চারদিক-‘মনে রেখো মোর গান’ by বিপ্লব বালা
ওয়াহিদ ভাই সারা জীবন কেবল দল করে গেছেন। একের পর এক দল। এ বুঝি ছিল তাঁর নাগরিক সমাজ-রাজনীতির শিক্ষা। দেশের জন্য কিছু করতে হলে দল করতে হয়। সবাই মিলতে হয় আপন হতে বাহির হয়ে। একা আর বোকা যে সমান। তবে দল বা সংগঠন যেই একটি কাঠামো পেয়ে যায়, হয়ে ওঠে তা ক্রমে তো এক ক্ষমতাকাঠামোই।
তারই অনিবার্য বেগে চলতে থাকে দলে তখন কেবলই ক্ষমতার নানা দলাদলি। যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বাইরে যতই কেন তার গালভরা নাম থাক গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। কমিটির মিটিংয়ে কোনো কিছু গরিষ্ঠজনের মত নিয়েই তো পাস করাতে হয়। তবে সেটা কখনোই তো সরল-সোজাভাবে হয় না। আগে থেকেই অনেক দেনদরবার, দলাদলি করেই কিছু ‘পাস’ করাতে হয়। এরই প্রক্রিয়ায় যেকোনো দলে ক্রমে কাজটার চেয়ে ক্ষমতার নিরন্তর ঘাত-প্রতিঘাতই প্রধান কর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
পরস্পরের মধ্যে থাকে না তখন আর স্বাভাবিক মানবিক কোনো সত্য সম্পর্ক। অজান্তে তা এক হিসাবি ক্ষমতা-সম্পর্কেরই চেহারা নেয়। দল করে, দলে থেকে এটা এড়ানো বুঝি যায়ই না। এর প্রতিষেধক সাংস্কৃতিক মানবিক কোনো প্রক্রিয়া তো কোনো দলেই শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া হয় না। তার ফলে দল হয়ে যায় এক দলই, তার নিয়ত দলাদলির নানামুখী ক্ষমতার এক লড়াই সর্বদা জারি রেখে। এটাই সামাজিক সংগঠনের যেন চির এক চরিত্র। নেতা-কর্মীর নিয়ত পারস্পরিক জায়গা বদলের স্বাচ্ছন্দ্য আজও অর্জিত হয়নি হয়তো কোথাও, যাকে বলা যায়, ‘চাই বয়সানুসারে আর সম্বন্ধ যাথার্থ্যে সমতাই।’
ওয়াহিদ ভাইকেও কাজ করার জন্য যেমন দল করতে হয়েছে তেমনি জড়াতে হয়েছে নানা দলাদলিতেও। শুনেছি আগে তিনি পেছনে থেকেই কাজটা করতেন। ক্ষমতাকাঠামোর কমিটিতে না ঢুকে, সাধারণ সদস্য হয়েই। জানি না সেখানেও বিনা দলাদলিতে কিছু পেরেছিলেন কি না করতে। শুনেছি ছায়ানটের অনেক ভাবনা, কাজ, অনুষ্ঠানের রীতি-পদ্ধতি তাঁর ভাবনা থেকেই নাকি হয়েছে অনেকটা। সেসব তিনি সবাইকে দিয়ে কীভাবে করাতে, মানাতে পেরেছিলেন? কারও কারও সঙ্গে আলাদা করে যুক্তিবুদ্ধি করতে কি হয়নি আগে থেকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মিটিংয়ে? বিশেষ ক্ষমতাধর কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই বাগ মানাতে হয়েছিল একেক সময়। খুব সরলভাবে নতুন কিছু, ভালো কিছু সবাই মেনে নিল এমন তো নিশ্চয় হয় না, হতো না, তাহলে কেমন হতো সেসব প্রক্রিয়া?
ওয়াহিদ ভাই সবাইকে বেশ বোঝাতে, মতে আনতে পারতেন সহজেই। তবু ক্ষমতা-স্বার্থ তো দলে নানাভাবে নানাজনের ভেতর তৈরি হয়, সেটা বাগ মানিয়েই তো যা করার করতে হয়। ঢাকার বা একেক শহরের সম্মিলন পরিষদের নেতৃস্থানীয় অনেকের যা সব চেহারা দেখেছি, তাতে আরও বিস্মিত হতাম, তাদের একমত করিয়ে কী করে যে এত দিন এত কিছু করানো যায়! নিশ্চয় তার অন্য মাজেজা আছে, নেতৃত্বের জাদু বা কারিশমা যাকে বলে। ছোট ছোট স্বার্থ-সুবিধা ছাড়া বেশির ভাগ যারা কিছু দেখে না, ভাবে না, তাদের বশ করিয়ে সম্মেলন করে যাওয়া, বছরের পর বছর, ভাবা যায় কতটা দুঃসাধ্য সে কাজ? সমালোচনা করা তো সহজ। কাজ করতে গেলেই বোঝা যায় কত ধানে কত চাল। তাই বুঝি মূল ও জেলা নেতৃত্বে কিছু বদল সর্বদা চলতই। কেউ কেউ কেবল রয়ে যান দীর্ঘকাল। সেই নেতৃত্ব কেবল কোনো সরল সাধু ভালো মানুষিতায় চলে না নিশ্চয়।
তাঁর বেশির ভাগ ভাবনা, কথা তো অবাস্তব, কাল্পনিকই মনে করা হতো দীর্ঘকাল ধরে। অথচ ছায়ানটের জন্ম-বিকাশও মহা অসম্ভব কাল্পনিক ঘটনাই নয় কি? কোনো মহা বাস্তববাদীর কষ্টকল্পনায়ও সে ভাবনা আসতে পারত না নিশ্চয়।
অনেক ধরনের গান নিজে নিজে শিখে সঞ্জয় কী করে যেন ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল বছর কয়েক আগে। তারপর আঠার মতো এমন লেগে থাকে যে আর ছাড়ে না। তাকে নিয়ে সম্মিলন পর্ষদেও নাকি ওয়াহিদ ভাইকে নানা মুশকিলে পড়তে হয়েছে।
বাগেরহাটের গ্রামের এই নিম্নবর্ণের ছোকড়া এত দিন ঢাকায় থেকেও কথাবার্তায় সবার মন জোগানো চালাক-চতুর তেমন হতে পারল না, অথচ কোন গুণে সে-ই কিনা বশ করল শ্রেষ্ঠ এক ‘বাক্য নবাব’ আমাদের এই ওয়াহিদ ভাইকে। নানা গান শোনাত সে তাঁকে, তাঁর গান শেখানোর আসরেও বসে থাকত চ্যালা হয়ে। গানও কিছু তুলেছে ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছে। তো শেষ বয়সে এই এক আজব ঠোঁট-কাটা গানে-খ্যাপা সাগরেদ পেয়েই বুঝি চাগাড় দিয়েছিল তাঁর চির সেই বাসনা—গানের দল করার। এভাবেই ‘গীতিসত্র’। নিশ্চয় কতক শিল্পী সুহূদজন রেগেমেগে টং হয়েছে ওয়াহিদ ভাইয়ের ওপর এই গাঁইয়া ভূতকে অত পাত্তা দেওয়ার জন্য।
ওয়াহিদ ভাই নিজেরই স্বভাব-দোষে তাঁর অমন ‘বাঙ্গাল ঠেঁটা’ গোঁ ধরেই যেন আমৃত্যু কোল দিয়ে গেলেন এই পোষ্যটিকেই। তার হাতেই দিয়ে গেলেন যেন তাঁর এই অন্তিম অঞ্জলি, ‘গীতিসত্র’।
আজ ২১ জ্যৈষ্ঠ ৪ জুন শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায় ছায়ানট সংগীত ভবনে আছে ‘ধ্রুপদী বাংলা গান’-এর অনুষ্ঠান গীতিসত্র পরিবেশিত ‘মনে রেখো মোর গান’।
পরস্পরের মধ্যে থাকে না তখন আর স্বাভাবিক মানবিক কোনো সত্য সম্পর্ক। অজান্তে তা এক হিসাবি ক্ষমতা-সম্পর্কেরই চেহারা নেয়। দল করে, দলে থেকে এটা এড়ানো বুঝি যায়ই না। এর প্রতিষেধক সাংস্কৃতিক মানবিক কোনো প্রক্রিয়া তো কোনো দলেই শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া হয় না। তার ফলে দল হয়ে যায় এক দলই, তার নিয়ত দলাদলির নানামুখী ক্ষমতার এক লড়াই সর্বদা জারি রেখে। এটাই সামাজিক সংগঠনের যেন চির এক চরিত্র। নেতা-কর্মীর নিয়ত পারস্পরিক জায়গা বদলের স্বাচ্ছন্দ্য আজও অর্জিত হয়নি হয়তো কোথাও, যাকে বলা যায়, ‘চাই বয়সানুসারে আর সম্বন্ধ যাথার্থ্যে সমতাই।’
ওয়াহিদ ভাইকেও কাজ করার জন্য যেমন দল করতে হয়েছে তেমনি জড়াতে হয়েছে নানা দলাদলিতেও। শুনেছি আগে তিনি পেছনে থেকেই কাজটা করতেন। ক্ষমতাকাঠামোর কমিটিতে না ঢুকে, সাধারণ সদস্য হয়েই। জানি না সেখানেও বিনা দলাদলিতে কিছু পেরেছিলেন কি না করতে। শুনেছি ছায়ানটের অনেক ভাবনা, কাজ, অনুষ্ঠানের রীতি-পদ্ধতি তাঁর ভাবনা থেকেই নাকি হয়েছে অনেকটা। সেসব তিনি সবাইকে দিয়ে কীভাবে করাতে, মানাতে পেরেছিলেন? কারও কারও সঙ্গে আলাদা করে যুক্তিবুদ্ধি করতে কি হয়নি আগে থেকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মিটিংয়ে? বিশেষ ক্ষমতাধর কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই বাগ মানাতে হয়েছিল একেক সময়। খুব সরলভাবে নতুন কিছু, ভালো কিছু সবাই মেনে নিল এমন তো নিশ্চয় হয় না, হতো না, তাহলে কেমন হতো সেসব প্রক্রিয়া?
ওয়াহিদ ভাই সবাইকে বেশ বোঝাতে, মতে আনতে পারতেন সহজেই। তবু ক্ষমতা-স্বার্থ তো দলে নানাভাবে নানাজনের ভেতর তৈরি হয়, সেটা বাগ মানিয়েই তো যা করার করতে হয়। ঢাকার বা একেক শহরের সম্মিলন পরিষদের নেতৃস্থানীয় অনেকের যা সব চেহারা দেখেছি, তাতে আরও বিস্মিত হতাম, তাদের একমত করিয়ে কী করে যে এত দিন এত কিছু করানো যায়! নিশ্চয় তার অন্য মাজেজা আছে, নেতৃত্বের জাদু বা কারিশমা যাকে বলে। ছোট ছোট স্বার্থ-সুবিধা ছাড়া বেশির ভাগ যারা কিছু দেখে না, ভাবে না, তাদের বশ করিয়ে সম্মেলন করে যাওয়া, বছরের পর বছর, ভাবা যায় কতটা দুঃসাধ্য সে কাজ? সমালোচনা করা তো সহজ। কাজ করতে গেলেই বোঝা যায় কত ধানে কত চাল। তাই বুঝি মূল ও জেলা নেতৃত্বে কিছু বদল সর্বদা চলতই। কেউ কেউ কেবল রয়ে যান দীর্ঘকাল। সেই নেতৃত্ব কেবল কোনো সরল সাধু ভালো মানুষিতায় চলে না নিশ্চয়।
তাঁর বেশির ভাগ ভাবনা, কথা তো অবাস্তব, কাল্পনিকই মনে করা হতো দীর্ঘকাল ধরে। অথচ ছায়ানটের জন্ম-বিকাশও মহা অসম্ভব কাল্পনিক ঘটনাই নয় কি? কোনো মহা বাস্তববাদীর কষ্টকল্পনায়ও সে ভাবনা আসতে পারত না নিশ্চয়।
অনেক ধরনের গান নিজে নিজে শিখে সঞ্জয় কী করে যেন ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল বছর কয়েক আগে। তারপর আঠার মতো এমন লেগে থাকে যে আর ছাড়ে না। তাকে নিয়ে সম্মিলন পর্ষদেও নাকি ওয়াহিদ ভাইকে নানা মুশকিলে পড়তে হয়েছে।
বাগেরহাটের গ্রামের এই নিম্নবর্ণের ছোকড়া এত দিন ঢাকায় থেকেও কথাবার্তায় সবার মন জোগানো চালাক-চতুর তেমন হতে পারল না, অথচ কোন গুণে সে-ই কিনা বশ করল শ্রেষ্ঠ এক ‘বাক্য নবাব’ আমাদের এই ওয়াহিদ ভাইকে। নানা গান শোনাত সে তাঁকে, তাঁর গান শেখানোর আসরেও বসে থাকত চ্যালা হয়ে। গানও কিছু তুলেছে ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছে। তো শেষ বয়সে এই এক আজব ঠোঁট-কাটা গানে-খ্যাপা সাগরেদ পেয়েই বুঝি চাগাড় দিয়েছিল তাঁর চির সেই বাসনা—গানের দল করার। এভাবেই ‘গীতিসত্র’। নিশ্চয় কতক শিল্পী সুহূদজন রেগেমেগে টং হয়েছে ওয়াহিদ ভাইয়ের ওপর এই গাঁইয়া ভূতকে অত পাত্তা দেওয়ার জন্য।
ওয়াহিদ ভাই নিজেরই স্বভাব-দোষে তাঁর অমন ‘বাঙ্গাল ঠেঁটা’ গোঁ ধরেই যেন আমৃত্যু কোল দিয়ে গেলেন এই পোষ্যটিকেই। তার হাতেই দিয়ে গেলেন যেন তাঁর এই অন্তিম অঞ্জলি, ‘গীতিসত্র’।
আজ ২১ জ্যৈষ্ঠ ৪ জুন শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায় ছায়ানট সংগীত ভবনে আছে ‘ধ্রুপদী বাংলা গান’-এর অনুষ্ঠান গীতিসত্র পরিবেশিত ‘মনে রেখো মোর গান’।
No comments