আমার দেশ-এর মুখোমুখি ভাষাসৈনিক ড. জসীম উদ্দিন আহমেদঃ আবুল বরকতের আহ্ শব্দটি আজও কানে বাজে সাক্ষাত্কার গ্রহণ
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লার গৌরীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন পরমাণু বিজ্ঞানী। আমেরিকা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি (আইএই) ভিয়েনাতে দীর্ঘ চব্বিশ বছর চাকরি করেন এবং আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন অবস্থায় ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি আণবিক বিকিরণ বিষয়ে ৫০ বছর ধরে ৪০টি দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপদেষ্টা ছিলেন এবং আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন মানসম্মত গাইড, কোডস ও টেকনিক্যাল রিপোর্টস বিষয়ক বহু বই লিখেছেন ভিয়েনাতে থাকা অবস্থায়। এছাড়াও তিনি বিশ্বের আটটি দেশের জন্য ইউরেনিয়াম ও থেরিয়াম মাইনিং এবং মিলিং সিকিউরিটি বিষয়ক আইন-কানুন তৈরি করেন যেগুলো কোনো কোনো দেশে পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদনের পর জারি করা হয়। ২০০১ সালে ভিয়েনা থেকে বংলাদেশে চলে আসেন। তিনি তুলনামূলকভাবে ধর্মবিষয়ক একজন গবেষক, যিনি কোরআনের বিজ্ঞান বিষয়ক আয়াতগুলো বিগত ৩০ বছর যাবত গবেষণা করেছেন। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে কবিতা লেখায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়োজিত আছেন। তিনি পল্লীকবি জসীম উদদীনের বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতাকে ইংরেজি ছন্দাবরণে রূপান্তর করেছেন। এছাড়া জধহফড়স ঠবত্ংবং, ঞযব ঊহফষবংং গরহফ, অন্তরে দোলা, তবু লিখি বারবার গ্রন্থসহ রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটি সিডিও প্রকাশিত হয়েছে তার। তিনি সামাজিক বিভিন্ন অনিয়ম-অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছেন ‘মনের ছড়া’ নামক ছড়ার বই। এ বছরও তার লেখা ৪টি বই একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে। তার লেখা জধহফড়স ঠবত্ংবং বইটি নোবেল কমিটিতে গেছে বলে জানা গেছে।
এতকিছুর পরও এই মহান খ্যাতিমান পুরুষ ড. জসীম উদ্দিন আহমেদের অন্যতম পরিচয়, তিনি ভাষা আন্দোলনে সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সম্মুখ সারিতে শহীদ বরকতের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসিতে পড়তেন। থাকতেন ওয়েস্ট হাউসের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ১৩৩ নম্বর রুমে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির যে সময়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদ বরকতের গায়ে গুলি লাগে, সেই মুহূর্তে বরকতসহ তারা তিনজন একযোগে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আর ইট-পাটকেল ছুড়ছিলেন। সহযোদ্ধা বরকত গুলি খেয়ে বারান্দায় লুটিয়ে পড়লে তিনি প্রথম বরকতের রক্তমাখা দেহ কোলে তুলে নেন।
আমার দেশ : প্রাণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার জনগণ সেদিন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : বাংলার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা—এতবড় ঘটনা মেনে নেয়ার আসলে উপায় ছিল না। তাই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা সংক্রান্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি এবং ৪ ফেব্রুয়ারিতে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি হলে ওইদিনই তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাথমিক মিটিং ও পরে মিছিল বের হয়। ঢাকার নবাবপুর রোড, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, চকবাজার হয়ে বিরাট মিছিলটি ‘রাষ্ট্র্রভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই’ স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আবার মিলিত হলো। সেদিনের সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি অর্থাত্ যেদিন এসেম্বলি বা অধিবেশন হবে সেদিন এই ঘোষণার প্রতিবাদে ধর্মঘট করা হবে এবং এসেম্বলির সামনে সবাই সমবেত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হবে। সে অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত ধর্মঘট ও এসেম্বলি হলের সামনে সমবেত হওয়ার জন্য সবার প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালের দিকে জানা গেল, মিছিল বা সমাবেশের প্রতিকূলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আমি তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতাম। আমরা জানতে পারি, পরদিন অর্থাত্ ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ সকালে সবাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে এসেমব্লি হলের দিকে যাওয়া হবে কিনা।
আমার দেশ : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আপনি সম্মুখ সারিতে শহীদ বরকতের সঙ্গে ছিলেন। আসলে কি ঘটেছিল সেদিন?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ২১ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সময় সকাল ১০টা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তখন অসংখ্য ছাত্র সমবেত। সবাই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এসেমব্লি হলের দিকে যাওয়া হবে কিনা। এক পর্যায়ে ঘোষণা এলো, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় আমরা সবাই সমবেত হব। বড় বড় গ্রুপে বের না হয়ে আমাদের ৫ জনের ছোট গ্রুপের যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। একটি গ্রুপে আমিসহ আরও ৪ জন রওনা দেই। আমাদের আগে-পিছে আরও কয়েকটি গ্রুপ ছিল। মেডিকেল গেট থেকে ৫০ গজ দূরে দেখলাম ছাত্রদের পুলিশ লাঠিপেটা করছে। এটা দেখে আমরা কয়েকজন পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ে পেছনে দৌড়ে মেডিকেল কলেজে ঢুকে যাই। তারপর ভেতর দিক দিয়ে হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় ঢুকে যাই। মেডিকেল কলেজ ও হোস্টেলের সীমানা দেয়ালের মাঝে একটু ফাঁক মতো জায়গা ছিল, যেখান দিয়ে ছাত্ররা যাতায়াত করত।
এরই মধ্যে ছাত্র ও পুলিশের সংঘর্ষ তুমুল পর্যায়ে। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করছে ছাত্রদের। কালবিলম্ব না করে আমি ও সলিমুল্লাহ হলের রুমমেট শাহজাহান ঢিলাঢিলিতে শরিক হয়ে যাই। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। হোস্টেল এলাকায় ততক্ষণে অনেক ছাত্রের জমায়েত। আমি উচ্চতায় ছোট হলেও আস্ত ইট পুলিশের ওপর ছুড়ে মারি। ৫০-৬০ ফুট দূরে গিয়ে ইট পড়ল। এখনও ভেবে পাই না, এত শক্তি সেদিন কোথা থেকে পেয়েছিলাম? আস্ত ইটের ঢিল পেয়ে পুলিশ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে কিছু পুলিশ ঝড়ের বেগে গেটের ভেতর ঢুকে তাদের হাতের লাঠিগুলো ছাত্রদের পায়ে ছুড়ে মারতে থাকে। আমি তখন ভীষণ বেগে দৌড় দিয়ে পুলিশের নাগালের বাইরে চলে যাই। পুলিশ গেটের বাইরে গেলে ছাত্ররা আবার রাস্তার দিকে ও গেটের দিকে আসে। আমি, শাহজাহান ও আবুল বরকত (যদিও তখন তাকে চিনতাম না) রাস্তা থেকে দ্বিতীয় ব্যারাকটির বারান্দায় দাঁড়াই। এটির দূরত্ব গেট থেকে ৩০ ফুট হবে। আমার দুই হাতে দুটি ইটের টুকরো। শাহজাহানের হাতেও। বরকতের হাতে কী ছিল জানি না।
আমার দেশ : পুলিশ গুলি ছুড়ল কোন পরিস্থিতিতে? এ ধরনের পরিস্থিতি ঘটবে তা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল তিনটার ঘটনা। ওই সময় দেখতে পেলাম, তিনজন পুলিশ গেটের পূর্ব পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুক আমাদের দিকে তাক করে আছে। তাদের পেছনে আরও অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা চিন্তাও করিনি যে তারা গুলি ছোড়ার মতো কাজ করবে।
হটাত্ খটখট গুলির শব্দ। আমার ও শাহজাহানের মাথার ওপর ঘেঁষে, কানের পাশ দিয়ে কয়েকটি গুলি বারান্দায় বাঁশের চালায় আওয়াজ করে বিঁধে গেল। একদম ফ্রন্ট লাইনে পুলিশের সম্মুখে তখন কেবল আমরা তিনজন। আমার বাঁ পাশে শাহজাহান আর গা ঘেঁষে ডান পাশে আর একজন। মুহূর্তে ধপাস করে আমার ডান পাশের ছেলেটি বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেল। তখনও গুলি চলছে। ডানে তাকালাম। একবার আহ্ শব্দ করে দুই হাতে ভর দিয়ে সে নিজেকে পিছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। গুলি তার বাম পায়ের উরুর গোড়ায় লেগেছে। ইস্ত্রি করা খাকি রংয়ের প্যান্টে গুলির ছিদ্র দিয়ে কলকল করে রক্ত বের হচ্ছে। কোরবানির পশু জবাইয়ের পর রক্তপ্রবাহের মতো রক্তস্রোত বইছে সিমেন্টের বারান্দায়। আমার দুই হাতের ঢিল ফেলে তাড়াতাড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে কোলে নেয়ার চেষ্টা করি। শাহজাহানও আমার সঙ্গে এসে যোগ দেয়। দু’জনে মিলে তাকে বুকের ওপর তুলে ফেলি। আমার কাপড়, জুতা এবং শাহজাহানের কাপড় তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পেছন থেকে আরও দু’তিনজন এসে তাকে ধরে (ওই তিনজনের মধ্যে ভাষা মতিন সাহেবও ছিলেন যা তিনি পরে তার বাসায় গেলে আমাকে বলেছিলেন)। তারা এবং শাহজাহান দ্রুত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। পুলিশের প্রতি ক্রোধে তখন আমি পাগলপ্রায়। দুটি ঢিল আবার হাতে নিয়ে ফ্রন্টে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে বন্দুকের আওয়াজ থেমে গেছে, কিন্তু পুলিশ তখনও সেই স্থানে বসা। নিচের দিকে তাকিয়ে বারান্দার মেঝেতে দেখলাম বেশ জায়গাজুড়ে রক্ত ছড়িয়ে জমে আছে। ঢিল দুটি হাত থেকে পড়ে গেল। এ সময়ের আমার মনের অবস্থা কোনো ভাষায় বর্ণনা দেয়ার মতো নয়।
ছেলেটি আমার চেয়ে লম্বা। পরনে ছিল সদ্য ইস্ত্রি করা খাকি রংয়ের প্যান্ট এবং ডোরাওয়ালা সাদা শার্ট। আগে তাকে চিনতাম না। পুলিশের গুলিতে পড়ে যাওয়ায় তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে তাকে চিনলাম। সে আবুল বরকত।
আমার দেশ : ২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিন কী ঘটেছিল?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ওই রাতটা আমার খুব খারাপ কেটেছিল। তবে এ ঘটনার পর হলগুলোতে ভাষা আন্দোলনের চেতনা, দৃঢ়তা ও কর্মতত্পরতা আরও জোরদার হলো। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে দৈনন্দিন এটি একটি ভাষা আন্দোলনের দুর্গ হিসেবে গড়ে ওঠে। সারাদিন মাইকে পুলিশের গুলির বিচার দাবি, সরকারের অবিচারের প্রতিবাদ ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও প্রচার আরও জোরালো হতে থাকল।
পুলিশের গুলিতে যারা জীবন দিয়েছেন, পরদিন তাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেদিনও সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সন্দেহ ছিল লোকজন জানাজায় অংশ নিতে পারবে কিনা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আস্তে আস্তে ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ জনগণ জানাজার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দিকে আসতে থাকে। জানাজার পর অলি আহাদ সাহেব কয়েক মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে গেলে মিছিলের মাঝামাঝি স্থানে পুলিশের হামলা হয়। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে, এক পর্যায়ে গুলি ছোড়ে। তখন ঢাকার সর্বত্রই একটা বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা।
আমার দেশ : ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার কখন নির্মাণ করা হলো?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ওই রাতেই নির্মাণ করা হলো শহীদ মিনার। আমার যতদূর মনে পড়ে, ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে হলে প্রচণ্ড হৈ চৈ পড়ে যে পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু রাতে কারফিউ জারি থাকায় বাইরে বের হতে পারলাম না খোঁজ নিতে। রাস্তায় তখন পুলিশ টহল দিচ্ছে। অনেকেই তখন ঘুমিয়ে। কিন্তু শহীদ মিনার ভেঙেছে কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমরা বিভিন্ন রুম থেকে মৌমাছির মতো বের হয়ে হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় সমবেত হই। সিদ্ধান্ত হলো—হর্ন বাজিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের ডেকে তাদের সাহায্য নেয়া হোক। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ছাত্রদের একই উপায়ে ডেকে খবর নিতে পারবে।
যে কথা সেই কাজ। বিরাট শরীর ও দীপ্ত কণ্ঠধারী আবদুল আলিম সাহেব হর্ন হাতে নিয়ে বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধুগণ, আপনারা জেনে দিন পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে কিনা। কারফিউ দেয়া নীরব রাতে আলিম ভাইয়ের গলার আওয়াজ মাইকের মতোই শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে খবর এলো—বন্ধুগণ, শহীদ মিনার কেউ ভাঙেনি। এরপর সবাই যে যার রুমে ফিরে গেলাম।
আমার দেশ : ওই সময়ের আর বিশেষ কোনো স্মৃতি বা ঘটনার কথা কি মনে পড়ে?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : একটি ঘটনা আমার বেশ মনে পড়ে এবং আমাকে দারুণভাবে উদ্বেলিত করে।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা। আমার পিতা (মরহুম) আমার রুমে উপস্থিত। বললেন, তোমার মা তোমাকে বাড়ি নিতে পাঠিয়েছেন। তারা জানতেন না যে পুুলিশ গুলি ছোড়ার সময় আমি সামনে ছিলাম। আব্বাকে সব বললাম এবং রক্তমাখা কাপড় ও জুতা দেখালাম। আব্বা বললেন, ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতে খাওয়ার সময় আমার কথা মনে হলে হঠাত্ আমার মায়ের বুকে ব্যথা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি আমার জন্য দুটো নফল রোজার নিয়ত করেন ও রোজা রাখেন। আমি আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তখন বুঝতে পারি, আমার মায়ের দোয়ার বরকতেই পুলিশের এতগুলো গুলি আমার গায়ে লাগেনি সেদিন। মায়ের এই দোয়ার কথা যখনই মনে হয়, তখনই আমার দু’চোখে অশ্রু ভরে ওঠে।
সবকিছু শুনে এবং রক্তমাখা কাপড় দেখে আমার বাবা বললেন, ‘আমি তোমাকে নিতে এসেছিলাম, কিন্তু তোমাকে রেখে গেলাম। মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলন করে যাও।’ এই বলে আমার জন্য দোয়া করে চলে গেলেন। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দেয়া হলো এবং হল থেকে ছাত্রদের চলে যেতে বলা হলো। আতাউর রহমান কাবুল।
এতকিছুর পরও এই মহান খ্যাতিমান পুরুষ ড. জসীম উদ্দিন আহমেদের অন্যতম পরিচয়, তিনি ভাষা আন্দোলনে সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সম্মুখ সারিতে শহীদ বরকতের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসিতে পড়তেন। থাকতেন ওয়েস্ট হাউসের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ১৩৩ নম্বর রুমে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির যে সময়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদ বরকতের গায়ে গুলি লাগে, সেই মুহূর্তে বরকতসহ তারা তিনজন একযোগে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আর ইট-পাটকেল ছুড়ছিলেন। সহযোদ্ধা বরকত গুলি খেয়ে বারান্দায় লুটিয়ে পড়লে তিনি প্রথম বরকতের রক্তমাখা দেহ কোলে তুলে নেন।
আমার দেশ : প্রাণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার জনগণ সেদিন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : বাংলার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা—এতবড় ঘটনা মেনে নেয়ার আসলে উপায় ছিল না। তাই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা সংক্রান্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি এবং ৪ ফেব্রুয়ারিতে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি হলে ওইদিনই তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাথমিক মিটিং ও পরে মিছিল বের হয়। ঢাকার নবাবপুর রোড, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, চকবাজার হয়ে বিরাট মিছিলটি ‘রাষ্ট্র্রভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই’ স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আবার মিলিত হলো। সেদিনের সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি অর্থাত্ যেদিন এসেম্বলি বা অধিবেশন হবে সেদিন এই ঘোষণার প্রতিবাদে ধর্মঘট করা হবে এবং এসেম্বলির সামনে সবাই সমবেত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হবে। সে অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত ধর্মঘট ও এসেম্বলি হলের সামনে সমবেত হওয়ার জন্য সবার প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালের দিকে জানা গেল, মিছিল বা সমাবেশের প্রতিকূলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আমি তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতাম। আমরা জানতে পারি, পরদিন অর্থাত্ ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ সকালে সবাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে এসেমব্লি হলের দিকে যাওয়া হবে কিনা।
আমার দেশ : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আপনি সম্মুখ সারিতে শহীদ বরকতের সঙ্গে ছিলেন। আসলে কি ঘটেছিল সেদিন?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ২১ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সময় সকাল ১০টা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তখন অসংখ্য ছাত্র সমবেত। সবাই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এসেমব্লি হলের দিকে যাওয়া হবে কিনা। এক পর্যায়ে ঘোষণা এলো, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় আমরা সবাই সমবেত হব। বড় বড় গ্রুপে বের না হয়ে আমাদের ৫ জনের ছোট গ্রুপের যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। একটি গ্রুপে আমিসহ আরও ৪ জন রওনা দেই। আমাদের আগে-পিছে আরও কয়েকটি গ্রুপ ছিল। মেডিকেল গেট থেকে ৫০ গজ দূরে দেখলাম ছাত্রদের পুলিশ লাঠিপেটা করছে। এটা দেখে আমরা কয়েকজন পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ে পেছনে দৌড়ে মেডিকেল কলেজে ঢুকে যাই। তারপর ভেতর দিক দিয়ে হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় ঢুকে যাই। মেডিকেল কলেজ ও হোস্টেলের সীমানা দেয়ালের মাঝে একটু ফাঁক মতো জায়গা ছিল, যেখান দিয়ে ছাত্ররা যাতায়াত করত।
এরই মধ্যে ছাত্র ও পুলিশের সংঘর্ষ তুমুল পর্যায়ে। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করছে ছাত্রদের। কালবিলম্ব না করে আমি ও সলিমুল্লাহ হলের রুমমেট শাহজাহান ঢিলাঢিলিতে শরিক হয়ে যাই। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। হোস্টেল এলাকায় ততক্ষণে অনেক ছাত্রের জমায়েত। আমি উচ্চতায় ছোট হলেও আস্ত ইট পুলিশের ওপর ছুড়ে মারি। ৫০-৬০ ফুট দূরে গিয়ে ইট পড়ল। এখনও ভেবে পাই না, এত শক্তি সেদিন কোথা থেকে পেয়েছিলাম? আস্ত ইটের ঢিল পেয়ে পুলিশ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে কিছু পুলিশ ঝড়ের বেগে গেটের ভেতর ঢুকে তাদের হাতের লাঠিগুলো ছাত্রদের পায়ে ছুড়ে মারতে থাকে। আমি তখন ভীষণ বেগে দৌড় দিয়ে পুলিশের নাগালের বাইরে চলে যাই। পুলিশ গেটের বাইরে গেলে ছাত্ররা আবার রাস্তার দিকে ও গেটের দিকে আসে। আমি, শাহজাহান ও আবুল বরকত (যদিও তখন তাকে চিনতাম না) রাস্তা থেকে দ্বিতীয় ব্যারাকটির বারান্দায় দাঁড়াই। এটির দূরত্ব গেট থেকে ৩০ ফুট হবে। আমার দুই হাতে দুটি ইটের টুকরো। শাহজাহানের হাতেও। বরকতের হাতে কী ছিল জানি না।
আমার দেশ : পুলিশ গুলি ছুড়ল কোন পরিস্থিতিতে? এ ধরনের পরিস্থিতি ঘটবে তা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল তিনটার ঘটনা। ওই সময় দেখতে পেলাম, তিনজন পুলিশ গেটের পূর্ব পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুক আমাদের দিকে তাক করে আছে। তাদের পেছনে আরও অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা চিন্তাও করিনি যে তারা গুলি ছোড়ার মতো কাজ করবে।
হটাত্ খটখট গুলির শব্দ। আমার ও শাহজাহানের মাথার ওপর ঘেঁষে, কানের পাশ দিয়ে কয়েকটি গুলি বারান্দায় বাঁশের চালায় আওয়াজ করে বিঁধে গেল। একদম ফ্রন্ট লাইনে পুলিশের সম্মুখে তখন কেবল আমরা তিনজন। আমার বাঁ পাশে শাহজাহান আর গা ঘেঁষে ডান পাশে আর একজন। মুহূর্তে ধপাস করে আমার ডান পাশের ছেলেটি বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেল। তখনও গুলি চলছে। ডানে তাকালাম। একবার আহ্ শব্দ করে দুই হাতে ভর দিয়ে সে নিজেকে পিছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। গুলি তার বাম পায়ের উরুর গোড়ায় লেগেছে। ইস্ত্রি করা খাকি রংয়ের প্যান্টে গুলির ছিদ্র দিয়ে কলকল করে রক্ত বের হচ্ছে। কোরবানির পশু জবাইয়ের পর রক্তপ্রবাহের মতো রক্তস্রোত বইছে সিমেন্টের বারান্দায়। আমার দুই হাতের ঢিল ফেলে তাড়াতাড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে কোলে নেয়ার চেষ্টা করি। শাহজাহানও আমার সঙ্গে এসে যোগ দেয়। দু’জনে মিলে তাকে বুকের ওপর তুলে ফেলি। আমার কাপড়, জুতা এবং শাহজাহানের কাপড় তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পেছন থেকে আরও দু’তিনজন এসে তাকে ধরে (ওই তিনজনের মধ্যে ভাষা মতিন সাহেবও ছিলেন যা তিনি পরে তার বাসায় গেলে আমাকে বলেছিলেন)। তারা এবং শাহজাহান দ্রুত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। পুলিশের প্রতি ক্রোধে তখন আমি পাগলপ্রায়। দুটি ঢিল আবার হাতে নিয়ে ফ্রন্টে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে বন্দুকের আওয়াজ থেমে গেছে, কিন্তু পুলিশ তখনও সেই স্থানে বসা। নিচের দিকে তাকিয়ে বারান্দার মেঝেতে দেখলাম বেশ জায়গাজুড়ে রক্ত ছড়িয়ে জমে আছে। ঢিল দুটি হাত থেকে পড়ে গেল। এ সময়ের আমার মনের অবস্থা কোনো ভাষায় বর্ণনা দেয়ার মতো নয়।
ছেলেটি আমার চেয়ে লম্বা। পরনে ছিল সদ্য ইস্ত্রি করা খাকি রংয়ের প্যান্ট এবং ডোরাওয়ালা সাদা শার্ট। আগে তাকে চিনতাম না। পুলিশের গুলিতে পড়ে যাওয়ায় তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে তাকে চিনলাম। সে আবুল বরকত।
আমার দেশ : ২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিন কী ঘটেছিল?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ওই রাতটা আমার খুব খারাপ কেটেছিল। তবে এ ঘটনার পর হলগুলোতে ভাষা আন্দোলনের চেতনা, দৃঢ়তা ও কর্মতত্পরতা আরও জোরদার হলো। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে দৈনন্দিন এটি একটি ভাষা আন্দোলনের দুর্গ হিসেবে গড়ে ওঠে। সারাদিন মাইকে পুলিশের গুলির বিচার দাবি, সরকারের অবিচারের প্রতিবাদ ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও প্রচার আরও জোরালো হতে থাকল।
পুলিশের গুলিতে যারা জীবন দিয়েছেন, পরদিন তাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেদিনও সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সন্দেহ ছিল লোকজন জানাজায় অংশ নিতে পারবে কিনা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আস্তে আস্তে ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ জনগণ জানাজার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দিকে আসতে থাকে। জানাজার পর অলি আহাদ সাহেব কয়েক মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে গেলে মিছিলের মাঝামাঝি স্থানে পুলিশের হামলা হয়। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে, এক পর্যায়ে গুলি ছোড়ে। তখন ঢাকার সর্বত্রই একটা বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা।
আমার দেশ : ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার কখন নির্মাণ করা হলো?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : ওই রাতেই নির্মাণ করা হলো শহীদ মিনার। আমার যতদূর মনে পড়ে, ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে হলে প্রচণ্ড হৈ চৈ পড়ে যে পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু রাতে কারফিউ জারি থাকায় বাইরে বের হতে পারলাম না খোঁজ নিতে। রাস্তায় তখন পুলিশ টহল দিচ্ছে। অনেকেই তখন ঘুমিয়ে। কিন্তু শহীদ মিনার ভেঙেছে কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমরা বিভিন্ন রুম থেকে মৌমাছির মতো বের হয়ে হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় সমবেত হই। সিদ্ধান্ত হলো—হর্ন বাজিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের ডেকে তাদের সাহায্য নেয়া হোক। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ছাত্রদের একই উপায়ে ডেকে খবর নিতে পারবে।
যে কথা সেই কাজ। বিরাট শরীর ও দীপ্ত কণ্ঠধারী আবদুল আলিম সাহেব হর্ন হাতে নিয়ে বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধুগণ, আপনারা জেনে দিন পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে কিনা। কারফিউ দেয়া নীরব রাতে আলিম ভাইয়ের গলার আওয়াজ মাইকের মতোই শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে খবর এলো—বন্ধুগণ, শহীদ মিনার কেউ ভাঙেনি। এরপর সবাই যে যার রুমে ফিরে গেলাম।
আমার দেশ : ওই সময়ের আর বিশেষ কোনো স্মৃতি বা ঘটনার কথা কি মনে পড়ে?
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ : একটি ঘটনা আমার বেশ মনে পড়ে এবং আমাকে দারুণভাবে উদ্বেলিত করে।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা। আমার পিতা (মরহুম) আমার রুমে উপস্থিত। বললেন, তোমার মা তোমাকে বাড়ি নিতে পাঠিয়েছেন। তারা জানতেন না যে পুুলিশ গুলি ছোড়ার সময় আমি সামনে ছিলাম। আব্বাকে সব বললাম এবং রক্তমাখা কাপড় ও জুতা দেখালাম। আব্বা বললেন, ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতে খাওয়ার সময় আমার কথা মনে হলে হঠাত্ আমার মায়ের বুকে ব্যথা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি আমার জন্য দুটো নফল রোজার নিয়ত করেন ও রোজা রাখেন। আমি আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তখন বুঝতে পারি, আমার মায়ের দোয়ার বরকতেই পুলিশের এতগুলো গুলি আমার গায়ে লাগেনি সেদিন। মায়ের এই দোয়ার কথা যখনই মনে হয়, তখনই আমার দু’চোখে অশ্রু ভরে ওঠে।
সবকিছু শুনে এবং রক্তমাখা কাপড় দেখে আমার বাবা বললেন, ‘আমি তোমাকে নিতে এসেছিলাম, কিন্তু তোমাকে রেখে গেলাম। মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলন করে যাও।’ এই বলে আমার জন্য দোয়া করে চলে গেলেন। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দেয়া হলো এবং হল থেকে ছাত্রদের চলে যেতে বলা হলো। আতাউর রহমান কাবুল।
No comments