চুক্তি-সমঝোতার সুফল জনগণ পেতে চায়-দিল্লি শীর্ষ বৈঠক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে ৫০ দফার যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হলো, তা থেকে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের অধিকতর সহযোগিতামূলক ধারা সূচিত হতে যাচ্ছে, যা দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। উভয় দেশের জনগণের জন্যই আশাব্যঞ্জক বার্তা বয়ে এনেছে হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠক।


প্রথমত, সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তি এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদ ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা দমনের উদ্যোগে দুই দেশকে আরও কাছে টানবে। দুই দেশের আন্তরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। উভয় দেশের জনগণ শান্তিকামী; সন্ত্রাসবাদ তাই কোনো এক পক্ষের বিষয় নয়।
দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের সমুদ্র, রেল ও সড়কপথ একে অন্যকে ব্যবহারের সুযোগ দেবে বলে যে সমঝোতা হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিসঞ্চারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেবে বাংলাদেশ; এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অনেক রাজস্ব আয় হবে। বিশেষত, প্রায় অচল মংলা বন্দরটি এই সুবাদে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে, সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও ঘটবে। আর নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ। ওই দুটি দেশে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এটি হবে অত্যন্ত সহায়ক। এই উদ্যোগ শুধু দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারত-বাংলাদেশ নয়, বরং আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটির পথ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আরও কিছু ইতিবাচক, বন্ধুসুলভ মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে কয়েকটি বিষয়ের মধ্য দিয়ে। এসবের মধ্যে আরও ৪৭টি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতে প্রবেশাধিকার, রেল ও যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, নদী পুনঃখনন ইত্যাদির জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ-সহায়তার ঘোষণা ও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ বিক্রির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেমন, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, যা বাংলাদেশের একটি বড় অগ্রাধিকার; তা নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। কথা হয়েছে, চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মার্চে দুই দেশের পানিসম্পদমন্ত্রীদের বৈঠক বসবে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়েও আলোচনা কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেনি, শুধু আভাস দেওয়া হয়েছে যে জাতিসংঘের প্রচলিত সালিসব্যবস্থার পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রয়াস নেওয়া হবে। সীমান্ত নির্ধারণ, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি—এ ধরনের কিছু বিষয়ও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়েছে, এসব বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের ভৌগোলিক বাস্তবতাকে যুক্তিপূর্ণভাবে পারস্পরিক মঙ্গলের স্বার্থে কাজে লাগানোর পরিবর্তে অবিশ্বাস, অনাস্থা, দোষারোপের যে ধারা এত দিন কমবেশি চলে এসেছে, তার অবসান ঘটানো জরুরি হয়ে পড়েছিল। দিল্লি শীর্ষ বৈঠকে দুই দেশের সরকারের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং আরও যা হতে যাচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবিক সুফল জনজীবনে প্রতিফলিত হলেই দুই দেশের সম্পর্কের প্রকৃত উন্নতি ঘটবে। জনগণ চুক্তি ও সমঝোতার সুফল পেতে আগ্রহী।
আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর দেশ দুটির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাকে গঠনমূলকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে আঞ্চলিকভাবে বড় ধরনের উন্নয়নে সূচনা ঘটানো সম্ভব হবে।

No comments

Powered by Blogger.