সাংস্কৃতিক দূষণঃ কিছু প্রাসঙ্গিক কথা by শাহ্ আবদুল হান্নান
বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেছে— উত্সবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা দিবসের নামে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালিত হলো। ফুল, কার্ড, উপহার সামগ্রী ও মেসেজ প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব, বিবাহিতরা বিতরণ করে থাকেন। শত শত মানুষকে এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করতে দেখা গেছে।
শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের সমবেত হয়ে উত্সব করতেও দেখা গেছে। দিনটি উপলক্ষে তারা বিশেষ রঙিন পোশাক-আশাক পরিধান করে নিজেরা বর্ণিল সাজে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল। তবে বলাবাহুল্য ভালোবাসার নামে এই দিবসে তরুণ-তরুণীদের বেশি উত্সাহী দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কালচারাল সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে অনুষ্ঠান করে দিনটি উদ্যাপন করতে দেখা গেছে। ধানমন্ডি লেক ও রাজধানীর বিভিন্ন ডেটিংয়ের স্থানে তরুণ-তরুণীদের সরব উপস্থিতি থাকলেও ভ্যালেন্টাইন ডে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক থেকেছে। টিএসসি, বকুলতলা, চারুকলা ইনস্টিটিউট, বটতলার নামই পত্রপত্রিকায় বেশি এসেছে। ক্যাম্পাসের সব স্থানেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের বইমেলাতেও তরুণ-তরুণীদের ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে উত্সবমুখর উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। ছেলেদের পরনে টি-শার্ট, মেয়েরা হলুদ-কমলার সমন্বয়ের শাড়ি পরা। তাদের গায়ে, হাতে-মুখে উল্কি দেখা যায়। এসবের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। দিনটি উপলক্ষে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদ্যাপন পরিষদ’ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি মিছিল বের করে। দিনটি উপলক্ষে কনসার্টের আয়োজনও একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়িকভাবে এই দিনটিতে নানান পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়।
বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে এটুকু আমি নিয়েছি। এভাবেই আমাদের দেশের কোথাও কোথাও ভালোবাসা দিবসের নামে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে পালন হতে দেখা গেছে। তবে দেশের সাধারণ জনগণকে এই দিনটি পালন করতে দেখা যায়নি। এই দিন উপলক্ষে বাবা-মা’র প্রতি, গরিবদের বা বঞ্চিতদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। একজন সম্পাদক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাত্কারে বলছিলেন, এই দিনটি মালিক-শ্রমিকের মধ্যে, প্রতিপক্ষ দলের ও গ্রুপের ইত্যাদির মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর কিছুই দেখতে পাইনি। আসলে সেটা সেই বুদ্ধিজীবীর দিবাস্বপ্ন। প্রকৃতপক্ষে এই দিনটি পালনের মূল অংশ বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা। অবিবাহিতদের অবাধ মেলামেশা আর কিছু মুনাফাজনক পণ্যের বিক্রি বাড়ানো। এসবের পেছনে ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিষয়টি মুখ্য বলে পরিগণিত হয়। এখানে লন্ডনের ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় প্রকাশিত ড. খালিদ বেগ’র ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপর লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করা যায়, ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা করছে যেসব মুসলমান, তাদের বেশিরভাগই জানে না যে, আসলে তারা কি করছে। তারা অন্ধভাবে অনুকরণ করছে তাদের সাংস্কৃতিক নেতৃবর্গকে, যারা তাদের মতোই অন্ধ। যাকে নির্দোষ আনন্দ মনে করা হচ্ছে, তার শেকড় যে পৌত্তলিকতায় প্রোথিত হতে পারে, এটা ওরা বোঝেই না। আর যে ধ্যান-ধারণা তারা ধার নিয়েছে তা হতে পারে কুসংস্কার। এ সবকিছুই ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী।’
ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘ভালোবাসা দিবসের উত্পত্তি নিয়ে কাহিনী-কিংবদন্তি প্রচুর। এটা স্পষ্ট, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রোমানরা এটা শুরু করেছিল পৌত্তলিক পার্বন হিসেবে। ‘উর্বরতা ও জনসমষ্টির দেবতা’ লুপারকাসের সম্মানার্থেই এটা করা হতো। ... এর প্রধান আকর্ষণ ছিল যে লটারির মাধ্যমে যুবতীদের ওইদিন যুবকদের মধ্যে বণ্টন করা হতো পরবর্তী বছরের জন্য। পরের বছর লটারি না হওয়া পর্যন্ত যুবকরা ওই সুযোগ পেত। আরেকটি ঘৃণ্য প্রথা ছিল যুবতীদের প্রহার করা। ছাগলের চামড়া দ্বারা স্বল্প বসন পরা দুই যুবক একই চামড়ার বেত দিয়ে এ নির্যাতন চালাত। ছাগল ও কুকুরের রক্তে এ যুবকরা রঞ্জিত ছিল। তাদের প্রহার খেলে যুবতীরা আরও ভালোভাবে গর্ভধারণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করা হতো।”
পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টধর্ম এটাকে পৌত্তলিকতা ও অনৈতিকতা থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে; কিন্তু তারা কেবল লটারির নাম পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হলো না। একজন সাধু (ঝধরহঃ)-এর নামে লটারির নাম করা হতো যাতে এসব যুবক-যুবতী ওই সাধুর মতো চরিত্রবান হয় ।
এ দিবসের পূর্ব নাম ‘লুপারক্যালিয়া’ থেকে বর্তমান নাম ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হয়েছে। গেলাসিয়াস নামের পোপ ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটা করেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের সন্ন্যাসীর সম্মানার্থে। তবে ৫০ জন ভ্যালেন্টাইনের কথা বিভিন্ন কাহিনীতে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন সমধিক পরিচিত। অবশ্য তাদের জীবন ও আচরণ রহস্যাবৃত। সেখান থেকে আরও জানা যায়, লটারি নিয়ে মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেয়ায় ফরাসি সরকার ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন দিবস নিষিদ্ধ করে দেয়। এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকে দিবসটি বিদায় নেয়। সপ্তদশ শতকে পিউরিটানরা যখন বেশ প্রভাবশালী ছিল, তখন ইংল্যান্ডেও ভালোবাসা দিবস নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আবার এটি পালনের প্রথা চালু করেন। ইংল্যান্ড থেকে ভ্যালেন্টাইন গেল ‘নতুন দুনিয়া’য় এবং এটা এখন অর্থাত্ আমেরিকায়। সেখানে উত্সাহী ইয়াঙ্কিরা পয়সা কামানোর বড় সুযোগ খুঁজে পেল এর মাঝে।’ ক্রমে ক্রমে এটা ব্যবসা ও মুনাফা অর্জনের দিবসে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমরা দেখতে পাই, ভালোবাসা দিবস নিয়ে যে সংস্কৃতি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে তা কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতি হতে পারে না। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করে মুনাফার উদ্দেশেই এর প্রচলন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি যে, দিবসটি ক্রমেই একটি বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারেই পরিণত হচ্ছে। এর মাধ্যমে অবৈধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা আমাদের একটি অংশকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : চিন্তাবিদ, সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে এটুকু আমি নিয়েছি। এভাবেই আমাদের দেশের কোথাও কোথাও ভালোবাসা দিবসের নামে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে পালন হতে দেখা গেছে। তবে দেশের সাধারণ জনগণকে এই দিনটি পালন করতে দেখা যায়নি। এই দিন উপলক্ষে বাবা-মা’র প্রতি, গরিবদের বা বঞ্চিতদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। একজন সম্পাদক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাত্কারে বলছিলেন, এই দিনটি মালিক-শ্রমিকের মধ্যে, প্রতিপক্ষ দলের ও গ্রুপের ইত্যাদির মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর কিছুই দেখতে পাইনি। আসলে সেটা সেই বুদ্ধিজীবীর দিবাস্বপ্ন। প্রকৃতপক্ষে এই দিনটি পালনের মূল অংশ বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা। অবিবাহিতদের অবাধ মেলামেশা আর কিছু মুনাফাজনক পণ্যের বিক্রি বাড়ানো। এসবের পেছনে ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিষয়টি মুখ্য বলে পরিগণিত হয়। এখানে লন্ডনের ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় প্রকাশিত ড. খালিদ বেগ’র ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপর লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করা যায়, ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা করছে যেসব মুসলমান, তাদের বেশিরভাগই জানে না যে, আসলে তারা কি করছে। তারা অন্ধভাবে অনুকরণ করছে তাদের সাংস্কৃতিক নেতৃবর্গকে, যারা তাদের মতোই অন্ধ। যাকে নির্দোষ আনন্দ মনে করা হচ্ছে, তার শেকড় যে পৌত্তলিকতায় প্রোথিত হতে পারে, এটা ওরা বোঝেই না। আর যে ধ্যান-ধারণা তারা ধার নিয়েছে তা হতে পারে কুসংস্কার। এ সবকিছুই ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী।’
ভালোবাসা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘ভালোবাসা দিবসের উত্পত্তি নিয়ে কাহিনী-কিংবদন্তি প্রচুর। এটা স্পষ্ট, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রোমানরা এটা শুরু করেছিল পৌত্তলিক পার্বন হিসেবে। ‘উর্বরতা ও জনসমষ্টির দেবতা’ লুপারকাসের সম্মানার্থেই এটা করা হতো। ... এর প্রধান আকর্ষণ ছিল যে লটারির মাধ্যমে যুবতীদের ওইদিন যুবকদের মধ্যে বণ্টন করা হতো পরবর্তী বছরের জন্য। পরের বছর লটারি না হওয়া পর্যন্ত যুবকরা ওই সুযোগ পেত। আরেকটি ঘৃণ্য প্রথা ছিল যুবতীদের প্রহার করা। ছাগলের চামড়া দ্বারা স্বল্প বসন পরা দুই যুবক একই চামড়ার বেত দিয়ে এ নির্যাতন চালাত। ছাগল ও কুকুরের রক্তে এ যুবকরা রঞ্জিত ছিল। তাদের প্রহার খেলে যুবতীরা আরও ভালোভাবে গর্ভধারণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করা হতো।”
পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টধর্ম এটাকে পৌত্তলিকতা ও অনৈতিকতা থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে; কিন্তু তারা কেবল লটারির নাম পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হলো না। একজন সাধু (ঝধরহঃ)-এর নামে লটারির নাম করা হতো যাতে এসব যুবক-যুবতী ওই সাধুর মতো চরিত্রবান হয় ।
এ দিবসের পূর্ব নাম ‘লুপারক্যালিয়া’ থেকে বর্তমান নাম ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হয়েছে। গেলাসিয়াস নামের পোপ ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটা করেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের সন্ন্যাসীর সম্মানার্থে। তবে ৫০ জন ভ্যালেন্টাইনের কথা বিভিন্ন কাহিনীতে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন সমধিক পরিচিত। অবশ্য তাদের জীবন ও আচরণ রহস্যাবৃত। সেখান থেকে আরও জানা যায়, লটারি নিয়ে মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেয়ায় ফরাসি সরকার ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন দিবস নিষিদ্ধ করে দেয়। এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকে দিবসটি বিদায় নেয়। সপ্তদশ শতকে পিউরিটানরা যখন বেশ প্রভাবশালী ছিল, তখন ইংল্যান্ডেও ভালোবাসা দিবস নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আবার এটি পালনের প্রথা চালু করেন। ইংল্যান্ড থেকে ভ্যালেন্টাইন গেল ‘নতুন দুনিয়া’য় এবং এটা এখন অর্থাত্ আমেরিকায়। সেখানে উত্সাহী ইয়াঙ্কিরা পয়সা কামানোর বড় সুযোগ খুঁজে পেল এর মাঝে।’ ক্রমে ক্রমে এটা ব্যবসা ও মুনাফা অর্জনের দিবসে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমরা দেখতে পাই, ভালোবাসা দিবস নিয়ে যে সংস্কৃতি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে তা কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতি হতে পারে না। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করে মুনাফার উদ্দেশেই এর প্রচলন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি যে, দিবসটি ক্রমেই একটি বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারেই পরিণত হচ্ছে। এর মাধ্যমে অবৈধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা আমাদের একটি অংশকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : চিন্তাবিদ, সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
No comments