সিসিসি নির্বাচন-প্রার্থীদের ভালো-মন্দ: একটি ঝটিকা দৈবচয়ন সমীক্ষা by মশিউল আলম

‘মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর তিনটা গুণের কথা বলেন।’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে প্রকৌশলী রতন কুমার খাস্তগীর (৬০) বললেন, ‘উনার উপস্থিত বুদ্ধি ভালো, সাহসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, লোকজনকে কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেসব কায়দা-কানুন উনার খুব ভালো জানা।’


‘এবার বলেন তাঁর তিনটা দোষের কথা।’
প্রকৌশলী খাস্তগীর: ‘উনার মুখ খারাপ, উদ্ধত, ডিকটেটর।’
বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মঞ্জুর আলম সম্পর্কেও একই প্রশ্ন করলাম তাঁকে। তিনি বললেন, ‘মঞ্জুর সাহেব বিনয়ী মানুষ, ব্যবহার ভালো। এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারব না। উনার খারাপের মধ্যে হলো, উনি সারা জীবন আওয়ামী লীগে ছিলেন, এখন মেয়র হওয়ার জন্য বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন।’
‘যাকে ভোট দিয়ে মেয়র বানাবেন, তাঁর কাছে কী দাবি করবেন? আর কোন কোন কাজ করতে নিষেধ করবেন?’
প্রকৌশলী খাস্তগীরের উত্তর, ‘সব দিক দিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়ন করতে হবে। আর নিষেধ করি, মেয়রের চেয়ারে বসে জনগণের মতামতকে অবজ্ঞা করবেন না। একাই সব সিদ্ধান্ত নেবেন না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শুধু নিজের এলাকার উন্নয়ন করবেন না। আর মহিউদ্দিন সাহেব যদি আবার মেয়র হন, তাহলে তিনি যেন বেশি বাণিজ্যকরণ না করেন। লালদিঘিতে সুইমিংপুল করার দরকার নাই।’
প্লাইউড-পারটেক্স ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান চৌধুরী (৫৪) বললেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী উগ্র, ১৫ বছর মেয়র ছিলেন, কী উন্নয়ন করেছেন?’ মঞ্জুর আলম সম্পর্কে বললেন, ‘তিনি অত্যন্ত সৎ ও বিনয়ী লোক। দক্ষ ব্যক্তিও বটে, ৬০টা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে।’ মোটর যন্ত্রাংশের ব্যবসায়ী মো. নাসিম (৬৪) বললেন, ‘মহিউদ্দিন রাগী লোক, কিন্তু রাগের দরকার আছে। মঞ্জুর আলম খারাপ না।’
রাফি (২০), জামশেদ (২১), জোসেফ (২২), সোহান (২২), রাকিব (২০), রিয়াজ (২২)—সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম: মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক প্রতিষ্ঠান করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। মেয়র হিসেবে যখন কাজ করেছেন, দলীয়ভাবে কিছু করেননি। বিএনপির আমলে যা করেছেন, আওয়ামী লীগের আমলেও তাই। তবে তিনি সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর জন্য সবকিছু বাণিজ্যকরণ করতে চাইছেন—এটা খারাপ। লালখান বাজারে অনেকগুলো খুব পুরোনো বটগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ভেঙে; খেলার মাঠ, পার্ক নষ্ট করে তিনি মার্কেট, আবাসিক প্রকল্প এসব করতে চান। এগুলো করা চলবে না। আর রাস্তাঘাটের বিশৃঙ্খলা, যানজট—এসব দিকে তাঁর নজর ছিল না। নগরে পাবলিক টয়লেট নেই বললেই চলে, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে না, মশার যন্ত্রণায় মানুষ অস্থির। শহরের মধ্যে দিনের বেলা ট্রাক চলাচল করে, পুলিশ নিজেই আইন ভঙ্গ করে রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চালায়। ওয়ান-ওয়ে রাস্তাগুলো নামেই শুধু ওয়ান-ওয়ে, কেউ কিছু মানে না। মেয়েদের চলাফেরায় অসুবিধা, বখাটেরা তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে, দিনের বেলায় মাদক সেবন চলে। ট্যাক্সি, সিএনজি অটোরিকশাগুলো মিটারে চলে না, বাড়তি ভাড়া নেয়।
ওই শিক্ষার্থীরা সবাই বললেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী আগে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। এখন তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। তাঁরা আরও বলেন, মঞ্জুর আলম সম্পর্কে তাঁরা বেশি জানেন না। তবে তাঁর আচার-ব্যবহার ভালো। কিন্তু মেয়র হওয়ার জন্য তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন, এটা ঠিক করেননি। বিএনপি যদি তাঁকে এতই ভালোবাসত, তাহলে সংসদ নির্বাচনে তারা তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি কেন?
ওই শিক্ষার্থীদের সবারই বক্তব্য, যিনি মেয়র হবেন, তিনি যেন লক্ষ রাখেন নগরের জনগণ কী চায়, কী চায় না। জনগণের মতামত নিয়েই সব কাজ করতে হবে। বেশির ভাগ মানুষ যেটা চাইবে না, সেটা করা চলবে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী ইশরাত বললেন, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ এত বেশি যে সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার সময় হয় না বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর। তাঁরা জানেন না কোন প্রার্থীর কী অঙ্গীকার। তবে তাঁরা ভোট দেবেন। একই কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র শাহরিয়ারের বক্তব্যও অভিন্ন। অবশ্য রিজওয়ানা হক নামের পঞ্চম বর্ষেরই আরেক মেডিকেল শিক্ষার্থী বললেন অন্য কথা, নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বেশ খোঁজখবর রাখছেন, কোন প্রার্থীর কী বক্তব্য সেসব খেয়াল করছেন। কিন্তু তাঁদের দোষ-গুণ বা যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না তিনি।
এক বিপণিবিতানে কথা হলো তিনজন গৃহিণীর সঙ্গে। তাঁরা বিশেষ কিছু বলতে চান না। তাঁরা চান, মেয়র যে-ই হোক, নগরে শান্তিশৃঙ্খলা, চলাফেরায় নিরাপত্তা থাকুক (ছিনতাই খুব হচ্ছে, প্রবর্তকের মোড় নাকি এক ভয়ংকর জায়গা), যানজট দূর হোক। ভোট দেওয়ার আগে তাঁরা স্বামী বা পরিবারের মুরব্বিদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবেন, নাকি নিজের সিদ্ধান্তেই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন—এই প্রশ্নে একজন বললেন, ‘আমার ভোট আমিই দিব। কারও সাথে আলাপ করার তো দরকার নাই।’ অন্য দুজন অবশ্য বললেন, তাঁরা স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন, কাকে ভোট দিলে ভালো হয়।
কাকে ভোট দেবেন? এমন অনধিকারচর্চামূলক প্রশ্ন কাউকেই জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু পাঁচজন রিকশাচালক, তিনজন ভ্যানগাড়িচালক, দুজন বাদামবিক্রেতা, একজন ফলবিক্রেতা আমাকে বলেছেন, তাঁরা ভোট দেবেন মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। কেন? রিকশাওয়ালাদের উত্তর, মহিউদ্দিন মেয়র থাকলে রিকশার লাইসেন্স নিতে হবে না, রিকশায় হারিকেন লাগাতে হবে না, রাস্তার পাশে রিকশা নিয়ে দাঁড়ালে পুলিশ এসে তাড়িয়ে দেবে না। বাদামবিক্রেতা ও ফলবিক্রেতার বক্তব্য, মহিউদ্দিন তাঁদের ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করবেন না।
প্রশ্ন ছিল পাঁচ রকমের: ১. যাঁকে ভোট দিয়ে মেয়র বানাবেন, তাঁর কাছে আপনার দাবি কী? ২. মেয়রকে কী কী করতে নিষেধ করবেন? ৩. মহিউদ্দিন চৌধুরীর তিনটা গুণ আর তিনটা দোষ কী কী? ৪. মঞ্জুর আলমের তিনটা গুণ আর তিনটা দোষ কী কী? ৫. নির্বাচন কমিশন কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে?
প্রশ্নগুলো করেছিলাম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মোট ৫০ জন ভোটারকে। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ৬৫ বছর। নারী ১৫ জন, পুরুষ ৩৫। পেশা: রিকশাচালক (পাঁচজন), ভ্যানগাড়িচালক (তিনজন), বাদামবিক্রেতা (দুজন), ফলবিক্রেতা (একজন), হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (একজন), গার্মেন্টস কোম্পানির মাইক্রোবাসচালক (একজন), ছাত্র (আটজন), ছাত্রী (পাঁচজন), ব্যবসায়ী (পাঁচজন), অবসরভোগী (তিনজন), দরজি (একজন), তৈরি পোশাক-কারখানার নারীকর্মী (পাঁচজন), গৃহবধূ (তিনজন), রেস্টুরেন্টের ওয়েটার (একজন), হোটেলের বাবুর্চি (একজন), মসজিদের বারান্দায় গল্পরত মুসল্লি (পাঁচজন)।
সব প্রশ্নের পুরো উত্তর অধিকাংশের কাছেই পাওয়া যায়নি। বিশেষত নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে কি না—এই প্রশ্নে দ্বিধান্বিত ছিলেন বেশির ভাগ উত্তরদাতা। শুধু একজন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন মোটামুটি নিরপেক্ষ আছে। তবে কখনো কখনো তাঁর মনে হয়, আওয়ামী লীগের দিকে কমিশনের ‘ঝোঁক’ একটু বেশি। অবশ্য তিনি মনে করেন, এখনই বলা যাচ্ছে না, সামনের দিনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ওপরের প্রশ্নগুলোর বাইরে একটি বিষয়ে অনেক লোকের মন্তব্য লক্ষ করার মতো। তাঁরা মনে করেন, প্রার্থী কোন দলের মনোনয়ন পেয়েছেন সেটা তাঁদের কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতাই প্রধান ব্যাপার। ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নাকি রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকাই নেই।
৪১টি ওয়ার্ডের ১৭ লাখ ভোটারের মধ্যে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে পাওয়া মাত্র ৫০ জনের মতামত থেকে প্রকৃত পরিস্থিতির কিছুই হয়তো সত্যিকার অর্থে বোঝা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ভোটযুদ্ধের আরও অনেক নেপথ্য বিষয় থাকে। সেগুলোর সবই আছে এখানেও। মহিউদ্দিন চৌধুরী শেখ হাসিনার অনুমোদন পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের ভেতরে কোন্দল কমেছে বলে অনেকেই বলছেন। কিন্তু বিএনপিতে সমস্যা আছে, দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মঞ্জুর আলমকে মনোনীত করলেও চট্টগ্রাম বিএনপির সব অংশই যে আন্তরিকভাবে তাঁর পক্ষে কাজ করছে—এমন কথা শোনা যাচ্ছে না। বরং তিনি নির্বাচনী অন্তর্ঘাতের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে। আর জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে মঞ্জুর আলমকে সমর্থন দেওয়ার পর কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে মঞ্জুর আলম হয়তো জামায়াতের বিশ-পঁচিশ হাজার ভোট পাবেন, কিন্তু হারাবেন অন্তত পঞ্চাশ হাজার ভোটারকে, যাঁরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কিছু কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে একটা পরিবর্তনের জন্য মঞ্জুর আলমকে ভোট দিতেন। কিন্তু তাঁরা বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সখ্য পছন্দ করেন না বলে জামায়াত-প্রার্থীর মঞ্জুরকে সমর্থন করাটা মঞ্জুরের জন্য হতে পারে হিতে বিপরীত।
তবু এখানে অনেক মানুষের মুখেই শুনতে পাচ্ছি, আসন্ন নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মঞ্জুর আলমের মধ্যে খুব শক্ত লড়াই হবে।
চট্টগ্রাম, ৩ জুন, ২০১০
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.