আবারও কি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র by ড. মাহবুব উল্লাহ্
বিগত কয়েক সপ্তাহজুড়ে শাসক দলের মন্ত্রীবর্গ এবং তাদের বুদ্ধিশ্রমিকরা যেসব কথাবার্তা বলছেন এবং যেভাবে আচার-আচরণ করছেন তা থেকে এমন আশঙ্কা করা অমূলক হবে না যে, অচিরেই দেশে বেসামরিক স্বৈরাচারের উদ্ভব ঘটতে যাচ্ছে।
সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ব্যাপারে তার নিজের অনীহার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। সরকার সমর্থক রাজনীতিবিদরা বাকশাল ব্যবস্থার গুণকীর্তন করেছেন। এর মধ্যে একজন এমনও বলেছেন, ওই ব্যবস্থা যদি অব্যাহত থাকত তাহলে ১৯৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতো। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর উপর সর্বোচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কে সংবাদপত্রে যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তারপরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি সকল জড়তা এবং দ্বিধাচিত্ততা ঝেড়ে ফেলে এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে। কিন্তু তারা যে সত্যটি উপলব্ধি করতে চান না কিংবা যে সত্যের মুখোমুখি হতে চান না সেটা হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কীভাবে রচিত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরে অবিভক্ত পাকিস্তানের জনগণকে নিষ্কলুষ গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়েছে। সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিকতার জগদ্দল পাথর অপসারণের জন্য তত্কালীন পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছিল। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছিল পাকিস্তানি জনগণ গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা মেনে নেবে না। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি ছিল সামরিক স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় গ্রহণ। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র তরুণরাই সবচেয়ে সাহসীা ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক তারিক আলী তার চধশরংঃধহ : গরষরঃধত্ু ত্ঁষব ড়ত্ ঢ়বড়ঢ়ষব'ং ঢ়ড়বিত্ গ্রন্থে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সাফল্য সম্পর্কে তার অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ১৯৬৮তে ফ্রান্সের ছাত্র-শ্রমিকদের তুলনা করেছিলেন। ১৯৬৮-এর মে মাসে রুডি ডাটস্কি ও কোন বেন্ডিটের মতো প্রথাবিরোধী ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ফ্রান্সে যে বৈপ্লবিক টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে মনে হচ্ছিল ফ্রান্স একটি সমাজ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। কিন্তু সেই বিশাল অভ্যুত্থান কোনো সুনির্দিষ্ট সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তারা ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্যাগলের রক্ষণশীল সরকারকেও ক্ষমতা থেকে সরাতে সক্ষম হয়নি। তাদের এ ব্যর্থতার একটি বড় কারণ ছিল তত্কালীন ফ্রান্সের সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বের সমর্থন পায়নি। কিন্তু ১৯৬৯-এ যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল সেই অভ্যুত্থানে এশিয়ার দ্যাগল বলে পরিচিতি অর্জনকারী লৌহমানব আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এই দিক থেকে এশিয়ার এ ছাত্র অভ্যুত্থানটি ইউরোপের একটি দেশের ছাত্র অভ্যুত্থানের তুলনায় ছিল অনেক বেশি সফল; কিন্তু এই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা হলো একটি সামরিক বা আধা-সামরিক সরকারের বিদায় হলেও তার জায়গায় এসেছিল আরেকটি সামরিক সরকার। এই সামরিক সরকারেরই নেতৃত্বে ছিল জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। অর্থাত্ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী স্থিতাবস্থাকে ধরে রাখার জন্য তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিভূকে পাল্টে নতুন একজন প্রতিভূ খুঁজে নিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আমাদের একথাও স্মরণ করতে হবে যে, ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা মি. জিটির মতো কোনো সংস্থা বা দল খোলাখুলি আইয়ুব খানের পক্ষাবলম্বন করার সাহস পায়নি। অভ্যুত্থানের শক্তি এতই প্রবল ছিল যে, কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে আইয়ুব খানের জন্য ওকালতি করার সাহস হয়নি। আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক ডেকে একটি আপসরফা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তার সেই চেষ্টাও ভণ্ডুল হয়ে যায়।
আইয়ুব খান যখন গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন পাকিস্তানের ক্ষমতাকেন্দ্র পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন স্থানে আপসহীন লড়াই ও সংগ্রামের জন্য একের পর এক বিশাল জনসমাবেশে আগুনঝরা ভাষায় বক্তৃতা করছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক সফর শেষে তিনি ২৪ মার্চ ১৯৬৯ ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে বিপ্লবী সংবর্ধনা জানানো হয়। হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ এবং তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মী ও সমর্থকরা লাল পতাকা হাতে মিছিল সহকারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত নিয়ে আসে তাকে। মওলানা ভাসানীকে একটি ট্রাকের উপর বসানো হয়। তার পাশে আরও ছিলেন তত্কালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা, রাশেদ খান মেনন এবং আমি নিজে। মিছিল শেষে মওলানা ভাসানী ইস্কাটনে অবস্থিত ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী কর্তৃক গুম করে ফেলা সাইদুল হাসান সাহেবের বাসায় ওঠেন। সেদিনই রাত ৮টার দিকে মওলানা ভাসানী আমাদের বেশ ক’জনের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপে মেতে উঠেছিলেন। সেই বৈঠকে সদ্য কারামুক্ত ফরিদপুরের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সমর সিংও উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী অনেকটা হাল্কা মেজাজে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মহবুব দেশে যদি সামরিক শাসন জারি হয় তাহলে কি করবা?’ উল্লেখ্য যে, মওলানা ভাসানী আমাকে স্নেহ করে মাহবুবের পরিবর্তে মহবুব বলেই ডাকতেন। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, দেশে কি তাহলে সামরিক শাসন জারি হতে যাচ্ছে? আমার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই কমরেড সমর সিং বলে বসলেন, ‘না হুজুর, এটা অসম্ভব। এত বড় গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক শাসন অসম্ভব।’ মওলানা সাহেব কিঞ্চিত্ পরিহাসের সুরে বললেন, ‘তোমরা কমিউনিস্টরা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে চিনতে পারনি।’ তার এই উক্তির পর আমার সন্দেহের অবকাশ থাকল না যে, সামরিক শাসন অবশ্যম্ভাবী। পরদিনই ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করল। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তার পাশাপাশি সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা ও তার পরিণতি উপলব্ধি করে পূর্ববাংলাবাসীকে আশ্বস্ত করার জন্য এই প্রদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত দাবি জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিল ইয়াহিয়া খান। অতীতে সংখ্যাসাম্যের নীতি অনুসরণ করে পূর্ববাংলার জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা ছিল সমান সমান। কিন্তু জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকৃত হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার স্বাধিকার অর্জনের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হলো। ১৯৭০-এর ডিসেম্বর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি আসন বাদে সবক’টি আসন পেল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তা সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আঁচ করতে পারেননি। ফলেই শুরু হলো নানামুখী চক্রান্ত। সেই কাহিনী সচেতন পাঠকদের অজানা থাকার কথা নয়। সবশেষে পূর্ববাংলাবাসীর ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো বাংলাদেশ। একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসেবে প্রয়োজন ছিল একটি অবাধ নির্বাচন এবং জনসংখ্যার অনুপাতে জনপ্রতিনিধিত্ব। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবির নৈতিক সাফল্য নিশ্চিত করে। এই নৈতিক সাফল্যের পটভূমি ব্যতিরেকে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থতা বিশ্বজনমতের কাছে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতো না। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি এবং প্রাণরসের উত্স হলো গণতন্ত্র। আজ সেই গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী বাকশালী শাসনের যথার্থতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। যারা এভাবে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার কথা বলছেন তাদের এসব বক্তব্যকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভাবার সুযোগ নেই। অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরতন্ত্রের উলঙ্গ অভিব্যক্তি আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনো সভ্য মানুষ কখনোই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সেই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রকে গণগ্রেফতার ও হয়রানি কোন মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? অপরদিকে শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যখন হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটায় কিংবা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তিবাণিজ্যে লিপ্ত হয় তখন তো চিরুনি অভিযান চলতে দেখি না। আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো পক্ষের উপরই চিরুনি অভিযানজাতীয় ঢালাও কোনো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের দমনের জন্য বিদ্যমান আইনের ছক অনুসারেই এগুতে হবে। আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আইনের শাসনের ব্যাপারটি বর্তমান শাসক দলের কাছে খুব পছন্দনীয় কিছু নয়। ১৯৭৫-পূর্ববর্তী সময়ে হুঙ্কার দিয়ে উচ্চারণ করা হয়েছিল আমরা আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই। ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে এ ধরনের হুঙ্কার উচ্চারিত হয়েছিল। অবশ্য এর অল্প ক’মাসের মধ্যেই সংবিধানের খোলনইচে পাল্টে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ভারতেও প্রায় পাশাপাশি সময়ে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। দু’বছর স্থায়ী জরুরি অবস্থার সময় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী ভারত একটি বৃহত্ কারাগারে পরিণত হয়েছিল। সেই সময়কার ভারতেও স্লোগান তোলা হয়েছিল 'ওহফরধ রং ওহফরত্ধ ধহফ ওহফরত্ধ রং ওহফরধ'. ১৯৭৫-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশেও শাসক দল এরকমই একটি স্লোগান দিত। স্লোগানটি ছিল ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ আজ যখন বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে অনুপযোগী বলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মন্তব্য করেন তখন আতঙ্কিত বোধ না করে পারি না। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জেনারেল মইন বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন মডেলের গণতন্ত্র প্রয়োজন বলে একটি তত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিল। জেনারেল মইনের এই তত্ত্বের সঙ্গে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অনুসৃত তত্ত্বের একটি মিল লক্ষ্য করা যায়। আইয়ুব খান বলতেন, চধশরংঃধহ হববফং ধ ংুংঃবস ড়ভ ফবসড়পত্ধপু ংঁরঃবফ ঃড় ঃযব মবহরঁং ড়ভ রঃং ঢ়বড়ঢ়ষব. আইয়ুব খান মনে করতেন পাকিস্তানের নিরক্ষর ও বুদ্ধিশুদ্ধিহীন জনগণের জন্য মৌলিক গণতন্ত্রের মতো এক অদ্ভুত কিসিমের গণতন্ত্র দরকার। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার হরণ করে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায়ও টিকে ছিলেন। জেনারেল মইনও সম্ভবত তার আজব কল্পনার ফানুস হিসেবে বাংলাদেশের উপযোগী গণতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিলেন। এখন দেখছি যারা দাবি করেছিলেন মইন সাহেবদের শাসন তাদের আন্দোলনের ফসল তাদেরই মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আকারে-ইঙ্গিতে এমনকি খোলামেলাভাবে অতীতের স্বৈরশাসকদের মতো হয়তোবা কেবল গণতান্ত্রিকতার একটি লেবাস রেখে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বা অনুদার গণতন্ত্র চালু করার কথা ভাবছেন। এই অবিমৃষ্যকারিতার পরিণতি কী তারা আদৌ ভেবে দেখেছেন? আশা করব তারা হুঁশ-জ্ঞান হারাবেন না।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আইয়ুব খান যখন গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন পাকিস্তানের ক্ষমতাকেন্দ্র পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন স্থানে আপসহীন লড়াই ও সংগ্রামের জন্য একের পর এক বিশাল জনসমাবেশে আগুনঝরা ভাষায় বক্তৃতা করছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক সফর শেষে তিনি ২৪ মার্চ ১৯৬৯ ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে বিপ্লবী সংবর্ধনা জানানো হয়। হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ এবং তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মী ও সমর্থকরা লাল পতাকা হাতে মিছিল সহকারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত নিয়ে আসে তাকে। মওলানা ভাসানীকে একটি ট্রাকের উপর বসানো হয়। তার পাশে আরও ছিলেন তত্কালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা, রাশেদ খান মেনন এবং আমি নিজে। মিছিল শেষে মওলানা ভাসানী ইস্কাটনে অবস্থিত ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী কর্তৃক গুম করে ফেলা সাইদুল হাসান সাহেবের বাসায় ওঠেন। সেদিনই রাত ৮টার দিকে মওলানা ভাসানী আমাদের বেশ ক’জনের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপে মেতে উঠেছিলেন। সেই বৈঠকে সদ্য কারামুক্ত ফরিদপুরের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সমর সিংও উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী অনেকটা হাল্কা মেজাজে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মহবুব দেশে যদি সামরিক শাসন জারি হয় তাহলে কি করবা?’ উল্লেখ্য যে, মওলানা ভাসানী আমাকে স্নেহ করে মাহবুবের পরিবর্তে মহবুব বলেই ডাকতেন। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, দেশে কি তাহলে সামরিক শাসন জারি হতে যাচ্ছে? আমার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই কমরেড সমর সিং বলে বসলেন, ‘না হুজুর, এটা অসম্ভব। এত বড় গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক শাসন অসম্ভব।’ মওলানা সাহেব কিঞ্চিত্ পরিহাসের সুরে বললেন, ‘তোমরা কমিউনিস্টরা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে চিনতে পারনি।’ তার এই উক্তির পর আমার সন্দেহের অবকাশ থাকল না যে, সামরিক শাসন অবশ্যম্ভাবী। পরদিনই ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করল। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তার পাশাপাশি সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা ও তার পরিণতি উপলব্ধি করে পূর্ববাংলাবাসীকে আশ্বস্ত করার জন্য এই প্রদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত দাবি জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিল ইয়াহিয়া খান। অতীতে সংখ্যাসাম্যের নীতি অনুসরণ করে পূর্ববাংলার জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা ছিল সমান সমান। কিন্তু জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকৃত হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার স্বাধিকার অর্জনের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হলো। ১৯৭০-এর ডিসেম্বর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি আসন বাদে সবক’টি আসন পেল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তা সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আঁচ করতে পারেননি। ফলেই শুরু হলো নানামুখী চক্রান্ত। সেই কাহিনী সচেতন পাঠকদের অজানা থাকার কথা নয়। সবশেষে পূর্ববাংলাবাসীর ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো বাংলাদেশ। একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসেবে প্রয়োজন ছিল একটি অবাধ নির্বাচন এবং জনসংখ্যার অনুপাতে জনপ্রতিনিধিত্ব। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবির নৈতিক সাফল্য নিশ্চিত করে। এই নৈতিক সাফল্যের পটভূমি ব্যতিরেকে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থতা বিশ্বজনমতের কাছে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতো না। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি এবং প্রাণরসের উত্স হলো গণতন্ত্র। আজ সেই গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী বাকশালী শাসনের যথার্থতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। যারা এভাবে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার কথা বলছেন তাদের এসব বক্তব্যকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভাবার সুযোগ নেই। অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরতন্ত্রের উলঙ্গ অভিব্যক্তি আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনো সভ্য মানুষ কখনোই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সেই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রকে গণগ্রেফতার ও হয়রানি কোন মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? অপরদিকে শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যখন হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটায় কিংবা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তিবাণিজ্যে লিপ্ত হয় তখন তো চিরুনি অভিযান চলতে দেখি না। আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো পক্ষের উপরই চিরুনি অভিযানজাতীয় ঢালাও কোনো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের দমনের জন্য বিদ্যমান আইনের ছক অনুসারেই এগুতে হবে। আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আইনের শাসনের ব্যাপারটি বর্তমান শাসক দলের কাছে খুব পছন্দনীয় কিছু নয়। ১৯৭৫-পূর্ববর্তী সময়ে হুঙ্কার দিয়ে উচ্চারণ করা হয়েছিল আমরা আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই। ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে এ ধরনের হুঙ্কার উচ্চারিত হয়েছিল। অবশ্য এর অল্প ক’মাসের মধ্যেই সংবিধানের খোলনইচে পাল্টে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ভারতেও প্রায় পাশাপাশি সময়ে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। দু’বছর স্থায়ী জরুরি অবস্থার সময় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী ভারত একটি বৃহত্ কারাগারে পরিণত হয়েছিল। সেই সময়কার ভারতেও স্লোগান তোলা হয়েছিল 'ওহফরধ রং ওহফরত্ধ ধহফ ওহফরত্ধ রং ওহফরধ'. ১৯৭৫-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশেও শাসক দল এরকমই একটি স্লোগান দিত। স্লোগানটি ছিল ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ আজ যখন বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে অনুপযোগী বলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মন্তব্য করেন তখন আতঙ্কিত বোধ না করে পারি না। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জেনারেল মইন বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন মডেলের গণতন্ত্র প্রয়োজন বলে একটি তত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিল। জেনারেল মইনের এই তত্ত্বের সঙ্গে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অনুসৃত তত্ত্বের একটি মিল লক্ষ্য করা যায়। আইয়ুব খান বলতেন, চধশরংঃধহ হববফং ধ ংুংঃবস ড়ভ ফবসড়পত্ধপু ংঁরঃবফ ঃড় ঃযব মবহরঁং ড়ভ রঃং ঢ়বড়ঢ়ষব. আইয়ুব খান মনে করতেন পাকিস্তানের নিরক্ষর ও বুদ্ধিশুদ্ধিহীন জনগণের জন্য মৌলিক গণতন্ত্রের মতো এক অদ্ভুত কিসিমের গণতন্ত্র দরকার। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার হরণ করে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায়ও টিকে ছিলেন। জেনারেল মইনও সম্ভবত তার আজব কল্পনার ফানুস হিসেবে বাংলাদেশের উপযোগী গণতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিলেন। এখন দেখছি যারা দাবি করেছিলেন মইন সাহেবদের শাসন তাদের আন্দোলনের ফসল তাদেরই মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আকারে-ইঙ্গিতে এমনকি খোলামেলাভাবে অতীতের স্বৈরশাসকদের মতো হয়তোবা কেবল গণতান্ত্রিকতার একটি লেবাস রেখে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বা অনুদার গণতন্ত্র চালু করার কথা ভাবছেন। এই অবিমৃষ্যকারিতার পরিণতি কী তারা আদৌ ভেবে দেখেছেন? আশা করব তারা হুঁশ-জ্ঞান হারাবেন না।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments