সময়ের প্রতিবিম্ব-ভূমিদস্যুতা ও একজন ব্যতিক্রমী প্রতিমন্ত্রী by এবিএম মূসা
এসব কী শুনলাম গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের জবানিতে। আবাসন ব্যবসায়ের কতিপয় দুর্বৃত্ত ও সর্বজনবিদিত ভূমিদস্যুর সঙ্গে বৈঠকে এমন কঠোর ভাষায় বাতচিত করলেন কিসের ভরসায়? অগ্রপশ্চাত্ বিবেচনা না করে এমন সব চাঁচাছোলা কথা বললেন প্রভাবশালী কোটি-কোটিপতি অর্থবানদের, পত্রিকায় সেই বিবরণী পড়ে অবাক হয়ে গেলাম।
ভূমিদস্যুর নামে খ্যাতিমান একজন আবার দম্ভভরে অনেকখানি পাল্টা ধমকের সুরে মন্ত্রীকে শুনিয়েও দিলেন, সেদিন সকালেই তাঁর ছেলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কী কথা বলেছেন, যদি সত্যিই বলে থাকেন, অথবা কী বোঝাতে চেয়েছেন তা অবশ্য পত্রিকার পাতায় আসেনি। তবে বোঝা গেল, পরোক্ষে জানিয়ে দিলেন তাঁর প্রভাব কতখানি বিস্তৃত। তাঁর প্রচ্ছন্ন হুমকি আর প্রধানমন্ত্রীর দোহাইকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন আবদুল মান্নান খান, কী আশ্চর্য! আমার আজকের প্রতিবেদনের বিষয় এই ব্যতিক্রমী প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে।
নির্দিষ্ট বিষয় আলোচনার আগে বিশেষ কারণে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গান্তরে যেতে হচ্ছে। প্রথমেই বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলের কথা বলছি। গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দেড় দিন পর ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের একটুখানি বিবরণ দিয়েছি। কয়েকজন পাঠক কৌতূহলবশত জানতে চেয়েছেন, ১০ জন মন্ত্রী কারা ছিলেন? মন্ত্রীরা ছিলেন জ্যেষ্ঠতাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম (শিল্প), তাজউদ্দীন আহমদ (অর্থ), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (স্বরাষ্ট্র), খন্দকার মোশতাক আহমদ (পানিসম্পদ-জ্বালানি), আবদুস সামাদ আজাদ (পররাষ্ট্র), শেখ আবদুল আজিজ (তথ্য), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (শিক্ষা), জহুর আহমেদ চৌধুরী (স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা), ফণীভূষণ মজুমদার (খাদ্য), কামরুজ্জামান ও ড. কামাল হোসেন (আইন-সংসদ)। পরবর্তী সময় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, সোহরাব হোসেন ও মতিউর রহমান। পুরোনো লেখার জের ধরে মন্ত্রীদের নামোল্লেখ করছি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বিশেষত্বটির কারণে। সবাই ছিলেন পোড় খাওয়া জনসম্পৃক্ত রাজনীতিবিদ। সরকার চালনায় দু-চারজনের অভিজ্ঞতা শুধু পাকিস্তানি আমলে স্বল্পকালীন কেন্দ্রে ও প্রদেশে মন্ত্রী থাকাকালের। অন্যদের অভিজ্ঞতা না থাকুক, ব্যক্তিত্ব ছিল। বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশের সেই ব্যক্তিত্ব বা অভিজ্ঞতা কোনোটিই নেই বলে অনেকের ধারণা। তাই তো আমার আজকের লেখাটির শুরুতে আবদুল মান্নান খানের বিরল ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য উল্লিখিত হয়েছেন।
জনান্তিকে, অর্থাত্ মূল গুরুগম্ভীর আলোচনার বাইরে দপ্তর বণ্টন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুটি রসাল মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও পাঠক সমীপে পেশ করার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। শপথ অনুষ্ঠানের পর বঙ্গভবন চত্বরে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোশগল্পের সময়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দপ্তর বণ্টনের তথ্যটি দিলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘জহুরের দুই বউ আর এক ডজন ছেলেমেয়ে। তাই তাকে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধুর আরও একটি রসিকতা পাঠক উপভোগ করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন বাংলাদেশে এলেন, বঙ্গভবনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের স্ত্রীদের জন্য একটি করে দামি বেনারসি শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু ফণীভূষণের হাত থেকে শাড়িটি নিয়ে বললেন, ‘দাদা, আপনি তো ব্যাচেলর মানুষ, শাড়ি দিয়ে কী করবেন। ওটি জহুরকে দেব, তা না হলে তার দুই বউ একটি শাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে।’ পাঠক ক্ষমা করবেন, প্রথম আলোতে ‘অন্তরঙ্গ অবলোকে বঙ্গবন্ধু’ প্রতিবেদনটিতে উপরিউক্ত কাহিনি স্থানাভাবে সংযুক্ত করতে পারিনি বলে মনে একটুখানি খুঁতখুঁতি ছিল, তাই আজকের লেখায় সংযোজন করে দিলাম।
আগেই বলেছি, আমার আজকের প্রতিবেদনের মূল বিষয় হলো শেখ হাসিনার চমক লাগানো মন্ত্রিসভার একজন ব্যতিক্রমী সদস্যকে অভিনন্দন জানানো। বর্তমান মন্ত্রিসভাকে প্রথম দিকে অনেকে কচিকাঁচার আসর বলেছেন, আমি বলেছি পাঠশালা। আমার বিশেষণটির মাজেজা ছিল, পাঠশালার ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষানবিশেরা যা জানার পণ্ডিত মশায়ের কাছ থেকে জেনে নেন, যা করার তাঁর অনুমতি নিয়ে করেন। একটুখানি বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে বলছি, কোনো মন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নানাজনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষ সমস্যা নিয়ে বৈঠক করেন। সবার চাহিদা, দাবি ও অভাব-অভিযোগ শোনেন। সবার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন, যথার্থতা মেনে নিয়ে সব সমস্যা সমাধানের ও দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। সবশেষে আসন থেকে ওঠার সময়ে বলেন, ‘এসব নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ এ কথা পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণী পড়ে বলছি না, এতদসম্পর্কীয় আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট একটি চাহিদা নিয়ে একজন পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমার চাহিদার যথার্থতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর কোনো দ্বিধাবোধ ছিল না, সেটি পূরণে আন্তরিকতার অভাবও ছিল না। কিন্তু সব কথার শেষ কথাটি বললেন, ‘আপনাকেও নেত্রী অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তাঁকে একবার বলুন না।’ অর্থাত্ পূর্ণমন্ত্রী হয়েও পুরো দায়িত্ব তাঁর নয়, ফাইল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৌড়াতে হয়। পরবর্তী ঘটনাবলি বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন মনে করি, তবুও বলছি আমার চাহিদাটি মেটেনি। কারণ, মন্ত্রীকে বলতে পারিনি, আজই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। কারণ, শিখণ্ডী মন্ত্রীর অসহায়ত্ব আমি বুঝতে পারি।
তার পরও আমি ভেবে পাই না, বর্তমান মন্ত্রিসভার কিছু প্রবীণ ও অধিকাংশ নবীন সদস্য কি সত্যিই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অভিজ্ঞতার অভাবে অপারগ অথবা সব বোঝা একজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সব দায়দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকতে চান? এই প্রসঙ্গে আবার বঙ্গবন্ধু সরকারের জমানার আদি পর্বে যাচ্ছি। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাজকর্ম শেষে পেছনের বারান্দায় আমরা কয়েকজন নিত্য যাতায়াতকারীর সঙ্গে খোশগল্প করতেন। একদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করছি। একটু পরে তিনি বারান্দায় এসে একটি ফাইল আমাদের সামনে ছুড়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘দেখ দেখ, কাদের আমি মন্ত্রী বানিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদ চালানোর ক্ষমতা নাই, দপ্তর চালাবেন।’ আমাদের একজন ফাইলটি মাটি থেকে কুড়িয়ে তুলে সবার সামনে মেলে ধরল। চোখে পড়ল জনৈক মন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত বাবুর্চি নিয়োগ দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর সহূদয় অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছিল দেশের ঝুনো রাজনীতিবিদ মন্ত্রীদের প্রাথমিক কার্যক্রম। পরবর্তী সময় কালক্রমে তাঁরা প্রত্যেকেই আপন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অভিজ্ঞতার ঘাটতি পূরণ করে স্বাধীনভাবে আপন দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ আর ‘বাবুর্চি নিয়োগের’ ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাননি অথবা বলেননি, ‘একবার নেত্রীর সঙ্গে কথা বলুন।’ বর্তমান মন্ত্রিসভার কাঁচা মন্ত্রীদের কি এদ্দিনে পাকা হওয়ার কথা। শিক্ষানবিশী পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ‘মূল্যায়ন করে’ স্বপদে বহাল রেখেছেন। তার পরও পূর্তমন্ত্রীর মতো কেউ ধমকটি পর্যন্ত দিতে পারেন না।
পাঠক সমীপে ক্ষমা চাই, বারবার মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, তাই বক্তব্যও খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই আবদুল মান্নান খান প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেদিনকার প্রতিমন্ত্রী এবং ভূমি ব্যবসায়ীদের মধ্যকার বৈঠকের খণ্ডচিত্র অনেকেই টেলিভিশনে দেখেছেন, প্রথম আলোসহ কতিপয় পত্রিকার পাতায় একটুখানি পড়েছেন। একমাত্র দৈনিক ডেসটিনি ভূমিদস্যুদের সর্দারের নামোল্লেখ করে যে বিস্তারিত বিবরণ ছেপেছে, আমি তার কয়েকটি বাক্য উল্লেখ করতে চাই। একজন ‘ভূমিদস্যু’কে মন্ত্রী বললেন, এক. আপনার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকিসহ ৭১টি অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের প্রমাণও রয়েছে আমার কাছে। দুই. স্বপ্নের ঠিকানা আর বেহেশতে নিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করেন; আপনারা ঘুমান কীভাবে? অন্যের জমি নিজের নামে বিক্রি করেন, লজ্জা করে না? উত্তরটি আমিই দিয়ে দিচ্ছি এই বলে, ‘লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়।’
তিন. অন্য একজনের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো রকম শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়াই বড় বড় কথা বলেন!
উচিত কথা বলার জন্য যতই প্রশংসা করি না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, আবদুল মান্নান খান একটি অপরাধী চক্রের যেসব কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়েছেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন কি? তিনি ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করেছেন কিন্তু ‘দশ বাঁও মিলে না’ পানির নিচের জমি উদ্ধার করতে পারবেন না। তিনি অবশ্যই অবগত আছেন, কেন আদালতের শাস্তি এড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়ানো আসামিকে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারছেন না। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র নামধারী দলীয় লেবাসধারী সন্ত্রাসীরা অরাজকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করলে প্রধানমন্ত্রী বারবার শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, শিক্ষামন্ত্রীর কিছু বলার সাহস নেই কেন? নৌপরিবহনমন্ত্রী নদী অবমুক্ত করার কাজ ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করেন, তারপর কখন যেন থেমে যায়। বনদস্যুরা দলীয় সাংসদের প্রশ্রয়ে উপকূলীয় গাছ যখন নিশ্চিন্তে উজাড় করছে, তখন পরিবেশমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেন না বরং বিশ্ব আবহাওয়া নিয়ে বিশ্ব সম্মেলনে মুখে খই ফোটান। বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন, ‘দয়া করে আর দাম বাড়াবেন না।’ কিন্তু একটি গুদামে হানা দিতে পারেননি, একজন মজুদদারকেও শায়েস্তা করতে পারেননি। তাদের সঙ্গে তোয়াজ করে কথা বলেছেন, আঙুল তুলে ধমক দিতে পারেননি। একজন প্রতিমন্ত্রী পেরেছেন, এ জন্য তাঁকে শত বাহবা দিয়েও দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তাঁর দাবড়ানি আর ধমকি-ধামকিই সার। আর কিস্যু করতে পারবেন না, বরং উল্টো ধমক খেতে হবে, ‘আমার ছেলে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।’ এই ধৃষ্টতার সারকথাটি তিনি জানেন বৈকি। জেনেও অন্তত মৌখিক দাবড়ানি তো দিয়েছেন, তা-ই বা কম কী!
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
নির্দিষ্ট বিষয় আলোচনার আগে বিশেষ কারণে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গান্তরে যেতে হচ্ছে। প্রথমেই বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলের কথা বলছি। গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দেড় দিন পর ১১ সদস্যের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের একটুখানি বিবরণ দিয়েছি। কয়েকজন পাঠক কৌতূহলবশত জানতে চেয়েছেন, ১০ জন মন্ত্রী কারা ছিলেন? মন্ত্রীরা ছিলেন জ্যেষ্ঠতাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম (শিল্প), তাজউদ্দীন আহমদ (অর্থ), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (স্বরাষ্ট্র), খন্দকার মোশতাক আহমদ (পানিসম্পদ-জ্বালানি), আবদুস সামাদ আজাদ (পররাষ্ট্র), শেখ আবদুল আজিজ (তথ্য), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (শিক্ষা), জহুর আহমেদ চৌধুরী (স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা), ফণীভূষণ মজুমদার (খাদ্য), কামরুজ্জামান ও ড. কামাল হোসেন (আইন-সংসদ)। পরবর্তী সময় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, সোহরাব হোসেন ও মতিউর রহমান। পুরোনো লেখার জের ধরে মন্ত্রীদের নামোল্লেখ করছি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বিশেষত্বটির কারণে। সবাই ছিলেন পোড় খাওয়া জনসম্পৃক্ত রাজনীতিবিদ। সরকার চালনায় দু-চারজনের অভিজ্ঞতা শুধু পাকিস্তানি আমলে স্বল্পকালীন কেন্দ্রে ও প্রদেশে মন্ত্রী থাকাকালের। অন্যদের অভিজ্ঞতা না থাকুক, ব্যক্তিত্ব ছিল। বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশের সেই ব্যক্তিত্ব বা অভিজ্ঞতা কোনোটিই নেই বলে অনেকের ধারণা। তাই তো আমার আজকের লেখাটির শুরুতে আবদুল মান্নান খানের বিরল ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য উল্লিখিত হয়েছেন।
জনান্তিকে, অর্থাত্ মূল গুরুগম্ভীর আলোচনার বাইরে দপ্তর বণ্টন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুটি রসাল মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও পাঠক সমীপে পেশ করার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। শপথ অনুষ্ঠানের পর বঙ্গভবন চত্বরে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোশগল্পের সময়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর দপ্তর বণ্টনের তথ্যটি দিলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘জহুরের দুই বউ আর এক ডজন ছেলেমেয়ে। তাই তাকে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধুর আরও একটি রসিকতা পাঠক উপভোগ করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন বাংলাদেশে এলেন, বঙ্গভবনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের স্ত্রীদের জন্য একটি করে দামি বেনারসি শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু ফণীভূষণের হাত থেকে শাড়িটি নিয়ে বললেন, ‘দাদা, আপনি তো ব্যাচেলর মানুষ, শাড়ি দিয়ে কী করবেন। ওটি জহুরকে দেব, তা না হলে তার দুই বউ একটি শাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে।’ পাঠক ক্ষমা করবেন, প্রথম আলোতে ‘অন্তরঙ্গ অবলোকে বঙ্গবন্ধু’ প্রতিবেদনটিতে উপরিউক্ত কাহিনি স্থানাভাবে সংযুক্ত করতে পারিনি বলে মনে একটুখানি খুঁতখুঁতি ছিল, তাই আজকের লেখায় সংযোজন করে দিলাম।
আগেই বলেছি, আমার আজকের প্রতিবেদনের মূল বিষয় হলো শেখ হাসিনার চমক লাগানো মন্ত্রিসভার একজন ব্যতিক্রমী সদস্যকে অভিনন্দন জানানো। বর্তমান মন্ত্রিসভাকে প্রথম দিকে অনেকে কচিকাঁচার আসর বলেছেন, আমি বলেছি পাঠশালা। আমার বিশেষণটির মাজেজা ছিল, পাঠশালার ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষানবিশেরা যা জানার পণ্ডিত মশায়ের কাছ থেকে জেনে নেন, যা করার তাঁর অনুমতি নিয়ে করেন। একটুখানি বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে বলছি, কোনো মন্ত্রী বা উপমন্ত্রী নানাজনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষ সমস্যা নিয়ে বৈঠক করেন। সবার চাহিদা, দাবি ও অভাব-অভিযোগ শোনেন। সবার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন, যথার্থতা মেনে নিয়ে সব সমস্যা সমাধানের ও দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। সবশেষে আসন থেকে ওঠার সময়ে বলেন, ‘এসব নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ এ কথা পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণী পড়ে বলছি না, এতদসম্পর্কীয় আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট একটি চাহিদা নিয়ে একজন পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমার চাহিদার যথার্থতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর কোনো দ্বিধাবোধ ছিল না, সেটি পূরণে আন্তরিকতার অভাবও ছিল না। কিন্তু সব কথার শেষ কথাটি বললেন, ‘আপনাকেও নেত্রী অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তাঁকে একবার বলুন না।’ অর্থাত্ পূর্ণমন্ত্রী হয়েও পুরো দায়িত্ব তাঁর নয়, ফাইল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৌড়াতে হয়। পরবর্তী ঘটনাবলি বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন মনে করি, তবুও বলছি আমার চাহিদাটি মেটেনি। কারণ, মন্ত্রীকে বলতে পারিনি, আজই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। কারণ, শিখণ্ডী মন্ত্রীর অসহায়ত্ব আমি বুঝতে পারি।
তার পরও আমি ভেবে পাই না, বর্তমান মন্ত্রিসভার কিছু প্রবীণ ও অধিকাংশ নবীন সদস্য কি সত্যিই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অভিজ্ঞতার অভাবে অপারগ অথবা সব বোঝা একজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সব দায়দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকতে চান? এই প্রসঙ্গে আবার বঙ্গবন্ধু সরকারের জমানার আদি পর্বে যাচ্ছি। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাজকর্ম শেষে পেছনের বারান্দায় আমরা কয়েকজন নিত্য যাতায়াতকারীর সঙ্গে খোশগল্প করতেন। একদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করছি। একটু পরে তিনি বারান্দায় এসে একটি ফাইল আমাদের সামনে ছুড়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘দেখ দেখ, কাদের আমি মন্ত্রী বানিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদ চালানোর ক্ষমতা নাই, দপ্তর চালাবেন।’ আমাদের একজন ফাইলটি মাটি থেকে কুড়িয়ে তুলে সবার সামনে মেলে ধরল। চোখে পড়ল জনৈক মন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত বাবুর্চি নিয়োগ দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর সহূদয় অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছিল দেশের ঝুনো রাজনীতিবিদ মন্ত্রীদের প্রাথমিক কার্যক্রম। পরবর্তী সময় কালক্রমে তাঁরা প্রত্যেকেই আপন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অভিজ্ঞতার ঘাটতি পূরণ করে স্বাধীনভাবে আপন দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ আর ‘বাবুর্চি নিয়োগের’ ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাননি অথবা বলেননি, ‘একবার নেত্রীর সঙ্গে কথা বলুন।’ বর্তমান মন্ত্রিসভার কাঁচা মন্ত্রীদের কি এদ্দিনে পাকা হওয়ার কথা। শিক্ষানবিশী পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ‘মূল্যায়ন করে’ স্বপদে বহাল রেখেছেন। তার পরও পূর্তমন্ত্রীর মতো কেউ ধমকটি পর্যন্ত দিতে পারেন না।
পাঠক সমীপে ক্ষমা চাই, বারবার মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, তাই বক্তব্যও খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই আবদুল মান্নান খান প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেদিনকার প্রতিমন্ত্রী এবং ভূমি ব্যবসায়ীদের মধ্যকার বৈঠকের খণ্ডচিত্র অনেকেই টেলিভিশনে দেখেছেন, প্রথম আলোসহ কতিপয় পত্রিকার পাতায় একটুখানি পড়েছেন। একমাত্র দৈনিক ডেসটিনি ভূমিদস্যুদের সর্দারের নামোল্লেখ করে যে বিস্তারিত বিবরণ ছেপেছে, আমি তার কয়েকটি বাক্য উল্লেখ করতে চাই। একজন ‘ভূমিদস্যু’কে মন্ত্রী বললেন, এক. আপনার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকিসহ ৭১টি অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের প্রমাণও রয়েছে আমার কাছে। দুই. স্বপ্নের ঠিকানা আর বেহেশতে নিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করেন; আপনারা ঘুমান কীভাবে? অন্যের জমি নিজের নামে বিক্রি করেন, লজ্জা করে না? উত্তরটি আমিই দিয়ে দিচ্ছি এই বলে, ‘লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়।’
তিন. অন্য একজনের উদ্দেশে তিনি বলেন, কোনো রকম শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়াই বড় বড় কথা বলেন!
উচিত কথা বলার জন্য যতই প্রশংসা করি না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, আবদুল মান্নান খান একটি অপরাধী চক্রের যেসব কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়েছেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন কি? তিনি ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করেছেন কিন্তু ‘দশ বাঁও মিলে না’ পানির নিচের জমি উদ্ধার করতে পারবেন না। তিনি অবশ্যই অবগত আছেন, কেন আদালতের শাস্তি এড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়ানো আসামিকে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারছেন না। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র নামধারী দলীয় লেবাসধারী সন্ত্রাসীরা অরাজকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করলে প্রধানমন্ত্রী বারবার শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, শিক্ষামন্ত্রীর কিছু বলার সাহস নেই কেন? নৌপরিবহনমন্ত্রী নদী অবমুক্ত করার কাজ ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করেন, তারপর কখন যেন থেমে যায়। বনদস্যুরা দলীয় সাংসদের প্রশ্রয়ে উপকূলীয় গাছ যখন নিশ্চিন্তে উজাড় করছে, তখন পরিবেশমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেন না বরং বিশ্ব আবহাওয়া নিয়ে বিশ্ব সম্মেলনে মুখে খই ফোটান। বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন, ‘দয়া করে আর দাম বাড়াবেন না।’ কিন্তু একটি গুদামে হানা দিতে পারেননি, একজন মজুদদারকেও শায়েস্তা করতে পারেননি। তাদের সঙ্গে তোয়াজ করে কথা বলেছেন, আঙুল তুলে ধমক দিতে পারেননি। একজন প্রতিমন্ত্রী পেরেছেন, এ জন্য তাঁকে শত বাহবা দিয়েও দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তাঁর দাবড়ানি আর ধমকি-ধামকিই সার। আর কিস্যু করতে পারবেন না, বরং উল্টো ধমক খেতে হবে, ‘আমার ছেলে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।’ এই ধৃষ্টতার সারকথাটি তিনি জানেন বৈকি। জেনেও অন্তত মৌখিক দাবড়ানি তো দিয়েছেন, তা-ই বা কম কী!
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
No comments