রাসায়নিক মরণফাঁদ-শুধু তদন্ত নয়, এক্ষুনি কাজ শুরু করতে হবে by ফরিদা আখতার

বেগুনবাড়ি থেকে নিমতলীর দূরত্ব ছয় কিলোমিটারের মতো। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে দুটো এলাকার দুই ধরনের ঘটনা পুরো ঢাকা শহরকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতের খবর দেখছিলাম টেলিভিশনে। বেগুনবাড়ির ত্রুটিপূর্ণ বিল্ডিং ধসে টিনের বাড়ির মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।


২৫ জন মানুষ মরে গেল, যার মধ্যে ১৪ জনই নারী ও শিশু। এরা সবাই শ্রমজীবী মানুষ, সারা দিন কাজের পর ঘরে পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাবে, আবার পরদিন যথারীতি কাজে যাবে, এমন একটি নিয়মের মধ্যে যারা জীবন কাটায়, তাদের মৃতদেহ ধসে যাওয়া বিল্ডিংয়ের তলায় পানির ভেতর থেকে উদ্ধার করেছে দমকল বাহিনী। বৃহস্পতিবার রাতে খবরে দেখছিলাম, দমকল বাহিনীর কর্মকর্তা ঘোষণা দিচ্ছিলেন, পানির মধ্যে আর কোনো মৃতদেহ নেই। যদিও কেউ কেউ তখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করছিলেন। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল, টিভিস্ক্রিনের নিচে একটি লেখা ঘুরছে, পুরোনো ঢাকায় ভয়াবহ আগুন লেগেছে।
মনটা আঁতকে উঠেছিল কিছু না বুঝেই। বেগুনবাড়ির ঘটনাই তখনো মনে কষ্ট ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ভাবছিলাম, রাজউকের এই গাফিলতি আর কত দিন আমরা সহ্য করব? গরিব মানুষকে ঢাকা শহর থেকে বের করে দেওয়ার কোনো ফন্দি নয় তো? শুধু ঢাকা শহর থেকেই নয়, এই পৃথিবী থেকেই তাদের একটি অংশকে বের করে দিলে আরও ভালো। রাজউকের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু যে কারণেই হোক, এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এখনো দেখা যাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে খবর আসতে থাকল, বেগুনবাড়ির বিল্ডিং ধসে পড়ার খবরটাই ধসে পড়ল। এবার নিমতলীর আগুনের ঘটনা। আগুনের ভয়াবহতা সবাই দেখেছেন। বলা হচ্ছে, এটা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা। এলাকার মানুষ পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। যে যার মতো করে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল বলে সাংবাদিকেরা পরে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা এত বেশি তীব্র ছিল যে ১১৭ জন জ্যান্ত পুড়ে মরেছে, আরও অনেকে আহত আবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে। আগ্নিদগ্ধ বীভৎস লাশ সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছিল। সেখানে জায়গা হচ্ছিল না। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া এত ঝলসে যাওয়া এবং লাশের কফিন নিয়ে কবর দিতে যাওয়া আমি দেখিনি। আজিমপুর গোরস্থানে যখন লাশগুলো একের পর এক আনা হচ্ছিল তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ফিলিস্তিন ও ইরাকের কথা। আমরা কোথায় আছি? আমি কেঁদেছি সেই দৃশ্য দেখে। আমি একা নই, সেদিন আমার যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তারা সবাই এক কথা বলেছে। বলতে গেলে সবাই কেঁদেছে। আজিমপুর গোরস্থানের গোরখোদক রিপন মিয়া, যাঁর কাজই হচ্ছে কবর খোঁড়া, বলেছেন, ‘এক দিনে এত কবর খুঁড়তে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।’ আসলে শোকদিবস ঘোষণা জনগণই দিয়েছিল। সরকার শোক দিবস পালন করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেদিনের কর্মসূচিও বাতিল করেছেন। ভালো কথা। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ছিল, কর্মসূচি স্থগিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেবে না। তাদের কাজ কি শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করা? এত বড় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে গেল, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কোনো নড়াচড়া দেখলাম না। বরং পরিবেশ দিবসে এই বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা হতে পারত। এর চেয়ে বড় পরিবেশ দূষণ আর কী হতে পারে! খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়েরও একই অবস্থা। খোদ ঢাকা শহরে এত বড় মানুষ-সৃষ্ট দুর্যোগ ঘটে গেল, তারা কিছু করছে না। এখন বিষয়টি যেন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সেখানেও কিছু ফাঁক লক্ষ করেছি। শনিবার হাসপাতালে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের আভিযোগ শুনব আশা করিনি। যেখানে প্রধানমন্ত্রী এসে আহত সবাইকে বিনা পয়সায় চিকিৎসার ঘোষণা দিয়ে গেছেন, সেখানে ওষুধ ও সেবা পাওয়া কষ্টকর হওয়া উচিত ছিল না।
আগুনের সূত্রপাত একটি বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকে হোক বা বিয়েবাড়ির রান্না থেকে হোক, যা শেষ পর্যন্ত এতগুলো মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে, তা হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে আগুন ধরার পরেই আগুনের লেলিহান রূপ নেওয়া। কেউ কেউ বলেছেন, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো আগুন ছুটে আসছিল। দমকল বাহিনীও বলেছে, বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছে রাসায়নিক ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে। আমি শুক্রবার টেলিভিশনের খবর প্রায় সব শুনেছি, সব পত্রিকা পড়েছি এবং বোঝার চেষ্টা করেছি, কেন এমন ঘটনা ঘটে গেল। সবখানেই দেখেছি, রাসায়নিক গুদামের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্লাস্টিক কারখানা, স্যান্ডেল ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম আবাসিক এলাকার মধ্যেই হয়ে আছে। সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশকে ‘ওত পাতা মৃত্যু’ কিংবা ‘নিরন্তর জীবনের ঝুঁকি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমি সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই যে তাঁরা ঘটনার চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। ৫ জুন পত্রিকায় একাধিক শিরোনামে প্রথম পাতায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। টিভিতেও খবরের পাশাপাশি প্রতিবেদকের নিজস্ব মন্তব্য, এমনকি ক্যামেরাম্যানের অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে। আমার কাছে ভালো লেগেছে যে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রচারমাধ্যম নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী বিস্তারিত তুলে ধরতে পারছে। এই ঘটনা কোনো রাজনৈতিক দলের বিষয় কি না জানি না, কিন্তু সরকারের প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া যে কত জরুরি তা বোঝা যায়। সংবাদমাধ্যম জনগণকে তথ্য তুলে ধরে সাহায্য করবে, এটাই কাম্য। কারও কণ্ঠ যেন রোধ করা না হয়।
সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু আমি বুঝলাম না, তাদের এক সপ্তাহ সময় লাগবে কেন? সেদিন এত আগুনের মধ্যেও যদি সাংবাদিকেরা এত তথ্য জানতে পারেন, সেখানে সরকারের তদন্তের প্রাথমিক কাজ তো হয়েই গেছে। তদন্ত কমিটি সব প্রকাশিত সংবাদ এবং টিভির ভিডিও ছবি দেখে অনেক কিছুই সহজে বুঝতে পারবে। আমার ভয় হচ্ছে, তদন্তে দেরি হলে সমস্যার সমাধান হবে না। আরও অনেক দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে যেন ওত পেতে আছে। এই ঘটনাকে নিছক একটিমাত্র দুর্ঘটনা ভাবলে আমরা মারাত্মক ভুল করব, এটা এর চেয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনার পূর্বাভাস। লাগাতার ঘটনাও হতে পারে। বেগুনবাড়ির পর যেমন একের পর এক দালান হেলে পড়ার ঘটনা মানুষের চোখে পড়ছে, আতঙ্ক বাড়ছে, তেমনি রাসায়নিক গুদাম, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি বিরাট হুমকি হয়ে আছে। কালের কণ্ঠ (৫ জুন, ২০১০) পুরান ঢাকায় ‘ওত পাতা মৃত্যু’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, আরও অনেক এলাকা এমন মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। যেমন লালবাগ, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, শ্যামপুর, মতিঝিল—সব এলাকাই ভীতিকর হয়ে আছে। যায় যায় দিন (৫ জুন, ২০১০) বলেছে, কেমিক্যালের আগুনে বারবার পুড়ছে ঢাকা। তার অর্থ হচ্ছে, এই আগুনের ঘটনা এবারই নয়, আগেও ঘটেছে। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই এবারের ঘটনা ঘটতে পারল। সেদিক থেকে দেখলে এবারের এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। এই গাফিলতি ক্ষমার যোগ্য নয়।
নিমতলীর মানুষ স্বজন হারিয়ে শোকাহত। একই সঙ্গে তারা ক্ষুব্ধ, রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম নিয়ে আতঙ্কিত। তাদের সঙ্গে জনগণও ক্ষুব্ধ। তাই আর দেরি নয়, এক্ষুনি কাজ শুরু করতে হবে। আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এই রাসায়নিক কারখানা আবাসিক এলাকা থেকে সরাতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.