সহজিয়া কড়চা-বেগুনবাড়ি ও নিমতলী ট্র্যাজেডির রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো নির্মম ঘটনা ও অস্বাভাবিক মৃত্যুই এখন আর আমাদের স্তম্ভিত করে না। মনে হয়, সবই যেন স্বাভাবিক। যেন এমনটি ছাড়া অন্যকিছু হতে পারত না। একটি শিশু বা একটি বয়স্ক মানুষকে একটি বাস চাপা দিয়ে চলে গেল, কেউ তা দেখে হন্ হন্ করে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যায়।
একদল মানুষ হতভাগ্য লোকটির লাশটি কৌতূহল নিয়ে ভিড় করে দেখতে থাকে। তারা বিচলিত হয় না, যেন উপভোগ করে দৃশ্যটি। আর একদল কোত্থেকে দৌড়ে এসে চালায় ভাঙচুর। হাতের কাছে, আশপাশে যা পায় তা-ই। গাড়ি হোক, দোকানপাট অথবা কোনো ফুচকা বিক্রেতার ঠেলাগাড়ি। কেউ আগুন লাগাতে শুকনো পাতা ও খড়কুটোর সন্ধানে দিগ্বিদিক ছোটে। ভাঙচুরে অংশগ্রহণে লোকের অভাব হয় না। অথচ কোনো মর্মান্তিক ঘটনায় আমাদের হূদয়ের ভেতরে কোনো ভাঙাগড়া চলে না। যেমনটি আগে ছিলাম তেমনটি রয়ে যাই।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বেগুনবাড়িতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি পাঁচতলা বাড়ি হঠাৎ ভেঙে পাশের পাঁচটি টিনশেড বস্তিঘরের ওপর পড়ে যায়। তাতে চাপা পড়ে ওই ভবনের ও বস্তির ২৫ জন প্রাণ হারান।
বেগুনবাড়ির বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটার ৫০ ঘণ্টার মধ্যে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে আরেক ভয়াবহ ও অবর্ণনীয় বিয়োগান্ত ঘটনা। যে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখন দেশের সব মানুষই জেনে গেছে। সরকার তার রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু টাকা দিয়েছে এবং একটি শোক দিবস পালন করেছে। ওই দিন টিভি চ্যানেলগুলোতে কোরআন তেলাওয়াত হয়েছে, নজরুলের শোকের গান পরিবেশিত হয়েছে এবং জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ বাড়ির বাইরে পাবলিক অনুষ্ঠানে গেছেন পাঞ্জাবিতে একটুকরো কালো কাপড় আলপিন দিয়ে সেঁটে।
চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারি ও যানবাহনের মতো সংবাদপত্র ও রেডিও-টিভিও এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। ভাত, রুটি, তরকারিতে আমাদের পেট ভরে; পত্রিকা ও টিভির খবরে আমাদের মন ভরে। আমাদের এমনই নিয়তি যে সাংঘাতিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা অনবরত ঘটছেই। একটি ভয়াবহ ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই ঘটছে আরেকটি ভয়াবহতর ঘটনা। একটি ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ততদিন ব্যস্ত থাকে, যতদিন আর একটি ঘটনা না ঘটে।
৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে ১১৮ জন প্রাণ হারালে বেগুনবাড়ির ২৫ জনের মৃত্যুকে ছোট ঘটনা মনে হয়। বার্ন ইউনিটে ৩৯ জন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তাঁদের পরিণতি কী বলা সম্ভব নয়। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, চিন্তাশীল জাতি নই। আমাদের সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যেই একজন কবি বাস করেন। তাই আমাদের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও তথ্যের থেকে কবিতা থাকে বেশি। হার্ড নিউজের চেয়ে সাইড স্টোরি বেশি। সে জন্যই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাধান্য পেয়েছে দুই যুবক-যুবতীর বিয়ের হলুদের বা আকেদর ঘটনাটি। নগর আওয়ামী লীগের নেতারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘সকলের প্রতি’ আহ্বান জানিয়ে তাঁদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। আওয়ামী লীগের ডাকেই হোক বা নিজেদের গরজ থেকেই হোক, জামায়াতে ইসলামী ওই দুই বর-কনের ‘বিয়ের সব খরচ বহন করবে’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল। পর দিন তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উপলক্ষে দ্রুত বিভিন্ন সংগঠন ‘নানা কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে মহানগর জামায়াতে ইসলামী নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনার জন্য দোয়া মাহফিল করেছে। খিলগাঁওয়ে বেশ কয়েক গজ ‘মৌন পদযাত্রা’ও হয়েছে। মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-লেনিন-স্টালিনের অনুসারীরা ‘মুক্তাঙ্গনে শোক সমাবেশ ও শোভাযাত্রা’ করেছেন। ঢাকার বাইরেও মানববন্ধন হওয়ার খবর কাগজে এসেছে। মানববন্ধন আরও অনেক দিন হবে, বিএনপি দোয়া মাহফিলের ঘোষণা দিয়েছে। আগেই বলেছি আমাদের সবার মধ্যেই একজন কবি বাস করেন। সুতরাং এত বড় ঘটনায় কবিতা আবৃত্তি না হয়েই পারে না। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিরাটেরা শনিবার সকালে কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধন্যবাদ জানাই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, যাঁরা এক দিনের বেতনের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার চুপ করে বসে নেই। ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ সিআইডি। পাশাপাশি পিডিবির একটি টিমও একই উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছে।’ [যায়যায়দিন]
তদন্ত কমিটির সদস্যরা শনিবারও ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন’ এবং আলামত হিসেবে ওখানকার কিছু ছাইও সংগ্রহ করেছেন। ‘তাঁরা ১৯ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বক্তব্য রেকর্ড করেছেন।’ অর্থাৎ সরকারের দিক থেকে কাজে কোনো অবহেলা হয়েছে, তা বলার সাধ্য কারও নেই।
নিমতলীতে যা ঘটেছে, তা কোনো অপরাধ নয়—দুর্ঘটনা। ইসলামি জঙ্গিরা অন্য জায়গায় ঘোরাফেরা করলেও ওখানে সেদিন গিয়েছিল বলে মনে হয় না। যেখানে অপরাধ আছে, সেখানে আমাদের সিআইডির কর্মকর্তারা বিশেষ যান বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বখাটে যুবকদের অত্যাচারে দিনদুপুরে রাস্তার মধ্যে অসংখ্য মেয়ের জীবন বিপন্ন। সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে বহু কিশোরী। বহু মেয়ের অভিভাবকদেরও জীবন পর্যন্ত বিপন্ন। ওই সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে কাজ করার কোনো সিআইডি তদন্ত টিম নেই।
নিমতলীর ঘটনাটি সম্পর্কে কাগজে করুণ বর্ণনামূলক প্রতিবেদন আমরা পড়েছি। কবিত্বময় সেই রিপোর্ট পড়ে পাঠকদের মধ্যে হতভাগ্য ব্যক্তিদের জন্য শোক ও করুণার উদ্রেক হয়। কবিত্বহীন নিরেট গদ্যে লেখা সিআইডি ও অন্যান্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টও পাওয়া যাবে। মহানগরের মেয়র, রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারও কয়েক দিন টিভির খবরে তুমুল প্রচারিত হবে। এই যানজটের মধ্যেও টকশোতে অংশ নিতে সময় হাতে রেখে ছুটছেন অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে মানুষের কী লাভ?
সামান্য বিদ্যা-বুদ্ধিতে আমি যা বুঝি, তা হলো বেগুনবাড়ি ও নিমতলীর ঘটনা দুটি বিশ্লেষণের কাজ খবরের কাগজেরও নয়, পুলিশ অফিসারদেরও নয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের চেয়ারম্যান এবং ঢাকার মেয়রের এ ব্যাপারে কাজ সবচেয়ে বেশি। তবে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁদের মূল দায়িত্বের প্রতি তাঁরা বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেন না। এই যে তাঁদের মূল দায়িত্ব পালন না করা—তারই বা কারণ কী, সেটাও গবেষণার বিষয়।
বেগুনবাড়ি বা নিমতলীতে যাঁরা মারা গেছেন এবং যাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? কী তাঁদের জীবিকা? কেন তাঁরা বসবাসের জন্য ওই জায়গাগুলোই বেছে নিয়েছেন? ওখানে বসবাসের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন? তখন তাঁদের পেশা কী ছিল? এখন তাঁদের গড় আয়সীমা কত? তাঁদের পিতৃপুরুষদের আবাস ও পেশা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়া এই দুর্ঘটনার যে তদন্ত রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ দেবে তা হবে অর্থহীন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেন এবং তা বিশ্লেষণ করতে পারেন সমাজবিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ বেগুনবাড়ি বা নিমতলীর ঘটনার রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার।
আমাদের মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এক চমৎকার তত্ত্ব বের করেছেন। যা প্রধানমন্ত্রীরও অনুমোদন লাভ করেছে। অভিনব তত্ত্বটি হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়—আশীর্বাদ। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন জনসংখ্যা কমছে। বাংলাদেশের বাড়তি মানুষ আমরা ওই সব দেশে রপ্তানি বা চালান করব। তাতে আমরা এমন লাভবান হব, যা ফুলবাড়ীর ৯৬ ভাগ নয়, ১০০ ভাগ কয়লা রপ্তানি করেও সম্ভব নয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউকের এলাকায় এখন জনসংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি হবে। এত অল্প জায়গায় পৃথিবীর আর কোথাও এত বেশি মানুষ বাস করে না। ঢাকা নগর এখন আর একজন বাড়তি মানুষও ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ প্রতিদিন হাজারখানেক নতুন অতিথিকে এই নগর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এই নগর মহেঞ্জোদারো বা হরপ্পার মতো মরে যাবে। তখন আর এখানে কোনো মানুষ বাস করবে না। ঢাকার ধ্বংসস্তূপ দেখার জন্য প্রতিদিন কুর্মিটোলা ও ত্রিশাল বিমানবন্দরে শুধু পর্যটকেরা ভিড় করবেন।
আমাদের একশ্রেণীর ইতিহাসবিদ একটি মাত্র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলছেন, ঢাকার বয়স ৪০০ বছর। আমি বলি, ওটা ঢাকার রাজনৈতিক বয়স। ঢাকার আসল বয়স আরও অনেক বেশি। ঢাকার ৪০০ বছর অনেকটা ম্যাট্রিক পাস মানুষের সার্টিফিকেটের বয়সের মতো। ঢাকা কলকাতার চেয়ে মাত্র ১০০ বছরের বড় নয়, অন্তত ৩০০ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ। নিমতলীর যে জায়গাটিতে আগুন লেগেছে, ওই জায়গায় অবশ্য বসতি স্থাপন হয়েছে ৪০০ বছর আগে। তখন এবং ইংরেজ আমলেও ওখানে মানুষ ছিল হাতেগোনা, এখন ওই এলাকার মানুষ গুনে শেষ করা যাবে না।
ঢাকা সম্পর্কে কিছু কাগজপত্র আমি দেখেছিলাম, বহু বছর আগে চকবাজারের গলির মধ্যে হাকিম হাবিবুর রহমানের বাড়িতে একটি মরচেপড়া টিনের বাক্সে। তাঁর সংগ্রহের বহু আরবি-ফারসি বই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন। এই প্রাচীন মহানগরের ইতিহাস একদিকে গৌরবের, অন্যদিকে অতি করুণ। একদিকে এই নগর ভাগ্যবিড়ম্বিত, অন্যদিকে অতি ভাগ্যবান। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা এই উদ্দেশ্য থেকে ১৯০৩-০৪ সাল থেকেই ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। একদল অদূরদর্শী, স্বার্থপর ও হীনম্মন্য মানুষের ষড়যন্ত্রে নতুন প্রদেশ বানচাল হয়ে যায় ১৯১১ সালে। কিন্তু সাত বছরেই ঢাকার অসাধারণ উন্নয়ন হয়। তবে ১৯১২ সাল থেকে তা থেমে থাকে ‘বহু দিন।’
নতুন প্রদেশ গঠনের সময়—যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ, একবার ঢাকার উন্নতি হয়েছিল। বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা আবার প্রাণ ফিরে পায়। ওই সময় নিমতলী থেকে পলাশী পর্যন্ত নতুন নতুন পাকা বাড়িঘর উঠতে থাকে। যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিজেদের বাড়িতে অথবা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। দ্বিতীয়বার ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পনামাফিক উন্নতি হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যে ষাটের দশকে।
স্বাধীনতার পর সব ক্ষেত্রে যেমন নৈরাজ্য দেখা দেয়, তেমনি ঢাকা নগরও খেয়ালখুশি ও অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে। অথচ স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ার কথা ছিল তার বিপরীত। রাজধানীতে মানুষের স্বাভাবিক চাপ বাড়বেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে রাজধানী উন্নয়নের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা বা মাস্টার প্লান তৈরি করলেই হয় না। আরবান এরিয়া প্লান, ডিটেইল এরিয়া প্লান প্রভৃতি নিতান্তই কাগুজে ব্যাপার। তা ছাড়া যে দেশে এক সরকারের সঙ্গে আরেক সরকারের সম্পর্ক অহি-নকুল সেখানে কোনো ভালো পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
গত এক সপ্তাহে যে দেড় শ মানুষ দুর্ঘটনায় বীভৎসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই ঢাকায় এসেছিলেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়। তাঁরা চলে গেছেন, কিন্তু তাঁদের মতো লাখ লাখ মানুষ একই রকমভাবে মৃত্যুর পনের আনা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় রয়ে গেছেন। এই নগরের পুরান ঢাকায় ৫০ বর্গফুট ঘরে সাত-আটজন মানুষ বাস করে। শহরতলির নতুন এলাকায়ও এখন সব উঁচু বাড়ি নির্মিত হচ্ছে সরু গলির মধ্যে, যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। আগুন লাগলে নিমতলীর মতোই মুহূর্তে অগণিত মানুষ কয়লায় পরিণত হবে।
অত্যন্ত কষ্ট করে থেকেও সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা ঢাকায় ছিলেন এবং আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তে যাঁদের জীবনের শিখা নিভে গেল আসলে তাঁরা মারা যাননি। আমরা তাঁদের হত্যা করেছি। আমাদের রাষ্ট্র তাঁদের হত্যা করেছে। তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের সব সরকার।
কোনো কোনো করুণ ঘটনা জাতীয় জীবনে নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়। যেমন ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়। ওই দুর্যোগ আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের কেউ নয়। দুর্গত এলাকা সফর করে এসে মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে বললেন, ‘ওরা কেউ আসেনি।’ আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়তে হবে। তিনি বললেন, ‘জাতীয় সংহতির কথা বলা হয়। এই ন্যাশনাল ইনটেগ্রিটি বোগাস।’ তিনি স্লোগান দিলেন, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ। শামসুর রাহমানসহ দৈনিক পাকিস্তান-এর কারও কারও সঙ্গে আমিও স্টেডিয়ামের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। বিস্মিত কবির প্রশ্ন: মওলানা সাহেব এ কী বলছেন।
নিমতলীর ঘটনাটি একটি বড় সতর্ক সংকেত। পুরান ঢাকার ৫০ লাখ মানুষের জীবন চরম ঝুঁকিতে। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা বংশপরম্পরায় নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। তাঁরা শান্তিপ্রিয় ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করেন। এখন তাঁরা সংখ্যালঘু। গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি। ছোট ছোট কারখানায় কাজ করে লাখ লাখ মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই কিশোর। গ্রাম থেকে আসা মানুষ নাগরিক জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষও জানেন না, আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকার পার্থক্য কী? বিত্তবান ব্যক্তিরা আইনের পরোয়া করেন না। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি বানাবেন না। রাজউকের নজরদারির ব্যবস্থা যা আছে তা নামমাত্র। তার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা দুর্নীতিবাজ। সমস্যা সমাধানে অর্থবহ রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেই, যা আছে তা বায়বীয়।
অল্প বয়সে পাটুয়াটুলী ও লালবাগে ছিলাম। পুরান ঢাকা আমার প্রিয়। এখনো বাখরখানি কিনতে মাঝেমধ্যে নাজিমউদ্দিন রোড, নিমতলী প্রভৃতি মহল্লায় যাই। বদলে গেছে অনেক কিছু, তবু ভালো লাগে। শুক্রবার মোজাফফর আহমদ, বদিউল আলম মজুমদার ও আমি নিমতলী গিয়েছিলাম। আণবিক বোমায় পোড়া হিরোশিমা দেখিনি। দেখলাম নিমতলী। প্রবল বর্ষণের পরও নিমতলীর হতভাগ্য গলিটির অভিশপ্ত বাড়িগুলো থেকে বেরোচ্ছিল পোড়া গন্ধ। স্থানীয় মানুষের চোখে-মুখে, আতঙ্কের গভীর ছাপ। বেদনায় তাঁদের মুখ ফ্যাকাসে। কারও বা চোখে টলমল করে পানি।
আর একটি বড় কিছু না ঘটা পর্যন্ত নিমতলী নিয়ে লেখালেখি হবে। তারপর আমার ভুলে যাব ১১৮টি জীবনের কথা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সংসারগুলোর কথা। যেমন আমরা ভুলে গেছি পিলখানার কথা। আমাদের চরিত্রের মূল জায়গায় গলদ রয়েছে। আমরা আত্মপ্রবঞ্চনা পছন্দ করি। প্রচারমাধ্যমের প্রাচুর্যে আজ একশ্রেণীর মানুষ কিছু কিছু কাজ করতে উৎসাহিত হচ্ছে। যেকোনো উপলক্ষে মিনিট পনের মানববন্ধন, ২০০ গজ পদযাত্রা, দেড় শ গজ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, দোয়া মাহফিল, রুহের মাগফিরাত কামনা, কবিতা আবৃত্তি প্রভৃতি। আমরা মানুষকে দেখাই আমরা দায়িত্ব পালন করছি।
পশ্চিমের সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক দর্শনের পণ্ডিতেরা মানুষের জীবন ও সমাজ নিয়ে গভীর কাজ করছেন শত শত বছর ধরে। মানুষ অতি বুদ্ধিমান ও বিশেষ শারীরিক গঠনবিশিষ্ট জীব। অন্য প্রাণীর চেয়ে তার চিন্তা ও ভাবাবেগের ধরন ভিন্ন। বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর চিন্তা, ভাবাবেগ কাজের ধরনও আলাদা। কেন তা আলাদা সেটা সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণের বিষয়। সিআইডি বা ডিটেকটিভ পুলিশের রিপোর্টে তা ধরা পড়ে না।
কেন উঁচু ভবন হেলে পড়ে, দোতলার ভিত্তির ওপর কেন সাততলা ওঠে, নতুন ২২ তলা ভবনে কেন ফাটল দেখা দেয়, যে বাড়িতে থাকার কথা ১০ জনের, সেখানে কেন ৪৫ জন গাদাগাদি করে থাকে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেন দাহ্য পদার্থের গুদাম এবং তার পাশেই কেন চা-দোকানের চুলা, কেন প্রতিদিন বাস-ট্রাক মানুষ চাপা দেয়, গ্রাম থেকে কেন মানুষ ঢাকায় ছুটছে—এসব নিয়ে যদি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ না হয়, নিমতলীর চেয়েও বড় দুর্ঘটনা আমরা ঠেকাতে পারব না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বেগুনবাড়িতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি পাঁচতলা বাড়ি হঠাৎ ভেঙে পাশের পাঁচটি টিনশেড বস্তিঘরের ওপর পড়ে যায়। তাতে চাপা পড়ে ওই ভবনের ও বস্তির ২৫ জন প্রাণ হারান।
বেগুনবাড়ির বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটার ৫০ ঘণ্টার মধ্যে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে আরেক ভয়াবহ ও অবর্ণনীয় বিয়োগান্ত ঘটনা। যে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখন দেশের সব মানুষই জেনে গেছে। সরকার তার রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু টাকা দিয়েছে এবং একটি শোক দিবস পালন করেছে। ওই দিন টিভি চ্যানেলগুলোতে কোরআন তেলাওয়াত হয়েছে, নজরুলের শোকের গান পরিবেশিত হয়েছে এবং জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ বাড়ির বাইরে পাবলিক অনুষ্ঠানে গেছেন পাঞ্জাবিতে একটুকরো কালো কাপড় আলপিন দিয়ে সেঁটে।
চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারি ও যানবাহনের মতো সংবাদপত্র ও রেডিও-টিভিও এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। ভাত, রুটি, তরকারিতে আমাদের পেট ভরে; পত্রিকা ও টিভির খবরে আমাদের মন ভরে। আমাদের এমনই নিয়তি যে সাংঘাতিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা অনবরত ঘটছেই। একটি ভয়াবহ ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই ঘটছে আরেকটি ভয়াবহতর ঘটনা। একটি ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ততদিন ব্যস্ত থাকে, যতদিন আর একটি ঘটনা না ঘটে।
৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে ১১৮ জন প্রাণ হারালে বেগুনবাড়ির ২৫ জনের মৃত্যুকে ছোট ঘটনা মনে হয়। বার্ন ইউনিটে ৩৯ জন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তাঁদের পরিণতি কী বলা সম্ভব নয়। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, চিন্তাশীল জাতি নই। আমাদের সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যেই একজন কবি বাস করেন। তাই আমাদের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও তথ্যের থেকে কবিতা থাকে বেশি। হার্ড নিউজের চেয়ে সাইড স্টোরি বেশি। সে জন্যই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাধান্য পেয়েছে দুই যুবক-যুবতীর বিয়ের হলুদের বা আকেদর ঘটনাটি। নগর আওয়ামী লীগের নেতারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘সকলের প্রতি’ আহ্বান জানিয়ে তাঁদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। আওয়ামী লীগের ডাকেই হোক বা নিজেদের গরজ থেকেই হোক, জামায়াতে ইসলামী ওই দুই বর-কনের ‘বিয়ের সব খরচ বহন করবে’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল। পর দিন তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উপলক্ষে দ্রুত বিভিন্ন সংগঠন ‘নানা কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে মহানগর জামায়াতে ইসলামী নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনার জন্য দোয়া মাহফিল করেছে। খিলগাঁওয়ে বেশ কয়েক গজ ‘মৌন পদযাত্রা’ও হয়েছে। মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-লেনিন-স্টালিনের অনুসারীরা ‘মুক্তাঙ্গনে শোক সমাবেশ ও শোভাযাত্রা’ করেছেন। ঢাকার বাইরেও মানববন্ধন হওয়ার খবর কাগজে এসেছে। মানববন্ধন আরও অনেক দিন হবে, বিএনপি দোয়া মাহফিলের ঘোষণা দিয়েছে। আগেই বলেছি আমাদের সবার মধ্যেই একজন কবি বাস করেন। সুতরাং এত বড় ঘটনায় কবিতা আবৃত্তি না হয়েই পারে না। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিরাটেরা শনিবার সকালে কবিতাও আবৃত্তি করেছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধন্যবাদ জানাই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, যাঁরা এক দিনের বেতনের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার চুপ করে বসে নেই। ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ সিআইডি। পাশাপাশি পিডিবির একটি টিমও একই উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছে।’ [যায়যায়দিন]
তদন্ত কমিটির সদস্যরা শনিবারও ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন’ এবং আলামত হিসেবে ওখানকার কিছু ছাইও সংগ্রহ করেছেন। ‘তাঁরা ১৯ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বক্তব্য রেকর্ড করেছেন।’ অর্থাৎ সরকারের দিক থেকে কাজে কোনো অবহেলা হয়েছে, তা বলার সাধ্য কারও নেই।
নিমতলীতে যা ঘটেছে, তা কোনো অপরাধ নয়—দুর্ঘটনা। ইসলামি জঙ্গিরা অন্য জায়গায় ঘোরাফেরা করলেও ওখানে সেদিন গিয়েছিল বলে মনে হয় না। যেখানে অপরাধ আছে, সেখানে আমাদের সিআইডির কর্মকর্তারা বিশেষ যান বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বখাটে যুবকদের অত্যাচারে দিনদুপুরে রাস্তার মধ্যে অসংখ্য মেয়ের জীবন বিপন্ন। সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে বহু কিশোরী। বহু মেয়ের অভিভাবকদেরও জীবন পর্যন্ত বিপন্ন। ওই সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে কাজ করার কোনো সিআইডি তদন্ত টিম নেই।
নিমতলীর ঘটনাটি সম্পর্কে কাগজে করুণ বর্ণনামূলক প্রতিবেদন আমরা পড়েছি। কবিত্বময় সেই রিপোর্ট পড়ে পাঠকদের মধ্যে হতভাগ্য ব্যক্তিদের জন্য শোক ও করুণার উদ্রেক হয়। কবিত্বহীন নিরেট গদ্যে লেখা সিআইডি ও অন্যান্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টও পাওয়া যাবে। মহানগরের মেয়র, রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারও কয়েক দিন টিভির খবরে তুমুল প্রচারিত হবে। এই যানজটের মধ্যেও টকশোতে অংশ নিতে সময় হাতে রেখে ছুটছেন অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে মানুষের কী লাভ?
সামান্য বিদ্যা-বুদ্ধিতে আমি যা বুঝি, তা হলো বেগুনবাড়ি ও নিমতলীর ঘটনা দুটি বিশ্লেষণের কাজ খবরের কাগজেরও নয়, পুলিশ অফিসারদেরও নয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের চেয়ারম্যান এবং ঢাকার মেয়রের এ ব্যাপারে কাজ সবচেয়ে বেশি। তবে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁদের মূল দায়িত্বের প্রতি তাঁরা বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেন না। এই যে তাঁদের মূল দায়িত্ব পালন না করা—তারই বা কারণ কী, সেটাও গবেষণার বিষয়।
বেগুনবাড়ি বা নিমতলীতে যাঁরা মারা গেছেন এবং যাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? কী তাঁদের জীবিকা? কেন তাঁরা বসবাসের জন্য ওই জায়গাগুলোই বেছে নিয়েছেন? ওখানে বসবাসের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন? তখন তাঁদের পেশা কী ছিল? এখন তাঁদের গড় আয়সীমা কত? তাঁদের পিতৃপুরুষদের আবাস ও পেশা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়া এই দুর্ঘটনার যে তদন্ত রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ দেবে তা হবে অর্থহীন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেন এবং তা বিশ্লেষণ করতে পারেন সমাজবিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ বেগুনবাড়ি বা নিমতলীর ঘটনার রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার।
আমাদের মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এক চমৎকার তত্ত্ব বের করেছেন। যা প্রধানমন্ত্রীরও অনুমোদন লাভ করেছে। অভিনব তত্ত্বটি হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়—আশীর্বাদ। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন জনসংখ্যা কমছে। বাংলাদেশের বাড়তি মানুষ আমরা ওই সব দেশে রপ্তানি বা চালান করব। তাতে আমরা এমন লাভবান হব, যা ফুলবাড়ীর ৯৬ ভাগ নয়, ১০০ ভাগ কয়লা রপ্তানি করেও সম্ভব নয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউকের এলাকায় এখন জনসংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি হবে। এত অল্প জায়গায় পৃথিবীর আর কোথাও এত বেশি মানুষ বাস করে না। ঢাকা নগর এখন আর একজন বাড়তি মানুষও ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ প্রতিদিন হাজারখানেক নতুন অতিথিকে এই নগর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এই নগর মহেঞ্জোদারো বা হরপ্পার মতো মরে যাবে। তখন আর এখানে কোনো মানুষ বাস করবে না। ঢাকার ধ্বংসস্তূপ দেখার জন্য প্রতিদিন কুর্মিটোলা ও ত্রিশাল বিমানবন্দরে শুধু পর্যটকেরা ভিড় করবেন।
আমাদের একশ্রেণীর ইতিহাসবিদ একটি মাত্র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলছেন, ঢাকার বয়স ৪০০ বছর। আমি বলি, ওটা ঢাকার রাজনৈতিক বয়স। ঢাকার আসল বয়স আরও অনেক বেশি। ঢাকার ৪০০ বছর অনেকটা ম্যাট্রিক পাস মানুষের সার্টিফিকেটের বয়সের মতো। ঢাকা কলকাতার চেয়ে মাত্র ১০০ বছরের বড় নয়, অন্তত ৩০০ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ। নিমতলীর যে জায়গাটিতে আগুন লেগেছে, ওই জায়গায় অবশ্য বসতি স্থাপন হয়েছে ৪০০ বছর আগে। তখন এবং ইংরেজ আমলেও ওখানে মানুষ ছিল হাতেগোনা, এখন ওই এলাকার মানুষ গুনে শেষ করা যাবে না।
ঢাকা সম্পর্কে কিছু কাগজপত্র আমি দেখেছিলাম, বহু বছর আগে চকবাজারের গলির মধ্যে হাকিম হাবিবুর রহমানের বাড়িতে একটি মরচেপড়া টিনের বাক্সে। তাঁর সংগ্রহের বহু আরবি-ফারসি বই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন। এই প্রাচীন মহানগরের ইতিহাস একদিকে গৌরবের, অন্যদিকে অতি করুণ। একদিকে এই নগর ভাগ্যবিড়ম্বিত, অন্যদিকে অতি ভাগ্যবান। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা এই উদ্দেশ্য থেকে ১৯০৩-০৪ সাল থেকেই ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। একদল অদূরদর্শী, স্বার্থপর ও হীনম্মন্য মানুষের ষড়যন্ত্রে নতুন প্রদেশ বানচাল হয়ে যায় ১৯১১ সালে। কিন্তু সাত বছরেই ঢাকার অসাধারণ উন্নয়ন হয়। তবে ১৯১২ সাল থেকে তা থেমে থাকে ‘বহু দিন।’
নতুন প্রদেশ গঠনের সময়—যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ, একবার ঢাকার উন্নতি হয়েছিল। বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা আবার প্রাণ ফিরে পায়। ওই সময় নিমতলী থেকে পলাশী পর্যন্ত নতুন নতুন পাকা বাড়িঘর উঠতে থাকে। যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিজেদের বাড়িতে অথবা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। দ্বিতীয়বার ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পনামাফিক উন্নতি হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যে ষাটের দশকে।
স্বাধীনতার পর সব ক্ষেত্রে যেমন নৈরাজ্য দেখা দেয়, তেমনি ঢাকা নগরও খেয়ালখুশি ও অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে। অথচ স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ার কথা ছিল তার বিপরীত। রাজধানীতে মানুষের স্বাভাবিক চাপ বাড়বেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে রাজধানী উন্নয়নের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা বা মাস্টার প্লান তৈরি করলেই হয় না। আরবান এরিয়া প্লান, ডিটেইল এরিয়া প্লান প্রভৃতি নিতান্তই কাগুজে ব্যাপার। তা ছাড়া যে দেশে এক সরকারের সঙ্গে আরেক সরকারের সম্পর্ক অহি-নকুল সেখানে কোনো ভালো পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
গত এক সপ্তাহে যে দেড় শ মানুষ দুর্ঘটনায় বীভৎসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই ঢাকায় এসেছিলেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়। তাঁরা চলে গেছেন, কিন্তু তাঁদের মতো লাখ লাখ মানুষ একই রকমভাবে মৃত্যুর পনের আনা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় রয়ে গেছেন। এই নগরের পুরান ঢাকায় ৫০ বর্গফুট ঘরে সাত-আটজন মানুষ বাস করে। শহরতলির নতুন এলাকায়ও এখন সব উঁচু বাড়ি নির্মিত হচ্ছে সরু গলির মধ্যে, যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। আগুন লাগলে নিমতলীর মতোই মুহূর্তে অগণিত মানুষ কয়লায় পরিণত হবে।
অত্যন্ত কষ্ট করে থেকেও সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা ঢাকায় ছিলেন এবং আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তে যাঁদের জীবনের শিখা নিভে গেল আসলে তাঁরা মারা যাননি। আমরা তাঁদের হত্যা করেছি। আমাদের রাষ্ট্র তাঁদের হত্যা করেছে। তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের সব সরকার।
কোনো কোনো করুণ ঘটনা জাতীয় জীবনে নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়। যেমন ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়। ওই দুর্যোগ আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের কেউ নয়। দুর্গত এলাকা সফর করে এসে মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে বললেন, ‘ওরা কেউ আসেনি।’ আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়তে হবে। তিনি বললেন, ‘জাতীয় সংহতির কথা বলা হয়। এই ন্যাশনাল ইনটেগ্রিটি বোগাস।’ তিনি স্লোগান দিলেন, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ। শামসুর রাহমানসহ দৈনিক পাকিস্তান-এর কারও কারও সঙ্গে আমিও স্টেডিয়ামের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। বিস্মিত কবির প্রশ্ন: মওলানা সাহেব এ কী বলছেন।
নিমতলীর ঘটনাটি একটি বড় সতর্ক সংকেত। পুরান ঢাকার ৫০ লাখ মানুষের জীবন চরম ঝুঁকিতে। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা বংশপরম্পরায় নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। তাঁরা শান্তিপ্রিয় ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করেন। এখন তাঁরা সংখ্যালঘু। গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি। ছোট ছোট কারখানায় কাজ করে লাখ লাখ মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই কিশোর। গ্রাম থেকে আসা মানুষ নাগরিক জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষও জানেন না, আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকার পার্থক্য কী? বিত্তবান ব্যক্তিরা আইনের পরোয়া করেন না। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি বানাবেন না। রাজউকের নজরদারির ব্যবস্থা যা আছে তা নামমাত্র। তার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা দুর্নীতিবাজ। সমস্যা সমাধানে অর্থবহ রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেই, যা আছে তা বায়বীয়।
অল্প বয়সে পাটুয়াটুলী ও লালবাগে ছিলাম। পুরান ঢাকা আমার প্রিয়। এখনো বাখরখানি কিনতে মাঝেমধ্যে নাজিমউদ্দিন রোড, নিমতলী প্রভৃতি মহল্লায় যাই। বদলে গেছে অনেক কিছু, তবু ভালো লাগে। শুক্রবার মোজাফফর আহমদ, বদিউল আলম মজুমদার ও আমি নিমতলী গিয়েছিলাম। আণবিক বোমায় পোড়া হিরোশিমা দেখিনি। দেখলাম নিমতলী। প্রবল বর্ষণের পরও নিমতলীর হতভাগ্য গলিটির অভিশপ্ত বাড়িগুলো থেকে বেরোচ্ছিল পোড়া গন্ধ। স্থানীয় মানুষের চোখে-মুখে, আতঙ্কের গভীর ছাপ। বেদনায় তাঁদের মুখ ফ্যাকাসে। কারও বা চোখে টলমল করে পানি।
আর একটি বড় কিছু না ঘটা পর্যন্ত নিমতলী নিয়ে লেখালেখি হবে। তারপর আমার ভুলে যাব ১১৮টি জীবনের কথা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সংসারগুলোর কথা। যেমন আমরা ভুলে গেছি পিলখানার কথা। আমাদের চরিত্রের মূল জায়গায় গলদ রয়েছে। আমরা আত্মপ্রবঞ্চনা পছন্দ করি। প্রচারমাধ্যমের প্রাচুর্যে আজ একশ্রেণীর মানুষ কিছু কিছু কাজ করতে উৎসাহিত হচ্ছে। যেকোনো উপলক্ষে মিনিট পনের মানববন্ধন, ২০০ গজ পদযাত্রা, দেড় শ গজ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, দোয়া মাহফিল, রুহের মাগফিরাত কামনা, কবিতা আবৃত্তি প্রভৃতি। আমরা মানুষকে দেখাই আমরা দায়িত্ব পালন করছি।
পশ্চিমের সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক দর্শনের পণ্ডিতেরা মানুষের জীবন ও সমাজ নিয়ে গভীর কাজ করছেন শত শত বছর ধরে। মানুষ অতি বুদ্ধিমান ও বিশেষ শারীরিক গঠনবিশিষ্ট জীব। অন্য প্রাণীর চেয়ে তার চিন্তা ও ভাবাবেগের ধরন ভিন্ন। বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর চিন্তা, ভাবাবেগ কাজের ধরনও আলাদা। কেন তা আলাদা সেটা সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণের বিষয়। সিআইডি বা ডিটেকটিভ পুলিশের রিপোর্টে তা ধরা পড়ে না।
কেন উঁচু ভবন হেলে পড়ে, দোতলার ভিত্তির ওপর কেন সাততলা ওঠে, নতুন ২২ তলা ভবনে কেন ফাটল দেখা দেয়, যে বাড়িতে থাকার কথা ১০ জনের, সেখানে কেন ৪৫ জন গাদাগাদি করে থাকে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেন দাহ্য পদার্থের গুদাম এবং তার পাশেই কেন চা-দোকানের চুলা, কেন প্রতিদিন বাস-ট্রাক মানুষ চাপা দেয়, গ্রাম থেকে কেন মানুষ ঢাকায় ছুটছে—এসব নিয়ে যদি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ না হয়, নিমতলীর চেয়েও বড় দুর্ঘটনা আমরা ঠেকাতে পারব না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments