সময়ের প্রেক্ষিত-প্রতিশ্রুতির কাছে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর হার by মনজুরুল হক

জাপানে গত গ্রীষ্মের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গণতান্ত্রিক দলের বিজয়ের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বেশ কয়েক বছরের অস্থিতিশীল প্রশাসনের অবসান ঘটিয়ে আবারও বোধহয় পোক্ত একটি সরকার ক্ষমতাসীন হচ্ছে।


এ রকম ধারণার পেছনে উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপির পাঁচ দশকের বেশি সময়ের প্রায় বিরতিহীন আধিপত্যের অবসান ঘটানো এবং সদ্য ক্ষমতাসীন দলটির জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। উদার গণতন্ত্রী দল বাম ও ডানের উদ্ভট এক মিশ্রণ থেকে তৈরি মধ্য বাম নীতিমালায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রত্যাশা নিয়েই জনগণ দলটিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে।
ইউকিয়ো হাতোয়ামা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, তিনি হয়তো সংসদে ব্যাপক সমর্থনের ভিত্তিতে শক্ত হাতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। ভাবা হয়েছিল, হাতোয়ামার পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্ভবত তাঁকে সাহায্য করবে এবং বলিষ্ঠ এক নেতা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি হয়তো সক্ষম হবেন। কিন্তু এসবের বাস্তব প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বছর অতিক্রান্ত না হতেই অসময়ে তাঁকে এখন বিদায় নিতে হলো। তিনি হলেন ২০০৬ সালে জুনিচিরো কোইজুমি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে চার বছরের কম সময়ে বিদায় নেওয়া জাপানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী।
হাতোয়ামার নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল আগের যেকোনো সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এলডিপিকে নির্বাচনে ধরাশায়ী করার মধ্য দিয়ে ভোটারদের অনেকেই ভেবেছিলেন, জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যাশিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ রদবদল তাঁরা হয়তো লক্ষ করতে পারবেন। দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব খর্ব করায় সরকার অনেকটাই সফল হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বিরোধী দলের আসন গ্রহণকারী দলের যে সরকার পরিচালনার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারার ঘাটতি নিশ্চিতভাবে দেখা দেবে, আমলাতন্ত্রের পক্ষে তা বুঝে ওঠা মোটেও কষ্টকর হয়নি।
ফলে সরকারকে পরোক্ষে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্রে যে আমলাতন্ত্র জড়িত থাকেনি, তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। রাজনীতির বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, প্রভাবশালী আমলাতান্ত্রিক কাঠামো শুরু থেকেই নানারকম উপায়ে সেই চেষ্টা করে গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী তহবিলসংক্রান্ত অনিয়ম এবং গণতান্ত্রিক পার্টির মহাসচিবের রাজনৈতিক তহবিল কেলেংকারি ঘটনার তদন্তে কৌঁসুলিদের আচরণকে সে রকম দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁরা দেখছেন, যা কি না শুরু থেকেই হাতোয়ামা প্রশাসনের সামনে বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনসমর্থন দ্রুত হ্রাস পাওয়ার একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে হাতোয়ামার হঠাৎ করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে যে দুটি কারণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তা হলো, ওকিনাওয়া দ্বীপে অবস্থিত মার্কিন মেরিন বাহিনীর ফুতেনমা বিমান স্টেশন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিকে ঘিরে জাপানের ওপর মার্কিন সরকারের ক্রমশ বৃদ্ধি করে চলা চাপ এবং ক্ষমতাসীন দলে ক্ষমতার দ্বৈত উৎস ঘিরে দেখা দেওয়া জটিলতা।
গত গ্রীষ্মের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হাতোয়ামার মনোনয়ন অনেকটাই ছিল দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী মহাসচিব ইচিরো ওজাওয়ার সর্বময় কর্তৃত্ব বজায় রাখার পরোক্ষ পাঁয়তারা। এ জন্যই জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া নাওতো কানকে পরাজিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। কান হচ্ছেন রাজনীতিবিদ হিসেবে হাতোয়ামার চেয়ে অনেক বেশি ক্যারিশমার অধিকারী এবং তাঁর অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও হাতোয়ামার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত রাখতে আগ্রহী ওজাওয়া স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন চিন্তার অধিকারী একজন রাজনীতিবিদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে নিশ্চিত হতে পারেন না। ফলে হাতোয়ামার বিজয় নিশ্চিত করে নিতে সব রকম চেষ্টা তিনি তখন করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর পুরস্কার হিসেবে হাতোয়ামা ওজাওয়াকে দলীয় মহাসচিব পদে নিয়োগ দিয়ে তাঁর ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং এর মধ্য দিয়ে দলের বাইরে সরকারেও ক্ষমতার দ্বৈত উৎস তৈরি হয়। কৌঁসুলিরা পরে ওজাওয়ার আর্থিক কেলেংকারির সূত্র ধরে তাঁর কয়েকজন সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীকে গ্রেপ্তার করলে গণতান্ত্রিক দলের প্রতি জনসমর্থন দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে এবং জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে ক্ষমতার সুতো ধরা আছে ওজাওয়ার হাতে এবং নিজের ইচ্ছামতো সেই সুতোয় তিনি টান দিয়ে চলেছেন।
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ওকিনাওয়া দ্বীপের ওপর চেপে বসা মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সরানোর সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ওকিনাওয়াবাসী গত নির্বাচনে দলটির প্রতি ব্যাপক সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। দ্বীপবাসীদের প্রত্যাশা ছিল সরকার হয়তো প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে।
বিশেষ করে ফুতেনমা বিমান ঘাঁটি দ্বীপের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার তাদের আশান্বিত করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাতোয়ামা শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের চাপের মুখে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুয়ায়ী একই দ্বীপের নাগো শহরে ফুতেনমার বিকল্প তৈরি করে দিতে সম্মত হন। ওকিনাওয়াবাসীর মধ্যে তা ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং সরকার ও ঘাঁটিবিরোধী বিশাল বিক্ষোভ দ্বীপজুড়ে চলতে থাকে। সে রকম অবস্থায় কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার সমাজ গণতন্ত্রী দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দলিল স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানালে প্রধানমন্ত্রী ঐ দলের সভানেত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করে নতুন বিপদ ডেকে আনেন। দলের নীতিনির্ধারকদের কাছেও পরিষ্কার হয়ে যায়, নীতিগত প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর দোদুল্যমান আচরণে জনসমর্থনে ধস নামছে এবং অবস্থার রদবদল না হলে আগামী গ্রীষ্মের উচ্চকক্ষ নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য পরাজয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এ রকম অবস্থায় ওজাওয়া নিজেই প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালে হাতোয়ামাও প্রথমবারের মতো নিজস্ব অবস্থান নেন। তিনি ওজাওয়াকেও একই সঙ্গে দলীয় মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন, ওজাওয়ার পক্ষে যে অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
এ রকম এক জটিল পথ ধরেই শেষ পর্যন্ত নাওতো কানের সামনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পথ খুলে যায় এবং হাতোয়ামা-ওজাওয়ার দ্বৈত ক্ষমতার প্রভাব থেকে দলটি আপাতত বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী গণতান্ত্রিক পার্টির প্রতি জনসমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হবেন কি না এবং জাপানকে অর্থনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের করে আনতে পারবেন কি না, আগামী দিনগুলোতে তার আভাস পাওয়া যাবে।
(টোকিও, ৬ জুন ২০১০)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.