বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১০-জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবীই আমাদের স্বপ্ন by ফায়জুল আজিম
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আটত্রিশতমবারের মতো দিনটি পালন করতে যাচ্ছে পৃথিবীবাসী। ১৯৭৩ সালের আগে পরিবেশ নিয়ে দিবস পালন করার কথা কেউ ভাবেনি। এমনকি জাতিসংঘও না। মোটামুটি ২০০ বছর আগেও গাছপালা-নদী-বাতাস-মাটি-আবহাওয়া ও দূষণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
আঠারো শতকের শিল্পবিপ্লব এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি—এ দুটো কারণে প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যায় অতিমাত্রায়। ফলে কোনো বাছবিচার না করেই প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণের পর্ব চলতে থাকে। খুব বেশি দিন লাগেনি। শ-খানেক বছরের মধ্যে বিপদের আশঙ্কা টের পাওয়া যায়।
প্রথমে বিজ্ঞানীরা তথ্য-উপাত্ত জড় করে আসন্ন ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন। শুরুতে কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি। ধীরে ধীরে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবং হরেক রকম পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় টনক নড়ে। পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারক-রাষ্ট্রনায়ক পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। একটা কিছু করতেই হবে এমন মনোভাব নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে ৫ থেকে ১৬ জুন ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে অনুষ্ঠিত হয়, যা স্টকহোম সম্মেলন নামেই পরিচিত। পরিবেশ বিষয়ে এটিই প্রথম আয়োজিত বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলন থেকেই দুনিয়াজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা হয়। সে বছরের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২১১২তম সভায় প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয় পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্টকহোম সম্মেলনের নীতিমালা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার। তার পর থেকে প্রতিবছর দুনিয়াজুড়ে জাতিসংঘের ‘পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি’ নামের সংগঠনটির উদ্যোগে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Many Species. One Planet. One Future’। সুন্দর শব্দচয়নে বাংলা করা হয় ‘জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবীই আমাদের স্বপ্ন’। রিও সম্মেলনে গৃহীত (বাংলাদেশও অন্যতম স্বাক্ষরকারী) সংজ্ঞা অনুসারে স্থল, সমুদ্র, জলভাগ প্রতিবেশসহ সব এলাকার জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যই হলো জীববৈচিত্র্য। ব্যাপক দূষণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার দরুন পরিবর্তিত জলবায়ুতে জীববৈচিত্র্য আজ বিপন্ন। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা ভারসাম্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্য মানুষের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি ২০ মিনিটে ধরণীর বুক থেকে চিরবিদায় নিচ্ছে কোনো না কোনো জীবপ্রজাতি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামনে রেখে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে প্রচারণা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই বছরটিকে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য বর্ষ’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। সব ধরনের প্রাণিকুলের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই আমাদের আজকের স্বপ্ন: ‘জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবী’।
এ বছর স্বাগতিক শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে রুয়ান্ডা সিটি। ‘হাজার পাহাড়ের দেশ নামে খ্যাত পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার রাজধানী শহর। পাহাড়-পর্বতে ঘেরা সবুজ দেশটি সমৃদ্ধ পরিবেশগত সম্পদ দ্বারা। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিজ সম্পদও রয়েছে প্রচুর। প্রায় ৭৫০টি পাহাড়ি গরিলা আছে, যা বিশ্ব বিবেচনায় তৃতীয়। ১৫১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৬৭০ প্রজাতির পাখির জীববৈচিত্র্য নিয়েই রুয়ান্ডা। নতুন করে গ্রহণ করেছে সবুজায়নের নীতিমালা। রুয়ান্ডা ইতিমধ্যে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। জ্বালানি সংগ্রহের জন্য সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, মিথেনগ্যাস প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক বাদল বন (Rain Forest) সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্যই রুয়ান্ডা লাভ করেছে ২০১০ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্বাগতিক হওয়ার গৌরব। আর দেশটিও মেতে উঠেছে সবুজ আন্দোলনে।
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত পৃথিবীতে মোটামুটি ৪৫ হাজার স্তন্যপায়ী, ১৫ হাজার সরীসৃপ ও উভচর, নয় হাজার পাখি ও ২১ হাজার মাছের প্রজাতি নথিভুক্ত করেছেন। এর মধ্যে গত ২০০ বছরে প্রায় দুই শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং এক শতাংশের বেশি পাখির প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেছে। একসময় সমৃদ্ধ আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য আজ চরম হুমকির মুখে আছে। বাংলাদশে কম করে পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, মাছসহ ৭০৮ প্রজাতির জলচর প্রাণী, ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব এবং ৩৮৮ প্রজাতির পাখি আছে। গত কয়েক বছরে আমাদের পরিবেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতির জীবজন্তু ও উদ্ভিদ। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট, বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মনুষ্যসৃষ্ট বিরূপ পরিবেশের কারণে ইতিমধ্যে ১৩ প্রজাতির প্রাণী আমরা হারিয়েছি। হুমকির মুখে আছে প্রায় ৮০০ প্রজাতি। হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর মধ্যে রায়েছে: ময়ূর, কুমির, নেকড়ে, বুনো মহিষ, নীলগাই ও গন্ডার। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ধীরে ধীরে আরও ১৫০ প্রজাতির প্রাণী যোগ দেবে হারিয়ে যাওয়ার মিছিলে।
জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতার একটা কারণ কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার বিবরণ এবং পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। এগুলোর মাধ্যমে প্রকল্পটির কারণে পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিরূপণ করা সম্ভব। যদি কোনো পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ওপর অসমাধানযোগ্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে, তাহলে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের জন্য পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং অবস্থা অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোকে সবুজ, কমলা-ক, কমলা-খ ও লাল—এই চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেবল লাল শ্রেণীর শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোর জন্যই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুষ্ঠু সংরক্ষণের জন্য সব শ্রেণীর শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোর জন্যই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় হয়তো কিছুটা বাড়বে। কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুষ্ঠু সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে ওই বাড়তি ব্যয় আমাদের মেনে নেওয়াই উচিত। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
এই গ্রহের পরিবেশকে মানুষ ও প্রাণিজগতের জন্য বাসযোগ্য রাখতে কাজ করে যাওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। অনাদিকাল থেকে আমাদের সবুজ গ্রহটি ছিল প্রাণিকুলের এক চমৎকার আবাস। দীর্ঘদিন একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরম শান্তিতে বসবাস করেছে। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্যের সীমা লঙ্ঘন করে চলেছে। এতে ক্রমশ এই পৃথিবী হয়ে উঠছে প্রাণিকুলের বসবাসের অযোগ্য। এখনই সতর্ক হওয়ার সময়। নতুবা চরম মূল্য দিতে হবে। সুতরাং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প আমদের সামনে নেই।
ফায়জুল আজিম: বিচারক, ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ আদালত।
azimfowzul@yahoo.com
প্রথমে বিজ্ঞানীরা তথ্য-উপাত্ত জড় করে আসন্ন ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন। শুরুতে কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি। ধীরে ধীরে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবং হরেক রকম পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় টনক নড়ে। পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারক-রাষ্ট্রনায়ক পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। একটা কিছু করতেই হবে এমন মনোভাব নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে ৫ থেকে ১৬ জুন ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে অনুষ্ঠিত হয়, যা স্টকহোম সম্মেলন নামেই পরিচিত। পরিবেশ বিষয়ে এটিই প্রথম আয়োজিত বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলন থেকেই দুনিয়াজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা হয়। সে বছরের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২১১২তম সভায় প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয় পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্টকহোম সম্মেলনের নীতিমালা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার। তার পর থেকে প্রতিবছর দুনিয়াজুড়ে জাতিসংঘের ‘পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি’ নামের সংগঠনটির উদ্যোগে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Many Species. One Planet. One Future’। সুন্দর শব্দচয়নে বাংলা করা হয় ‘জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবীই আমাদের স্বপ্ন’। রিও সম্মেলনে গৃহীত (বাংলাদেশও অন্যতম স্বাক্ষরকারী) সংজ্ঞা অনুসারে স্থল, সমুদ্র, জলভাগ প্রতিবেশসহ সব এলাকার জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যই হলো জীববৈচিত্র্য। ব্যাপক দূষণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার দরুন পরিবর্তিত জলবায়ুতে জীববৈচিত্র্য আজ বিপন্ন। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা ভারসাম্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্য মানুষের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি ২০ মিনিটে ধরণীর বুক থেকে চিরবিদায় নিচ্ছে কোনো না কোনো জীবপ্রজাতি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামনে রেখে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে প্রচারণা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই বছরটিকে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য বর্ষ’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। সব ধরনের প্রাণিকুলের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই আমাদের আজকের স্বপ্ন: ‘জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি পৃথিবী’।
এ বছর স্বাগতিক শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে রুয়ান্ডা সিটি। ‘হাজার পাহাড়ের দেশ নামে খ্যাত পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার রাজধানী শহর। পাহাড়-পর্বতে ঘেরা সবুজ দেশটি সমৃদ্ধ পরিবেশগত সম্পদ দ্বারা। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিজ সম্পদও রয়েছে প্রচুর। প্রায় ৭৫০টি পাহাড়ি গরিলা আছে, যা বিশ্ব বিবেচনায় তৃতীয়। ১৫১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৬৭০ প্রজাতির পাখির জীববৈচিত্র্য নিয়েই রুয়ান্ডা। নতুন করে গ্রহণ করেছে সবুজায়নের নীতিমালা। রুয়ান্ডা ইতিমধ্যে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। জ্বালানি সংগ্রহের জন্য সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, মিথেনগ্যাস প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক বাদল বন (Rain Forest) সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্যই রুয়ান্ডা লাভ করেছে ২০১০ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্বাগতিক হওয়ার গৌরব। আর দেশটিও মেতে উঠেছে সবুজ আন্দোলনে।
বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত পৃথিবীতে মোটামুটি ৪৫ হাজার স্তন্যপায়ী, ১৫ হাজার সরীসৃপ ও উভচর, নয় হাজার পাখি ও ২১ হাজার মাছের প্রজাতি নথিভুক্ত করেছেন। এর মধ্যে গত ২০০ বছরে প্রায় দুই শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং এক শতাংশের বেশি পাখির প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেছে। একসময় সমৃদ্ধ আমাদের দেশেও জীববৈচিত্র্য আজ চরম হুমকির মুখে আছে। বাংলাদশে কম করে পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, মাছসহ ৭০৮ প্রজাতির জলচর প্রাণী, ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব এবং ৩৮৮ প্রজাতির পাখি আছে। গত কয়েক বছরে আমাদের পরিবেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতির জীবজন্তু ও উদ্ভিদ। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট, বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মনুষ্যসৃষ্ট বিরূপ পরিবেশের কারণে ইতিমধ্যে ১৩ প্রজাতির প্রাণী আমরা হারিয়েছি। হুমকির মুখে আছে প্রায় ৮০০ প্রজাতি। হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর মধ্যে রায়েছে: ময়ূর, কুমির, নেকড়ে, বুনো মহিষ, নীলগাই ও গন্ডার। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ধীরে ধীরে আরও ১৫০ প্রজাতির প্রাণী যোগ দেবে হারিয়ে যাওয়ার মিছিলে।
জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতার একটা কারণ কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার বিবরণ এবং পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। এগুলোর মাধ্যমে প্রকল্পটির কারণে পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিরূপণ করা সম্ভব। যদি কোনো পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ওপর অসমাধানযোগ্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে, তাহলে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের জন্য পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং অবস্থা অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোকে সবুজ, কমলা-ক, কমলা-খ ও লাল—এই চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেবল লাল শ্রেণীর শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোর জন্যই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুষ্ঠু সংরক্ষণের জন্য সব শ্রেণীর শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোর জন্যই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় হয়তো কিছুটা বাড়বে। কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুষ্ঠু সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে ওই বাড়তি ব্যয় আমাদের মেনে নেওয়াই উচিত। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
এই গ্রহের পরিবেশকে মানুষ ও প্রাণিজগতের জন্য বাসযোগ্য রাখতে কাজ করে যাওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। অনাদিকাল থেকে আমাদের সবুজ গ্রহটি ছিল প্রাণিকুলের এক চমৎকার আবাস। দীর্ঘদিন একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরম শান্তিতে বসবাস করেছে। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্যের সীমা লঙ্ঘন করে চলেছে। এতে ক্রমশ এই পৃথিবী হয়ে উঠছে প্রাণিকুলের বসবাসের অযোগ্য। এখনই সতর্ক হওয়ার সময়। নতুবা চরম মূল্য দিতে হবে। সুতরাং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প আমদের সামনে নেই।
ফায়জুল আজিম: বিচারক, ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ আদালত।
azimfowzul@yahoo.com
No comments