অভিমত ভিন্নমত
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: হাঁটতে হবে যুক্তির পথে আমার প্রতিবেশী কে হবেন, তা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। প্রতিবেশী যদি ভালো হয়, তাহলে সোনায় সোহাগা। আর খারাপ হলে ভাবতে হয়, কেমন করে সম্পর্কটা ভালো করা যায়, তিক্ততা এড়িয়ে শান্তিতে বসবাস করা যায়।
বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী দেশ। আগে এ দুটি একই দেশ ছিল। পরে তা ভাগ হয়ে গেছে। এর আছে বিস্তৃত পটভূমি, যা তৈরি করেছে স্বতন্ত্র জাতিতত্ত্ব, অর্থনীতি এবং নাগরিকদের মনোজগত্। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের অবধারিত ফল ছিল পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অল্প সময়ের মধ্যেই বাঙালির মোহভঙ্গ হলো। তার পরের ইতিহাস আমরা জানি।
বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা হয়ে গেছে। আসলে কি তাই? গত প্রায় চার দশকের সালতামামি এ প্রতীতির জন্ম দেয় যে আমরা বাঙালি মুসলমানের একটা জাতীয় রাষ্ট্র পেয়েছি। এ কারণেই আমাদের বাঙালি মুসলমান পরিচয় ক্রমাগত মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং বাঙালি মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক বিচারে প্রতিবেশী ভারত দৃশ্যমান হয়েছে একটি ‘শত্রুরাষ্ট্র’ হিসেবে। তাই এখনো অনেককে বলতে শোনা যায়, জান না ওরা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করত? এ ‘নির্যাতিতের মনস্তত্ত্ব’ থেকেই উত্সারিত হয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের আগে আমরা যে পাসপোর্ট ব্যবহার করতাম, তাতে জাতীয়তা হিসেবে উল্লেখ করা হতো ‘সিটিজেন অব বাংলাদেশ’, এখন লেখা হয় ‘বাংলাদেশি’। আমরা এখন বাংলাদেশি হিসেবেই ভারতকে দেখতে অভ্যস্ত। এ ভারত হলো হিন্দু ভারত। বিষয়টাকে আরও অধিকতর ব্যঞ্জনা দেওয়ার জন্য কেউ কেউ বলেন, ইসলামাবাদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া ছিল মাত্র ২৩ বছরের। কিন্তু দিল্লির সঙ্গে আমাদের বিবাদ ৭০০ বছরের।
এ তো গেল আমাদের কথা, ভারতবাসী বিষয়টাকে কীভাবে দেখ? দিল্লির সাউথ ব্লকের আমলারা এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ইতিহাসের একটি ভুল সংশোধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। তাঁদের চোখে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তি। একাত্তরে এর একটি মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু এ তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশ দিল্লির অনুগত একটি অবস্থান বজায় রেখে চলবে—এ রকমই আশা করেছিলেন অনেকে, সেটা হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা বৈরী মনোভাব ভারতীয় প্রশাসনে ও কূটনীতিতে মাঝে-মধ্যেই দেখা যায়। এর প্রকাশ ঘটে দুই রাষ্ট্রের আন্তসম্পর্কের ক্ষেত্রে। দুর্বল ও ছোট দেশ হওয়ার কারণে অবহেলা করা, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া বা জোর খাটানোর প্রয়াস ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিতে দৃশ্যমান।
ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কতগুলো গুরুতর অভিযোগ আছে। যেমন: উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা, অসম বাণিজ্যনীতি ও বাণিজ্য উদারীকরণের ক্ষেত্রে বাধা, ছিটমহলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও ভারতের বেশ কিছু অভিযোগ আছে এবং এগুলোও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন: বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন (যাঁরা আশ্রয়ের জন্য ভারত যান), ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে ট্রানজিট বা করিডর দেওয়ার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা ইত্যাদি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে এ অভিযোগগুলো বরাবর অস্বীকার করা হলেও বাস্তবে এগুলো সত্য। এসব অভিযোগ টেবিলে রেখে খোলামনে আলাপ-আলোচনা করা বা এ ধরনের সংলাপের জন্য পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি। আমাদের এ দেশেই বসবাস করতে হবে এবং প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়েই। আলোচনা হতে হবে নাগরিকদের স্বার্থে। ১৯০৫ সালে কে কাকে গালি দিয়েছিল, ১৯৪৬ সালে কে কার বাড়ি লুট করেছিল—এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে, কিন্তু আন্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সুস্থ বিকাশ সম্ভব নয়।
ভারতের সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব ভারতের জনগোষ্ঠী ও সরকারকে বোঝানো যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই সমতাভিত্তিক নয়, সম্মানজনকও নয়। আমাদের সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব হচ্ছে, আমাদের সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করা, জনসচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করা, যাতে আমরা এ বৈরী সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী, আমলা এবং রাজনীতিক উত্তর-পূর্ব ভারতের দেড় কোটি মানুষের বাজারের দিকে তাকিয়ে আছেন। ট্রানজিটের বিরোধিতার এটি একটি অন্যতম কারণ। কিন্তু আমাদের পশ্চিমে ভারতের ১০০ কোটি মানুষের যে বিশাল বাজার পড়ে আছে, আমরা তা দেখছি না। আমাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আমরা শুধু বাধা দেখি, সুযোগ দেখি না।
ভারত-বিরোধিতা আমাদের অনেকের মজ্জাগত। আহমেদাবাদে দাঙ্গা হলে আমাদের মুসলমানি রক্ত টগবগ করে। চীনে মুসলমান নিধন হলে এখানে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিল বের হয় না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা অনেক হইচই করলাম। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নিয়ে আমাদের মুখে টুঁ শব্দটিও নেই। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সমান সমান। কিন্তু আমরা গেল গেল রব তুলি কেবল ভারতের বেলায়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত রাষ্ট্রের আচরণ অনেকটাই শভিনিস্টিক—সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে দাদাগিরি। এ অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে শুধু বাংলাদেশের নয়, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কারও। আবার ভারতের মধ্যেও দাদাগিরি আছে। উত্তর-পূর্ব ভারত ও দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ভারতের আচরণও সমতাভিত্তিক নয়। বলা হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলোকে যে চোখে দেখে, ভারত তার প্রতিবেশীদেরও সে রকম দৃষ্টিতেই দেখে।
আমরা অবশ্যই ভারতের সব ধরনের অবমাননাকর আচরণের প্রতিবাদ করব। কিন্তু আমাদের হাঁটতে হবে যুক্তির পথে, ভবিষ্যতের দিকে। আমি মনে করি না, ভারতীয় রেলওয়ে কিংবা বিদ্যুত্ গ্রিডে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।
শুধু সাংসদ বা জজদের ভিসা ছাড়া ভারতে বেড়ানোর জন্য আমরা এ দেশ স্বাধীন করিনি। আমরা সব নাগরিকের অবাধ যাতায়াতের পথে সব ধরনের বাধা দূর করতে চাই। এ দুই দেশের নেতারা যখন আলোচনায় বসেন, তখন নাগরিকদের অধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা তাঁদের ভাবতে হবে। বছরে কয়েকটি সাংস্কৃতিক দলের পাল্টাপাল্টি সফর হলেই সম্পর্ক ভালো হবে না, প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া। এ দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে কেবল সাধারণ মানুষই। এটাকে সম্পূর্ণভাবে আমলাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ, ঢাকা।
mohi 2005 @ gmail.com
বিপন্ন নদী: বিপর্যস্ত জীবন
জালের মতো দেশজুড়ে আমাদের নদী। বড় অহংকার বাঙালিদের এ নিয়ে। এখানকার সভ্যতার জয়যাত্রা তথা মানব বসতি, কৃষির পত্তনের সঙ্গে গ্রাম-নগর-বন্দর গড়েছে ওই নদী। অধিবাসীদের প্রাণশক্তির বিকাশে, তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এর রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। নদীগুলো কূল ভাঙে, আবার কূল গড়েও। নদীবাহিত পলি পড়ে উর্বর হয় ফসলি জমি। শাখানদী, উপনদী মিলে দেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। এ ছাড়া মৌসুমি খাঁড়ি, পাহাড়ি ছড়া, বিল-হাওর-বাঁওড় তো রয়েছেই।
কিন্তু দুঃখজনক যে পদ্মা (উত্সমুখে গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো আন্তর্জাতিক নদীসহ দেশের সব নদীই ক্রমান্বয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। ভাটিতে অবস্থানের দরুন সীমান্ত দিয়ে বয়ে আসা নদীর ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই হচ্ছে প্রবল বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড খরা। একদিকে নদীবাহিত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে নদী, অপরদিকে উত্সমুখে পর্যায়ক্রমে বাঁধ নির্মাণ, জনবসতি ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে নদী ভরাট এবং দূষিত বর্জ্য ফেলে নদীর আয়ু হ্রাস করা হচ্ছে। এ অবস্থা আসলেই নদীর জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে।
নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় দেশের অনেক জায়গায়ই হালকা নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের রিও গ্র্যান্ডি কলোরাডো নদী শুকিয়ে ভারী জলযান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় তারা কমিশন গঠন করে নদী দুটির গভীরতা পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে। এ রকম কমিশন গঠন করে আমাদের দেশেও নদী সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে পরিবহন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত যানজট নিরসনের স্বার্থে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির অনন্য উত্সমুখ আবহমানকালের বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থেই নদীগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যে নদী নিয়ে হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবিরা চমত্কার করে লিখেছিলেন ‘ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহি’। অর্ধশতাব্দী কাল আগেও এক বাঙালি কবি পদ্মা নদীর বিশালতা নিয়ে লিখেছিলেন: ‘গহীন নদীর দুই পার দিয়া আঁখি যায় যত দূরে’। আমাদের নদীগুলোকে এখন দেখলে সেই দৃশ্য কি চোখে পড়ে? বরং রবীন্দ্রনাথের আমাদের ছোট নদী কবিতার কথাই বারবার মনে পড়ে।
আমরা যদি নদীর প্রতি মনোযোগী না হই, তবে এমন একসময় আসতে পারে যখন আমাদের নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। শঙ্কিত হয়ে ওঠার মতো একটা ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে না তো? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, হলিউডের সাড়া-জাগানো ছবি দ্য ডে আফটার টুমরো-এর কথা, যাতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছে, বরফযুগ গ্রাস করছে আমেরিকাকে। সামান্য একটু রৌদ্রের প্রত্যাশায় লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে পাশের দেশ মেক্সিকোতে। জনশূন্য নিউইয়র্ক শহর—যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে নেকড়ের দল। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ক্যালিফোর্নিয়া শহর। এমন কোনো বিপর্যয় অপেক্ষা করে নেই তো দক্ষিণ এশিয়ার গাঙ্গেয় বদ্বীপের এ ছোট্ট দেশটির জন্য?
সাইফুদ্দীন চৌধুরী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
এফএম রেডিওর সম্ভাবনা
স্যাটেলাইট টিভির পরে এফএম রেডিওর আবির্ভাবের ফলে দেশে গণমাধ্যমের বহুমুখীনতার যে সূচনা ঘটেছে তা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও এফএম রেডিও গান, মিউজিক, আড্ডা ইত্যাদি প্রচার করে। এফএম রেডিওর কারণে ইদানীং বাংলা গানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এ দেশের বাজারে হিন্দি ও ভারতীয় বাংলা গানের আধিপত্য ছিল। ইদানীং এটা অনেকখানি কমেছে। হিন্দি গান খুব কমই শোনা যায়।
কিন্তু এফএম বেতারকেন্দ্রগুলোর উপস্থাপকরা (রেডিও জকি বা আরজে) এমন উচ্চারণে বাংলা বলেন, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া ইংরেজি শব্দের আধিক্য প্রায় দৃষ্টিকটু মাত্রায়। এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ আছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা উচিত, যেখানে ভাষা ব্যবহারের একটি আদর্শ মান সম্পর্কে নির্দেশনা থাকবে। এফএম রেডিও একটি গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের আনুষ্ঠানিক ভাষা মান ভাষা হওয়া উচিত। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তা-ই আছে।
এ ছাড়া, আরজেদের আড্ডার বিষয়বস্তুর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসাই প্রধান। এটি অনেক সময় একঘেঁয়ে লাগে। তা ছাড়া তরুণ সমাজের আলোচনা করার বিষয় কী আর নেই? প্রেম-ভালোবাসাই কি তাঁদের একমাত্র আগ্রহের বিষয়? তা হতে পারে না। শিক্ষাজীবনের সমস্যাসহ বিভিন্ন সমসাময়িক প্রসঙ্গেও এফএম রেডিওতে আড্ডা হতে পারে, হওয়া উচিত।
বিশ্বের অনেক দেশে এফএম রেডিও স্টেশনগুলো বিনোদনধর্মী। সংবাদ প্রচারের অনুমতি তাদের থাকে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ এফএম রেডিও স্টেশন সংবাদ প্রচার করে। অর্থাত্ এখানে বেসরকারি পর্যায়ে বেতার সাংবাদিকতারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এফএম রেডিওর প্রচারসীমা সীমিত হলেও কার্যকারিতার দিক থেকে এর সম্ভাবনা বিরাট। বিনোদনের পাশাপাশি সংবাদ ও তথ্যমূলক নানা অনুষ্ঠান আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এফএম রেডিওগুলো সামনের দিনগুলোতে আরও জনপ্রিয় ও জনকল্যাণকর হতে পারে।
শাকিল মনজুর, ঢাকা।
কোটা পদ্ধতি ও জাতীয় অদক্ষতা
সরকারি নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা নির্ধারিত আছে। অর্থাত্ রাষ্ট্রীয় কর্মীবাহিনীতে মেধাবীদের জন্য অর্ধেক জায়গাও নেই। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে ‘সরকারী নিয়োগ লাভের সমতা’র কথা থাকলেও, এই সংবিধানেরই ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদে কোটা পদ্ধতির কিছুটা বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” আমাদের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান (৩০%), মহিলা, উপজাতি, জেলা, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি কোটা রয়েছে।
প্রথমে আসি সবচেয়ে বড় কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাই তাদের কাছে জাতি চিরঋণী। রাষ্ট্রের তাঁদের জন্য অবশ্যই অনেক কিছু করণীয় আছে। তবে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর পদগুলোতে যদি কোটার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে রাষ্ট্র পরিচালনা অদক্ষ থেকে যাবে, উন্নয়ন ব্যাহত হবে; আর আমরা বঞ্চিত হব প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ থেকে। তা এই মহান মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নও ভেঙে দেবে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্র নানাভাবে সহায়তা করতে পারে; যেমন—তাদের জন্য আজীবন আর্থিক সহায়তা দিতে পারে, চাষাবাদের জমি দিতে পারে, এমনকি বিসিএস ও প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য চাকরির ক্ষেত্রে এই কোটা রাখা যেতে পারে।
মহিলা, উপজাতি, প্রতিবন্ধীরা নিঃসন্দেহে জাতির অনগ্রসর অংশ। তাই সংবিধান অনুযায়ী এই কোটাগুলো বৈধ। কিন্তু মহিলাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রদান করে প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব না করিয়ে বরং তাদের শিক্ষা ও উন্নতির সুযোগ এমনভাবে প্রদান করা, যাতে তারা যোগ্য হয়ে কোটা নয় বরং মেধা দিয়েই প্রজাতন্ত্রের কাজে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
প্রতিবন্ধীরা প্রকৃতপক্ষেই সুবিধাবঞ্চিত অংশ, তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য আমরা কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারি না, তাই তাদের জন্য সামান্য পরিমাণ কোটা রাখা যেতে পারে। উপজাতীয়রা আরেকটি অনগ্রসর অংশ। তাদের উন্নতির জন্যও সরকার তাদের শিক্ষা ও মৌলিক প্রয়োজনগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে পারে। এভাবেই তাদের উন্নতি টেকসই হতে পারে। জেলা কোটা থেকে কখনো একটি জেলার উন্নতি করা যায় না। অনগ্রসর জেলাগুলোতে বেশি বেশি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে সেখানকার টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
সবার স্বার্থে প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিলোপ করা।
শেখ আজম আলী
শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের সংসদ: বিচারপতির মন্তব্য
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী গত ১৯ ডিসেম্বর ব্র্যাক সেন্টারে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা: রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক সেমিনারে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সাংসদদের আইন সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। তাঁদের সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেন, কেরানিরা আইনের খসড়া তৈরি করেন আর মূর্খ সাংসদেরা হু-হু করে হাততালি দিয়ে তা পাস করেন। কারণ, নিজদলীয় লোক তা উত্থাপন করেন। অনেক সময় তাঁরা খসড়া আইনটি পড়েও দেখেন না। এ মন্তব্যের পরদিন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সেই বিচারপতির বিরুদ্ধে সংসদ অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ করার হুমকি দেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনার কথা বলেন। এর পরদিন ওই বিচারপতিকে আইনমন্ত্রী আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ওই বিচারপতি সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা কি একেবারেই ভিত্তিহীন? যেকোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ সংসদের অধিবেশন নিয়মিত দেখলেই বুঝতে পারবেন। বর্তমান সংসদের শুরুতেই নতুন সংসদ সদস্যদের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে স্পিকারের সংসদ পরিচালনায় অসুবিধা হচ্ছে—এমন মন্তব্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী নতুন সাংসদদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছিলেন। প্রধান বিরোধী দলের অব্যাহত সংসদ বর্জনের কারণে প্রায় অধিকাংশ অধিবেশনেই সংসদ অকার্যকর থাকে। সপ্তম ও অষ্টম সংসদে জাতীয় পার্টির বেশ কিছু অভিজ্ঞ সদস্য সংসদে থাকায় তাঁরা উত্থাপিত বিলের বিভিন্ন অংশ নিয়ে সমালোচনা করতেন। কিন্তু বর্তমান সংসদে অধিকাংশ দিনই কোনো বিরোধী দলের সদস্য উপস্থিত না থাকায় মহাসমারোহে সরকারি দল বিল উত্থাপন ও তা পাস করে।
তাই বিচারপতি নজরুল ইসলাম যে উক্তি করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ না হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে আইন প্রতিমন্ত্রীর বাস্তব অবস্থা চিন্তা করে আত্মসমালোচনা করা উচিত। সাংসদদের উচিত দেশের শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া। আর সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।
খাদেমুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ভর্তিযুদ্ধ থেকে শিশুদের মুক্তি দিন
আমার প্রথম সন্তান এবার স্কুলে ভর্তির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতিযোগিতা তো নয়, যেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ী হলে সে পাবে ঢাকা শহরের হাতেগোনা কয়েকটি ভালো স্কুলের একটিতে পড়ার সুযোগ। এ ভর্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কয়েক হাজার শিশু। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের বাস। দুঃসহ যানজটের এ শহরের এক প্রান্তে বাস করে অন্য প্রান্তের স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়াও যেন শিশুর মতোই তার মা-বাবার জন্যও বিজয় অর্জন। এ কথা বলার কারণ, রাজধানীতে সরকারি স্কুল হাতেগোনা। এগুলোতে আসনসংখ্যাও সীমিত। প্রতিটি আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু থাকে পাঁচ থেকে ১০ জন। বেসরকারি ভালো স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার।
শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি-বেসরকারি ভালো স্কুল ও এগুলোর আসনসংখ্যা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণে এমন মা-বাবাও আছেন, যাঁরা সন্তানকে কোনো স্কুলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে ভালো স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাতে আনছেন, যেন সে ভর্তিযুদ্ধে টেকে।
এখানেই শেষ নয়, ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে ছয় মাস, এক বছর, কখনো কখনো দুই বছর ধরে। এ যুদ্ধের জন্য কোচিং করানো অনিবার্য। কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় ১০০-তে ১০০ (বর্তমানে ৫০-এ ৫০) না পেলে নাকি বাচ্চারা ভর্তি হতে পারবে না। কাজেই কোচিং সেন্টারের মেশিনের মধ্য দিয়ে মগজ ধোলাই করে তারপর তাকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাতে হয়। কী ভয়াবহ সেই কোচিং, সেখানে না গেলে তার প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোথাও কোনো সিলেবাস নেই। তাই প্রথম শ্রেণীতে ভতিচ্ছুদের স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য গণিত পর্যন্ত সবই তোতা পাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর সাধারণ জ্ঞান (!) যা শেখানো হয়, তা একজন বিসিএস পরীক্ষার্থীরও শিখতে বেগ পেতে হয়। এসব শেখানোয় অনেক মা খুশিও হচ্ছেন। তাঁরা ভাবছেন, সন্তানেরা অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। যে শিশু স্কুলের ধাপগুলো একটু একটু করে পার হয়ে এসব শিখতে পারত, তা কয়েক মাসেই পড়িয়ে ফেলা হলো। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
এটি কি সঠিক পদ্ধতি? আমার বিবেক-বিবেচনায় তা বলে না। এ শহরে এক কোটিরও বেশি মানুষের বাস। শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি-বেসরকারি স্কুল কম। ইংলিশ মিডিয়াম কিছু স্কুলও আছে, তবে সেগুলোতে পড়ানোর ব্যয় বহন করা অনেক অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে এ সমস্যার সমাধান কী? সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো এবং একই সঙ্গে এগুলোতে আসনসংখ্যা বাড়ানো। বাড়াতে হবে ভালো বেসরকারি স্কুলও। বেসরকারি স্কুলগুলোর মানও ধীরে ধীরে বাড়ানো দরকার। বোধ করি বহুমুখী শিক্ষার মাধ্যমও কমানো দরকার। আর দরকার মা-বাবার মানসিকতার পরিবর্তন। তাদের ভাবতে হবে, সন্তান শিশু, তার মেধা রয়েছে এবং পারিবারিক পরিবেশেই সে হয়ে উঠতে পারে একজন অসাধারণ মানুষ। তারা শিশুকে এলাকার ভালো স্কুলে দিয়ে প্রতিদিনের যাতায়াতের কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে এবং সময় বাঁচিয়ে কোনো সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত করতে পারেন। জানি, কোনো কিছুই একদিনে সম্ভব নয়, তবু সরকারসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যদি আজ থেকেও আমরা ভাবী এসবের সমাধান নিয়ে, তাহলে বোধহয় এ যুদ্ধের হাত থেকে ওদের মেধাগুলোকে বাঁচাতে পারব।
বিদৌরা সুমি
কলাবাগান, ঢাকা।
বেহাল এনজিও ব্যুরো
সম্প্রতি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এনজিও ব্যুরোর বিভিন্ন সংকট, প্রতিষ্ঠানটির ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অসংখ্য এনজিওর সঠিক তত্ত্বাবধান, নজরদারি ও নিরীক্ষা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ক্ষুদ্রঋণ-সংশ্লিষ্ট বহু এনজিও বর্তমানে তাদের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুত্ হয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদি শব্দ সংবলিত সাইনবোর্ড এখন শুধু নিজেদের রক্ষাকবচ। বহু এনজিও প্রাপ্ত অনুদানের টাকায় অথবা সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকা ব্যবহার করে শহরে বড় বড় ভবন নির্মাণ অথবা গ্রামাঞ্চলে বিপুল সম্পত্তি ক্রয় করে বা লিজ পেয়ে তাতে নানা ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট এনজিওর মালিক তথা উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে নিজেরা বিপুল লাভবান হলেও জড়িত সদস্য বা তথাকথিত উপকারভোগীদের ভাগ্যের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে না।
এ অবস্থা নিরসনকল্পে এনজিও ব্যুরোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সারা দেশের সব শ্রেণীর এনজিওর কাজের তদারকি, নজরদারি ও নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদারের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতে পরিচালিত সব ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প/কর্মসূচির সামগ্রিক মূল্যায়ন করে যথাযথ সহায়তা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি।
শাহীদুল আযম
সাবেক কর্মকর্তা, বিআরডিবি, ঢাকা।
বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা হয়ে গেছে। আসলে কি তাই? গত প্রায় চার দশকের সালতামামি এ প্রতীতির জন্ম দেয় যে আমরা বাঙালি মুসলমানের একটা জাতীয় রাষ্ট্র পেয়েছি। এ কারণেই আমাদের বাঙালি মুসলমান পরিচয় ক্রমাগত মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং বাঙালি মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক বিচারে প্রতিবেশী ভারত দৃশ্যমান হয়েছে একটি ‘শত্রুরাষ্ট্র’ হিসেবে। তাই এখনো অনেককে বলতে শোনা যায়, জান না ওরা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করত? এ ‘নির্যাতিতের মনস্তত্ত্ব’ থেকেই উত্সারিত হয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের আগে আমরা যে পাসপোর্ট ব্যবহার করতাম, তাতে জাতীয়তা হিসেবে উল্লেখ করা হতো ‘সিটিজেন অব বাংলাদেশ’, এখন লেখা হয় ‘বাংলাদেশি’। আমরা এখন বাংলাদেশি হিসেবেই ভারতকে দেখতে অভ্যস্ত। এ ভারত হলো হিন্দু ভারত। বিষয়টাকে আরও অধিকতর ব্যঞ্জনা দেওয়ার জন্য কেউ কেউ বলেন, ইসলামাবাদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া ছিল মাত্র ২৩ বছরের। কিন্তু দিল্লির সঙ্গে আমাদের বিবাদ ৭০০ বছরের।
এ তো গেল আমাদের কথা, ভারতবাসী বিষয়টাকে কীভাবে দেখ? দিল্লির সাউথ ব্লকের আমলারা এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ইতিহাসের একটি ভুল সংশোধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। তাঁদের চোখে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তি। একাত্তরে এর একটি মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু এ তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশ দিল্লির অনুগত একটি অবস্থান বজায় রেখে চলবে—এ রকমই আশা করেছিলেন অনেকে, সেটা হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা বৈরী মনোভাব ভারতীয় প্রশাসনে ও কূটনীতিতে মাঝে-মধ্যেই দেখা যায়। এর প্রকাশ ঘটে দুই রাষ্ট্রের আন্তসম্পর্কের ক্ষেত্রে। দুর্বল ও ছোট দেশ হওয়ার কারণে অবহেলা করা, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া বা জোর খাটানোর প্রয়াস ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিতে দৃশ্যমান।
ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কতগুলো গুরুতর অভিযোগ আছে। যেমন: উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা, অসম বাণিজ্যনীতি ও বাণিজ্য উদারীকরণের ক্ষেত্রে বাধা, ছিটমহলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও ভারতের বেশ কিছু অভিযোগ আছে এবং এগুলোও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন: বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন (যাঁরা আশ্রয়ের জন্য ভারত যান), ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে ট্রানজিট বা করিডর দেওয়ার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা ইত্যাদি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে এ অভিযোগগুলো বরাবর অস্বীকার করা হলেও বাস্তবে এগুলো সত্য। এসব অভিযোগ টেবিলে রেখে খোলামনে আলাপ-আলোচনা করা বা এ ধরনের সংলাপের জন্য পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি। আমাদের এ দেশেই বসবাস করতে হবে এবং প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়েই। আলোচনা হতে হবে নাগরিকদের স্বার্থে। ১৯০৫ সালে কে কাকে গালি দিয়েছিল, ১৯৪৬ সালে কে কার বাড়ি লুট করেছিল—এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে, কিন্তু আন্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সুস্থ বিকাশ সম্ভব নয়।
ভারতের সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব ভারতের জনগোষ্ঠী ও সরকারকে বোঝানো যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই সমতাভিত্তিক নয়, সম্মানজনকও নয়। আমাদের সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব হচ্ছে, আমাদের সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করা, জনসচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করা, যাতে আমরা এ বৈরী সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী, আমলা এবং রাজনীতিক উত্তর-পূর্ব ভারতের দেড় কোটি মানুষের বাজারের দিকে তাকিয়ে আছেন। ট্রানজিটের বিরোধিতার এটি একটি অন্যতম কারণ। কিন্তু আমাদের পশ্চিমে ভারতের ১০০ কোটি মানুষের যে বিশাল বাজার পড়ে আছে, আমরা তা দেখছি না। আমাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আমরা শুধু বাধা দেখি, সুযোগ দেখি না।
ভারত-বিরোধিতা আমাদের অনেকের মজ্জাগত। আহমেদাবাদে দাঙ্গা হলে আমাদের মুসলমানি রক্ত টগবগ করে। চীনে মুসলমান নিধন হলে এখানে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিল বের হয় না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা অনেক হইচই করলাম। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নিয়ে আমাদের মুখে টুঁ শব্দটিও নেই। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সমান সমান। কিন্তু আমরা গেল গেল রব তুলি কেবল ভারতের বেলায়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত রাষ্ট্রের আচরণ অনেকটাই শভিনিস্টিক—সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে দাদাগিরি। এ অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে শুধু বাংলাদেশের নয়, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কারও। আবার ভারতের মধ্যেও দাদাগিরি আছে। উত্তর-পূর্ব ভারত ও দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ভারতের আচরণও সমতাভিত্তিক নয়। বলা হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলোকে যে চোখে দেখে, ভারত তার প্রতিবেশীদেরও সে রকম দৃষ্টিতেই দেখে।
আমরা অবশ্যই ভারতের সব ধরনের অবমাননাকর আচরণের প্রতিবাদ করব। কিন্তু আমাদের হাঁটতে হবে যুক্তির পথে, ভবিষ্যতের দিকে। আমি মনে করি না, ভারতীয় রেলওয়ে কিংবা বিদ্যুত্ গ্রিডে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।
শুধু সাংসদ বা জজদের ভিসা ছাড়া ভারতে বেড়ানোর জন্য আমরা এ দেশ স্বাধীন করিনি। আমরা সব নাগরিকের অবাধ যাতায়াতের পথে সব ধরনের বাধা দূর করতে চাই। এ দুই দেশের নেতারা যখন আলোচনায় বসেন, তখন নাগরিকদের অধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা তাঁদের ভাবতে হবে। বছরে কয়েকটি সাংস্কৃতিক দলের পাল্টাপাল্টি সফর হলেই সম্পর্ক ভালো হবে না, প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া। এ দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে কেবল সাধারণ মানুষই। এটাকে সম্পূর্ণভাবে আমলাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ, ঢাকা।
mohi 2005 @ gmail.com
বিপন্ন নদী: বিপর্যস্ত জীবন
জালের মতো দেশজুড়ে আমাদের নদী। বড় অহংকার বাঙালিদের এ নিয়ে। এখানকার সভ্যতার জয়যাত্রা তথা মানব বসতি, কৃষির পত্তনের সঙ্গে গ্রাম-নগর-বন্দর গড়েছে ওই নদী। অধিবাসীদের প্রাণশক্তির বিকাশে, তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এর রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। নদীগুলো কূল ভাঙে, আবার কূল গড়েও। নদীবাহিত পলি পড়ে উর্বর হয় ফসলি জমি। শাখানদী, উপনদী মিলে দেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। এ ছাড়া মৌসুমি খাঁড়ি, পাহাড়ি ছড়া, বিল-হাওর-বাঁওড় তো রয়েছেই।
কিন্তু দুঃখজনক যে পদ্মা (উত্সমুখে গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো আন্তর্জাতিক নদীসহ দেশের সব নদীই ক্রমান্বয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। ভাটিতে অবস্থানের দরুন সীমান্ত দিয়ে বয়ে আসা নদীর ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই হচ্ছে প্রবল বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড খরা। একদিকে নদীবাহিত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে নদী, অপরদিকে উত্সমুখে পর্যায়ক্রমে বাঁধ নির্মাণ, জনবসতি ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে নদী ভরাট এবং দূষিত বর্জ্য ফেলে নদীর আয়ু হ্রাস করা হচ্ছে। এ অবস্থা আসলেই নদীর জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে।
নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় দেশের অনেক জায়গায়ই হালকা নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের রিও গ্র্যান্ডি কলোরাডো নদী শুকিয়ে ভারী জলযান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় তারা কমিশন গঠন করে নদী দুটির গভীরতা পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে। এ রকম কমিশন গঠন করে আমাদের দেশেও নদী সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে পরিবহন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত যানজট নিরসনের স্বার্থে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির অনন্য উত্সমুখ আবহমানকালের বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থেই নদীগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যে নদী নিয়ে হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবিরা চমত্কার করে লিখেছিলেন ‘ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহি’। অর্ধশতাব্দী কাল আগেও এক বাঙালি কবি পদ্মা নদীর বিশালতা নিয়ে লিখেছিলেন: ‘গহীন নদীর দুই পার দিয়া আঁখি যায় যত দূরে’। আমাদের নদীগুলোকে এখন দেখলে সেই দৃশ্য কি চোখে পড়ে? বরং রবীন্দ্রনাথের আমাদের ছোট নদী কবিতার কথাই বারবার মনে পড়ে।
আমরা যদি নদীর প্রতি মনোযোগী না হই, তবে এমন একসময় আসতে পারে যখন আমাদের নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। শঙ্কিত হয়ে ওঠার মতো একটা ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে না তো? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, হলিউডের সাড়া-জাগানো ছবি দ্য ডে আফটার টুমরো-এর কথা, যাতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছে, বরফযুগ গ্রাস করছে আমেরিকাকে। সামান্য একটু রৌদ্রের প্রত্যাশায় লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে পাশের দেশ মেক্সিকোতে। জনশূন্য নিউইয়র্ক শহর—যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে নেকড়ের দল। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ক্যালিফোর্নিয়া শহর। এমন কোনো বিপর্যয় অপেক্ষা করে নেই তো দক্ষিণ এশিয়ার গাঙ্গেয় বদ্বীপের এ ছোট্ট দেশটির জন্য?
সাইফুদ্দীন চৌধুরী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
এফএম রেডিওর সম্ভাবনা
স্যাটেলাইট টিভির পরে এফএম রেডিওর আবির্ভাবের ফলে দেশে গণমাধ্যমের বহুমুখীনতার যে সূচনা ঘটেছে তা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও এফএম রেডিও গান, মিউজিক, আড্ডা ইত্যাদি প্রচার করে। এফএম রেডিওর কারণে ইদানীং বাংলা গানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এ দেশের বাজারে হিন্দি ও ভারতীয় বাংলা গানের আধিপত্য ছিল। ইদানীং এটা অনেকখানি কমেছে। হিন্দি গান খুব কমই শোনা যায়।
কিন্তু এফএম বেতারকেন্দ্রগুলোর উপস্থাপকরা (রেডিও জকি বা আরজে) এমন উচ্চারণে বাংলা বলেন, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া ইংরেজি শব্দের আধিক্য প্রায় দৃষ্টিকটু মাত্রায়। এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ আছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা উচিত, যেখানে ভাষা ব্যবহারের একটি আদর্শ মান সম্পর্কে নির্দেশনা থাকবে। এফএম রেডিও একটি গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের আনুষ্ঠানিক ভাষা মান ভাষা হওয়া উচিত। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তা-ই আছে।
এ ছাড়া, আরজেদের আড্ডার বিষয়বস্তুর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসাই প্রধান। এটি অনেক সময় একঘেঁয়ে লাগে। তা ছাড়া তরুণ সমাজের আলোচনা করার বিষয় কী আর নেই? প্রেম-ভালোবাসাই কি তাঁদের একমাত্র আগ্রহের বিষয়? তা হতে পারে না। শিক্ষাজীবনের সমস্যাসহ বিভিন্ন সমসাময়িক প্রসঙ্গেও এফএম রেডিওতে আড্ডা হতে পারে, হওয়া উচিত।
বিশ্বের অনেক দেশে এফএম রেডিও স্টেশনগুলো বিনোদনধর্মী। সংবাদ প্রচারের অনুমতি তাদের থাকে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ এফএম রেডিও স্টেশন সংবাদ প্রচার করে। অর্থাত্ এখানে বেসরকারি পর্যায়ে বেতার সাংবাদিকতারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এফএম রেডিওর প্রচারসীমা সীমিত হলেও কার্যকারিতার দিক থেকে এর সম্ভাবনা বিরাট। বিনোদনের পাশাপাশি সংবাদ ও তথ্যমূলক নানা অনুষ্ঠান আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে এফএম রেডিওগুলো সামনের দিনগুলোতে আরও জনপ্রিয় ও জনকল্যাণকর হতে পারে।
শাকিল মনজুর, ঢাকা।
কোটা পদ্ধতি ও জাতীয় অদক্ষতা
সরকারি নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা নির্ধারিত আছে। অর্থাত্ রাষ্ট্রীয় কর্মীবাহিনীতে মেধাবীদের জন্য অর্ধেক জায়গাও নেই। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে ‘সরকারী নিয়োগ লাভের সমতা’র কথা থাকলেও, এই সংবিধানেরই ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদে কোটা পদ্ধতির কিছুটা বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” আমাদের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান (৩০%), মহিলা, উপজাতি, জেলা, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি কোটা রয়েছে।
প্রথমে আসি সবচেয়ে বড় কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাই তাদের কাছে জাতি চিরঋণী। রাষ্ট্রের তাঁদের জন্য অবশ্যই অনেক কিছু করণীয় আছে। তবে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর পদগুলোতে যদি কোটার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে রাষ্ট্র পরিচালনা অদক্ষ থেকে যাবে, উন্নয়ন ব্যাহত হবে; আর আমরা বঞ্চিত হব প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ থেকে। তা এই মহান মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নও ভেঙে দেবে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্র নানাভাবে সহায়তা করতে পারে; যেমন—তাদের জন্য আজীবন আর্থিক সহায়তা দিতে পারে, চাষাবাদের জমি দিতে পারে, এমনকি বিসিএস ও প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য চাকরির ক্ষেত্রে এই কোটা রাখা যেতে পারে।
মহিলা, উপজাতি, প্রতিবন্ধীরা নিঃসন্দেহে জাতির অনগ্রসর অংশ। তাই সংবিধান অনুযায়ী এই কোটাগুলো বৈধ। কিন্তু মহিলাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রদান করে প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব না করিয়ে বরং তাদের শিক্ষা ও উন্নতির সুযোগ এমনভাবে প্রদান করা, যাতে তারা যোগ্য হয়ে কোটা নয় বরং মেধা দিয়েই প্রজাতন্ত্রের কাজে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
প্রতিবন্ধীরা প্রকৃতপক্ষেই সুবিধাবঞ্চিত অংশ, তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য আমরা কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারি না, তাই তাদের জন্য সামান্য পরিমাণ কোটা রাখা যেতে পারে। উপজাতীয়রা আরেকটি অনগ্রসর অংশ। তাদের উন্নতির জন্যও সরকার তাদের শিক্ষা ও মৌলিক প্রয়োজনগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে পারে। এভাবেই তাদের উন্নতি টেকসই হতে পারে। জেলা কোটা থেকে কখনো একটি জেলার উন্নতি করা যায় না। অনগ্রসর জেলাগুলোতে বেশি বেশি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে সেখানকার টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
সবার স্বার্থে প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিলোপ করা।
শেখ আজম আলী
শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের সংসদ: বিচারপতির মন্তব্য
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী গত ১৯ ডিসেম্বর ব্র্যাক সেন্টারে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা: রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক সেমিনারে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সাংসদদের আইন সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। তাঁদের সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেন, কেরানিরা আইনের খসড়া তৈরি করেন আর মূর্খ সাংসদেরা হু-হু করে হাততালি দিয়ে তা পাস করেন। কারণ, নিজদলীয় লোক তা উত্থাপন করেন। অনেক সময় তাঁরা খসড়া আইনটি পড়েও দেখেন না। এ মন্তব্যের পরদিন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সেই বিচারপতির বিরুদ্ধে সংসদ অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ করার হুমকি দেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনার কথা বলেন। এর পরদিন ওই বিচারপতিকে আইনমন্ত্রী আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ওই বিচারপতি সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা কি একেবারেই ভিত্তিহীন? যেকোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ সংসদের অধিবেশন নিয়মিত দেখলেই বুঝতে পারবেন। বর্তমান সংসদের শুরুতেই নতুন সংসদ সদস্যদের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে স্পিকারের সংসদ পরিচালনায় অসুবিধা হচ্ছে—এমন মন্তব্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী নতুন সাংসদদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছিলেন। প্রধান বিরোধী দলের অব্যাহত সংসদ বর্জনের কারণে প্রায় অধিকাংশ অধিবেশনেই সংসদ অকার্যকর থাকে। সপ্তম ও অষ্টম সংসদে জাতীয় পার্টির বেশ কিছু অভিজ্ঞ সদস্য সংসদে থাকায় তাঁরা উত্থাপিত বিলের বিভিন্ন অংশ নিয়ে সমালোচনা করতেন। কিন্তু বর্তমান সংসদে অধিকাংশ দিনই কোনো বিরোধী দলের সদস্য উপস্থিত না থাকায় মহাসমারোহে সরকারি দল বিল উত্থাপন ও তা পাস করে।
তাই বিচারপতি নজরুল ইসলাম যে উক্তি করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ না হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে আইন প্রতিমন্ত্রীর বাস্তব অবস্থা চিন্তা করে আত্মসমালোচনা করা উচিত। সাংসদদের উচিত দেশের শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া। আর সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।
খাদেমুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ভর্তিযুদ্ধ থেকে শিশুদের মুক্তি দিন
আমার প্রথম সন্তান এবার স্কুলে ভর্তির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতিযোগিতা তো নয়, যেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ী হলে সে পাবে ঢাকা শহরের হাতেগোনা কয়েকটি ভালো স্কুলের একটিতে পড়ার সুযোগ। এ ভর্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কয়েক হাজার শিশু। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের বাস। দুঃসহ যানজটের এ শহরের এক প্রান্তে বাস করে অন্য প্রান্তের স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়াও যেন শিশুর মতোই তার মা-বাবার জন্যও বিজয় অর্জন। এ কথা বলার কারণ, রাজধানীতে সরকারি স্কুল হাতেগোনা। এগুলোতে আসনসংখ্যাও সীমিত। প্রতিটি আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু থাকে পাঁচ থেকে ১০ জন। বেসরকারি ভালো স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার।
শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি-বেসরকারি ভালো স্কুল ও এগুলোর আসনসংখ্যা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণে এমন মা-বাবাও আছেন, যাঁরা সন্তানকে কোনো স্কুলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে ভালো স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাতে আনছেন, যেন সে ভর্তিযুদ্ধে টেকে।
এখানেই শেষ নয়, ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে ছয় মাস, এক বছর, কখনো কখনো দুই বছর ধরে। এ যুদ্ধের জন্য কোচিং করানো অনিবার্য। কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় ১০০-তে ১০০ (বর্তমানে ৫০-এ ৫০) না পেলে নাকি বাচ্চারা ভর্তি হতে পারবে না। কাজেই কোচিং সেন্টারের মেশিনের মধ্য দিয়ে মগজ ধোলাই করে তারপর তাকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাতে হয়। কী ভয়াবহ সেই কোচিং, সেখানে না গেলে তার প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোথাও কোনো সিলেবাস নেই। তাই প্রথম শ্রেণীতে ভতিচ্ছুদের স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য গণিত পর্যন্ত সবই তোতা পাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর সাধারণ জ্ঞান (!) যা শেখানো হয়, তা একজন বিসিএস পরীক্ষার্থীরও শিখতে বেগ পেতে হয়। এসব শেখানোয় অনেক মা খুশিও হচ্ছেন। তাঁরা ভাবছেন, সন্তানেরা অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। যে শিশু স্কুলের ধাপগুলো একটু একটু করে পার হয়ে এসব শিখতে পারত, তা কয়েক মাসেই পড়িয়ে ফেলা হলো। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
এটি কি সঠিক পদ্ধতি? আমার বিবেক-বিবেচনায় তা বলে না। এ শহরে এক কোটিরও বেশি মানুষের বাস। শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি-বেসরকারি স্কুল কম। ইংলিশ মিডিয়াম কিছু স্কুলও আছে, তবে সেগুলোতে পড়ানোর ব্যয় বহন করা অনেক অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে এ সমস্যার সমাধান কী? সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো এবং একই সঙ্গে এগুলোতে আসনসংখ্যা বাড়ানো। বাড়াতে হবে ভালো বেসরকারি স্কুলও। বেসরকারি স্কুলগুলোর মানও ধীরে ধীরে বাড়ানো দরকার। বোধ করি বহুমুখী শিক্ষার মাধ্যমও কমানো দরকার। আর দরকার মা-বাবার মানসিকতার পরিবর্তন। তাদের ভাবতে হবে, সন্তান শিশু, তার মেধা রয়েছে এবং পারিবারিক পরিবেশেই সে হয়ে উঠতে পারে একজন অসাধারণ মানুষ। তারা শিশুকে এলাকার ভালো স্কুলে দিয়ে প্রতিদিনের যাতায়াতের কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে এবং সময় বাঁচিয়ে কোনো সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত করতে পারেন। জানি, কোনো কিছুই একদিনে সম্ভব নয়, তবু সরকারসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যদি আজ থেকেও আমরা ভাবী এসবের সমাধান নিয়ে, তাহলে বোধহয় এ যুদ্ধের হাত থেকে ওদের মেধাগুলোকে বাঁচাতে পারব।
বিদৌরা সুমি
কলাবাগান, ঢাকা।
বেহাল এনজিও ব্যুরো
সম্প্রতি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এনজিও ব্যুরোর বিভিন্ন সংকট, প্রতিষ্ঠানটির ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অসংখ্য এনজিওর সঠিক তত্ত্বাবধান, নজরদারি ও নিরীক্ষা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ক্ষুদ্রঋণ-সংশ্লিষ্ট বহু এনজিও বর্তমানে তাদের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুত্ হয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদি শব্দ সংবলিত সাইনবোর্ড এখন শুধু নিজেদের রক্ষাকবচ। বহু এনজিও প্রাপ্ত অনুদানের টাকায় অথবা সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকা ব্যবহার করে শহরে বড় বড় ভবন নির্মাণ অথবা গ্রামাঞ্চলে বিপুল সম্পত্তি ক্রয় করে বা লিজ পেয়ে তাতে নানা ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট এনজিওর মালিক তথা উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে নিজেরা বিপুল লাভবান হলেও জড়িত সদস্য বা তথাকথিত উপকারভোগীদের ভাগ্যের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে না।
এ অবস্থা নিরসনকল্পে এনজিও ব্যুরোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সারা দেশের সব শ্রেণীর এনজিওর কাজের তদারকি, নজরদারি ও নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদারের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতে পরিচালিত সব ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প/কর্মসূচির সামগ্রিক মূল্যায়ন করে যথাযথ সহায়তা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি।
শাহীদুল আযম
সাবেক কর্মকর্তা, বিআরডিবি, ঢাকা।
No comments