চারদিক-মাছের মেলার মাছের কাহন by আকমল হোসেন
মৌলভীবাজারের শেরপুরে মাছের মেলা শেষ হলো কাল। মাছে-ভাতে বাঙালি—এই প্রবাদটা পুরোনো। তবে প্রবাদটা খামাখা তৈরি হয়নি। বাংলার খাল-বিল, নদী-নালা আর হাওর-বাঁওড়—একটা সময় সবখানেই মাছের ঘাই ছিল, লাফালাফি ছিল, সাঁতার ছিল।
প্রবাদটা হয়তো এ কারণেই তৈরি হয়েছে। মানুষ চাইলেই মাছ পেয়েছে। ভাতে-মাছে পেট পুরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।
পরিস্থিতিটা এখন আর সে রকম নেই। কালে কালে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। সেই জলাশয়, ডোবা, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ও নেই, মাছও নেই। মানুষ নির্বিচারে মাছ ধরেছে, ডিমঅলা মাছ, পোনা মাছ—বাদ দেয়নি কিছুই। ঝাড়েবংশে নাশ করেছে সব, ধ্বংস করেছে মাছের আবাসস্থল। হারিয়ে গেছে অনেক জাতের দেশজ, স্থানীয় মাছ। এখন চাইলেই আর ইচ্ছামতো মাছের দেখা মেলে না। অনেকে তো কালেভদ্রে মাছের স্বাদ পায়। মাছ ছুঁয়ে দেখাই এখন অনেক গৃহবাসীর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ রকম অবস্থাতেও বছরে অন্তত একটা দিন মৌলভীবাজারের শেরপুরে মাছের বাজার বলে দেয়, বাঙালির মাছে-ভাতের প্রবাদটা নিছক প্রবাদ নয়। মাছের দুর্দিন চলছে, হয়তো এটা ঠিক। কিন্তু পৌষসংক্রান্তির আগের দিনে এই মাছের মেলা—মাছে মাছে সয়লাব হয়ে যায়। অনেক জাতের ছোট-বড় মাছ। বোয়াল, চিতল, আইড়, রুই, মৃগেল, কাতলা...। ওজনেও ভারী। সাধারণ হাটবাজারে এ রকম মাছ এ সময়ে খুব কমই দেখা যায়। আর তাদের পাশে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেমন আর সব প্রাণী থেকে আলাদা, তেমনি মাছ হলেও আর সব মাছ থেকে পৃথক মেজাজি বাঘাইড়। অনেকে বলে, বাঘ মাছ। এই বাঘাইড় মাছের ওজন এক থেকে পাঁচ/ছয় মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। দামও হাঁকা হয় লাখ টাকার ওপর। এমন দামের ক্রেতাও আছেন। মাছের এই রাজত্বে এসে মাছে-ভাতে বাঙালি—কথাটা হয়তো মনে পড়বেই। মাছের আকাল কথাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলবে!
মাছের মেলা বলেই হয়তো এখানে মাছের রাজত্ব। স্থানীয় লোকজন সারা বছর এ মাছের মেলার জন্যই যেন নীরবে অপেক্ষা করে থাকে। মাছের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মাছের মেলার জন্য মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরে কিছু কিছু বিল আছে। মনু, কুশিয়ারাসহ বেশ কিছু ছোট-বড় নদীর নির্দিষ্ট স্থান আছে, যা এই মাছের মেলার জন্য সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। মেলার সময় এসব বিল ও নদী থেকে মাছ ধরা হয়। পাইকারেরা সেই মাছ কিনে নিয়ে আসেন মাছের মেলায়। এ ছাড়া এখন বিভিন্ন মত্স্যখামার আছে, যে খামারগুলো মেলায় মাছের জোগান দেয়।
সুনির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও এলাকার লোকজনের ধারণা, মেলার বয়স শত বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমে মেলা শুরু হয়েছিল কুশিয়ারা ও মনু নদীর মিলনস্থল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখে। মনু নদীর পাড়ে মেলা বসত। নদীপথে যোগাযোগ সহজ ছিল বলে নানা স্থান থেকে মাছের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসতেন। পরে মনুমুখ বাজারটি নদীভাঙনের কবলে পড়লে মেলাটি সরে যায় শেরপুর এলাকার হামরকোনায়। এলাকার বাসিন্দাদের মতে, প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর বাজারের দক্ষিণ দিকে কুশিয়ারা নদীর পশ্চিম পাড়ে মাছের মেলা বসছে। মেলাটি বসে পৌষসংক্রান্তির এক দিন আগে। বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণের এই দেশে পৌষসংক্রান্তিতে পিঠাপুলি আর মাছের নানা পদের তরকারির ঐতিহ্য শত অভাব-অনটনের মধ্যেও এলাকায় উত্সবের আনন্দ নিয়ে আসে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, মাছের মেলা থেকে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের খুচরা বিক্রেতা মাছ কিনে থাকেন। মাছের মেলায় অবশ্য মাছের দামে বেশ ঝাঁজ থাকে। মাঝারি আকারের একটি মাছের দামও ১০-২০ হাজার টাকা হাঁকা হয়। এর নিচে দাম হাঁকা হলে হয়তো মাছটার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।
অনেক বিক্রেতার কাছে এই মাছের মেলা একটি বার্ষিক বাণিজ্যিক উত্সব। রথ দেখা আর কলা বেচার মতো। এখানে মাছের আড়ত বসে ৩০-৪০টির কম নয়। খুচরা মাছের দোকান বসে তিন শতাধিক। স্থানীয় লোকজন জানান, মেলার আগের দিন থেকেই সুনামগঞ্জ, মার্কুলিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে রুপালি মাছের আঁশটে গন্ধ।
এখানে প্রকৃত অর্থে মাছের মেলা বসলেও একপর্যায়ে এটি বারোয়ারি রূপ নেয়। শুধু মাছের মেলা আর থাকে না। মাছের মেলা ঘিরে গরম জিলাপি, ঝোল-মাংসের ধোঁয়া ওড়া তরকারি আর পরোটা, আখনি, ডিমভুনা, তিলুয়া-বাতাসা, খই-মুড়ি, নানারকম মৌসুমি ফল থাকে ছড়ানো-ছিটানো। থাকে শিশুদের খেলনা, কিশোরী-তরুণীদের প্রসাধনী, শীতের কাপড়চোপড়, বাঁশ-বেত ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র। ঘর-সংসারের নানারকম মাটির বাসন, কাঠের জিনিস, লোহালক্কড়ের সামগ্রী। বসে কয়েক শ দোকান। থাকে নাগরদোলা, বায়োস্কোপ—হরেক রকম চোখ ধাঁধানো পণ্য। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
স্থানীয় লোকজন জানায়, মাসখানেক আগে থেকেই এলাকায় পৌষসংক্রান্তির আঁচ পাওয়া যায়। ঘরে ঘরে নীরব প্রস্তুতি শুরু হতে থাকে। উত্সব পেলে বাঙালি যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মাছের মেলা ছাড়া এলাকার পূর্ণতা নেই। হয়তো এ কারণেই হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল মাছের মেলায়।
No comments