চ্যানেল জুড়ে অনুষ্ঠান নকল প্রবণতা
তাবৎ দুনিয়ার টেলিভিশন মাধ্যম যেখানে এগিয়ে চলছে দারুণ গতিতে, সেখানে আমাদের দেশের টেলিভিশন ধীরগতিতেই চলমান। দিন দিন টেলিভিশন চ্যানেল বৃদ্ধি, সে অনুযায়ী অনুষ্ঠান, নাটক ও সংবাদে নতুনত্ব আর বৈচিত্র্যের অভাব এবং আরও নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের টেলিভিশন এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এ চ্যালেঞ্জের আদ্যোপান্ত নিয়েই ধারাবাহিক এই প্রতিবেদন। লিখেছেন মাহমুদ মানজুর ‘কাশেম টিভি’র কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। দেশীয় টিভি চ্যানেলের দর্শক পাল্লা দিয়ে কমলেও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে হানিফ সংকেতের অনবদ্য সৃষ্টি স্যাটায়ার ঘরানার সেই ‘কাশেম টিভি’র জনপ্রিয়তা কিন্তু দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যে কাশেম টিভি’র নানা ব্যঙ্গাত্মক প্রতীকী নাটিকার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়ে আসছে টিভি দর্শকদের মনের কথা এবং দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অপরিপক্বতার ধারাবাহিক ঘটনা। নাম এবং লোগো ভিন্ন হলেও দেশীয় সিংগভাগ টিভি চ্যানেলের চেহারায় এখন ভর করে আছে সেই প্রতীকী ‘কাশেম টিভি’র হুবহু প্রতিচ্ছবি। আপামর দর্শকদের জন্য কি কি থাকছে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালায়? মোটা দাগে হিসাব কষলে সংবাদ, নাটক, গান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, পলিটিক্যাল টকশো, লাইভ শো, ফোনোলাইভ কনসার্ট, মেলা, রিয়েলিটি শো, সিনেমা প্রভৃতি। যেমনটা পৃথিবীর অন্য কোন জনপ্রিয় চ্যানেলে একসঙ্গে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকদের মতে, চ্যানেলগুলোর এই জগাখিচুড়ি নীতিই আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। শুধু জগাখিচুড়ি নীতিই নয়, এর সঙ্গে রয়েছে একটি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান কোনমতে দর্শকরা গ্রহণ করলেই হলো, এরপর সর্বোচ্চ দু’মাসের মাথায় একই অনুষ্ঠান দেশের প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে একই সময়ে সমপ্রচার হতে দেখা যাবে! অর্থাৎ চ্যানেলগুলোতে বেশ ক’বছর ধরেই চলছে মেধাহীন কিংবা অনভিজ্ঞ প্রযোজকদের আস্ফালন। যার ফলে অনুষ্ঠান প্রযোজকদের বড় একটি অংশ নিজেদের মেধা বিকিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পনার বাইরে অন্যেরটা নকল করতেই বেশি অভ্যস্ত। কিংবা এটাই এখন কালচারে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বৈচিত্র্যহীনতা। এ প্রসঙ্গে বিটিভি’র মহাপরিচালক ম. হামিদ বলেন, কি বলবো আর। স্যাটেলাইট চ্যানেলের পাশাপাশি এমনটা ঘটছে বিটিভি এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ডের ক্ষেত্রেও। আসলে আমাদের এখানে মেধাবীদের সমাবেশ ঘটানো বেশ কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সর্বত্র এখন নকলের ছড়াছড়ি। যার কারণে বিটিভিসহ স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো এখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমশ। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ থেকে উত্তরণের পথ যে নেই তা কিন্তু নয়। আমার মনে হয়, টিআরপি নামক আজব বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যদি টিভি কর্র্তৃপক্ষ সরাসরি দর্শকদের কাছে যেতে পারেন, তবেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা কিংবা নকল প্রবণতা থেকে আমরা বেরুতে পারবো। এদিকে চ্যানেলজুড়ে নকল প্রবণতার স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে চলে আসে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের নাম। এর মধ্যে চ্যানেল আই বেশ ক’বছর আগে শুরু করেছিল সংবাদপত্র পর্যালোচনাভিত্তিক মধ্যরাতের টক টকশো ‘গ্রামীণফোন আজকের সংবাদপত্র’। এ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হতে না হতেই বিটিভিসহ দেশের প্রত্যেকটি চ্যানেলে একই সময়ে একই আঙ্গিকে সমপ্রচার শুরু করে এ ধারার অনুষ্ঠান। একইভাবে বিটিভি’র ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’, এনটিভি-ইউনিলিভারের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ রিয়েলিটি শো কিংবা একুশে টিভির মধ্যরাতের ‘ফোনোলাইভ কনসার্ট’, প্রথমে বিটিভি পরে চ্যানেল আইতে কৃষক ও কৃষিভিত্তিক অনন্য আয়োজন ‘মাটি ও মানুষ’-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। অনুষ্ঠানই শুধু নকল হচ্ছে না, নকল হচ্ছে অনুষ্ঠান সমপ্রচারের সময়ও! যেমন একই সময়ে দেশের প্রায় সবক’টি চ্যানেল সমপ্রচার করছে প্রায় একই ধারার অনুষ্ঠান, সিনেমা, টকশো কিংবা খবর। এদিকে বিদেশী চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান কিংবা নাটক নকলের বিষয়টি তো অনেক আগেই অলিখিত বৈধতা পেয়ে গেছে দেশীয় চ্যানেলগুলোতে। এ প্রসঙ্গে নন্দিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত বলেন, চ্যানেলগুলোর এই নকল প্রবণতা কিংবা মেধাহীনতা নিয়ে গেল দশ বছর ধরে আমি কম স্যাটায়ার করিনি। স্যাটায়ার করতে করতে এখন আমার কাল্পনিক ‘কাশেম টিভি’ পুরো পুরি স্ট্যাবলিস্ট হয়ে গেছে। তবুও টনক নড়েনি চ্যানেলওয়ালাদের। সবাই যেন কেন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরে আপন মনে ছুটে চলেছেন দল বেঁধে। আমরা যখন উপস্থাপনা শুরু করি তার আগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অডিশন দিয়ে পাশ করে উপস্থাপক হয়েছি। ২৪টি বছর ধরে নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতিযোগিতা করে চলছি নিত্যদিন। আমাকে অথবা ইত্যাদিকে নকল করে অনেকেই এসেছেন, চলেও গেছেন। এখানেই হচ্ছে মৌলিক ক্রিয়েশন আর নকল ক্রিয়েশনের মধ্যে বড় পার্থক্য। আর এখন শিল্পী থেকে শুরু করে কৌতুক অভিনেতারাও উপস্থাপক হয়ে যায় রাতারাতি! এখন টিভি অনুষ্ঠানে হরহামেশা গামছা মাথায় দিয়ে লুঙ্গি পরেও অতিথি কিংবা উপস্থাপকের আসনে বসে পড়েন অনেকে। এতগুলো চ্যানেলের কোথাও কোন অনুষ্ঠানে কোন রকম ক্রিয়েশনের বালাই নেই। এই চিন্তাটা আমাকে প্রতিনিয়ত পোড়ায়। আরও খারাপ লাগে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের ক্রিয়েশন হুবহু নকল করে নিজের নতুন ক্রিয়েশন বলে অবলীলায় চালিয়ে দেয়। নকল করলেও সেটা যদি বলে কয়ে করা হয়, তাতেতো কোন সমস্যা নেই। হানিফ সংকেত প্রসঙ্গক্রমে আরও বলেন, এর জন্য আমি পুরোপুরি দায় দিবো টিভি চ্যানেলগুলোর শীর্ষ কর্তাদের। তাদের অজ্ঞানতা এবং অদূরদর্শিতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। হতে হতে এখন দেশের টিভি মাধ্যমটা একেবারে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে খাদে পড়ার আগেই ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এদিকে দেশীয় টিভি চ্যানেলের সবচেয়ে তরুণ এবং সফল অনুষ্ঠান প্রধান (বাংলাভিশন) শামীম শাহেদ একই প্রসঙ্গে খানিক আফসোসের সুরেই বলেন, আমাদের এ অঙ্গনে প্রচণ্ড মেধা সঙ্কট রয়েছে। এটুকু না বললেই নয়। তবে এটা ঠিক, এ সঙ্কট থাকবে না। তরুণরাই এ মেধা সঙ্কটের পথ থেকে বের করে আনবে। এটা আমার বিশ্বাস। তবে মজার বিষয় হলো, প্রতি বছর যে হারে চ্যানেলের জন্ম হচ্ছে, তাতে আমরা টেলিভিশন কর্মীরা তেমন কিছু শেখার আগে, বোঝার আগেই তর তর করে পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছি। এক চ্যানেলে তিন মাস সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ করে অন্য চ্যানেলে লাফ দিচ্ছি সিনিয়র প্রযোজক হিসেবে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন কিংবা পুরাতন কিছু মেধাহীন লোক। চ্যানেল সংখ্যা এভাবে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকলে চলমান নকল প্রবণতা কিংবা মেধা সঙ্কট থেকে উত্তরণ একটু কঠিন হবে, হয়তো।
No comments