মানুষের মুখ-পথের কবি আবদুর রহিম by মামুনুর রশিদ
চারপাশ ঘিরে মানুষের জটলা। সব বয়সের লোকজন আছেন তাঁকে ঘিরে। মাঝখানে মাঝবয়সী একজন। হাতে খঞ্জনি আর মুখে সুর। পরনে আধছেঁড়া প্যান্ট আর গায়ে পুরাতন ছেঁড়া শার্ট। মূলত তাঁকে ঘিরেই লোকজনের সমাগম। আপন মনে সুর আর ছন্দে নেচে চলেছেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে আর উপভোগ করেছে লোকজন।
যাঁর কথা শুনছে, যিনি এত লোকজনকে ধরে রেখেছেন, তিনি আবদুর রহিম। নিজেকে উপস্থাপন করেন ভূমিহীন, নির্যাতিত, বঞ্চিত পল্লিকবি হিসেবে। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার দ্বীপনগর গ্রামে। তিনি শোনালেন তাঁর কবি হওয়ার কথা, শোনালেন বঞ্চিত হওয়ার কথা, শোষণের কথা। এভাবেই কবিতা আর পুঁথি পাঠ করে চলে তাঁর সংসার। শুধু যে সংসার চালানোর জন্য এ কাজ করেন, তা নয়। মানুষকে আনন্দ দেওয়া, সমাজ পরিবর্তন, অসংগতি তুলে ধরা এবং লোকজনকে সচেতন করার জন্য তিনি ঘুরে বেড়ান রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে। এটাকে পেশা হিসেবেই নিয়েছেন তিনি।
বেশ কিছুক্ষণ গান দিয়ে ধরে রাখলেন লোকজনকে। যখন আসর ভেঙে গেল, তখন এগিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। কিছু সময় চাইলাম। হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘কেন সময় দেব না, কী জানতে চান, বলেন।’ শুনতে চাইলাম তাঁর কবি হওয়ার গল্প। নিজ সম্পর্কে বলতে কোনো বাধা নেই তাঁর। শুরু করলেন নিজের গল্প। রহিম জানালেন, তিনি লেখাপড়া বলতে কিছুই জানেন না। বিদ্যালয়ের বারান্দায় গেলেও পড়ালেখা হয়নি। দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। খুব একটা মনে নেই তাঁর কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। তবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার বড়ুয়ার বেশ কিছু কবিতা মনে আছে তাঁর। কোনো ক্লাসে যেন এগুলো পড়েছেন। নিজের আগ্রহে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছুটে গিয়ে পড়তে ও লিখতে শিখেছেন পরে। তাদের কাছ থেকে শিখেছেন পড়ালেখা। পড়ালেখা বলতে এটাই তাঁর সম্বল, তবে পড়তে সমস্যা হয় না তাঁর। তখন থেকে পুঁথিপাঠ শুরু করেন। কণ্ঠ ভালো হওয়ায় সবাই তাঁর কাছে ছুটে আসেন পুঁথিপাঠ শোনার জন্য।
রহিম জানালেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য করাতমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এলাকার বিভিন্ন এলাকায় পেশার জন্য যেতেন, আর রাতে বসতেন পুঁথি নিয়ে। শোনালেন তাঁর কবি হওয়ার গল্প। ১৯৯২ সালের কথা। সরকার থেকে ভূমিহীন হিসেবে খাসজমি পেয়েছিলেন। সেখানে টিনের ছাপড়া করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করছিলেন তিনি। হঠাৎ রাতে তাঁর ঘরটি ভেঙে ফেলেন প্রভাবশালীরা। উচ্ছেদ করেন তাঁকে। নিরুপায় হয়ে ছোটেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। প্রতিপক্ষরা প্রভাবশালী হওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। প্রতিবাদেরও ভাষা নেই। এর প্রতিবাদ হিসেবে হাতে কলম আর খাতা তুলে নেন এই ‘মূর্খ’ মানুষটি। যা জানেন, নিজের বুঝবার মতো করে তাঁর নির্যাতনের ঘটনা ছন্দে ছন্দে লিখে ফেললেন। এলাকার লোকজন ও প্রশাসনের কাছে ছন্দে ছন্দে লেখা তাঁর গীতি কবিতা পাঠ করে শোনানো শুরু করেন। সেই থেকে কবি হওয়া আবদুর রহিমের। আর পেছন ফিরে তাকাননি। রহিম জানান, এই কবিতা লিখে আর পাঠ করে চলে তাঁর সংসার। এ ছাড়া পুঁথিও পাঠ করেন তিনি।
এলাকায় কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেই সাংবাদিকদের মতো ছুটে যান ঘটনাস্থলে। পুরো ঘটনা সম্পর্কে তথ্য নিয়ে লিখে ফেলেন কবিতা। তা চটি বই আকারে প্রকাশ করেন এবং হাটবাজারে বিক্রি করেন, তবে অর্থের অভাবে আর প্রকাশ করতে পারেন না। পুঁথি ও নিজের লেখা কবিতা হাটবাজার ও গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে পড়ে শুনিয়ে যা পান, তা দিয়ে চলে তাঁর সংসার। শুধু কোনো ঘটনায় কবিতা লেখেন না তিনি—লোকজন সচেতন করা এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্যও লিখে থাকেন কবিতা। একই কায়দায় নেচে নেচে পড়ে শোনান তিনি। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যৌতুকবিরোধী, নারী নির্যাতন, স্যানিটেশন, বৃক্ষরোপণ, মাদকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও সামাজিক সমস্যা, তার ক্ষতিকারক ও প্রতিকার নিয়ে কবিতা লিখে পাঠ করেন। তাঁর লেখনীর কারণে এলাকায় অনেক পরিবর্তনও হয়েছে, তবে এ জন্য তাঁকে কেউ উদ্বুদ্ধ করে না। নিজের তাগিদেই লিখে থাকেন আবদুর রহিম। তাঁর মতে, তাঁর কবিতা ও পুঁথিপাঠ সব শ্রেণীর লোকজন শোনেন। তাই তাদের সচেতন করার জন্য নিজের বিবেকের তাড়নায় এসব বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি সমাজকে পরিবর্তন করতে চান। এটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। রহিম এ পর্যন্ত ৪০০-র অধিক কবিতা লিখেছেন। প্রকাশও করেছেন অনেক, তবে টাকার অভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। লেখাপড়া না জানলেও লিখতে পারেন তিনি নিজের মতো করে, তবে তাঁর লেখায় বিভিন্ন ভাষা বা শব্দ প্রকাশের জন্য সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেন। এটা তিনি ছাড়া আর কেউ পড়তে পারে না। ছাপাখানায় পাঠালে সেখানে গিয়ে তাঁকে তাদের বুঝিয়ে দিতে হয়। নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হয় তাঁর। এখনো বেদখল হওয়া জমি বুঝে পাননি তিনি। দখল বুঝে পাওয়ার জন্য প্রশাসনের দরজায় এখনো কড়া নাড়েন। এসব বলতেই চটের ঝোলা থেকে এক গাদা কাগজ বের করে দেখান। যেখানে রয়েছে জমি বুঝে পাওয়ার আবেদন ও বিভিন্ন কর্মকর্তা, ব্যক্তি, সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ। এত কিছুর পরও হতাশ নন আবদুর রহিম। তাঁর অধিকার ফিরে পাবেন কিংবা আন্দোলন সফল হবে, সমাজ পরিবর্তন হবে, সমাজে যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন আর মাদক থাকবে না। তাঁর কবিতার সুফল আসবেই।
বেশ কিছুক্ষণ গান দিয়ে ধরে রাখলেন লোকজনকে। যখন আসর ভেঙে গেল, তখন এগিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। কিছু সময় চাইলাম। হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘কেন সময় দেব না, কী জানতে চান, বলেন।’ শুনতে চাইলাম তাঁর কবি হওয়ার গল্প। নিজ সম্পর্কে বলতে কোনো বাধা নেই তাঁর। শুরু করলেন নিজের গল্প। রহিম জানালেন, তিনি লেখাপড়া বলতে কিছুই জানেন না। বিদ্যালয়ের বারান্দায় গেলেও পড়ালেখা হয়নি। দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। খুব একটা মনে নেই তাঁর কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। তবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার বড়ুয়ার বেশ কিছু কবিতা মনে আছে তাঁর। কোনো ক্লাসে যেন এগুলো পড়েছেন। নিজের আগ্রহে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছুটে গিয়ে পড়তে ও লিখতে শিখেছেন পরে। তাদের কাছ থেকে শিখেছেন পড়ালেখা। পড়ালেখা বলতে এটাই তাঁর সম্বল, তবে পড়তে সমস্যা হয় না তাঁর। তখন থেকে পুঁথিপাঠ শুরু করেন। কণ্ঠ ভালো হওয়ায় সবাই তাঁর কাছে ছুটে আসেন পুঁথিপাঠ শোনার জন্য।
রহিম জানালেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য করাতমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এলাকার বিভিন্ন এলাকায় পেশার জন্য যেতেন, আর রাতে বসতেন পুঁথি নিয়ে। শোনালেন তাঁর কবি হওয়ার গল্প। ১৯৯২ সালের কথা। সরকার থেকে ভূমিহীন হিসেবে খাসজমি পেয়েছিলেন। সেখানে টিনের ছাপড়া করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করছিলেন তিনি। হঠাৎ রাতে তাঁর ঘরটি ভেঙে ফেলেন প্রভাবশালীরা। উচ্ছেদ করেন তাঁকে। নিরুপায় হয়ে ছোটেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। প্রতিপক্ষরা প্রভাবশালী হওয়ায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। প্রতিবাদেরও ভাষা নেই। এর প্রতিবাদ হিসেবে হাতে কলম আর খাতা তুলে নেন এই ‘মূর্খ’ মানুষটি। যা জানেন, নিজের বুঝবার মতো করে তাঁর নির্যাতনের ঘটনা ছন্দে ছন্দে লিখে ফেললেন। এলাকার লোকজন ও প্রশাসনের কাছে ছন্দে ছন্দে লেখা তাঁর গীতি কবিতা পাঠ করে শোনানো শুরু করেন। সেই থেকে কবি হওয়া আবদুর রহিমের। আর পেছন ফিরে তাকাননি। রহিম জানান, এই কবিতা লিখে আর পাঠ করে চলে তাঁর সংসার। এ ছাড়া পুঁথিও পাঠ করেন তিনি।
এলাকায় কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেই সাংবাদিকদের মতো ছুটে যান ঘটনাস্থলে। পুরো ঘটনা সম্পর্কে তথ্য নিয়ে লিখে ফেলেন কবিতা। তা চটি বই আকারে প্রকাশ করেন এবং হাটবাজারে বিক্রি করেন, তবে অর্থের অভাবে আর প্রকাশ করতে পারেন না। পুঁথি ও নিজের লেখা কবিতা হাটবাজার ও গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে পড়ে শুনিয়ে যা পান, তা দিয়ে চলে তাঁর সংসার। শুধু কোনো ঘটনায় কবিতা লেখেন না তিনি—লোকজন সচেতন করা এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্যও লিখে থাকেন কবিতা। একই কায়দায় নেচে নেচে পড়ে শোনান তিনি। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যৌতুকবিরোধী, নারী নির্যাতন, স্যানিটেশন, বৃক্ষরোপণ, মাদকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও সামাজিক সমস্যা, তার ক্ষতিকারক ও প্রতিকার নিয়ে কবিতা লিখে পাঠ করেন। তাঁর লেখনীর কারণে এলাকায় অনেক পরিবর্তনও হয়েছে, তবে এ জন্য তাঁকে কেউ উদ্বুদ্ধ করে না। নিজের তাগিদেই লিখে থাকেন আবদুর রহিম। তাঁর মতে, তাঁর কবিতা ও পুঁথিপাঠ সব শ্রেণীর লোকজন শোনেন। তাই তাদের সচেতন করার জন্য নিজের বিবেকের তাড়নায় এসব বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি সমাজকে পরিবর্তন করতে চান। এটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। রহিম এ পর্যন্ত ৪০০-র অধিক কবিতা লিখেছেন। প্রকাশও করেছেন অনেক, তবে টাকার অভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। লেখাপড়া না জানলেও লিখতে পারেন তিনি নিজের মতো করে, তবে তাঁর লেখায় বিভিন্ন ভাষা বা শব্দ প্রকাশের জন্য সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেন। এটা তিনি ছাড়া আর কেউ পড়তে পারে না। ছাপাখানায় পাঠালে সেখানে গিয়ে তাঁকে তাদের বুঝিয়ে দিতে হয়। নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হয় তাঁর। এখনো বেদখল হওয়া জমি বুঝে পাননি তিনি। দখল বুঝে পাওয়ার জন্য প্রশাসনের দরজায় এখনো কড়া নাড়েন। এসব বলতেই চটের ঝোলা থেকে এক গাদা কাগজ বের করে দেখান। যেখানে রয়েছে জমি বুঝে পাওয়ার আবেদন ও বিভিন্ন কর্মকর্তা, ব্যক্তি, সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ। এত কিছুর পরও হতাশ নন আবদুর রহিম। তাঁর অধিকার ফিরে পাবেন কিংবা আন্দোলন সফল হবে, সমাজ পরিবর্তন হবে, সমাজে যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন আর মাদক থাকবে না। তাঁর কবিতার সুফল আসবেই।
No comments