প্রধানমন্ত্রীরও নীরব থাকাটা বাঞ্ছনীয় ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাজটা ঠিকই করেছেন কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেননি। তিনি মন্তব্য করে ইস্যুটিকে নতুন রূপ দিয়েছেন। ছোট দেশের বড় কথা সব সময় মানায় না। ছোট দেশকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। অনেক সময় অনেক সত্য এড়িয়ে যেতে হয়। দেশের স্বার্থেই এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
আমরা সবাই জানি, এককেন্দ্রিক বিশ্বের প্রধান নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সব সরকারের আমলেই এ সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে যেসব সরকার এসেছে, সবারই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে এক নীতি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও পণ্যসামগ্রী রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ইস্যুটি অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে।
আমরা দেখে আসছি, বাংলাদেশ বরাবরই ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে এমন কোনো কাজ কোনো পর্যায় থেকেই করা হয় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাবতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সরকারের স্বাধীন কাজের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু যেকোনো দেশ যেকোনো ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। সব প্রতিক্রিয়ারই যে জবাব দিতে হবে তা তো নয়! বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারতেন। তাঁর মন্তব্যের মধ্য দিয়ে অপরিপক্বতাই ফুটে উঠল।
এর আগে বিএনপি সরকারের আমলে দেখেছি, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই দেশের বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সে পর্যায়ে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে সহজ-স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.