সাদা কথাঃ একুশের সৃষ্টিশীলতা by মুহম্মদ নূরুল হুদা
আবার দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ধর্মবর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালির দ্বিতীয় কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্সব নেই যা একুশের সঙ্গে তুলনীয়। যদিও একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকায় শহীদ মিনারের মূল বেদীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে এই উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিক আলোকায়ন, আসলে এর বিস্তৃতি মাসব্যাপী।
তার শুরু বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনের মুহূর্ত। এই মেলা এখন আমাদের সৃষ্টিশীলতার জাতীয় প্রতীক। যেমন বাংলা একাডেমী আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক। যেদিন এই বইমেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের সমান্তরালে সারা দেশে অন্তত জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে, সেদিন এই সৃষ্টিশীলতার অভিব্যক্তি পূর্ণতর হবে। এবারের বইমেলা এই সম্ভাবনার সূচনা করেছে। বাংলা একাডেমীর ভেতর প্রাঙ্গণ ও সামনের রাস্তার উভয় পাশে বসেছে এই মেলা। পহেলা ফেব্রুয়ারি মেলার উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। রেওয়াজটা চলছে গত দুই দশক ধরে। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলা একাডেমীর যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। জাতীয়ভাবে সমূহ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিরই মুখ্য ব্যবস্থাপনা আর প্রকাশক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় প্রতিবছর মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই গ্রন্থোত্সব। এ কারণে এই আয়োজনের তাত্পর্যই আলাদা। লেখক প্রকাশক সবাই চায় এই মেলায় সরকার ও জনগণ সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সম্পৃক্ত হোক। সরকার প্রধানরাও এই মেলায় এসে আনন্দিত হন, মেলাও সর্বাধিক প্রচার ও মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বইয়ের বৈচিত্র্য ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে উন্নীত করার পরিকল্পনাও তার সরকারের রয়েছে। তার জন্য প্রথম পর্যায় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন। তা না হলে এটি কথার কথা হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা সংরক্ষণ, তরুণ লেখকদের গুরুত্বদান এবং সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় স্থাপনের কথাও বলেছেন। আমরা এই বলয়ের মধ্যে লেখকদের জন্য একটি পৃথক লেখক ভবন ও কমপ্লেক্স স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা আবার উত্থাপন করছি। মেলা রাস্তায় নেমেছে, তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রবেশ করেনি। ভবিষ্যতে ঢুকতে হবে অবশ্যই। কেননা আগামী বার এবারের মতো ৫০৫ স্টল দিলে চলবে না, তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। মেলায় ঘুরে মনে হয়েছে মেলা ভেতরের চেয়ে বাইরে বেশি জমজমাট। মাঝের আইল্যান্ডে দর্শক-ক্রেতারা চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। জমজমাট মনে হয়েছে লিটল ম্যাগ চত্বর। লিটল ম্যাগের জন্য আলাদা স্টল দিয়ে লেখকদের বসার জন্য জায়গা করা হয়েছে প্রশস্ত। তবে লেখকরা বেশি ভিড় করছেন যেসব টিভি সরাসরি সম্প্রচার করছে সেইখানে। লেখক-পাঠককে মেলার সর্বত্র আসা-যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া জরুরি। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপও অনতিবিলম্বে শুরু করা ও চালু রাখা অত্যাবশ্যক। তা না হলে এটি অন্যান্য বারের মতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
টিএসসির মোড়ে মেলার যে প্রথম প্রবেশপথ তার সামনে রিকশাগুলোর বিহিত করতেই হবে। তা না হলে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠতে পারে। আশা করি, কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মীরা এ নিয়ে আরও তত্পর হবেন। ভিড় ঠেলে প্রবেশপথ পার হতেই বেশ ভালো লাগল। দু’পাশের ফুটপাথ পরিচ্ছন্ন, ফাঁকা। অন্তত নেটের বইঅলারা নেই, নেই তাদের সম্মিলিত হাঁকডাক। বুঝলাম, এটি কপিরাইট সুরক্ষার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের কর্মতত্পরতার প্রাথমিক সাফল্য। মেলায় পাইরেসি সমূলে উত্খাত করতে হলে যা যা করা দরকার তার সবটা এখনও করা হয়ে ওঠেনি। এ মেলায় যে হবে তা-ও আশা করি না। তবে এমন কিছু মৌলিক কাজ হওয়া আবশ্যক, যা পরবর্তী সাফল্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করবে। তেমন কাজ হলো লেখক-প্রকাশক বৈধ চুক্তি সম্পাদন।
এক সময়ে মেলাকে একাডেমীর ভেতরে সীমিত রাখার কথা বললেও এখন কিন্তু লেখক-প্রকাশক-ক্রেতা-পরিদর্শক সবাই একবাক্যে এর বিরুদ্ধে, অর্থাত্ মেলার স্থান বাড়ানোর কথা বলছেন। প্রতিদিন আমাদের বিশিষ্টজনরা পত্রিকার পাতা তাদের প্রকাশিত অভিমতে এই বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা আণবিক শক্তি কমিশন বাংলা একাডেমীকে দেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। আমার মনে হয়, সুশীল সমাজের পদ্ধতিগত দাবি ও আন্দোলন ছাড়া এটি সহজে হবে না।
আমরা এগুচ্ছি সন্দেহ নেই, কিন্তু সময় লাগবে, আরও সময়। টাস্কফোর্সের সদস্যসচিব মনজুরুর রহমানের কাছ থেকে জানলাম, কিছু কিছু নিষিদ্ধ স্টল আবার চালু হয়েছে। আমার ধারণা, স্টল বরাদ্দের সময় যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা না গেলে নিয়ম ভঙ্গের এই অজাচার থামবে না। মেলাকে পেশাদার ও অপেশাদার এলাকায় ভাগ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাকালাম নজরুল মঞ্চের মোড়ক উন্মোচনের দিকে। এ এক অফুরন্ত আনন্দ, অনির্বচনীয় উত্সব। তবে এখনও এই বিষয়টিও অপরিকল্পিতভাবেই চলছে। মোড়ক উন্মোচনের আগে কর্তৃপক্ষ বইটির ন্যূনতম গুণাগুণ পরীক্ষা করছে না। মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে, এখনও একটি লোভনীয় বই প্রকাশিত হয়নি। এটি আমাদের সৃষ্টিশীলতার অগ্রগতি নয়। কিন্তু যে কোনো মূল্যে এগিয়ে নিতে হবে আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে। স্মর্তব্য, একুশ আমাদের আত্মদান, আমাদের বীরত্ব, আমাদের ভাষাসত্তা, আমাদের স্বাধিকার, আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের স্বাধীনতা আর আমাদের সর্বব্যাপী সৃষ্টিশীলতার উত্স। একুশ রূপকথা নয়, আমাদের বাস্তব পুরাণ। বাঙালির আত্মদানে গড়া এই জীবন্ত পুরাণকে সচল ও নবায়ন করতে হলে আমাদের সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটাতেই হবে।
লেখক : কবি, প্রফেসর, সভাপতি বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
টিএসসির মোড়ে মেলার যে প্রথম প্রবেশপথ তার সামনে রিকশাগুলোর বিহিত করতেই হবে। তা না হলে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠতে পারে। আশা করি, কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মীরা এ নিয়ে আরও তত্পর হবেন। ভিড় ঠেলে প্রবেশপথ পার হতেই বেশ ভালো লাগল। দু’পাশের ফুটপাথ পরিচ্ছন্ন, ফাঁকা। অন্তত নেটের বইঅলারা নেই, নেই তাদের সম্মিলিত হাঁকডাক। বুঝলাম, এটি কপিরাইট সুরক্ষার জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের কর্মতত্পরতার প্রাথমিক সাফল্য। মেলায় পাইরেসি সমূলে উত্খাত করতে হলে যা যা করা দরকার তার সবটা এখনও করা হয়ে ওঠেনি। এ মেলায় যে হবে তা-ও আশা করি না। তবে এমন কিছু মৌলিক কাজ হওয়া আবশ্যক, যা পরবর্তী সাফল্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করবে। তেমন কাজ হলো লেখক-প্রকাশক বৈধ চুক্তি সম্পাদন।
এক সময়ে মেলাকে একাডেমীর ভেতরে সীমিত রাখার কথা বললেও এখন কিন্তু লেখক-প্রকাশক-ক্রেতা-পরিদর্শক সবাই একবাক্যে এর বিরুদ্ধে, অর্থাত্ মেলার স্থান বাড়ানোর কথা বলছেন। প্রতিদিন আমাদের বিশিষ্টজনরা পত্রিকার পাতা তাদের প্রকাশিত অভিমতে এই বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা আণবিক শক্তি কমিশন বাংলা একাডেমীকে দেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। আমার মনে হয়, সুশীল সমাজের পদ্ধতিগত দাবি ও আন্দোলন ছাড়া এটি সহজে হবে না।
আমরা এগুচ্ছি সন্দেহ নেই, কিন্তু সময় লাগবে, আরও সময়। টাস্কফোর্সের সদস্যসচিব মনজুরুর রহমানের কাছ থেকে জানলাম, কিছু কিছু নিষিদ্ধ স্টল আবার চালু হয়েছে। আমার ধারণা, স্টল বরাদ্দের সময় যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা না গেলে নিয়ম ভঙ্গের এই অজাচার থামবে না। মেলাকে পেশাদার ও অপেশাদার এলাকায় ভাগ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাকালাম নজরুল মঞ্চের মোড়ক উন্মোচনের দিকে। এ এক অফুরন্ত আনন্দ, অনির্বচনীয় উত্সব। তবে এখনও এই বিষয়টিও অপরিকল্পিতভাবেই চলছে। মোড়ক উন্মোচনের আগে কর্তৃপক্ষ বইটির ন্যূনতম গুণাগুণ পরীক্ষা করছে না। মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে, এখনও একটি লোভনীয় বই প্রকাশিত হয়নি। এটি আমাদের সৃষ্টিশীলতার অগ্রগতি নয়। কিন্তু যে কোনো মূল্যে এগিয়ে নিতে হবে আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে। স্মর্তব্য, একুশ আমাদের আত্মদান, আমাদের বীরত্ব, আমাদের ভাষাসত্তা, আমাদের স্বাধিকার, আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের স্বাধীনতা আর আমাদের সর্বব্যাপী সৃষ্টিশীলতার উত্স। একুশ রূপকথা নয়, আমাদের বাস্তব পুরাণ। বাঙালির আত্মদানে গড়া এই জীবন্ত পুরাণকে সচল ও নবায়ন করতে হলে আমাদের সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটাতেই হবে।
লেখক : কবি, প্রফেসর, সভাপতি বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
No comments