গ্যাস-বিদ্যুৎ-নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে দিতে হবে বেশি টাকা-শুনানিতে অংশ নেননি ব্যবসায়ী নেতারা by আরিফুজ্জামান তুহিন
শিল্প ও আবাসিকে বিশেষ শ্রেণীর (কিউ শ্রেণী) নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। আর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে ব্যবসায়ী ও আবাসিক গ্রাহকদের তা বেশি দামে কিনতে হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কিউ শ্রেণীর বিশেষ এ বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে
(বিইআরসি) পাঠানোর পর গতকাল বুধবার কমিশন এ বিষয়ে গণশুনানি শেষে দাম বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকে প্রথম দফায় শিল্পে বেশি দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে আবাসিক গ্রাহকদেরও এ শ্রেণীর বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। তবে যাঁদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হবে, সেই ব্যবসায়ীরাই উপস্থিত ছিলেন না গতকালের শুনানিতে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত ছাড়াই কমিশন আগামী ১০ দিনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে পণ্য উৎপাদন করলে তাঁরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। ফলে বেশি দামের বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত।
বিইআরসির কাছে পিডিবির দেওয়া প্রস্তাবে আবাসিকে প্রতি ইউনিট ১৩ দশমিক ১৫ টাকা, শিল্পে ১৬ দশমিক ৭৩ টাকা (১৩২ কেভি লাইন), ১৭ দশমিক ৫২ টাকা (২২ কেভি লাইন) ও ১৮ দশমিক ২৩ টাকা (১১ কেভি লাইন) দাম নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পিডিবি বর্তমানে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ১৬ টাকা করে বিদ্যুৎ কিনছে।
শুনানির পর আরো কিছু বিষয় বিচার-বিবেচনা করে ১০ দিনের মধ্যে রায় ঘোষণা করার ঘোষণা দিয়েছে কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'কিউ শ্রেণীর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে পিডিবির দেওয়া তথ্য, যুক্তি ও ব্যাখ্যায় আমরা সন্তুষ্ট। মূল্য নির্ধারণের এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করা যেতে পারে।' কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে কবে নাগাদ বিইআরসি ঘোষণা দেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, 'সাত কার্য দিবস বা ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হবে।'
শুনানিতে বিইআরসি জানায়, কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। বিদ্যুৎ লাইন, সাবস্টেশন স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের খরচ গ্রাহককে বহন করতে হবে। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সাধারণ শ্রেণীর গ্রাহকদের দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন শুনানিতে উপস্থিত জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে সাধারণ শ্রেণীর গ্রাহকরা আরো বেশি লোডশেডিংয়ের শিকার হবেন।
গতকালের শুনানিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অটো রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মজুমদার ও বিএসআরএমের এক প্রতিনিধি ছাড়া শিল্পমালিকদের আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হবে, যাঁদের জন্য তাঁদের অনুপস্থিতিতে দাম ঠিক করা হলে আদৌ বিদ্যুৎ কিনবেন কি না ব্যবসায়ীরা। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, যেসব ব্যবসায়ী বেশি টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে চান, কেবল তাঁদেরকেই কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া হবে। একবার কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হলে আগের সাধারণ গ্রাহকের তালিকা থেকে তাঁর নাম কাটা যাবে।
কমিশনের সুপারিশ দুটির কোনোটিরই ব্যত্যয় হবে না বলে জানান পিডিবি চেয়ারম্যান এ এস এম আলমগীর কবির। তিনি বলেন, এটা শুধু আগ্রহীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে শ্রমঘন ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এমনকি কিউ শ্রেণীর গ্রাহকদের নতুন করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ফলে তাদের পুরনো সংযোগে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা যাবে। এতে লোডশেডিং কমবে। মূল্য নির্ধারণ হলেও বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ সরবরাহ আগামী অর্থবছরে করা হবে বলে জানান তিনি। কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ সংযোগ প্রথম দফায় শিল্প খাতে এবং পর্যায়ক্রমে বাসাবাড়িতে দেওয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে পিডিবির চেয়ারম্যান জানান, মূল্য নির্ধারণের পর এ ধরনের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন শর্তের আলোকে একটি চুক্তিনামা তৈরি করা হবে। তারপর আগ্রহীদের আবেদনের ভিত্তিতে সংযোগ দেওয়া হবে। তবে একটি এলাকায় এককভাবে কাউকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না, গুচ্ছ আকারে এ ধরনের সংযোগ দিতে হবে। তবে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে চুক্তিতে গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হবে।
বিইআরসি ও পিডিবির চেয়ারম্যান ছাড়াও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, সদস্য মো. ইমদাদুল হক প্রমুখ।
কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজন হবে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জোগান আসবে আটটি কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এই আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ (প্লান্ট ফ্যাক্টর) বিদ্যুতের উৎপাদন নিশ্চিত করা গেলে তবেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। তবে পিডিবির দাবি, এই আটটি কেন্দ্রের সক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ উৎপাদন করা সম্ভব। আটটি কেন্দ্রের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পিডিবির মাত্র ৫০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র রয়েছে। বাকিগুলো ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিডিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্যক্তি খাতের কুইক রেন্টাল ও আইপিপির বিদ্যুৎ বেশি দামে বিক্রি করার জন্যই মূলত এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এত কুইক রেন্টাল ও আইপিপি থাকতে ব্যক্তি খাতের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বেছে নেওয়া হয়েছে।' পিডিবির দাবি, কিছু ব্যক্তি খাতের কম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি।
উল্লেখ্য, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রাখার কারণে বর্তমানে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যার টাকা আছে তার জন্য ভালো বিদ্যুৎ (নিরবচ্ছিন্ন) আর যার টাকা নেই তার জন্য খারাপ বিদ্যুৎতের (লোডশেডিং) ব্যবস্থা হলে বিদ্যুৎ খাতে বৈষম্য তৈরি হবে। এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম শুনানিতে বলেন, 'কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণের মাধ্যমে যাঁরা বেশি টাকা দিতে পারবেন তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবেন আর যাঁরা কম টাকা দেবেন, তাঁরা অন্ধকারে থাকবেন এমনটি হতে পারে না। এটি হলে বিদ্যুৎ খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।' তিনি আরো বলেন, 'সরকারের উচিত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে কম টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাতে ধনি-গরিব নির্বিশেষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায়।'
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে পণ্য উৎপদান করা সম্ভব নয়। বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনলে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ব্যবসায়ীরা ছিটকে পড়বেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, জেনারেটর আমদানির ওপর শুল্ক তুলে নিলে তাঁরা নিজেরাই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবেন, সরকারের কাছে বিদ্যুতের জন্য যাবেন না।
আবুল কাশেম মজুমদার ও বিএসআরএমের প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, 'এক টন রড তৈরি করতে ৯০০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে স্ক্র্যাপ থেকে রড তৈরিতে টনপ্রতি খরচ পড়বে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ ক্যাপটিভ পাওয়ার (নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন) থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিটন রড উৎপাদনে খরচ পড়ে দুই হাজার ২৫০ টাকা। এতে করে এ খাতের প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হবে।' ইস্পাত শিল্পের মতো অন্যান্য শিল্প খাতের উদ্যোক্তারাও এত দামে বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নন।
বাংলাদেশ এঙ্পোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী বলেন, 'আমাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে, এর জন্য আমরা বাড়তি দাম দিতে প্রস্তুত কিন্তু তার তো একটা সীমা থাকবে। যেখানে বিদেশি মালিকানাধীন কম্পানিগুলোয় ইপিজেড এলাকায় বিদ্যুৎ কম দামে দেওয়া হয়, সেখানে আমরা এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনব কেন?'
বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে আগ্রহ নেই বাংলাদেশ নিটওয়ার সংশ্লিষ্ট কারখানামালিকদেরও। বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং আ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমই) প্রেসিডেন্ট সেলিম ওসমান বলেন, 'এককথায় এত দামে আমরা বিদ্যুৎ কিনব না।'
সেচ মৌসুমের চাহিদা মেটাতে গত ২১ মার্চ শিল্পকারখানায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর সঙ্গে ৪ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের ফলে দিনে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ এপ্রিল শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পিডিবি গত ১৫ এপ্রিল নিরবচ্ছিন বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে বিইআরসিতে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি গত ২২ এপ্রিল কমিশন সভায় পর্যালোচনা করে আমলে নেয়।
বিইআরসির কাছে পিডিবির দেওয়া প্রস্তাবে আবাসিকে প্রতি ইউনিট ১৩ দশমিক ১৫ টাকা, শিল্পে ১৬ দশমিক ৭৩ টাকা (১৩২ কেভি লাইন), ১৭ দশমিক ৫২ টাকা (২২ কেভি লাইন) ও ১৮ দশমিক ২৩ টাকা (১১ কেভি লাইন) দাম নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পিডিবি বর্তমানে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ১৬ টাকা করে বিদ্যুৎ কিনছে।
শুনানির পর আরো কিছু বিষয় বিচার-বিবেচনা করে ১০ দিনের মধ্যে রায় ঘোষণা করার ঘোষণা দিয়েছে কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'কিউ শ্রেণীর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে পিডিবির দেওয়া তথ্য, যুক্তি ও ব্যাখ্যায় আমরা সন্তুষ্ট। মূল্য নির্ধারণের এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করা যেতে পারে।' কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে কবে নাগাদ বিইআরসি ঘোষণা দেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, 'সাত কার্য দিবস বা ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হবে।'
শুনানিতে বিইআরসি জানায়, কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। বিদ্যুৎ লাইন, সাবস্টেশন স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের খরচ গ্রাহককে বহন করতে হবে। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সাধারণ শ্রেণীর গ্রাহকদের দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন শুনানিতে উপস্থিত জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে সাধারণ শ্রেণীর গ্রাহকরা আরো বেশি লোডশেডিংয়ের শিকার হবেন।
গতকালের শুনানিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অটো রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মজুমদার ও বিএসআরএমের এক প্রতিনিধি ছাড়া শিল্পমালিকদের আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হবে, যাঁদের জন্য তাঁদের অনুপস্থিতিতে দাম ঠিক করা হলে আদৌ বিদ্যুৎ কিনবেন কি না ব্যবসায়ীরা। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, যেসব ব্যবসায়ী বেশি টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে চান, কেবল তাঁদেরকেই কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া হবে। একবার কিউ শ্রেণীর গ্রাহক হলে আগের সাধারণ গ্রাহকের তালিকা থেকে তাঁর নাম কাটা যাবে।
কমিশনের সুপারিশ দুটির কোনোটিরই ব্যত্যয় হবে না বলে জানান পিডিবি চেয়ারম্যান এ এস এম আলমগীর কবির। তিনি বলেন, এটা শুধু আগ্রহীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে শ্রমঘন ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এমনকি কিউ শ্রেণীর গ্রাহকদের নতুন করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ফলে তাদের পুরনো সংযোগে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা যাবে। এতে লোডশেডিং কমবে। মূল্য নির্ধারণ হলেও বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ সরবরাহ আগামী অর্থবছরে করা হবে বলে জানান তিনি। কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ সংযোগ প্রথম দফায় শিল্প খাতে এবং পর্যায়ক্রমে বাসাবাড়িতে দেওয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে পিডিবির চেয়ারম্যান জানান, মূল্য নির্ধারণের পর এ ধরনের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন শর্তের আলোকে একটি চুক্তিনামা তৈরি করা হবে। তারপর আগ্রহীদের আবেদনের ভিত্তিতে সংযোগ দেওয়া হবে। তবে একটি এলাকায় এককভাবে কাউকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না, গুচ্ছ আকারে এ ধরনের সংযোগ দিতে হবে। তবে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে চুক্তিতে গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হবে।
বিইআরসি ও পিডিবির চেয়ারম্যান ছাড়াও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, সদস্য মো. ইমদাদুল হক প্রমুখ।
কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজন হবে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জোগান আসবে আটটি কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এই আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ (প্লান্ট ফ্যাক্টর) বিদ্যুতের উৎপাদন নিশ্চিত করা গেলে তবেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। তবে পিডিবির দাবি, এই আটটি কেন্দ্রের সক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ উৎপাদন করা সম্ভব। আটটি কেন্দ্রের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পিডিবির মাত্র ৫০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র রয়েছে। বাকিগুলো ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিডিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্যক্তি খাতের কুইক রেন্টাল ও আইপিপির বিদ্যুৎ বেশি দামে বিক্রি করার জন্যই মূলত এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এত কুইক রেন্টাল ও আইপিপি থাকতে ব্যক্তি খাতের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বেছে নেওয়া হয়েছে।' পিডিবির দাবি, কিছু ব্যক্তি খাতের কম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি।
উল্লেখ্য, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রাখার কারণে বর্তমানে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যার টাকা আছে তার জন্য ভালো বিদ্যুৎ (নিরবচ্ছিন্ন) আর যার টাকা নেই তার জন্য খারাপ বিদ্যুৎতের (লোডশেডিং) ব্যবস্থা হলে বিদ্যুৎ খাতে বৈষম্য তৈরি হবে। এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম শুনানিতে বলেন, 'কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণের মাধ্যমে যাঁরা বেশি টাকা দিতে পারবেন তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবেন আর যাঁরা কম টাকা দেবেন, তাঁরা অন্ধকারে থাকবেন এমনটি হতে পারে না। এটি হলে বিদ্যুৎ খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।' তিনি আরো বলেন, 'সরকারের উচিত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে কম টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাতে ধনি-গরিব নির্বিশেষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায়।'
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে পণ্য উৎপদান করা সম্ভব নয়। বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনলে প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ব্যবসায়ীরা ছিটকে পড়বেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, জেনারেটর আমদানির ওপর শুল্ক তুলে নিলে তাঁরা নিজেরাই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবেন, সরকারের কাছে বিদ্যুতের জন্য যাবেন না।
আবুল কাশেম মজুমদার ও বিএসআরএমের প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, 'এক টন রড তৈরি করতে ৯০০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়লে স্ক্র্যাপ থেকে রড তৈরিতে টনপ্রতি খরচ পড়বে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ ক্যাপটিভ পাওয়ার (নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন) থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিটন রড উৎপাদনে খরচ পড়ে দুই হাজার ২৫০ টাকা। এতে করে এ খাতের প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হবে।' ইস্পাত শিল্পের মতো অন্যান্য শিল্প খাতের উদ্যোক্তারাও এত দামে বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নন।
বাংলাদেশ এঙ্পোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী বলেন, 'আমাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে, এর জন্য আমরা বাড়তি দাম দিতে প্রস্তুত কিন্তু তার তো একটা সীমা থাকবে। যেখানে বিদেশি মালিকানাধীন কম্পানিগুলোয় ইপিজেড এলাকায় বিদ্যুৎ কম দামে দেওয়া হয়, সেখানে আমরা এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনব কেন?'
বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে আগ্রহ নেই বাংলাদেশ নিটওয়ার সংশ্লিষ্ট কারখানামালিকদেরও। বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং আ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমই) প্রেসিডেন্ট সেলিম ওসমান বলেন, 'এককথায় এত দামে আমরা বিদ্যুৎ কিনব না।'
সেচ মৌসুমের চাহিদা মেটাতে গত ২১ মার্চ শিল্পকারখানায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর সঙ্গে ৪ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের ফলে দিনে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ এপ্রিল শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পিডিবি গত ১৫ এপ্রিল নিরবচ্ছিন বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে বিইআরসিতে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি গত ২২ এপ্রিল কমিশন সভায় পর্যালোচনা করে আমলে নেয়।
No comments