জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসঙ্গতি by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
দেশব্যাপী সরকারি দল, সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি এখন সবারই জানা বিষয়। এসব নিয়ে কখনও কখনও আন্তঃদলীয় সংঘাতকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও অজানা কোনো বিষয় নয়।
শিক্ষাঙ্গনেও এর বিস্তার লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এক সাবেক ছাত্র নেতা এবং বর্তমানে একটি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিভিন্ন ‘ভাইয়ের’ নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় রাখার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ছাত্রদের মধ্যে নিজস্ব বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে কেবল রাজনৈতিক দলের অশুভ তত্পরতার অস্ত্র হিসেবেই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সে কারণে সর্বক্ষেত্রেই পরিস্থিতি রুগ্ন হয়ে পড়ছে। এটুকুই শুধু নয়, এসব ক্যাডার দেখতে পাচ্ছে তাদের বড় ভাইয়েরা লাখপতি থেকে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভাবনা ‘আমরা তাকে ওপরে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছি; কিন্তু আমাদের ভাগ কোথায়? এভাবে তারাও লুটপাটের ভাগবাটোয়ারার অংশীদার হওয়ার সংস্কৃতিতে মিশে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এটা কেবল বড় ভাইদের কাছ থেকে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার ব্যাপার নয়, বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অর্থ উপার্জনের স্থান হিসেবে তৈরি করে নিয়েছে তারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ভর্তি বাণিজ্য, আসন বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, রাস্তা থেকে মানুষ তুলে এনে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধ পরিচালনা করছে। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কেবল বড় ভাইদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বই প্রকাশ পাচ্ছে তা নয়, সেখানেও একটি অর্থনৈতিক লুটপাটের ব্যবস্থার কারণে লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়েও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।’ অর্থাত্ ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা-লুটপাটের ধারায় নগদ নারায়ণ লাভের পথে অগ্রসর হওয়ার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি। এ লুটপাটের অর্থনীতিই হচ্ছে এদের রাজনীতি। ফলে বর্তমানে ছাত্রনীতির নামে যা হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই—এ ধারণা-পোষণ করা যথাযথ নয়। অথচ উপরে উল্লিখিত সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, ‘বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা প্রধানত দলবাজি। রাজনীতির মৌলিক বিষয় হলো আদর্শ, নীতি, দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা। এসব বিষয় এখন অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সামান্যই পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি না থাকার ফলে শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপকর্ম গ্রাস করে ফেলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে হাতেগোনা অল্প কিছু ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী মস্তানদের হাতে (সূত্র : সাপ্তাহিক বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।’
উপরে উল্লিখিত সাবেক ছাত্রনেতার নাম মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এত বড় একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনীতি সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা মোটেই ঠিক নয়। রাজনীতির মৌলিক বিষয় হলো-আদর্শ, নীতি, দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা—এ উপলব্ধি মোটেই সঠিক নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির জন্ম। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ মানেই পরস্পরবিরোধী স্বার্থের অবস্থান। স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হলে রাজনীতিও হবে পরস্পরবিরোধী স্বার্থকে কেন্দ্র করেই—এটাই স্বাভাবিক। ফলে রাজনীতিকে একভাবে দেখা ঠিক নয়। রাজনীতি মানেই আদর্শ, নীতি, দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা—এরকমটা ভাবা হচ্ছে একমুখীনতা অর্থাত্ বাস্তবতা অস্বীকার করে কল্পনার জগতে বসবাস করা। দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের রাজনীতি, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ক্ষমতা কাঠামো বিনির্মাণের বিষয়। কিন্তু এর বিপরীতে যারা তারাও কি একই চরিত্র বিশিষ্ট? যদি তাই হয় তবে সমাজে কোনো রাজনীতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি রাজনৈতিক দল সমাজে কোনো না কোনো অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে চায় এবং এ কাজ করতে গিয়ে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও স্তরের মাঝে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিজেদের রাজনীতির শক্ত ভিত গড়ে তোলে—এ ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। ফলে ছাত্রসমাজের মধ্যে ছাত্র সংগঠনকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মস্তানি—এসবও এক ধরনের রাজনীতি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ছাত্রসমাজের মাঝেই এর দেখা মেলে। এরাই প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মিছিল, মিটিংয়ে সক্রিয় থাকে। ফলে এদের কার্যকলাপকে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো কারণ নেই। রাজনীতি সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিফলন ঘটায়, আর এ কারণেই সমাজে রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। প্রতিটি রাজনৈতিক সংঘাতের পেছনে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ বোধ সক্রিয় থাকে। কোনো রাজনীতি যদি লুটপাটের অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে তবে তার প্রতিফলন রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতেও একইভাবে প্রতিফলিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা রাজনীতি হলো অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ। এ জন্য অর্থনীতি যদি লুটপাটের ধারায় গড়ে ওঠে, তবে রাজনীতিও লুটপাটের ধারায় গড়ে উঠবে। রাজনীতির বিষয়ে এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েও যখন সেলিম সাহেব বলেন, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই—তখন তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রকে ভুলভাবে চিত্রিত করেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক চরিত্রকে ভুলভাবে চিত্রিত করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মনে হয় এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনের মস্তানির চরিত্র নতুনভাবে গড়ে উঠেছে বিষয়টি এমন নয়। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠনের এই চরিত্র বিদ্যমান ছিল। ওই সময় ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ) নামে সরকারের পেটোয়া বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল এটা সবারই জানা। তারাও তত্কালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হয়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ধরনে তখনকার সন্ত্রাসের সঙ্গে এখনকার সন্ত্রাসের কিছু পার্থক্য থাকলেও তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করাটাই যথাযথ। হয়তোবা আজকের মতো গুলি-বন্দুকের ব্যবহার তখন ছিল না; কিন্তু হকিস্টিক, ছুরি-চাকুর ব্যবহার ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুবিধা লাভ করার বিষয়টি তখনও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে ছাত্র রাজনীতির একটি সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। ছাত্র রাজনীতি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে সক্ষম হয়েছিল, যার পরিণতিতে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যার কারণে এখনও রাষ্ট্রের দলবাজি চরিত্র বহাল থেকে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা জাতীয় হয়ে ওঠেনি, অর্থাত্ জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণে সংগতিশীল রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়নি ক্ষমতাসীনরা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এখনও ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলীয় স্বার্থ হাসিল করার ক্ষমতা হিসেবেই বিদ্যমান থেকে গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, অতীতের মতো বর্তমানেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেণীটি বিদেশি স্বার্থের সেবায় নিজেদের চালিত করে চলেছে। জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণের প্রয়োজনে জাতীয় পুঁজির গঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কোনো নীতি কাঠামোর ধারে কাছেও এরা অবস্থান নিতে চায় না। এ কারণে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলেই তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমন করার প্রবণতা এদের মধ্যে বিদ্যমান। চরিত্রের দিক হতে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে তারাই জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে চলেছে। এ কারণে বিদেশি মহাশক্তিধরদের সঙ্গে যেসব চুক্তি তারা করেছে তারা সেটা প্রকাশ করতে চায় না। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির বিরোধিতায় যারা সোচ্চার হয়েছিলেন তারা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দিলেও চুক্তির বিষয়ে সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব এখনও উত্থাপন করেননি। সংসদের বাইরে দেশ বাঁচানোর আওয়াজ তুললেও সংসদে বসে মনে হয় তারা বিষয়টি ভুলে গেছেন। আগামী দিনগুলোতেই সংসদে তাদের ভূমিকা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে আশা করা যায়।
জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রশ্নে যারা তাদের দলীয় দলিলে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তারাও কিন্তু সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো নিয়ে সংসদে খোলামেলা আলোচনা করার কোনো দাবি উত্থাপন করছেন না জোরালোভাবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি পরিত্যাজ্য হলে তার বিপরীতে কী ধরনের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা দরকার, যা আমাদের দেশে জাতীয় পুঁজির গঠনকে শক্তিশালী করবে—এ প্রশ্নে পরিষ্কার অবস্থান নিয়ে কথা বলা দরকার। এই বিষয়ে এ দেশে যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের সমূহ দুর্বলতা বিদ্যমান। পাকিস্তানের মাত্র পঁচিশ বছরের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের জনগণ অস্ত্রহাতে লড়াই করতে দ্বিধা করেনি; কিন্তু সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৩৮ বছর পার হয়ে গেল কিন্তু লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকরাই শক্তিশালী হয়ে থাকল—এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে জাতীয় রাজনৈতিক দীনতাকেই প্রকট করে তোলে। এই দীনতা হচ্ছে লুটপাটের অর্থনীতির রাজনীতি যারা করে তাদের সঙ্গে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির নামে ঐক্যের মধ্যে নিহিত। লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকদের সঙ্গে যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এদেশে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হবে না। পরিণতিতে লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকরাই জাতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। এই যদি হয় অবস্থা তবে শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে যা ঘটছে তার পরিবর্তন আশা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। অর্থাত্ শিক্ষাঙ্গনের এ নৈরাজ্য থেকে নিস্তার পেতে জাতিকে আরও অনেক বড় মাশুল দিতে হবে। হয়তো বা দেখা যাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে যেতেই ভয় পাবেন জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে। এর লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাই প্রকট হয়ে উঠবে। আমরা কেউ চাই না এদেশে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারা যাক। কিন্তু আমরা না চাইলে কী হবে, এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে যতদিন পর্যন্ত লুটপাটের অর্থনীতির রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে থাকবে।
জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনীতির শক্তিশালী অবস্থান দরকার। এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ হলে হয়তো বা দেখা যাবে রাজনীতিতে স্বাধীনতার সপক্ষ আর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি জোটভুক্ত হয়ে পড়েছে, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলার জন্য। তাই যারা চায় এদেশের জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াক, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমরা সক্ষম হয়ে উঠি, তারা অন্তত সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপক্ষে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে অথবা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষম অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং এই কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজটি প্রাধান্য দাবি করে।
উপরে উল্লিখিত সাবেক ছাত্রনেতার নাম মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এত বড় একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনীতি সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা মোটেই ঠিক নয়। রাজনীতির মৌলিক বিষয় হলো-আদর্শ, নীতি, দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা—এ উপলব্ধি মোটেই সঠিক নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির জন্ম। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ মানেই পরস্পরবিরোধী স্বার্থের অবস্থান। স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হলে রাজনীতিও হবে পরস্পরবিরোধী স্বার্থকে কেন্দ্র করেই—এটাই স্বাভাবিক। ফলে রাজনীতিকে একভাবে দেখা ঠিক নয়। রাজনীতি মানেই আদর্শ, নীতি, দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা—এরকমটা ভাবা হচ্ছে একমুখীনতা অর্থাত্ বাস্তবতা অস্বীকার করে কল্পনার জগতে বসবাস করা। দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের রাজনীতি, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ক্ষমতা কাঠামো বিনির্মাণের বিষয়। কিন্তু এর বিপরীতে যারা তারাও কি একই চরিত্র বিশিষ্ট? যদি তাই হয় তবে সমাজে কোনো রাজনীতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি রাজনৈতিক দল সমাজে কোনো না কোনো অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে চায় এবং এ কাজ করতে গিয়ে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও স্তরের মাঝে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিজেদের রাজনীতির শক্ত ভিত গড়ে তোলে—এ ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। ফলে ছাত্রসমাজের মধ্যে ছাত্র সংগঠনকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মস্তানি—এসবও এক ধরনের রাজনীতি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ছাত্রসমাজের মাঝেই এর দেখা মেলে। এরাই প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মিছিল, মিটিংয়ে সক্রিয় থাকে। ফলে এদের কার্যকলাপকে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো কারণ নেই। রাজনীতি সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিফলন ঘটায়, আর এ কারণেই সমাজে রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। প্রতিটি রাজনৈতিক সংঘাতের পেছনে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ বোধ সক্রিয় থাকে। কোনো রাজনীতি যদি লুটপাটের অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে তবে তার প্রতিফলন রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতেও একইভাবে প্রতিফলিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা রাজনীতি হলো অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ। এ জন্য অর্থনীতি যদি লুটপাটের ধারায় গড়ে ওঠে, তবে রাজনীতিও লুটপাটের ধারায় গড়ে উঠবে। রাজনীতির বিষয়ে এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েও যখন সেলিম সাহেব বলেন, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই—তখন তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রকে ভুলভাবে চিত্রিত করেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক চরিত্রকে ভুলভাবে চিত্রিত করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মনে হয় এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনের মস্তানির চরিত্র নতুনভাবে গড়ে উঠেছে বিষয়টি এমন নয়। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র সংগঠনের এই চরিত্র বিদ্যমান ছিল। ওই সময় ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ) নামে সরকারের পেটোয়া বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল এটা সবারই জানা। তারাও তত্কালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হয়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ধরনে তখনকার সন্ত্রাসের সঙ্গে এখনকার সন্ত্রাসের কিছু পার্থক্য থাকলেও তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করাটাই যথাযথ। হয়তোবা আজকের মতো গুলি-বন্দুকের ব্যবহার তখন ছিল না; কিন্তু হকিস্টিক, ছুরি-চাকুর ব্যবহার ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুবিধা লাভ করার বিষয়টি তখনও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে ছাত্র রাজনীতির একটি সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। ছাত্র রাজনীতি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে সক্ষম হয়েছিল, যার পরিণতিতে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যার কারণে এখনও রাষ্ট্রের দলবাজি চরিত্র বহাল থেকে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা জাতীয় হয়ে ওঠেনি, অর্থাত্ জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণে সংগতিশীল রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়নি ক্ষমতাসীনরা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এখনও ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলীয় স্বার্থ হাসিল করার ক্ষমতা হিসেবেই বিদ্যমান থেকে গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, অতীতের মতো বর্তমানেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেণীটি বিদেশি স্বার্থের সেবায় নিজেদের চালিত করে চলেছে। জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণের প্রয়োজনে জাতীয় পুঁজির গঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কোনো নীতি কাঠামোর ধারে কাছেও এরা অবস্থান নিতে চায় না। এ কারণে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলেই তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমন করার প্রবণতা এদের মধ্যে বিদ্যমান। চরিত্রের দিক হতে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে তারাই জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে চলেছে। এ কারণে বিদেশি মহাশক্তিধরদের সঙ্গে যেসব চুক্তি তারা করেছে তারা সেটা প্রকাশ করতে চায় না। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির বিরোধিতায় যারা সোচ্চার হয়েছিলেন তারা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দিলেও চুক্তির বিষয়ে সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব এখনও উত্থাপন করেননি। সংসদের বাইরে দেশ বাঁচানোর আওয়াজ তুললেও সংসদে বসে মনে হয় তারা বিষয়টি ভুলে গেছেন। আগামী দিনগুলোতেই সংসদে তাদের ভূমিকা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে আশা করা যায়।
জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রশ্নে যারা তাদের দলীয় দলিলে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তারাও কিন্তু সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো নিয়ে সংসদে খোলামেলা আলোচনা করার কোনো দাবি উত্থাপন করছেন না জোরালোভাবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি পরিত্যাজ্য হলে তার বিপরীতে কী ধরনের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা দরকার, যা আমাদের দেশে জাতীয় পুঁজির গঠনকে শক্তিশালী করবে—এ প্রশ্নে পরিষ্কার অবস্থান নিয়ে কথা বলা দরকার। এই বিষয়ে এ দেশে যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের সমূহ দুর্বলতা বিদ্যমান। পাকিস্তানের মাত্র পঁচিশ বছরের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের জনগণ অস্ত্রহাতে লড়াই করতে দ্বিধা করেনি; কিন্তু সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৩৮ বছর পার হয়ে গেল কিন্তু লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকরাই শক্তিশালী হয়ে থাকল—এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে জাতীয় রাজনৈতিক দীনতাকেই প্রকট করে তোলে। এই দীনতা হচ্ছে লুটপাটের অর্থনীতির রাজনীতি যারা করে তাদের সঙ্গে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির নামে ঐক্যের মধ্যে নিহিত। লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকদের সঙ্গে যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এদেশে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হবে না। পরিণতিতে লুটপাটের অর্থনীতির ধারক-বাহকরাই জাতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। এই যদি হয় অবস্থা তবে শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে যা ঘটছে তার পরিবর্তন আশা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। অর্থাত্ শিক্ষাঙ্গনের এ নৈরাজ্য থেকে নিস্তার পেতে জাতিকে আরও অনেক বড় মাশুল দিতে হবে। হয়তো বা দেখা যাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে যেতেই ভয় পাবেন জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে। এর লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাই প্রকট হয়ে উঠবে। আমরা কেউ চাই না এদেশে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারা যাক। কিন্তু আমরা না চাইলে কী হবে, এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে যতদিন পর্যন্ত লুটপাটের অর্থনীতির রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে থাকবে।
জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনীতির শক্তিশালী অবস্থান দরকার। এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ হলে হয়তো বা দেখা যাবে রাজনীতিতে স্বাধীনতার সপক্ষ আর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি জোটভুক্ত হয়ে পড়েছে, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলার জন্য। তাই যারা চায় এদেশের জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াক, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমরা সক্ষম হয়ে উঠি, তারা অন্তত সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপক্ষে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে অথবা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষম অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং এই কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজটি প্রাধান্য দাবি করে।
No comments