তারুণ্য-হিমালয়শিখরে জাতীয়তাবাদ by ফারুক ওয়াসিফ
ওরা পাঁচজনে গান করছে। সবই তারুণ্যে-ভরা কথা ও সুর। সবই বাংলা গান। তিনটি মেয়ে আর দুটি ছেলে, সবারই বয়স ২০-এর কাছাকাছি। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে টানা ঘণ্টাখানেক ওরা গাইল। একটি মেয়ের মাথায় কালো স্কার্ফ। তার গলাই বেশি শোনা যাচ্ছে এবং গলাটা সুরেলাও। এই গ্রুপে সেই লিডার।
এরই মধ্যে দুটি চার-পাঁচ বছরের বালিকা তাদের কাছে চকলেট বেচতে গেল। তাদের আবদার, তাদের কাছ থেকে চকলেট কিনতে হবে। ওরা চকলেট কিনল না। বরং সেই স্কার্ফ পরা মেয়েটি ওদের টেনে বসিয়ে বলল, ‘আগে বসো, আমাদের সঙ্গে গান করো, তারপর কিনব।’ বাচ্চা দুটি বসলও। স্কার্ফ পরিহিতা তাদের বলে, ‘আমরা তো গাইছি, এবার তোমরা একটা গান করো।’ কিছুটা চাপাচাপির পর শিশু দুটির একজন কচি কণ্ঠে গাইল দে দে দে দিল দে দে মুঝকো টাইপের একটা চটুল হিন্দি গানের কয়েকটা কলি। স্কার্ফ পরিহিতার গানটি পছন্দ হলো না। সে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা গাইছি, তোমরাও সঙ্গে সঙ্গে গাও।’ তারা রবীন্দ্রনাথের ‘আহা, কী আনন্দ’, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির’ ইত্যাদি গানগুলো গাইল। বুঝুক না বুঝুক, বাচ্চা দুটির এ আদর পছন্দ হয়েছে। চারটি বড় আর দুটি ছোট মিলে মেলা কিচিরমিচির হলো সেখানে। চলে আসবার সময় দেখি, ওরা সাতজন দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে গাইছে, ‘আমার সোনার বাংলা...।’ নির্ঘাত ছেলেমানুষী। তবুও সেই ছেলেমানুষীর পবিত্র আবেগ দেখে বুক ভরে গেল। ওই ছেলেমেয়েরা শেখাল, চটুল হিন্দি গানের জনপ্রিয়তাই শেষ কথা নয়।
গান শেষ হলে ওই মেয়েটিকে বলতে শুনি, ‘দ্যাখো, বুকের মধ্যে কেমন দপদপ করছে না?’ শিশু দুটো কী বুঝল জানি না, মাথা নেড়ে বলল, ‘হ’। ‘বুঝলা’, মেয়েটি বলে, ‘যখনই তুমি দেশের কথা ভাববা, দেশকে ভালোবাসবা, তখন দেখবা বুকের মধ্যে এইরকম দপদপ করবে!’ হিমালয় শিখরে লাল-সুবজ পতাকা হাতে মুসা ইব্রাহীমের দাঁড়িয়ে থাকা দেখেও তো বুকের মধ্যে এমন গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছিল।
কিছু সাফল্য আছে যা সবাই মিলে উপভোগ করা যায়, আবার কিছু সাফল্য স্বার্থপর। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য। তাহলেও এই আনন্দের ভাগীদার হতে পারে এই দেশের এই জাতির যেকোনো মানুষ। কারণ, জয়টা ‘আমাদের ছেলের’। এ ‘আমরা’র মধ্যে দেশপ্রেম আছে, জাতীয়তাবাদ আছে, বীরবন্দনা আছে। তাই তাঁর তুলে ধরা জাতীয় পতাকার মধ্যে সবাই পায় দেশপ্রেমের আবেগে ভাসার অধিকার।
অন্যদিকে দুর্নীতির এভারেস্ট যারা জয় করেছে, যারা নিত্য জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে যাচ্ছে, তাদের পাপকর্মের দায় কেউই নিতে চাইবে না। ওগুলো এমন ‘সাফল্য’ ওই সফলদের ছাড়া যা আর কাউকে সুখী করে না। মুসা যেমন ‘আমাদের ছেলে’, তেমনি এসব চিহ্নিত-অচিহ্নিত অপরাধীরা ‘আমাদের কেউ নয়’। এই আমরা ‘জাতি’ আর সেই ‘তারা’ জাতীয় শত্রু।
এই ‘আমাদের’ শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতি ও জাতীয়তাবাদের প্রাণভোমরা। জাতীয়তাবাদী প্রেরণাতেই সামান্য মানুষও অসামান্য কাজ করতে পারে, অকাতরে প্রাণ দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধে। আবার এই জাতীয়তাবাদের নামেই সংকীর্ণতা, হিংসা, বর্ণবাদ ও মিথ্যা অহংকার সর্বনাশও ঘটায়। জাতীয়তাবাদ সম্ভব হতো না যদি না সর্বজনীন শিক্ষা, দেশময় যোগাযোগ-ব্যবস্থা এবং জাতীয় সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম না থাকত। একই লিখিত ভাষায় সব শিশু যদি দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ না করে, যোগাযোগের মাধ্যমে এক এলাকার মানুষের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষের চিন-পরিচয় না হলে এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিদিনকার জাতীয় দিনপঞ্জি যদি সবার জানা না হয়, তাহলে জাতি নামক ধারণাটি আকাশকুসুম হয়েই থাকে। সে জন্যই মধ্যযুগে জাতীয়তাবাদের দেখা মেলে না। পলাশীর ময়দানে সিরাজের পরাজয়ে বাঙালি জাতি পরাজিত বোধ করেছে বলে প্রমাণ নেই। কিন্তু আধুনিক যুগে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদকে বাদ দেওয়া কঠিন।
মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্টে আরোহণ যে জাতীয়তাবাদী ‘ঘটনা’ তা জানা গেল গণমাধ্যমে শোরগোলে। এভাবে একটি ঘটনার অদৃশ্য সুতায় সবাই বাঁধা পড়ায়, মুসা ইব্রাহীম তাঁর পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের ‘নায়ক’ থেকে পরিণত হন জাতীয় বীরে। তিনি হয়ে যান জননন্দিত ‘পাবলিক আইকন’।
জাতীয়তাবাদ যেমন বীর চায়, তেমনি চায় জাতীয় প্রতীক, জাতীয় পতাকা। এর মর্মে আছে, ‘আমরাও পারি’, ‘আমরাও পারবো’ এমন বিশ্বাস। আমেরিকার ১৩ বছরের কিশোর রোমেরোর সঙ্গে মুসার পার্থক্য এখানেই। রোমেরোর আগে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিকের পা এভারেস্টে পড়েছে। তাই মার্কিন দেশে রোমেরোকে ঘিরে তেমন আলোড়ন নেই। একই রকম কষ্ট, সাহসিকতা ও একই উচ্চতা পেরিয়েও একজন অন্যতম এবং অন্যজন অনন্য। প্রথম মার্কিন নভোচারীর চাঁদে পা রাখা কিংবা দুনিয়ার প্রধান পরাশক্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশকে পদানত করার ‘গর্ব’-এর মতো গর্বিত হওয়ার আকছার সুযোগ মার্কিনিদের রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশ, যা গরিব, যার অনেক মানুষেরই দুঃখের কোনো শেষ নেই, বিশ্বসভায় এখন কোনো দিক থেকেই যার আসন মর্যাদাকর নয়, যে দেশের খেলোয়াড়েরা কখনো বিশ্বকাপ জয় করেনি, চাঁদ তো দূরের কথা দারিদ্র্য কিংবা লুটপাট-মাফিয়াতন্ত্রকেই যারা জয় করতে পারেনি, তাদের জন্য মুসার এভারেস্ট আরোহণ এক চিলতে সুবাতাস বইকি!
এ রকমই ব্যক্তিগত সংকল্প, মেধা ও পরিশ্রমে আমাদের যুবপ্রজন্ম অনেক কিছুই করছে। কেউ বিদেশে নাম করছে, কেউ ডলার আনছে, কেউ দেশের মাটিতেই উদয়াস্ত খেটে উৎপাদন বাড়াচ্ছে, কেউ গাছ লাগাচ্ছে, কেউ বই পড়াচ্ছে, কেউ পরীক্ষায় ভালো করছে, কেউ পাখি বাঁচাচ্ছে, কেউ মানুষ বাঁচাচ্ছে। কৃষকেরা প্রতি বছর বাম্পার ফলন ফলাচ্ছে। এসবও এভারেস্ট জয়ের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ রকম অজস্র উদ্যোগী তরুণ দেশে আছে। বাড়তে দিলে আমাদের তরুণেরা অনেক বড় হতে পারে, মুসা তার প্রমাণ।
কিন্তু এ ধরনের সাফল্যগাথায় সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সর্বদাই এত নগণ্য কেন? অহেতুক মাতব্বরি, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক পাকেচক্রে সরকারি উদ্যোগে বড় সাফল্য দেখা যায় না। সরকারগুলোর এ অযোগ্যতার জন্যই ব্যক্তি সফল হলেও জাতি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে যায়। যিনি যেখানে ক্ষমতাবান, তিনি এবং তাঁর ওই ক্ষমতাই জনগণের ওপরে উঠে আসবার পথে বাধা। স্কুল-কলেজ, গ্রাম-পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সাপ-লুডু খেলার ছকের মতো অনেক প্রতিবন্ধক। পদে পদে অনেক সাপের মুখ আর অনেক মইয়ের সিঁড়ি পাতা। ভালো লোকেরা সে সব উন্নতির সিঁড়িতে কদাচিৎই পা রাখতে পারে, বরং তাদের ঠেলে ফেলা হয় হা করে থাকা সাপের গর্তে। এভাবে অনেকে ব্যর্থ হয়, বখে যায়, মাস্তান হয়, নেশা করে আর অপচয় হয়ে যায়। আর একদল এসবের মাঝখানে থেকে জীবন-জীবিকার জন্য ছুটতে থাকে। একটু ভালো থাকার চেষ্টা করতে করতেই তাদের মেধা-শ্রম-সম্পদ খরচ হয়ে যায়।
মুসা এই চক্রের মধ্যে আটকে না থেকে গন্তব্যকে অনেক বড় করে নিয়েছিলেন। সবাই তাঁর মতো করে নিশ্চয়ই পর্বতে উঠতে যাবে না। কিন্তু লক্ষ্যটাকে বড় করার বহির্মুখীপনা, বাধা ডিঙাবার এই ইচ্ছাশক্তিটুকু আজ আমাদের বড় দরকার। পৃথিবীতে যারা সফল সেসব জাতির জীবনে এই ইচ্ছাশক্তির ভুমিকা রয়েছে। মুসার কাছেও চাওয়া সামান্যই, তিনি যেন তাঁর এই ভাবমূর্তি, এই সাফল্য ও সুনামকে দেশের সেই সব অগণিত মানুষের জন্য ব্যয় করেন, যারা তাঁকে ‘আমাদের ছেলে’ ভেবে আনন্দে আপ্লুত হয়েছে।
তরুণদের কেউ কেউ যেমন সব বাধার দেয়াল ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াবে, আবার তাদের জন্যই প্রয়োজন বেড়ে ওঠার মুক্ত পরিবেশ। তরুণদের বাড়তে দিন, দেশ বদলে যাবে। তখন জাতীয় সাফল্যের জন্য হিমালয় শিখরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, বাংলার নদীবিধৌত সমতলেই আমরা আমাদের আশার সমান হব।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
গান শেষ হলে ওই মেয়েটিকে বলতে শুনি, ‘দ্যাখো, বুকের মধ্যে কেমন দপদপ করছে না?’ শিশু দুটো কী বুঝল জানি না, মাথা নেড়ে বলল, ‘হ’। ‘বুঝলা’, মেয়েটি বলে, ‘যখনই তুমি দেশের কথা ভাববা, দেশকে ভালোবাসবা, তখন দেখবা বুকের মধ্যে এইরকম দপদপ করবে!’ হিমালয় শিখরে লাল-সুবজ পতাকা হাতে মুসা ইব্রাহীমের দাঁড়িয়ে থাকা দেখেও তো বুকের মধ্যে এমন গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছিল।
কিছু সাফল্য আছে যা সবাই মিলে উপভোগ করা যায়, আবার কিছু সাফল্য স্বার্থপর। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য। তাহলেও এই আনন্দের ভাগীদার হতে পারে এই দেশের এই জাতির যেকোনো মানুষ। কারণ, জয়টা ‘আমাদের ছেলের’। এ ‘আমরা’র মধ্যে দেশপ্রেম আছে, জাতীয়তাবাদ আছে, বীরবন্দনা আছে। তাই তাঁর তুলে ধরা জাতীয় পতাকার মধ্যে সবাই পায় দেশপ্রেমের আবেগে ভাসার অধিকার।
অন্যদিকে দুর্নীতির এভারেস্ট যারা জয় করেছে, যারা নিত্য জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে যাচ্ছে, তাদের পাপকর্মের দায় কেউই নিতে চাইবে না। ওগুলো এমন ‘সাফল্য’ ওই সফলদের ছাড়া যা আর কাউকে সুখী করে না। মুসা যেমন ‘আমাদের ছেলে’, তেমনি এসব চিহ্নিত-অচিহ্নিত অপরাধীরা ‘আমাদের কেউ নয়’। এই আমরা ‘জাতি’ আর সেই ‘তারা’ জাতীয় শত্রু।
এই ‘আমাদের’ শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতি ও জাতীয়তাবাদের প্রাণভোমরা। জাতীয়তাবাদী প্রেরণাতেই সামান্য মানুষও অসামান্য কাজ করতে পারে, অকাতরে প্রাণ দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধে। আবার এই জাতীয়তাবাদের নামেই সংকীর্ণতা, হিংসা, বর্ণবাদ ও মিথ্যা অহংকার সর্বনাশও ঘটায়। জাতীয়তাবাদ সম্ভব হতো না যদি না সর্বজনীন শিক্ষা, দেশময় যোগাযোগ-ব্যবস্থা এবং জাতীয় সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম না থাকত। একই লিখিত ভাষায় সব শিশু যদি দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ না করে, যোগাযোগের মাধ্যমে এক এলাকার মানুষের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষের চিন-পরিচয় না হলে এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিদিনকার জাতীয় দিনপঞ্জি যদি সবার জানা না হয়, তাহলে জাতি নামক ধারণাটি আকাশকুসুম হয়েই থাকে। সে জন্যই মধ্যযুগে জাতীয়তাবাদের দেখা মেলে না। পলাশীর ময়দানে সিরাজের পরাজয়ে বাঙালি জাতি পরাজিত বোধ করেছে বলে প্রমাণ নেই। কিন্তু আধুনিক যুগে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদকে বাদ দেওয়া কঠিন।
মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্টে আরোহণ যে জাতীয়তাবাদী ‘ঘটনা’ তা জানা গেল গণমাধ্যমে শোরগোলে। এভাবে একটি ঘটনার অদৃশ্য সুতায় সবাই বাঁধা পড়ায়, মুসা ইব্রাহীম তাঁর পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের ‘নায়ক’ থেকে পরিণত হন জাতীয় বীরে। তিনি হয়ে যান জননন্দিত ‘পাবলিক আইকন’।
জাতীয়তাবাদ যেমন বীর চায়, তেমনি চায় জাতীয় প্রতীক, জাতীয় পতাকা। এর মর্মে আছে, ‘আমরাও পারি’, ‘আমরাও পারবো’ এমন বিশ্বাস। আমেরিকার ১৩ বছরের কিশোর রোমেরোর সঙ্গে মুসার পার্থক্য এখানেই। রোমেরোর আগে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিকের পা এভারেস্টে পড়েছে। তাই মার্কিন দেশে রোমেরোকে ঘিরে তেমন আলোড়ন নেই। একই রকম কষ্ট, সাহসিকতা ও একই উচ্চতা পেরিয়েও একজন অন্যতম এবং অন্যজন অনন্য। প্রথম মার্কিন নভোচারীর চাঁদে পা রাখা কিংবা দুনিয়ার প্রধান পরাশক্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশকে পদানত করার ‘গর্ব’-এর মতো গর্বিত হওয়ার আকছার সুযোগ মার্কিনিদের রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশ, যা গরিব, যার অনেক মানুষেরই দুঃখের কোনো শেষ নেই, বিশ্বসভায় এখন কোনো দিক থেকেই যার আসন মর্যাদাকর নয়, যে দেশের খেলোয়াড়েরা কখনো বিশ্বকাপ জয় করেনি, চাঁদ তো দূরের কথা দারিদ্র্য কিংবা লুটপাট-মাফিয়াতন্ত্রকেই যারা জয় করতে পারেনি, তাদের জন্য মুসার এভারেস্ট আরোহণ এক চিলতে সুবাতাস বইকি!
এ রকমই ব্যক্তিগত সংকল্প, মেধা ও পরিশ্রমে আমাদের যুবপ্রজন্ম অনেক কিছুই করছে। কেউ বিদেশে নাম করছে, কেউ ডলার আনছে, কেউ দেশের মাটিতেই উদয়াস্ত খেটে উৎপাদন বাড়াচ্ছে, কেউ গাছ লাগাচ্ছে, কেউ বই পড়াচ্ছে, কেউ পরীক্ষায় ভালো করছে, কেউ পাখি বাঁচাচ্ছে, কেউ মানুষ বাঁচাচ্ছে। কৃষকেরা প্রতি বছর বাম্পার ফলন ফলাচ্ছে। এসবও এভারেস্ট জয়ের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ রকম অজস্র উদ্যোগী তরুণ দেশে আছে। বাড়তে দিলে আমাদের তরুণেরা অনেক বড় হতে পারে, মুসা তার প্রমাণ।
কিন্তু এ ধরনের সাফল্যগাথায় সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সর্বদাই এত নগণ্য কেন? অহেতুক মাতব্বরি, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক পাকেচক্রে সরকারি উদ্যোগে বড় সাফল্য দেখা যায় না। সরকারগুলোর এ অযোগ্যতার জন্যই ব্যক্তি সফল হলেও জাতি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে যায়। যিনি যেখানে ক্ষমতাবান, তিনি এবং তাঁর ওই ক্ষমতাই জনগণের ওপরে উঠে আসবার পথে বাধা। স্কুল-কলেজ, গ্রাম-পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সাপ-লুডু খেলার ছকের মতো অনেক প্রতিবন্ধক। পদে পদে অনেক সাপের মুখ আর অনেক মইয়ের সিঁড়ি পাতা। ভালো লোকেরা সে সব উন্নতির সিঁড়িতে কদাচিৎই পা রাখতে পারে, বরং তাদের ঠেলে ফেলা হয় হা করে থাকা সাপের গর্তে। এভাবে অনেকে ব্যর্থ হয়, বখে যায়, মাস্তান হয়, নেশা করে আর অপচয় হয়ে যায়। আর একদল এসবের মাঝখানে থেকে জীবন-জীবিকার জন্য ছুটতে থাকে। একটু ভালো থাকার চেষ্টা করতে করতেই তাদের মেধা-শ্রম-সম্পদ খরচ হয়ে যায়।
মুসা এই চক্রের মধ্যে আটকে না থেকে গন্তব্যকে অনেক বড় করে নিয়েছিলেন। সবাই তাঁর মতো করে নিশ্চয়ই পর্বতে উঠতে যাবে না। কিন্তু লক্ষ্যটাকে বড় করার বহির্মুখীপনা, বাধা ডিঙাবার এই ইচ্ছাশক্তিটুকু আজ আমাদের বড় দরকার। পৃথিবীতে যারা সফল সেসব জাতির জীবনে এই ইচ্ছাশক্তির ভুমিকা রয়েছে। মুসার কাছেও চাওয়া সামান্যই, তিনি যেন তাঁর এই ভাবমূর্তি, এই সাফল্য ও সুনামকে দেশের সেই সব অগণিত মানুষের জন্য ব্যয় করেন, যারা তাঁকে ‘আমাদের ছেলে’ ভেবে আনন্দে আপ্লুত হয়েছে।
তরুণদের কেউ কেউ যেমন সব বাধার দেয়াল ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াবে, আবার তাদের জন্যই প্রয়োজন বেড়ে ওঠার মুক্ত পরিবেশ। তরুণদের বাড়তে দিন, দেশ বদলে যাবে। তখন জাতীয় সাফল্যের জন্য হিমালয় শিখরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, বাংলার নদীবিধৌত সমতলেই আমরা আমাদের আশার সমান হব।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments