এই কি চলচ্চিত্র শিল্পনগর? by কামরুজ্জামান
ত্রিশ বছরেও দেশে গড়ে ওঠেনি চলচ্চিত্র শিল্পনগর। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কবিরপুরে ১০৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল চলচ্চিত্র শিল্পনগর নির্মাণের জন্য। ১৯৮০ সালের ১ জুলাই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৮৪ সালের জুন মাসের মধ্যে। কিন্তু কার্যত এর উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই হয়নি।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও এফডিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলচ্চিত্র নগরের জন্য বরাদ্দ করা জমি শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না, তা তারা নিজেরাও জানে না।
গত ৩০ বছরে ১০৫ একর জায়গা সংরক্ষণের জন্য ইটের দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই কাজও করা হয়নি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চলচ্চিত্র শিল্পনগর নির্মাণের জন্য একাধিক প্রকল্প নেওয়া হলেও সিংহভাগ কাজই শেষ হয়নি।
২৭ মে কবিরপুরের চলচ্চিত্র নগরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ২২টি একচালা টিনের ঘর ও কয়েকটি বাথরুম ছাড়া আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। দুটি পাওয়ার হাউস তৈরি করা হলেও সেগুলো এখন অচল। বিশাল এই জায়গা দেখভাল করার জন্য মাত্র পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক মাস ধরে সেখানে বিদ্যুৎ ও পানি নেই। যাঁরা সেখানে অবস্থান করছেন, তাঁরা জানালেন তাঁদের দুর্দশার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে মাঝেমধ্যে বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং হয়। কখনো কখনো বনভোজন করতে আসে লোকজন। কিন্তু চলচ্চিত্রের শুটিং করার জন্য যে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে, সেখানে শুটিং করার কোনো পরিবেশ নেই বলে কোনো চলচ্চিত্রের শুটিং হয় না।
চলচ্চিত্র শিল্পনগরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, ১০৫ একর জায়গার মধ্যে ৬০ বিঘা জমি লিজ দেওয়া হয়েছে চাষাবাদ করার জন্য। একটি লেক রয়েছে সেখানে; সেটি ইজারা দেওয়া হয়েছে মাছ চাষ করার জন্য।
চলচ্চিত্র নগরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। দিনের বেলায় শিল্পনগরের বিভিন্ন অরক্ষিত স্থান দিয়ে মানুষজন ঢুকে পড়ে এবং সেখানে গবাদিপশুর পাল চরানো হয়। এ ছাড়া কবিরপুরের বিশাল গজারিবনের বাগান থেকে রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে নেয় দুষ্কৃতকারীরা।
যে ২২টি কক্ষ স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। রূপসজ্জা কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নিরাপত্তারক্ষীরা লেকের পানি দিয়ে জীবনধারণ করছেন এবং দুটি কক্ষ তাঁরা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন।
কেন এই দুরবস্থা
তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হলেও পরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য দুবার কাজ পেছানো হয়। এরপর অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব এলেও এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ’৯১ সালে রাজনৈতিক সরকার হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি নিয়ে আর কোনো চিন্তাভাবনা করা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কবিরপুরের ১০৫ একর জায়গার ওপর চলচ্চিত্র শিল্পনগর করা হবে বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আবু সাইয়িদ। সে সময় এর নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ু্ল চলচ্চিত্র শিল্পনগর’। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়, ১০৫ একর জায়গার মধ্যে ৩০ একর জায়গা সমতলভূমিতে রূপ দেওয়া হবে। এখানে নির্মাণ করা হবে একাধিক ফ্লোর এবং শিল্পী-কুশলীদের জন্য আবাসন। থাকবে গ্রাম, নদী, পুকুর, পাহাড় ও পর্বত।
অজ্ঞাত কারণে পরে আর এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তথ্যমন্ত্রী মঈন খান হেলিকপ্টারে কবিরপুরে আসেন। তিনি সেখানে ‘বঙ্গবন্ু্ল চলচ্চিত্র নগর’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘জিয়া চলচ্চিত্র নগর’ নামকরণের ঘোষণা দেন।
তৎকালীন এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াসিমুল বারী রাজীবের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় নতুন প্রকল্প। বার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিসির উন্নয়নের জন্য মোট ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে কবিরপুরে জিয়া চলচ্চিত্র নগরের জন্য সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করা হবে বলেও চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় তিনি ঘোষণা দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে টাকা না পেয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই এফডিসির রাজস্ব খাত থেকে টাকা নিয়ে ওয়াসিমুল বারী রাজীব কাজ শুরু করেন। ওই টাকায় একচালা টিনের ঘর বানানো আর কিছু স্থানে মাটি কাটা ছাড়া কিছুই করা হয়নি। বরাদ্দের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় না হওয়ায় অনেক টাকা ফেরত চলে যায়। কিন্তু কাগজে-কলমে দেখানো হয় দুই কোটির বেশি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। (সূত্র: এফডিসি ওয়েবসাইট প্রকল্প)
বর্তমান অবস্থা
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান তথ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী মাস দুয়েক আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এফডিসির কর্মকর্তাদের নিয়ে কবিরপুরে সফর করেন। সেখানে পর্যালোচনা কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকার এর নতুন নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি’।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ফিল্ম সিটির নামে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি উন্নয়ন প্রকল্প’ (এফডিসি পর্যালোচনা কমিটি) তথ্য মন্ত্রণালয় বরাবর দুই ধাপে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দের এই আবেদন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাবে। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বৈঠকে (একনেক) অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হলেই এর কাজ শুরু করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমতাজ আলা শাকুর আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে কবিরপুরের উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ পেলেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপে ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এই টাকায় প্রথমে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, কবিরপুরে নন্দন পার্কের মতো চিত্তবিনোদন স্থাপনা, রেলস্টেশন, পাহাড়-পর্বত, ঝরনা, গ্রাম, নদী, বাগান ও মোটেল নির্মাণ করা হবে। এরপর যে ৩০ কোটি টাকার আবেদন করা হবে, সেখানে সম্ভবত আবাসন প্রকল্পও রয়েছে।’
বর্তমানের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেখানে এক মাস ধরে যে বিদ্যুৎ নেই, সেটি আমার জানা ছিল না। তবে আমরা সবকিছুই মনিটর করছি।’
অতীতে চলচ্চিত্র নগরের উন্নয়নের নামে এফডিসির রাজস্ব খাত থেকে নিয়ে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছিল, সেই টাকার সঠিক ব্যবহার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সেটি আসলে বলা কঠিন। সে সময় কিছু কাজ হয়েছিল। এরপর কী কী হয়নি, তা অফিস নথিপত্র দেখে বলতে হবে।’
হতাশ শিল্পী ও কুশলীরা
৩০ বছরেও চলচ্চিত্র শিল্পনগর না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিল্পী ও নির্মাতারা। অভিনেতা রাজ্জাক বলেন, ‘৩০ বছরে যখন হয়নি, তখন আগামী ৫০ বছরেও সেখানে চলচ্চিত্র শিল্পনগর হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ তিনি বলেন, ‘যে স্থানে শিল্পনগর করার কথা শুনে আসছি, সেই স্থানটিই উপযুক্ত নয়। বিএনপি সরকারের আমলে একবার আমাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগে কম করে তিন ঘণ্টা। গহিন অঞ্চলে গিয়ে কোনো শিল্পী কাজ করবে বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া জায়গাটার যে অবকাঠামো, তাতে সরকার শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র শিল্পনগর করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের আফসোস, আমরা প্রতিশ্রুতি পাই, কিন্তু এর কোনো বাস্তবায়ন দেখি না।’
অভিনেতা রাজ্জাক আরও বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে আবেদন করব, ওই এলাকাটি যেহেতু শিল্পকারখানার জায়গা, তাই সেটি বিক্রি করে দিয়ে পুবাইলের দিকে আমাদের জন্য শিল্পনগর করুন। অন্যথায় বছরে বছরে টাকা বরাদ্দ হবে, কিছু কাজ হবে, তারপর আবার সরকার বদল হলে সব কাজ থেমে যাবে।’
পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘৩০ বছরে সেখানে ৩০টি স্থাপনাও হয়নি, কারণ চলচ্চিত্রের প্রতি প্রতিটি সরকারই উদাসীন। আমরা শুনেই আসছি, আমাদের দেশে একটি চলচ্চিত্র শিল্পনগর হবে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন আদৌ কেউ করবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের সান্ত্বনা দিতেই হয়তো সরকার একটা বিশাল আয়তনের জমি বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটি আমাদের জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনেনি। আমরা সরকারকে বিভিন্ন বৈঠকে বলেছি, এত বড় জায়গায় সরকারের একার পক্ষে দ্রুত কিছু করা সম্ভব নয়। তাই এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিক অথবা পুরো জায়গাটি বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোনো ভালো স্থানে করা হোক। কিন্তু সব সরকারই ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, কার্যত কিছুই হচ্ছে না। জানি না, আমরা জীবদ্দশায় কিছু দেখত পাব কি না।’
গত ৩০ বছরে ১০৫ একর জায়গা সংরক্ষণের জন্য ইটের দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই কাজও করা হয়নি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চলচ্চিত্র শিল্পনগর নির্মাণের জন্য একাধিক প্রকল্প নেওয়া হলেও সিংহভাগ কাজই শেষ হয়নি।
২৭ মে কবিরপুরের চলচ্চিত্র নগরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ২২টি একচালা টিনের ঘর ও কয়েকটি বাথরুম ছাড়া আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। দুটি পাওয়ার হাউস তৈরি করা হলেও সেগুলো এখন অচল। বিশাল এই জায়গা দেখভাল করার জন্য মাত্র পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক মাস ধরে সেখানে বিদ্যুৎ ও পানি নেই। যাঁরা সেখানে অবস্থান করছেন, তাঁরা জানালেন তাঁদের দুর্দশার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে মাঝেমধ্যে বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং হয়। কখনো কখনো বনভোজন করতে আসে লোকজন। কিন্তু চলচ্চিত্রের শুটিং করার জন্য যে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে, সেখানে শুটিং করার কোনো পরিবেশ নেই বলে কোনো চলচ্চিত্রের শুটিং হয় না।
চলচ্চিত্র শিল্পনগরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, ১০৫ একর জায়গার মধ্যে ৬০ বিঘা জমি লিজ দেওয়া হয়েছে চাষাবাদ করার জন্য। একটি লেক রয়েছে সেখানে; সেটি ইজারা দেওয়া হয়েছে মাছ চাষ করার জন্য।
চলচ্চিত্র নগরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। দিনের বেলায় শিল্পনগরের বিভিন্ন অরক্ষিত স্থান দিয়ে মানুষজন ঢুকে পড়ে এবং সেখানে গবাদিপশুর পাল চরানো হয়। এ ছাড়া কবিরপুরের বিশাল গজারিবনের বাগান থেকে রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে নেয় দুষ্কৃতকারীরা।
যে ২২টি কক্ষ স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। রূপসজ্জা কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নিরাপত্তারক্ষীরা লেকের পানি দিয়ে জীবনধারণ করছেন এবং দুটি কক্ষ তাঁরা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন।
কেন এই দুরবস্থা
তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হলেও পরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য দুবার কাজ পেছানো হয়। এরপর অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব এলেও এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ’৯১ সালে রাজনৈতিক সরকার হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি নিয়ে আর কোনো চিন্তাভাবনা করা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কবিরপুরের ১০৫ একর জায়গার ওপর চলচ্চিত্র শিল্পনগর করা হবে বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আবু সাইয়িদ। সে সময় এর নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ু্ল চলচ্চিত্র শিল্পনগর’। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়, ১০৫ একর জায়গার মধ্যে ৩০ একর জায়গা সমতলভূমিতে রূপ দেওয়া হবে। এখানে নির্মাণ করা হবে একাধিক ফ্লোর এবং শিল্পী-কুশলীদের জন্য আবাসন। থাকবে গ্রাম, নদী, পুকুর, পাহাড় ও পর্বত।
অজ্ঞাত কারণে পরে আর এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তথ্যমন্ত্রী মঈন খান হেলিকপ্টারে কবিরপুরে আসেন। তিনি সেখানে ‘বঙ্গবন্ু্ল চলচ্চিত্র নগর’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘জিয়া চলচ্চিত্র নগর’ নামকরণের ঘোষণা দেন।
তৎকালীন এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াসিমুল বারী রাজীবের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় নতুন প্রকল্প। বার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিসির উন্নয়নের জন্য মোট ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে কবিরপুরে জিয়া চলচ্চিত্র নগরের জন্য সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করা হবে বলেও চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় তিনি ঘোষণা দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে টাকা না পেয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই এফডিসির রাজস্ব খাত থেকে টাকা নিয়ে ওয়াসিমুল বারী রাজীব কাজ শুরু করেন। ওই টাকায় একচালা টিনের ঘর বানানো আর কিছু স্থানে মাটি কাটা ছাড়া কিছুই করা হয়নি। বরাদ্দের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় না হওয়ায় অনেক টাকা ফেরত চলে যায়। কিন্তু কাগজে-কলমে দেখানো হয় দুই কোটির বেশি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। (সূত্র: এফডিসি ওয়েবসাইট প্রকল্প)
বর্তমান অবস্থা
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান তথ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী মাস দুয়েক আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এফডিসির কর্মকর্তাদের নিয়ে কবিরপুরে সফর করেন। সেখানে পর্যালোচনা কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকার এর নতুন নাম দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি’।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ফিল্ম সিটির নামে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি উন্নয়ন প্রকল্প’ (এফডিসি পর্যালোচনা কমিটি) তথ্য মন্ত্রণালয় বরাবর দুই ধাপে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দের এই আবেদন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাবে। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বৈঠকে (একনেক) অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হলেই এর কাজ শুরু করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমতাজ আলা শাকুর আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে কবিরপুরের উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ পেলেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম ধাপে ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এই টাকায় প্রথমে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, কবিরপুরে নন্দন পার্কের মতো চিত্তবিনোদন স্থাপনা, রেলস্টেশন, পাহাড়-পর্বত, ঝরনা, গ্রাম, নদী, বাগান ও মোটেল নির্মাণ করা হবে। এরপর যে ৩০ কোটি টাকার আবেদন করা হবে, সেখানে সম্ভবত আবাসন প্রকল্পও রয়েছে।’
বর্তমানের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেখানে এক মাস ধরে যে বিদ্যুৎ নেই, সেটি আমার জানা ছিল না। তবে আমরা সবকিছুই মনিটর করছি।’
অতীতে চলচ্চিত্র নগরের উন্নয়নের নামে এফডিসির রাজস্ব খাত থেকে নিয়ে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছিল, সেই টাকার সঠিক ব্যবহার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সেটি আসলে বলা কঠিন। সে সময় কিছু কাজ হয়েছিল। এরপর কী কী হয়নি, তা অফিস নথিপত্র দেখে বলতে হবে।’
হতাশ শিল্পী ও কুশলীরা
৩০ বছরেও চলচ্চিত্র শিল্পনগর না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিল্পী ও নির্মাতারা। অভিনেতা রাজ্জাক বলেন, ‘৩০ বছরে যখন হয়নি, তখন আগামী ৫০ বছরেও সেখানে চলচ্চিত্র শিল্পনগর হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ তিনি বলেন, ‘যে স্থানে শিল্পনগর করার কথা শুনে আসছি, সেই স্থানটিই উপযুক্ত নয়। বিএনপি সরকারের আমলে একবার আমাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগে কম করে তিন ঘণ্টা। গহিন অঞ্চলে গিয়ে কোনো শিল্পী কাজ করবে বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া জায়গাটার যে অবকাঠামো, তাতে সরকার শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র শিল্পনগর করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের আফসোস, আমরা প্রতিশ্রুতি পাই, কিন্তু এর কোনো বাস্তবায়ন দেখি না।’
অভিনেতা রাজ্জাক আরও বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে আবেদন করব, ওই এলাকাটি যেহেতু শিল্পকারখানার জায়গা, তাই সেটি বিক্রি করে দিয়ে পুবাইলের দিকে আমাদের জন্য শিল্পনগর করুন। অন্যথায় বছরে বছরে টাকা বরাদ্দ হবে, কিছু কাজ হবে, তারপর আবার সরকার বদল হলে সব কাজ থেমে যাবে।’
পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘৩০ বছরে সেখানে ৩০টি স্থাপনাও হয়নি, কারণ চলচ্চিত্রের প্রতি প্রতিটি সরকারই উদাসীন। আমরা শুনেই আসছি, আমাদের দেশে একটি চলচ্চিত্র শিল্পনগর হবে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন আদৌ কেউ করবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের সান্ত্বনা দিতেই হয়তো সরকার একটা বিশাল আয়তনের জমি বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটি আমাদের জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনেনি। আমরা সরকারকে বিভিন্ন বৈঠকে বলেছি, এত বড় জায়গায় সরকারের একার পক্ষে দ্রুত কিছু করা সম্ভব নয়। তাই এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিক অথবা পুরো জায়গাটি বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোনো ভালো স্থানে করা হোক। কিন্তু সব সরকারই ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, কার্যত কিছুই হচ্ছে না। জানি না, আমরা জীবদ্দশায় কিছু দেখত পাব কি না।’
No comments