সময়চিত্র-প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কী অর্জিত হলো by আসিফ নজরুল
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে ভারতের অনুকূলে কিছু বিশাল পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতের পত্রপত্রিকার খবর অনুসারে, উলফা নেতাদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ ভারতের হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল। ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার লক্ষ্যে এটি ছিল যুগান্তকারী এবং অসাধারণ একটি পদক্ষেপ।
ভারত ইতিপূর্বে বাংলাদেশের আদিবাসী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়েছিল, এমনকি সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছিল। শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে তাদের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন এবং পার্বত্য অঞ্চলের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছিল। চুক্তি সম্পাদনে ভারতের সহায়ক ভূমিকা বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। উলফাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ রকম ভূমিকা পালনের অবকাশ হয়তো ছিল না। তবে উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এবং বাংলাদেশে তাদের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করার ব্যবস্থা নিয়ে সরকার তার দায়িত্ব পালন করতে পারত। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে বাংলাদেশ সর্বোত্তম বন্ধুত্বের নিদর্শন রেখেছিল কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে।
টিপাইমুখ প্রকল্পে একতরফা ছাড় প্রদান এবং এশিয়ান হাইওয়ে ইস্যুতে বিভিন্ন বিকল্পের মধ্যে ভারতের জন্য সবচেয়ে অনুকূল রুটে প্রাথমিক সম্মতি প্রদানও ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত অনুকূল কিছু পদক্ষেপ। এ ছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় প্রকাশ্যভাবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নাকাল করে তদন্তকার্য পরিচালনা, সমুদ্রসীমা প্রশ্নে নমনীয় বিরোধিতার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জলবায়ু আলোচনায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে সম্পূর্ণ মৌন থাকাসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকার তার বন্ধুত্বের যে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিল, তা অভূতপূর্ব এবং অপরিসীম।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আমাদের অর্জন এসবের পটভূমিতে বিচার না করার কোনো কারণ নেই। বন্ধুত্বের প্রতিদান সমতুল্য বন্ধুত্বের মাধ্যমে দিতে হয়। না হলে বন্ধুত্বকে একতরফা হিসেবে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয় অনেকের জন্য। ভারত সফরে যা অর্জিত হয়েছে, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু তা ভারতের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রতিদান কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কারণ রয়েছে।
২.
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি বড় একটি বিষয়। নদীর পানির যথেষ্ট প্রাপ্যতা বাংলাদেশের প্রয়োজন, এটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন। কিন্তু এ লক্ষ্যে তাঁর আমলেই সম্পাদিত ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির আলোকে সব ধরনের একতরফা পদক্ষেপ থেকে দুটো দেশের বিরত থাকা উচিত, এ ধরনের কোনো কিছু তিনি বলেননি। তিনি টিপাইমুখ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে পুনরায় আশ্বস্ত হতে বলেছেন। তাঁর পিতার আমলে ভারতের আশ্বাস তো দূরের কথা, চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কা ব্যারাজের পরীক্ষামূলক চালুর পরও এর কুপ্রভাব সম্পর্কে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। তাঁর নিজের প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেও কোনো আশ্বাস নয়, চুক্তির ভিত্তিতে অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগির (গঙ্গা চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদ) কথা বলা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে দুই দেশের একটি জয়েন্ট কমিটি অব এক্স্পার্ট গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, মুহুরী, মনু, গোমতী, খোয়াই, দুধকুমার এই নয়টি নদীর পানি ভাগাভাগির জন্য চিহ্নিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অন্তত তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে ভারত বাংলাদেশের অসাধারণ বন্ধুত্বের কিছু প্রতিদান দিতে পারত।
ভারত সফরকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে টিপাইমুখ প্রকল্পের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রকল্পের শারীরিক অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এর পক্ষে বিভিন্ন অনুমোদন এমনকি কার্যাদেশ পর্যন্ত ভারত সরকার ইতিমধ্যে প্রদান করেছে। পৃথিবীতে সব দেশে প্রকল্প নির্মাণের আগেই প্রতিবাদ করা হয়, ভারতও কর্ণফুলী নদীতে একটি প্রস্তাবিত জলাধারের বিষয়ে প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার বহু আগে ১৯৫০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়টি যে রকম হালকাভাবে দেখছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তার চেয়ে ভিন্ন কিছু মনে হয়নি।
অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আলোচনার বহু সুযোগ এখনো আছে। দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে সুস্পষ্ট চুক্তির মাধ্যমে টিপাইমুখ কেন, আরও বহু প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে লিখিত চুক্তি ছাড়া একটি নিম্ন অববাহিকার দেশ উচ্চ অববাহিকার দেশের সরকারপ্রধানের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে থাকবে, এই চিন্তা শুধু অবাস্তব নয়, বিপজ্জনকও।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্য কিছু বিষয়েও বাংলাদেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখেনি বলে আমার মনে হয়েছে। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিয়মিতভাবে সাধারণ বাংলাদেশিদের মৃত্যুর ঘটনায় বর্তমান সরকার প্রায় নিশ্চুপ। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা দুই পক্ষ থেকেই কমবেশি হতে পারে। এ জন্য বিএসএফ অনুপ্রবেশকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারে, ফাঁকা গুলি করে তাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিয়মিতভাবে হত্যা করে ফেলার কোনো আইন তো কোথাও নেই। ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের ভাষণে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানাতে পারতেন। যুক্ত ইশতেহারে বরং উভয় পক্ষের সংযতভাবে দায়িত্ব পালন ও সীমান্তে বৈঠক নিয়মিতকরণের যে বক্তব্য এসেছে, তাতে মনে হবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সমভাবে দুই দেশ ঘটিয়ে চলেছে।
এ সফরে আরও কিছু দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্ত অনুসারে ছিটমহল বিনিময়ের এবং সীমান্ত নির্ধারণের যে বাধ্যবাধকতা ভারতের রয়েছে তা পালনে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্রগতি এ সফরে অর্জিত হয়নি। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রয়াসের আভাস এত দুর্বল যে এতে এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই।
৩.
প্রধানমন্ত্রীর সফরে চুক্তি যা হয়েছে, তা সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ বাংলাদেশের জন্য সমস্যা, ভারতের জন্য আরও অনেক বড় সমস্যা। এসব প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার চুক্তি কমবেশি দুই পক্ষকে লাভবান করতে পারে বলে আমরা একে স্বাগত জানাতে পারি। তবে এই চুক্তিতে অন্য দেশের বাহিনীর অবাধ প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকলে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরস্পরের সমুদ্র, রেল ও সড়কপথ ব্যবহারের লক্ষ্যে সমঝোতা হয়েছে। ইউরোপ ও আসিয়ানের অভিজ্ঞতায় ধারণা হিসেবে এটি অবশ্যই সমর্থনীয়। কিন্তু এর সুবিধা বাংলাদেশ কত বেশি নিতে পারবে, তা আসলে নির্ভর করবে সুনির্দিষ্ট চুক্তির শর্তাবলির ওপর। নির্ভর করবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কার্যক্ষমতা ও অবকাঠামো বহুগুণে বৃদ্ধি করার সামর্থ্য, এতে দাতাদের অংশগ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতার ওপর।
ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য-ঘাটতি সর্বজনবিদিত। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে ভারত ৪৭টি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশাধিকারের আশ্বাস দিয়েছে। এসব পণ্য প্রতিযোগিতামূলক ভারতীয় বাজারে টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকলে এবং পণ্যগুলোর প্রবেশে প্রতিকূল অশুল্ক শর্তাবলি না থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। ভারত বাংলাদেশের পরিবহন অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়নে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তা এবং বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ বিক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক অর্জন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, হিমালয়ের বিভিন্ন নদীতে ভারত-নেপাল এবং ভারত-ভুটান যেসব দৈত্যাকৃতির পরিবেশবিনাশী জলবিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, নিম্নতম অববাহিকতার দেশ হিসেবে তার কুফল একসময় বাংলাদেশকে ভোগ করতে হবে। এসব প্রকল্প ঠেকানো না গেলে, বিনিময়ে অন্তত জলবিদ্যুত্ লাভের জন্য এসবের অংশীদারি হওয়ার সুযোগ প্রদানে ভারতকে সম্মত করার চেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চালানো উচিত।
৪.
ভারত সফরে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে বাংলাদেশ তার সমর্থনের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের বড় দুটো দাতা দেশ জাপান ও জার্মানি এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশের এই সমর্থন তাই ভারতের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। সার্বিক বিচারে ভারতের যা প্রত্যাশা, বাংলাদেশের কাছে তা প্রায় সবটুকু পূরণ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে। এতে দোষের কিছু নেই যদি বাংলাদেশের প্রত্যাশা পর্যায়ক্রমে হলেও পূরণ করা হয় ভারতের পক্ষ থেকে। অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, তিনবিঘা করিডর ও অন্যান্য ছিটমহল প্রদান, ট্রানজিট, পণ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় সুষমকরণ, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ—এসব ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে দুই দেশের বন্ধুত্ব সুষম ও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
দুই দেশের সরকারের মধ্যে আস্থা ও বন্ধুত্বের পরিবেশ এখন বিরাজ করছে। এটি সর্বোত্তমভাবে দুই দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য আরও বহু পদক্ষেপ নিতে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
টিপাইমুখ প্রকল্পে একতরফা ছাড় প্রদান এবং এশিয়ান হাইওয়ে ইস্যুতে বিভিন্ন বিকল্পের মধ্যে ভারতের জন্য সবচেয়ে অনুকূল রুটে প্রাথমিক সম্মতি প্রদানও ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত অনুকূল কিছু পদক্ষেপ। এ ছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় প্রকাশ্যভাবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নাকাল করে তদন্তকার্য পরিচালনা, সমুদ্রসীমা প্রশ্নে নমনীয় বিরোধিতার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জলবায়ু আলোচনায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে সম্পূর্ণ মৌন থাকাসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকার তার বন্ধুত্বের যে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিল, তা অভূতপূর্ব এবং অপরিসীম।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আমাদের অর্জন এসবের পটভূমিতে বিচার না করার কোনো কারণ নেই। বন্ধুত্বের প্রতিদান সমতুল্য বন্ধুত্বের মাধ্যমে দিতে হয়। না হলে বন্ধুত্বকে একতরফা হিসেবে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয় অনেকের জন্য। ভারত সফরে যা অর্জিত হয়েছে, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু তা ভারতের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রতিদান কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কারণ রয়েছে।
২.
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি বড় একটি বিষয়। নদীর পানির যথেষ্ট প্রাপ্যতা বাংলাদেশের প্রয়োজন, এটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন। কিন্তু এ লক্ষ্যে তাঁর আমলেই সম্পাদিত ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির আলোকে সব ধরনের একতরফা পদক্ষেপ থেকে দুটো দেশের বিরত থাকা উচিত, এ ধরনের কোনো কিছু তিনি বলেননি। তিনি টিপাইমুখ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে পুনরায় আশ্বস্ত হতে বলেছেন। তাঁর পিতার আমলে ভারতের আশ্বাস তো দূরের কথা, চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কা ব্যারাজের পরীক্ষামূলক চালুর পরও এর কুপ্রভাব সম্পর্কে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। তাঁর নিজের প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেও কোনো আশ্বাস নয়, চুক্তির ভিত্তিতে অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগির (গঙ্গা চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদ) কথা বলা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে দুই দেশের একটি জয়েন্ট কমিটি অব এক্স্পার্ট গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, মুহুরী, মনু, গোমতী, খোয়াই, দুধকুমার এই নয়টি নদীর পানি ভাগাভাগির জন্য চিহ্নিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অন্তত তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে ভারত বাংলাদেশের অসাধারণ বন্ধুত্বের কিছু প্রতিদান দিতে পারত।
ভারত সফরকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে টিপাইমুখ প্রকল্পের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রকল্পের শারীরিক অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এর পক্ষে বিভিন্ন অনুমোদন এমনকি কার্যাদেশ পর্যন্ত ভারত সরকার ইতিমধ্যে প্রদান করেছে। পৃথিবীতে সব দেশে প্রকল্প নির্মাণের আগেই প্রতিবাদ করা হয়, ভারতও কর্ণফুলী নদীতে একটি প্রস্তাবিত জলাধারের বিষয়ে প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার বহু আগে ১৯৫০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়টি যে রকম হালকাভাবে দেখছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তার চেয়ে ভিন্ন কিছু মনে হয়নি।
অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আলোচনার বহু সুযোগ এখনো আছে। দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে সুস্পষ্ট চুক্তির মাধ্যমে টিপাইমুখ কেন, আরও বহু প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে লিখিত চুক্তি ছাড়া একটি নিম্ন অববাহিকার দেশ উচ্চ অববাহিকার দেশের সরকারপ্রধানের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে থাকবে, এই চিন্তা শুধু অবাস্তব নয়, বিপজ্জনকও।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্য কিছু বিষয়েও বাংলাদেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখেনি বলে আমার মনে হয়েছে। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিয়মিতভাবে সাধারণ বাংলাদেশিদের মৃত্যুর ঘটনায় বর্তমান সরকার প্রায় নিশ্চুপ। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা দুই পক্ষ থেকেই কমবেশি হতে পারে। এ জন্য বিএসএফ অনুপ্রবেশকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারে, ফাঁকা গুলি করে তাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিয়মিতভাবে হত্যা করে ফেলার কোনো আইন তো কোথাও নেই। ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের ভাষণে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানাতে পারতেন। যুক্ত ইশতেহারে বরং উভয় পক্ষের সংযতভাবে দায়িত্ব পালন ও সীমান্তে বৈঠক নিয়মিতকরণের যে বক্তব্য এসেছে, তাতে মনে হবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সমভাবে দুই দেশ ঘটিয়ে চলেছে।
এ সফরে আরও কিছু দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্ত অনুসারে ছিটমহল বিনিময়ের এবং সীমান্ত নির্ধারণের যে বাধ্যবাধকতা ভারতের রয়েছে তা পালনে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্রগতি এ সফরে অর্জিত হয়নি। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রয়াসের আভাস এত দুর্বল যে এতে এখনই আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই।
৩.
প্রধানমন্ত্রীর সফরে চুক্তি যা হয়েছে, তা সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ বাংলাদেশের জন্য সমস্যা, ভারতের জন্য আরও অনেক বড় সমস্যা। এসব প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার চুক্তি কমবেশি দুই পক্ষকে লাভবান করতে পারে বলে আমরা একে স্বাগত জানাতে পারি। তবে এই চুক্তিতে অন্য দেশের বাহিনীর অবাধ প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকলে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরস্পরের সমুদ্র, রেল ও সড়কপথ ব্যবহারের লক্ষ্যে সমঝোতা হয়েছে। ইউরোপ ও আসিয়ানের অভিজ্ঞতায় ধারণা হিসেবে এটি অবশ্যই সমর্থনীয়। কিন্তু এর সুবিধা বাংলাদেশ কত বেশি নিতে পারবে, তা আসলে নির্ভর করবে সুনির্দিষ্ট চুক্তির শর্তাবলির ওপর। নির্ভর করবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কার্যক্ষমতা ও অবকাঠামো বহুগুণে বৃদ্ধি করার সামর্থ্য, এতে দাতাদের অংশগ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতার ওপর।
ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য-ঘাটতি সর্বজনবিদিত। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে ভারত ৪৭টি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশাধিকারের আশ্বাস দিয়েছে। এসব পণ্য প্রতিযোগিতামূলক ভারতীয় বাজারে টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকলে এবং পণ্যগুলোর প্রবেশে প্রতিকূল অশুল্ক শর্তাবলি না থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। ভারত বাংলাদেশের পরিবহন অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়নে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তা এবং বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ বিক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক অর্জন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, হিমালয়ের বিভিন্ন নদীতে ভারত-নেপাল এবং ভারত-ভুটান যেসব দৈত্যাকৃতির পরিবেশবিনাশী জলবিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, নিম্নতম অববাহিকতার দেশ হিসেবে তার কুফল একসময় বাংলাদেশকে ভোগ করতে হবে। এসব প্রকল্প ঠেকানো না গেলে, বিনিময়ে অন্তত জলবিদ্যুত্ লাভের জন্য এসবের অংশীদারি হওয়ার সুযোগ প্রদানে ভারতকে সম্মত করার চেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চালানো উচিত।
৪.
ভারত সফরে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে বাংলাদেশ তার সমর্থনের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের বড় দুটো দাতা দেশ জাপান ও জার্মানি এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশের এই সমর্থন তাই ভারতের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। সার্বিক বিচারে ভারতের যা প্রত্যাশা, বাংলাদেশের কাছে তা প্রায় সবটুকু পূরণ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে। এতে দোষের কিছু নেই যদি বাংলাদেশের প্রত্যাশা পর্যায়ক্রমে হলেও পূরণ করা হয় ভারতের পক্ষ থেকে। অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, তিনবিঘা করিডর ও অন্যান্য ছিটমহল প্রদান, ট্রানজিট, পণ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় সুষমকরণ, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ—এসব ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে দুই দেশের বন্ধুত্ব সুষম ও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
দুই দেশের সরকারের মধ্যে আস্থা ও বন্ধুত্বের পরিবেশ এখন বিরাজ করছে। এটি সর্বোত্তমভাবে দুই দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য আরও বহু পদক্ষেপ নিতে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments