ভয়াবহ লাসা জ্বর by কাজী জহিরুল ইসলাম
আমাদের করিডোরে সারাদিন বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এখন বিদ্যুৎ নেই। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। তার চেয়েও অধিক অন্ধকার এক কালো পুরুষ বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার ময়িস বললেন, খবর জান, মনরোভিয়াতে লাসা ধরা পড়েছে।
আমার গা ছমছম করে ওঠে। লাসা মানে নিশ্চিত মৃত্যু, বলে কি ময়িস! করিডোরের অন্ধকারটা যেন আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসে। আমি নিজের অফিসে ফিরে আসি। মনরোভিয়া থেকে আবিদজান এমন কোনো দূরে নয়। পেছন পেছন ময়িসও আমার অফিসে ঢোকে। নিরীহ গোবেচারা ধরনের মানুষ ডাক্তার ময়িস। বাড়ি বেনিন। ওকে আমার খুব পছন্দই হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর গায়ে কোথাও লাসা জ্বরের ভাইরাস লেগে আছে। কিছু কাগজপত্রে আমার সই নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল ময়িস, সাবধানে থেক, মনরোভিয়া খুব দূরে তো নয়। আমি বলি, আগে লাসার ওপর কিছু জ্ঞান অর্জন করি, তোমার কাছে কোনো লিটারেচার থাকলে পাঠাও।
আমি পড়তে শুরু করি। পশ্চিম আফ্রিকায় একটি কথা প্রচলিত আছে লাসা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু জরিপের ফলাফল বলছে, হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারলে আর ঠিকমত চিকিত্সা করাতে পারলে ৮০ শতাংশ রোগী ভালো হয়ে যায় আর বাকি ২০ শতাংশ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। তবে যারা লাসার নির্মম থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের অধিকাংশই সারা জীবনের জন্য বধির হয়ে যায়। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে যে লাসা জ্বর সেরে গেছে কিন্তু মানুষটি আগের মতোই ঠিকঠাক কানে শোনে। পুরোপুরি বধির না হলেও আংশিক বা সাময়িক বধিরতা অনিবার্য। ১৯৬৯ সালে পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়াতে দু’জন মিশনারী নার্স লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেই এই রোগটি আবিষ্কৃত হয়। নাইজেরিয়ার লাসা নামক স্থানে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয় বলে এর নাম হয়েছে লাসা। এক ধরনের বাতি ইঁদুর (গধংঃড়সুং জড়ফবহঃ) এই লাসা জ্বরের ভাইরাস বহন করে। প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসটি ইঁদুরের শরীরেই তৈরি হয়। নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন, ঘানাসহ পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব দেশেই কম-বেশি লাসা জ্বরের উপস্থিতি আছে। এজন্যই বলা হয় পশ্চিম আফ্রিকায় এই অসুখটি এনডেমিক পর্যায়ে রয়েছে। গড়ে প্রতি বছর এক থেকে তিন লাখ মানুষ লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়। লাসা ভাইরাস আরেনাভিরিডে (অত্বহধারত্রফধব) ভাইরাস পরিবারের সদস্য।
আইভরিকোস্টের প্রত্যন্ত গ্রামে কিংবা আলোকোজ্জ্বল শহরে, সব খানেই একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, কেউ গাছের নিচে পড়ে থাকা কোনো ফলমূল তুলে খায় না। প্রায়ই প্রাতঃভ্রমণ করতে গিয়ে দেখি গাছের নিচে প্রচুর পরিমাণে আম পড়ে আছে, চালতা গাছের নিচে বিছিয়ে আছে চালতা, আরও কত ফলমূল পড়ে আছে কিন্তু কেউ পড়ে থাকা এসব ফল ছুঁয়েও দেখে না। প্রথম প্রথম ভাবতাম ওদের প্রচুর আছে বলে কুড়িয়ে খায় না, গাছ থেকে সরাসরি পেড়ে খায়। কিন্তু পরে জানতে পারলাম এটা লাসা সচেতনতা। ইঁদুরে খাওয়া খাবার বা খাবারের ওপর দিয়ে ইঁদুর হেঁটে গেলে অথবা ইঁদুরের মলমূত্র লেগেছে এমন খাবার খেলে, এমন কি ঘ্রাণ শুকলেও লাসা জ্বরের ভাইরাস মানবদেহে চলে আসতে পারে।
মানবদেহে লাসা ভাইরাস প্রবেশের এক থেকে তিন সপ্তাহ পরে রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। লাসা’র লক্ষণ অনেক, যেমন: জ্বর, বুকের দেয়ালের ভেতরে ব্যথা, গলায় প্রদাহ, পিঠে ব্যথা, কাশি, পেটে ব্যথা, বমি হওয়া, পাতলা পায়খানা, মুখের চামড়ায় জ্বালা-পোড়া, প্রশ্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্ত বা অস্বাভাবিক কিছু বের হওয়া, কারও কারও অস্বাভাবিক চুল পড়াও শুরু হতে পারে। এখনও পর্যন্ত এর সফল চিকিত্সা হিসেবে রিবাভিরিন ড্রাগ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিবাভিরিন ইনজেকশনের দাম খুব বেশি বলে লাসার চিকিত্সা ব্যয়বহুল। এক সময় একটি ইনজেকশনের দাম ছিল ১ হাজার ডলার, গত বছরও ৪৫০ ডলারে একেকটি ইনজেকশন কেনা হয়। তবে এর দাম ২০ ডলারে নেমে আসবে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
লাসা জ্বরের চিকিত্সার জন্য নাইজেরিয়া, সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া এবং ঘানায় বিশেষ লাসা হাসপাতাল আছে। এসব হাসপাতালে অন্য কোনো রোগের চিকিত্সা হয় না এবং অননুমোদিত কোনো মানুষকে ঢুকতে দেয়া হয় না। যেসব ডাক্তার, নার্স লাসা হাসপাতালে কাজ করেন তাদের বলা হয় ‘আত্মঘাতী মেডিকেল টিম’। লাসা জ্বরের চিকিত্সকদের কেউ যদি চিকিত্সারত অবস্থায় দেখেন তাহলে ভাববেন চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে অবস্থানরত কোনো নভোচারী। সারা শরীর মোটা সাদা পোশাকে ঢাকা, এমন কি মাথায় এস্ট্রনটদের মতো হেলমেট পরা, যার সামনের দিকে স্বচ্ছ কাচের ঢাকনা। এত সাবধানতার পরেও লাসা হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার-নার্সদের অধিকাংশই লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওরাই তো প্রকৃত মানবসেবী, মানুষের কল্যাণে জীবন উত্সর্গকারী। নিশ্চিত মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। লাসা জ্বরের চিকিত্সায় কর্মরত সেসব মহানুভব ডাক্তার-নার্সদের প্রতি মনে মনে একটি সেলুট ঠুকে দিলাম। লাসা ভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার লিখিত আইন আছে, লাসা জ্বরে আক্রান্ত কোনো মৃতদেহ বহন করা যাবে না। এই জ্বরে আক্রান্ত মৃতদেহকে কবর দেয়া হয় ২৫ ফুট মাটির নিচে। লাসা জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিঃশব্দ এবং ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ঘরে রাখা হয়। কারণ, রোগীরা আলো এবং শব্দ মোটেও সহ্য করতে পারে না।
রিসিভার তুলে ডাক্তার ময়িসকে ফোন করি। তোমার ক্লিনিকে রিবাভিরিন ইনজেকশন আছে তো? ও খিক খিক করে হেসে বলে, আছে। দুটা ইনজেকশন সব সময়ই রাখি। প্রতি তিন মাস পর পর এগুলো রিপ্লেস করে আসছি গত ছ’বছর ধরে। কখনোই ব্যবহার করতে হয়নি। আমি মনে মনে বলি, কোনোকালেই যেন ব্যবহার করতে না হয়।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
আমি পড়তে শুরু করি। পশ্চিম আফ্রিকায় একটি কথা প্রচলিত আছে লাসা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু জরিপের ফলাফল বলছে, হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারলে আর ঠিকমত চিকিত্সা করাতে পারলে ৮০ শতাংশ রোগী ভালো হয়ে যায় আর বাকি ২০ শতাংশ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। তবে যারা লাসার নির্মম থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের অধিকাংশই সারা জীবনের জন্য বধির হয়ে যায়। এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে যে লাসা জ্বর সেরে গেছে কিন্তু মানুষটি আগের মতোই ঠিকঠাক কানে শোনে। পুরোপুরি বধির না হলেও আংশিক বা সাময়িক বধিরতা অনিবার্য। ১৯৬৯ সালে পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়াতে দু’জন মিশনারী নার্স লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেই এই রোগটি আবিষ্কৃত হয়। নাইজেরিয়ার লাসা নামক স্থানে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয় বলে এর নাম হয়েছে লাসা। এক ধরনের বাতি ইঁদুর (গধংঃড়সুং জড়ফবহঃ) এই লাসা জ্বরের ভাইরাস বহন করে। প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসটি ইঁদুরের শরীরেই তৈরি হয়। নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন, ঘানাসহ পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব দেশেই কম-বেশি লাসা জ্বরের উপস্থিতি আছে। এজন্যই বলা হয় পশ্চিম আফ্রিকায় এই অসুখটি এনডেমিক পর্যায়ে রয়েছে। গড়ে প্রতি বছর এক থেকে তিন লাখ মানুষ লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়। লাসা ভাইরাস আরেনাভিরিডে (অত্বহধারত্রফধব) ভাইরাস পরিবারের সদস্য।
আইভরিকোস্টের প্রত্যন্ত গ্রামে কিংবা আলোকোজ্জ্বল শহরে, সব খানেই একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, কেউ গাছের নিচে পড়ে থাকা কোনো ফলমূল তুলে খায় না। প্রায়ই প্রাতঃভ্রমণ করতে গিয়ে দেখি গাছের নিচে প্রচুর পরিমাণে আম পড়ে আছে, চালতা গাছের নিচে বিছিয়ে আছে চালতা, আরও কত ফলমূল পড়ে আছে কিন্তু কেউ পড়ে থাকা এসব ফল ছুঁয়েও দেখে না। প্রথম প্রথম ভাবতাম ওদের প্রচুর আছে বলে কুড়িয়ে খায় না, গাছ থেকে সরাসরি পেড়ে খায়। কিন্তু পরে জানতে পারলাম এটা লাসা সচেতনতা। ইঁদুরে খাওয়া খাবার বা খাবারের ওপর দিয়ে ইঁদুর হেঁটে গেলে অথবা ইঁদুরের মলমূত্র লেগেছে এমন খাবার খেলে, এমন কি ঘ্রাণ শুকলেও লাসা জ্বরের ভাইরাস মানবদেহে চলে আসতে পারে।
মানবদেহে লাসা ভাইরাস প্রবেশের এক থেকে তিন সপ্তাহ পরে রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। লাসা’র লক্ষণ অনেক, যেমন: জ্বর, বুকের দেয়ালের ভেতরে ব্যথা, গলায় প্রদাহ, পিঠে ব্যথা, কাশি, পেটে ব্যথা, বমি হওয়া, পাতলা পায়খানা, মুখের চামড়ায় জ্বালা-পোড়া, প্রশ্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্ত বা অস্বাভাবিক কিছু বের হওয়া, কারও কারও অস্বাভাবিক চুল পড়াও শুরু হতে পারে। এখনও পর্যন্ত এর সফল চিকিত্সা হিসেবে রিবাভিরিন ড্রাগ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিবাভিরিন ইনজেকশনের দাম খুব বেশি বলে লাসার চিকিত্সা ব্যয়বহুল। এক সময় একটি ইনজেকশনের দাম ছিল ১ হাজার ডলার, গত বছরও ৪৫০ ডলারে একেকটি ইনজেকশন কেনা হয়। তবে এর দাম ২০ ডলারে নেমে আসবে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
লাসা জ্বরের চিকিত্সার জন্য নাইজেরিয়া, সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া এবং ঘানায় বিশেষ লাসা হাসপাতাল আছে। এসব হাসপাতালে অন্য কোনো রোগের চিকিত্সা হয় না এবং অননুমোদিত কোনো মানুষকে ঢুকতে দেয়া হয় না। যেসব ডাক্তার, নার্স লাসা হাসপাতালে কাজ করেন তাদের বলা হয় ‘আত্মঘাতী মেডিকেল টিম’। লাসা জ্বরের চিকিত্সকদের কেউ যদি চিকিত্সারত অবস্থায় দেখেন তাহলে ভাববেন চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে অবস্থানরত কোনো নভোচারী। সারা শরীর মোটা সাদা পোশাকে ঢাকা, এমন কি মাথায় এস্ট্রনটদের মতো হেলমেট পরা, যার সামনের দিকে স্বচ্ছ কাচের ঢাকনা। এত সাবধানতার পরেও লাসা হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার-নার্সদের অধিকাংশই লাসা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওরাই তো প্রকৃত মানবসেবী, মানুষের কল্যাণে জীবন উত্সর্গকারী। নিশ্চিত মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। লাসা জ্বরের চিকিত্সায় কর্মরত সেসব মহানুভব ডাক্তার-নার্সদের প্রতি মনে মনে একটি সেলুট ঠুকে দিলাম। লাসা ভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার লিখিত আইন আছে, লাসা জ্বরে আক্রান্ত কোনো মৃতদেহ বহন করা যাবে না। এই জ্বরে আক্রান্ত মৃতদেহকে কবর দেয়া হয় ২৫ ফুট মাটির নিচে। লাসা জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিঃশব্দ এবং ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ঘরে রাখা হয়। কারণ, রোগীরা আলো এবং শব্দ মোটেও সহ্য করতে পারে না।
রিসিভার তুলে ডাক্তার ময়িসকে ফোন করি। তোমার ক্লিনিকে রিবাভিরিন ইনজেকশন আছে তো? ও খিক খিক করে হেসে বলে, আছে। দুটা ইনজেকশন সব সময়ই রাখি। প্রতি তিন মাস পর পর এগুলো রিপ্লেস করে আসছি গত ছ’বছর ধরে। কখনোই ব্যবহার করতে হয়নি। আমি মনে মনে বলি, কোনোকালেই যেন ব্যবহার করতে না হয়।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments