পূর্ব রেলে জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি-অনিয়মের মূলে সাবেক জিএমসহ সাত কর্মকর্তা by একরামুল হক
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ২৫টি ক্যাটাগরিতে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ জন্য রেলের পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও তাঁর মেয়ের জামাইসহ সাতজনকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিটি। ২২ মে রেলের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
ঢাকায় মধ্যরাতের ৭০ লাখ টাকা কেলেঙ্কারির সময় সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের সঙ্গে ছিলেন এই ইউসুফ আলী মৃধা। তিনি তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হলেও অভিযোগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি অজুহাত তোলেন, কমিটির সদস্যরা তাঁর চেয়ে নিচের পদের কর্মকর্তা। তবে তিনি লিখিতভাবে জানান, ২০ জুনের আগে তিনি কোনো মতামত দিতে পারবেন না।
কমিটি বাকি যাঁদের মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে তাঁরা হলেন—অতিরিক্ত প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া, ইউসুফ আলী মৃধার মেয়ের জামাই ও বিভাগীয় প্রকৌশলী (ঢাকা) আরমান হোসেন, বিভাগীয় প্রকৌশলী (চট্টগ্রাম) আবিদুর রহমান, চিফ কমান্ড্যান্ট আমিনুর রশিদ ও সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ আহমেদ। এর বাইরে পূর্বাঞ্চলের সাতটি নিয়োগ কমিটির সদস্য আরও অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটি আংশিকভাবে দায়ী করেছে বলে জানা গেছে। কমিটির সদস্য হিসেবে এঁরা এই অনিয়মের কোনো প্রতিবাদ করেননি।
তদন্তকারী সূত্র বলছে, হাফিজুর রহমান দুটি ক্যাটাগরির নিয়োগে সরাসরি এবং সাতটিতে আংশিক, গোলাম কিবরিয়া ১১টি ক্যাটারিতে এবং আরমান হোসেন, আবিদুর রহমান, আমিনুর রশিদ ও আবু সাইদ আহমেদ একটি করে ক্যাটাগরির নিয়োগে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
তদন্ত কমিটি ইউসুফ আলী মৃধাকে ২৫টি ক্যাটাগরির নিয়োগেই অনিয়মের জন্য দায়ী করেছে। কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা করে জেনেছে, লেটারম্যান পদে নিয়োগের পরীক্ষার ফলাফল প্রতিবেদন প্রস্তুত করার দুই সপ্তাহ আগেই ইউসুফ আলী মৃধা ওই নিয়োগের অনুমোদন দেন! গত বছরের ১৮ মার্চ ও ১৬ এপ্রিল এই পদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা কমিটি গত বছরের ১৮ আগস্ট ফলাফল প্রস্তুত করে। কিন্তু মৃধা ফলাফল অনুমোদন করেন ১৪ দিন আগে, ৪ আগস্ট।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহে তদন্ত প্রতিবেদন যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি রেলসচিব পেয়েছেন। আমার কাছে রোববার (আজ) বা সোমবার আসতে পারে।’ তিনি বলেন, তদন্তে যাঁদের দায়ী করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ও শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলের সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত হলে জনসেবাও নিশ্চিত হবে। অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না।
কোন কোন পদে নিয়োগ: চৌকিদার, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার), ট্রলিম্যান, বাবুর্চি, মালী, ওয়েটিং রুম আয়া, ল্যাম্পম্যান, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, গুডস সহকারী, ট্রেন নম্বর টেকার, সহকারী লোকোমাস্টার, শরীরচর্চা শিক্ষক, কার্পেন্টার, টুলকিপার, জ্যেষ্ঠ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, কোর্ট ইন্সপেক্টর, লেটারম্যান, রেকর্ডকিপার, টেপরিডার, ক্লাসিক্যাল শিক্ষক, টিকিট ইস্যুয়ার, ফুয়েল চেকার, সহকারী কেমিস্ট।
কমিটি ও কার্যপরিধি: তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (যান্ত্রিক) মো. শামছুজ্জামান। অপর দুই সদস্য হলেন যুগ্ম মহাপরিচালক (পরিচালন) মো. মিয়াজাহান ও টেলিযোগাযোগ শাখার সিএসটিই নাসিরউদ্দিন আহমেদ। সদস্যসচিব ছিলেন সংস্থাপন শাখার উপপরিচালক মো. মোফাজ্জল হোসেন। কমিটিকে পূর্বাঞ্চলের ২৫ এবং পশ্চিমাঞ্চলের ১১ ক্যাটাগরিতে নিয়োগের বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১৮ এপ্রিল কমিটি পূর্বাঞ্চলের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে ২২ মে প্রতিবেদন দেয়। এবার কমিটি পশ্চিমাঞ্চলের নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে।
তদন্ত কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে ছিল: নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্র, বাছাই কমিটির নথিপত্র ও প্রতিবেদন, পরীক্ষার আহ্বানপত্র ইস্যু-সংক্রান্ত কাগজপত্র, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মূল্যায়ন (টেব্যুলেশন শিট), নিয়োগ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও অনুমোদনের নথি, নিয়োগপত্র ইস্যু ও বিতরণ এবং জেলা ও অন্য কোটা মানা হয়েছে কি না, তা যাচাই করা। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগসংক্রান্ত খবর পর্যালোচনার দায়িত্বও দেওয়া হয় কমিটিকে। তবে নিয়োগ কার্যক্রমে আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল না।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ও রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (পরিচালন) মো. মিয়াজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নথিপত্র যাচাই-বাছাই ও নির্বাচনী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যেসব অনিয়ম পেয়েছি, তা প্রতিবেদন আকারে মহাপরিচালককে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের নিয়োগের অনিয়ম নিয়েও আমরা তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছি।’
কী কী অনিয়ম: তদন্ত কমিটি যেসব অনিয়ম চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাছাই ও নিয়োগ কমিটি গঠনে অস্বচ্ছতা। প্রায় সব ক্যাটাগরির নিয়োগের ক্ষেত্রে এককভাবে চেনামুখের কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। নিয়োগ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের মতামত নেওয়া হয়নি। কোনো কমিটিকেই আবেদনপত্র বাছাইয়ের পর কোনো প্রতিবেদন দিতে বলা হয়নি। সব কমিটির সদস্যরা বাছাই শেষে রেজিস্টারে কিছু মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকেই রেজিস্টারের সব পাতায় ও সারাংশপত্রে স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু তাঁরা এ কাজের জন্য পারিশ্রমিক নিয়েছেন। কমিটি বলেছে, এতে বোঝা যায়, অধিকাংশ বাছাই কমিটির কাজে স্বচ্ছতা ছিল না।
তদন্ত কমিটির সূত্র জানায়, অধিকাংশ কমিটির সদস্য জেলা কোটার অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন চৌকিদার পদে জেলা কোটা না মেনে মেধা কোটা অনুসরণ করা হয়েছে। এতে সাত জেলার কোনো প্রার্থী (নয়জন নেওয়া যেত) নিয়োগ পাননি। ১২ জেলা থেকে ১৭ জন কম দেওয়া হয়েছে। ২১ জেলা থেকে ২৬ জন অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী কোটায় ১১ জনের জায়গায় নেওয়া হয়েছে দুজন।
কমিটি অনিয়ম চিহ্নিত করে বলেছে, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিসে ৪০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদটি চতুর্থ শ্রেণীর। এসএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্য বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু জেলা কোটাও অগ্রাহ্য করায় ৩২টি জেলা থেকে ৭১ জন প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। প্রতিবন্ধী ৩৬টি কোটার বিপরীতে নেওয়া হয়েছে মাত্র চারজনকে। কমিটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে—কিশোরগঞ্জ থেকে ১৮ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। পাস করেন ছয়জন। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চারজনকে। জেলা কোটায় নিয়োগ দেওয়া যেত আটজন।
কমিটির সূত্র জানায়, ২৫টি ক্যাটাগরিতেই এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জেলার প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, এর মাধ্যমে অনগ্রসর অঞ্চল ও শ্রেণীর প্রার্থীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সূত্রমতে, কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, অধিকাংশ ক্যাটাগরির নিয়োগের ক্ষেত্রে টেব্যুলেশন শিট ঘষামাজা, মৌখিক পরীক্ষার টেব্যুলেশন শিট সংঘবদ্ধ ও অমানবিক উপায়ে তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিটি ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, সহকারী লোকোমাস্টার (চালক), সহকারী উপপরিদর্শক, গুডস সহকারীসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে উত্তরপত্র কাটাকাটির প্রমাণ পেয়েছে। এতে প্রকৃত মেধাবীদের কারসাজি ও জালিয়াতি করে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেকের উত্তরপত্রে এবং মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ফেল করা প্রার্থীদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেস এবং মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে ক্যাটাগরিভিত্তিক জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিসের ৪০০ পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রার্থী পাস না করায় আট নম্বর গ্রেস দেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্ত নিয়োগে গিয়ে দেখা যায়, গ্রেস ছাড়া পাস করা ২৭০ জনের মধ্যে ১৫১ জন প্রার্থীই নিয়োগ পাননি। প্রকৃত পাস করা এই প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয় গ্রেসপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে।
এই পদের অন্তত ৩২ জনের খাতায় মোট নম্বর কাটাকাটি ও ঘষামাজা অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনো খাতায় পরীক্ষকের স্বাক্ষরও ছিল না। ২৮টি খাতায় নম্বর বাড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন—প্রাপ্ত নম্বর ২ কেটে ২৫ করে দেওয়া হয়েছে, ৯ কেটে করা হয়েছে ২৯। কমিটি বলছে, দৈবচয়ন ভিত্তিতে করা এই কয়েকটি খাতা অনিয়মের নমুনা মাত্র। ২৫ ক্যাটাগরির প্রায় সব কটিতে এ রকম বহু খাতা জালিয়াতি করা হয়েছে।
তদন্তে দেখা গেছে, নিয়োগ কমিটি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী কেন্দ্রে গত বছরের ১২ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মৌখিক পরীক্ষা শেষ করেছে। অথচ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ১০ মাস পর প্রার্থী চূড়ান্ত করা স্বাভাবিক কার্যক্রমের পরিপন্থী বলে মত দিয়েছে কমিটি।
কমিটির সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিটি ভবিষ্যতে এ ধরনের পরীক্ষা খাতার পরিবর্তে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে নিয়ে কম্পিউটারে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভাগীয় প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
কমিটি বাকি যাঁদের মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে তাঁরা হলেন—অতিরিক্ত প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, জ্যেষ্ঠ কল্যাণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া, ইউসুফ আলী মৃধার মেয়ের জামাই ও বিভাগীয় প্রকৌশলী (ঢাকা) আরমান হোসেন, বিভাগীয় প্রকৌশলী (চট্টগ্রাম) আবিদুর রহমান, চিফ কমান্ড্যান্ট আমিনুর রশিদ ও সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ আহমেদ। এর বাইরে পূর্বাঞ্চলের সাতটি নিয়োগ কমিটির সদস্য আরও অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটি আংশিকভাবে দায়ী করেছে বলে জানা গেছে। কমিটির সদস্য হিসেবে এঁরা এই অনিয়মের কোনো প্রতিবাদ করেননি।
তদন্তকারী সূত্র বলছে, হাফিজুর রহমান দুটি ক্যাটাগরির নিয়োগে সরাসরি এবং সাতটিতে আংশিক, গোলাম কিবরিয়া ১১টি ক্যাটারিতে এবং আরমান হোসেন, আবিদুর রহমান, আমিনুর রশিদ ও আবু সাইদ আহমেদ একটি করে ক্যাটাগরির নিয়োগে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
তদন্ত কমিটি ইউসুফ আলী মৃধাকে ২৫টি ক্যাটাগরির নিয়োগেই অনিয়মের জন্য দায়ী করেছে। কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা করে জেনেছে, লেটারম্যান পদে নিয়োগের পরীক্ষার ফলাফল প্রতিবেদন প্রস্তুত করার দুই সপ্তাহ আগেই ইউসুফ আলী মৃধা ওই নিয়োগের অনুমোদন দেন! গত বছরের ১৮ মার্চ ও ১৬ এপ্রিল এই পদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা কমিটি গত বছরের ১৮ আগস্ট ফলাফল প্রস্তুত করে। কিন্তু মৃধা ফলাফল অনুমোদন করেন ১৪ দিন আগে, ৪ আগস্ট।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহে তদন্ত প্রতিবেদন যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি রেলসচিব পেয়েছেন। আমার কাছে রোববার (আজ) বা সোমবার আসতে পারে।’ তিনি বলেন, তদন্তে যাঁদের দায়ী করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ও শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলের সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত হলে জনসেবাও নিশ্চিত হবে। অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না।
কোন কোন পদে নিয়োগ: চৌকিদার, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার), ট্রলিম্যান, বাবুর্চি, মালী, ওয়েটিং রুম আয়া, ল্যাম্পম্যান, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, গুডস সহকারী, ট্রেন নম্বর টেকার, সহকারী লোকোমাস্টার, শরীরচর্চা শিক্ষক, কার্পেন্টার, টুলকিপার, জ্যেষ্ঠ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, কোর্ট ইন্সপেক্টর, লেটারম্যান, রেকর্ডকিপার, টেপরিডার, ক্লাসিক্যাল শিক্ষক, টিকিট ইস্যুয়ার, ফুয়েল চেকার, সহকারী কেমিস্ট।
কমিটি ও কার্যপরিধি: তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (যান্ত্রিক) মো. শামছুজ্জামান। অপর দুই সদস্য হলেন যুগ্ম মহাপরিচালক (পরিচালন) মো. মিয়াজাহান ও টেলিযোগাযোগ শাখার সিএসটিই নাসিরউদ্দিন আহমেদ। সদস্যসচিব ছিলেন সংস্থাপন শাখার উপপরিচালক মো. মোফাজ্জল হোসেন। কমিটিকে পূর্বাঞ্চলের ২৫ এবং পশ্চিমাঞ্চলের ১১ ক্যাটাগরিতে নিয়োগের বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১৮ এপ্রিল কমিটি পূর্বাঞ্চলের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে ২২ মে প্রতিবেদন দেয়। এবার কমিটি পশ্চিমাঞ্চলের নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে।
তদন্ত কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে ছিল: নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্র, বাছাই কমিটির নথিপত্র ও প্রতিবেদন, পরীক্ষার আহ্বানপত্র ইস্যু-সংক্রান্ত কাগজপত্র, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মূল্যায়ন (টেব্যুলেশন শিট), নিয়োগ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও অনুমোদনের নথি, নিয়োগপত্র ইস্যু ও বিতরণ এবং জেলা ও অন্য কোটা মানা হয়েছে কি না, তা যাচাই করা। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগসংক্রান্ত খবর পর্যালোচনার দায়িত্বও দেওয়া হয় কমিটিকে। তবে নিয়োগ কার্যক্রমে আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত কমিটির কার্যপরিধিতে ছিল না।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ও রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (পরিচালন) মো. মিয়াজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নথিপত্র যাচাই-বাছাই ও নির্বাচনী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যেসব অনিয়ম পেয়েছি, তা প্রতিবেদন আকারে মহাপরিচালককে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের নিয়োগের অনিয়ম নিয়েও আমরা তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছি।’
কী কী অনিয়ম: তদন্ত কমিটি যেসব অনিয়ম চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাছাই ও নিয়োগ কমিটি গঠনে অস্বচ্ছতা। প্রায় সব ক্যাটাগরির নিয়োগের ক্ষেত্রে এককভাবে চেনামুখের কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। নিয়োগ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের মতামত নেওয়া হয়নি। কোনো কমিটিকেই আবেদনপত্র বাছাইয়ের পর কোনো প্রতিবেদন দিতে বলা হয়নি। সব কমিটির সদস্যরা বাছাই শেষে রেজিস্টারে কিছু মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকেই রেজিস্টারের সব পাতায় ও সারাংশপত্রে স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু তাঁরা এ কাজের জন্য পারিশ্রমিক নিয়েছেন। কমিটি বলেছে, এতে বোঝা যায়, অধিকাংশ বাছাই কমিটির কাজে স্বচ্ছতা ছিল না।
তদন্ত কমিটির সূত্র জানায়, অধিকাংশ কমিটির সদস্য জেলা কোটার অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন চৌকিদার পদে জেলা কোটা না মেনে মেধা কোটা অনুসরণ করা হয়েছে। এতে সাত জেলার কোনো প্রার্থী (নয়জন নেওয়া যেত) নিয়োগ পাননি। ১২ জেলা থেকে ১৭ জন কম দেওয়া হয়েছে। ২১ জেলা থেকে ২৬ জন অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী কোটায় ১১ জনের জায়গায় নেওয়া হয়েছে দুজন।
কমিটি অনিয়ম চিহ্নিত করে বলেছে, ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিসে ৪০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদটি চতুর্থ শ্রেণীর। এসএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্য বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু জেলা কোটাও অগ্রাহ্য করায় ৩২টি জেলা থেকে ৭১ জন প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। প্রতিবন্ধী ৩৬টি কোটার বিপরীতে নেওয়া হয়েছে মাত্র চারজনকে। কমিটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে—কিশোরগঞ্জ থেকে ১৮ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। পাস করেন ছয়জন। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চারজনকে। জেলা কোটায় নিয়োগ দেওয়া যেত আটজন।
কমিটির সূত্র জানায়, ২৫টি ক্যাটাগরিতেই এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জেলার প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, এর মাধ্যমে অনগ্রসর অঞ্চল ও শ্রেণীর প্রার্থীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সূত্রমতে, কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, অধিকাংশ ক্যাটাগরির নিয়োগের ক্ষেত্রে টেব্যুলেশন শিট ঘষামাজা, মৌখিক পরীক্ষার টেব্যুলেশন শিট সংঘবদ্ধ ও অমানবিক উপায়ে তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিটি ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, সহকারী লোকোমাস্টার (চালক), সহকারী উপপরিদর্শক, গুডস সহকারীসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে উত্তরপত্র কাটাকাটির প্রমাণ পেয়েছে। এতে প্রকৃত মেধাবীদের কারসাজি ও জালিয়াতি করে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেকের উত্তরপত্রে এবং মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ফেল করা প্রার্থীদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেস এবং মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে ক্যাটাগরিভিত্তিক জালিয়াতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিসের ৪০০ পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রার্থী পাস না করায় আট নম্বর গ্রেস দেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্ত নিয়োগে গিয়ে দেখা যায়, গ্রেস ছাড়া পাস করা ২৭০ জনের মধ্যে ১৫১ জন প্রার্থীই নিয়োগ পাননি। প্রকৃত পাস করা এই প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয় গ্রেসপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে।
এই পদের অন্তত ৩২ জনের খাতায় মোট নম্বর কাটাকাটি ও ঘষামাজা অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনো খাতায় পরীক্ষকের স্বাক্ষরও ছিল না। ২৮টি খাতায় নম্বর বাড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন—প্রাপ্ত নম্বর ২ কেটে ২৫ করে দেওয়া হয়েছে, ৯ কেটে করা হয়েছে ২৯। কমিটি বলছে, দৈবচয়ন ভিত্তিতে করা এই কয়েকটি খাতা অনিয়মের নমুনা মাত্র। ২৫ ক্যাটাগরির প্রায় সব কটিতে এ রকম বহু খাতা জালিয়াতি করা হয়েছে।
তদন্তে দেখা গেছে, নিয়োগ কমিটি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী কেন্দ্রে গত বছরের ১২ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মৌখিক পরীক্ষা শেষ করেছে। অথচ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ১০ মাস পর প্রার্থী চূড়ান্ত করা স্বাভাবিক কার্যক্রমের পরিপন্থী বলে মত দিয়েছে কমিটি।
কমিটির সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিটি ভবিষ্যতে এ ধরনের পরীক্ষা খাতার পরিবর্তে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে নিয়ে কম্পিউটারে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভাগীয় প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
No comments