কালের আয়নায়-বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমারও ধারণা, বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আপসের পথে যেতেন না। বাংলাদেশকে কোনো কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও নব্য আধিপত্যবাদীদের হাতে তুলে দিতেন না। তিনি বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলোর নেতাদের সঙ্গে মিলিত হতেন, আবার অস্ত্রের মোকাবেলায় আন্দোলনের শক্তিকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করা যায় কি-না তার চেষ্টা করতেন
আজ যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনি তিরানব্বই বছর বয়সে পা দিতেন। এতটা দীর্ঘ বয়স, কিংবা তার কাছাকাছি বয়সের কোনো নেতা কি বেঁচে ছিলেন না কিংবা বেঁচে নেই! নেলসন ম্যান্ডেলা তো আছেন। চার্চিল, ভেরউড, রেগান আরও কত নেতার নাম করব? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, তিনি ১২৫ বছর বেঁচে থাকবেন। নথুরাম গডসে তাকে হত্যা না করলে তিনি হয়তো বেঁচে থাকতেন।
বঙ্গবন্ধুকে যদি ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো, তাহলে তিনি কি স্বাভাবিকভাবেই নব্বই-ঊর্ধ্ব বয়সে বেঁচে থাকতেন না? প্রশ্নটির জবাব আমি জানি না। হয়তো বেঁচে থাকতেন। তবে নেলসন ম্যান্ডেলা বা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো ক্ষমতা থেকে অবসর নিতেন। আমি এ ক্ষেত্রে ফিদেল কাস্ত্রোর কথাটাই বেশি ভাবছি। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অবসর নিয়েছেন; কিন্তু জাতীয় অভিভাবকত্বের দায়িত্বটি তিনি এখনও পুরোপুরি পালন করছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একজন জাতীয় অভিভাবক প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতির পিতা। তবে সদ্য স্বাধীন দেশটির জাতীয় অভিভাবকত্বের দায়িত্বটি তার আরও কিছুকাল পালন করা উচিত ছিল।
যদি তিনি তা পালন করতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের আজ যে দুরবস্থা, কিছু মানুষের উন্নয়ন আর সমষ্টির ভয়াবহ অবনতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়, তা সম্ভবত ঘটত না। মাহাথির মোহাম্মদ বা লি কুয়ান কোনো জাতি গঠন করেননি। তারা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে উন্নতির বিস্ময়কর শিখরে তুলে দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু একটি জাতির অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করেছেন, একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছেন এবং সময় ও সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করে যেতে পারতেন। তিনি যে তা পারলেন না তার কারণ, কিছু কাপুরুষ ও নরপশু বাঙালির মধ্যরাতে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিতৃহত্যা।
পণ্ডিত নীরদ সি চৌধুরীর একটি বইয়ের নাম 'আত্মঘাতী বাঙালি'। বাঙালির চরিত্র নির্ণয়ে এর চেয়ে সঠিক অভিধা আর কিছু হয় না। বাঙালি তো আত্মঘাতী একবার হয়নি, বহুবার হয়েছে।
একবার হয়েছে পলাশীর যুদ্ধের মাঠে। একবার হয়েছে অবাঙালি জিন্নাহ নেতৃত্বের কাছে বাঙালি হক নেতৃত্ব ও সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বকে বলিদান করে। তারপর আত্মঘাতী হয়েছে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের সময় কংগ্রেস ও লীগের অবাঙালি নেতৃত্বের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে। বাঙালির সবচেয়ে ক্ষতিকর আত্মঘাতী ভূমিকা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, 'পিতৃহত্যা বড় পাপ।' এই পিতৃহত্যার পাপের দেনা বাঙালি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
কুড়ি শতকের গোড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম। বিশ্ব এখন একুশ শতকের গোড়ায়। এই প্রায় একশ' বছরের মধ্যে বিশ্বের সামগ্রিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতি এতটাই বদলেছে যে, গত শতকের গোড়ায় কোনো মানুষ যদি আজ একুশ শতকের গোড়ায় রিপভ্যান উইঙ্কলের মতো হঠাৎ দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, তাহলে বিশ্বকে দূরের কথা, নিজের দেশকেও চিনবেন না। কুড়ি শতকের গোড়ায় ব্রিটিশ শাসনাধীন যে কৃষিনির্ভর সামন্ত যুগীয় বাংলাদেশ ছিল, আজকের একুশ শতকের গোড়ায় স্বাধীন, খণ্ডিত এবং শিল্পোন্নতির যুগে প্রবেশে উন্মুখ বাংলাদেশের (দুই বাংলারই) সঙ্গে তার কোনো তুলনা করা চলে কি?
বঙ্গবন্ধুর কুড়ি শতকের বাংলাদেশের চেয়ে একুশ শতকের বাংলাদেশের সমস্যা অনেক বেশি জটিল ও বিপজ্জনক। বঙ্গবন্ধুর সমস্যা ছিল স্বাধীনতা অর্জন। এখনকার সমস্যা সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার। এটা আরও বেশি জটিল ও দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর সময়ে খণ্ডিত পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন তা পনেরো কোটি। তখন বাঙালি সিভিল ব্যুরোক্রেসি ছিল দুর্বল। তাদের মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি ছিল না বললেই চলে। নব্য এবং চরিত্রহীন ধনী গোষ্ঠী তখন মাথা তুলছে মাত্র। প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস ছিল। তা এখনকার মতো বর্বর সিন্ডিকেট ও মাফিয়া চক্র হয়ে উঠতে পারেনি। দেশে সাম্প্রদায়িকতা শক্তিশালী ছিল; কিন্তু হিংস্র মৌলবাদ ছিল অস্তিত্বহীন।
বঙ্গবন্ধুর আমলের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধ করতে হয়েছে নব্য ঔপনিবেশিকতা, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ক্যাপিটালিজমের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে। বর্তমানের বাংলাদেশসহ অধিকাংশ আফ্রো-এশিয়ান ও লাতিন আমেরিকান উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আরও ভয়াবহ গ্গ্নোবাল মার্কেট ক্যাপিটালিজম এবং তার হিংস্র আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিশ্ব ছিল দুই শক্তি শিবিরে বিভক্ত। বিশ্বে একটি শক্তিশালী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) ছিল। সমাজতন্ত্রী শক্তি শিবির এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আজ সমাজতন্ত্রী বিশ্ব শিবির নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিবীর্য।
অন্যদিকে বিশ্ব এখন ইউনিপোলার। একটি মাত্র দুর্ধর্ষ শক্তি শিবির বিশ্বে। সেটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একক শক্তি শিবির। তার হাতে মারাত্মক সমরাস্ত্র। কোনো নৈতিকতাবোধ, মানবতাবোধ এই 'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' নামধারী নব্য ফ্যাসিবাদের নেই। মধ্যপ্রাচ্যে এরা তথাকথিত ওয়ার অন টেররিজমের নামে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছে। ইরাক ও আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে এখন সিরিয়া ও ইরানকে ধ্বংস করতে উদ্যত। দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব আজ থাকলে গোটা বিশ্বে এই মহাপ্রলয় ঘটানো গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের দানবের পক্ষে সম্ভব হতো না। কোনো কোনো পশ্চিমা গবেষকের মতে, গত শতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধও নয় মাসে শেষ হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হয়তো 'ট্রেইটর' হিসেবে পাকিস্তানের কারাগারে প্রাণ দিতে হতো।
আজ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মিত্র এবং সহায়ক শক্তি কোথায়? সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবির নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিবীর্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র ছিল যে প্রতিবেশী দেশ ভারত, তার সরকার আজ আমেরিকার কাছে নতজানু, তার সঙ্গে আধা-সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দিলি্লর মনোভাব মিত্রসুলভ নয়। দিলি্লতে মনমোহন সিংয়ের অরাজনৈতিক নেতৃত্বে এমন একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, যার চেয়ে দুর্বল সরকার আগে কখনও দিলি্লতে ক্ষমতায় বসেনি। রাজ্যগুলো কেন্দ্রের কথা শুনতে চায় না। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সম্ভবত বাহাদুর শাহই দিলি্লতে এ ধরনের একটি সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দিলি্ল পাকিস্তানকে বলছে, 'মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?' অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বাড়াতে চাচ্ছে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে আজ যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেঁচে থাকতেন, এমনকি ক্ষমতাতেও থাকতেন, তাহলে কী করতেন? দক্ষিণ এশিয়ায় এই সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্তে তিনি কি পারতেন শক্ত হাতে রাষ্ট্র-তরণীর হাল ধরতে, এই দুর্যোগ সমুদ্র পাড়ি দিতে? পারতেন পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের মদদপুষ্ট বিএনপি-জামায়াতের এই ক্রমাগত ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসের রাজনীতির মোকাবেলায় জাতিকে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ রেখে বাংলাদেশের স্বাধীন, সেক্যুলার চরিত্র রক্ষা করতে? তার মাথার ওপর অনবরত ঝুলত হত্যা চক্রান্তের হিংস্র তরবারি। পারতেন তাকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অনড় ও অবিচল থাকতে?
এতগুলো প্রশ্নের জবাবে আমার মতো এক নগণ্য কলামিস্ট যদি হ্যাঁ বলি, যদি বলি পারতেন, তাহলে অনেকে বিস্মিত হবেন। কিন্তু এটা শুধু আমার নয়, মুজিব চরিত্রের কোনো কোনো বিদেশি বিশ্লেষকেরও ধারণা। প্রয়াত ব্রিটিশ বাম বুদ্ধিজীবী জ্যাক ওয়াদিসের মতে, 'শেখ মুজিব ছিলেন অপরাজেয় রাজনৈতিক চরিত্রের নেতা। কিন্তু তিনি আত্মরক্ষার কৌশলটি সম্পর্কে ছিলেন উদাসীন। যদি উদাসীন না থাকতেন, তাহলে কাস্ত্রোর মতো সফল হতে পারতেন (নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ওয়াদিস বলেননি। ম্যান্ডেলার চূড়ান্ত সাফল্য দেখার আগেই তিনি মারা যান)। তার জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় শত্রুরা জানত, তাকে মধ্য বা শেষ রাতে আকস্মিকভাবে হত্যা করা ছাড়া নির্বাচনে বা কোনো রাজনৈতিক যুদ্ধে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব নয়। আর বাঙালির স্বাধীনতা এবং সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যাপারে তিনি কোনোভাবেই আপসরফায় যেতেন না।' জ্যাক ওয়াদিসের এই বিশ্লেষণ আরও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দ্বারা স্বীকৃতি পেয়েছে।
কুড়ি শতকের গোড়ায় প্রত্যন্ত বাংলায় একটি কৃষিনির্ভর সমাজে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশে শেখ মুজিবের জন্ম। যৌবনে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনেও অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক চরিত্রের বিকাশ বিস্ময়কর। বাংলা ভাগ হওয়ার আগেই তিনি ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস হারান এবং বাঙালির প্রাচীন লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই ঘোর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যুগে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে রূপান্তর করার কাজে মওলানা ভাসানীকে শক্তি ও সমর্থন জোগান। আন্দোলন দ্বারা ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক যুক্ত নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন ঘটান। পূর্ব পাকিস্তানকে আবার বাংলাদেশ নামে রূপান্তর করার প্রথম ঘোষণা তার।
বাংলাদেশকে স্বাধীন নেশন স্টেটে পরিণত করার প্রথম সূচক আন্দোলন_ 'দুই অর্থনীতির আন্দোলন', তারপর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ। প্রত্যেকটিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি তার রাজনৈতিক আন্দোলনকে দেশের আর্থসামাজিক বিবর্তনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। অন্য অনেক নেতা যেটা পারেননি।
তার দুর্জয় রাজনৈতিক সাহস লক্ষ্য করার মতো। তিনি প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে দেশের রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে অসাম্প্রদায়িক ধারায় এবং সব শেষে সমাজতান্ত্রিক ধারায় (বাকশাল গঠন দ্বারা) উত্তরণ ঘটানোর সাহস দেখিয়েছেন এবং নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে আত্মদান করেছেন। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন করে সফল হননি। কিন্তু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বর্বর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা সফল হয়েছিলেন। কারণ, নিরস্ত্র জনগণকে প্রস্তুত করে কখন অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে পরিণত করা যায়, সেই কৌশলটি তিনি জানতেন। এই কৌশলটি তিনি বর্তমানে বেঁচে থাকলে গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিস্ট জান্তার বিরুদ্ধেও হয়তো প্রয়োগ করতে চাইতেন।
এমএন রায়ের হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের এক ব্রিটিশ নেতা কিছুকাল আগে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি তার একটি ছোট পুস্তিকায় লিখেছেন, 'বিশ্বের মানবতাবিরোধী শক্তি এখন ভয়াবহ মারণাস্ত্রে সজ্জিত। শক্তি দ্বারা এই শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এই শক্তি দ্বারা শক্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে ভেঙে গেছে। নয়া চীন এখন চাচ্ছে এই সামরিক শক্তি দ্বারা মার্কিন সামরিক শক্তির মোকাবেলা করতে। কিন্তু সে তার নৈতিক শক্তির মূল কেন্দ্রটি থেকে সরে গেছে। সুতরাং চীনের পরিণতিও কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। এখন দরকার প্রয়াত গান্ধীর অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ এবং শান্তিকামী নেতাদের বিশ্বময় ঐক্য।'
এই নিবন্ধে অহিংস-অসহযোগের শক্তির উদাহরণ দেখাতে গিয়ে ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট নেতা বাংলাদেশের এবং বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'একটি নিরস্ত্র জাতির নেতা হিসেবে একটি সশস্ত্র সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথমে অহিংস-অসহযোগের আন্দোলনে নেমে সফল হওয়া বিশ্বে এই প্রথম। বর্তমানেও মানবতার শত্রু ভয়াবহ মারণাস্ত্রের অধিকারী বিশ্ব দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিপীড়িত বিশ্বের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হলে এবং প্রথমে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলে বিশ্বময় অহিংস-অসহযোগের ডাক দিলে এই দানবকে সার্থকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। বর্তমানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে বিশ্ব মানবতাকে রক্ষার এটাই একমাত্র পন্থা। কিন্তু সে জন্য প্রথমেই দরকার শেখ মুজিবের মতো দুর্জয় সাহসের অধিকারী একজন নেতা। শুধু একজন নয়, দরকার আরও কয়েকজন শেখ মুজিবের।'
আমারও ধারণা, বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আপসের পথে যেতেন না। বাংলাদেশকে কোনো কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও নব্য আধিপত্যবাদীদের হাতে তুলে দিতেন না। তিনি বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলোর নেতাদের সঙ্গে মিলিত হতেন, আবার অস্ত্রের মোকাবেলায় আন্দোলনের শক্তিকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করা যায় কি-না তার চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে আবার প্রাণ দিতেন, পিছু হটতেন না। প্রতি বছর ১৭ মার্চ তারিখটি এলেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে আরেকজন বঙ্গবন্ধু আবার কি জন্মাবেন?
লন্ডন, শুক্রবার, ১৬ মার্চ ২০১২
বঙ্গবন্ধুকে যদি ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো, তাহলে তিনি কি স্বাভাবিকভাবেই নব্বই-ঊর্ধ্ব বয়সে বেঁচে থাকতেন না? প্রশ্নটির জবাব আমি জানি না। হয়তো বেঁচে থাকতেন। তবে নেলসন ম্যান্ডেলা বা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো ক্ষমতা থেকে অবসর নিতেন। আমি এ ক্ষেত্রে ফিদেল কাস্ত্রোর কথাটাই বেশি ভাবছি। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অবসর নিয়েছেন; কিন্তু জাতীয় অভিভাবকত্বের দায়িত্বটি তিনি এখনও পুরোপুরি পালন করছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একজন জাতীয় অভিভাবক প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতির পিতা। তবে সদ্য স্বাধীন দেশটির জাতীয় অভিভাবকত্বের দায়িত্বটি তার আরও কিছুকাল পালন করা উচিত ছিল।
যদি তিনি তা পালন করতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের আজ যে দুরবস্থা, কিছু মানুষের উন্নয়ন আর সমষ্টির ভয়াবহ অবনতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়, তা সম্ভবত ঘটত না। মাহাথির মোহাম্মদ বা লি কুয়ান কোনো জাতি গঠন করেননি। তারা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে উন্নতির বিস্ময়কর শিখরে তুলে দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু একটি জাতির অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করেছেন, একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছেন এবং সময় ও সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করে যেতে পারতেন। তিনি যে তা পারলেন না তার কারণ, কিছু কাপুরুষ ও নরপশু বাঙালির মধ্যরাতে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিতৃহত্যা।
পণ্ডিত নীরদ সি চৌধুরীর একটি বইয়ের নাম 'আত্মঘাতী বাঙালি'। বাঙালির চরিত্র নির্ণয়ে এর চেয়ে সঠিক অভিধা আর কিছু হয় না। বাঙালি তো আত্মঘাতী একবার হয়নি, বহুবার হয়েছে।
একবার হয়েছে পলাশীর যুদ্ধের মাঠে। একবার হয়েছে অবাঙালি জিন্নাহ নেতৃত্বের কাছে বাঙালি হক নেতৃত্ব ও সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বকে বলিদান করে। তারপর আত্মঘাতী হয়েছে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের সময় কংগ্রেস ও লীগের অবাঙালি নেতৃত্বের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে। বাঙালির সবচেয়ে ক্ষতিকর আত্মঘাতী ভূমিকা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, 'পিতৃহত্যা বড় পাপ।' এই পিতৃহত্যার পাপের দেনা বাঙালি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
কুড়ি শতকের গোড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম। বিশ্ব এখন একুশ শতকের গোড়ায়। এই প্রায় একশ' বছরের মধ্যে বিশ্বের সামগ্রিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতি এতটাই বদলেছে যে, গত শতকের গোড়ায় কোনো মানুষ যদি আজ একুশ শতকের গোড়ায় রিপভ্যান উইঙ্কলের মতো হঠাৎ দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, তাহলে বিশ্বকে দূরের কথা, নিজের দেশকেও চিনবেন না। কুড়ি শতকের গোড়ায় ব্রিটিশ শাসনাধীন যে কৃষিনির্ভর সামন্ত যুগীয় বাংলাদেশ ছিল, আজকের একুশ শতকের গোড়ায় স্বাধীন, খণ্ডিত এবং শিল্পোন্নতির যুগে প্রবেশে উন্মুখ বাংলাদেশের (দুই বাংলারই) সঙ্গে তার কোনো তুলনা করা চলে কি?
বঙ্গবন্ধুর কুড়ি শতকের বাংলাদেশের চেয়ে একুশ শতকের বাংলাদেশের সমস্যা অনেক বেশি জটিল ও বিপজ্জনক। বঙ্গবন্ধুর সমস্যা ছিল স্বাধীনতা অর্জন। এখনকার সমস্যা সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার। এটা আরও বেশি জটিল ও দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর সময়ে খণ্ডিত পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন তা পনেরো কোটি। তখন বাঙালি সিভিল ব্যুরোক্রেসি ছিল দুর্বল। তাদের মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি ছিল না বললেই চলে। নব্য এবং চরিত্রহীন ধনী গোষ্ঠী তখন মাথা তুলছে মাত্র। প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস ছিল। তা এখনকার মতো বর্বর সিন্ডিকেট ও মাফিয়া চক্র হয়ে উঠতে পারেনি। দেশে সাম্প্রদায়িকতা শক্তিশালী ছিল; কিন্তু হিংস্র মৌলবাদ ছিল অস্তিত্বহীন।
বঙ্গবন্ধুর আমলের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধ করতে হয়েছে নব্য ঔপনিবেশিকতা, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ক্যাপিটালিজমের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে। বর্তমানের বাংলাদেশসহ অধিকাংশ আফ্রো-এশিয়ান ও লাতিন আমেরিকান উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আরও ভয়াবহ গ্গ্নোবাল মার্কেট ক্যাপিটালিজম এবং তার হিংস্র আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিশ্ব ছিল দুই শক্তি শিবিরে বিভক্ত। বিশ্বে একটি শক্তিশালী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) ছিল। সমাজতন্ত্রী শক্তি শিবির এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আজ সমাজতন্ত্রী বিশ্ব শিবির নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিবীর্য।
অন্যদিকে বিশ্ব এখন ইউনিপোলার। একটি মাত্র দুর্ধর্ষ শক্তি শিবির বিশ্বে। সেটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একক শক্তি শিবির। তার হাতে মারাত্মক সমরাস্ত্র। কোনো নৈতিকতাবোধ, মানবতাবোধ এই 'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' নামধারী নব্য ফ্যাসিবাদের নেই। মধ্যপ্রাচ্যে এরা তথাকথিত ওয়ার অন টেররিজমের নামে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছে। ইরাক ও আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে এখন সিরিয়া ও ইরানকে ধ্বংস করতে উদ্যত। দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব আজ থাকলে গোটা বিশ্বে এই মহাপ্রলয় ঘটানো গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের দানবের পক্ষে সম্ভব হতো না। কোনো কোনো পশ্চিমা গবেষকের মতে, গত শতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধও নয় মাসে শেষ হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হয়তো 'ট্রেইটর' হিসেবে পাকিস্তানের কারাগারে প্রাণ দিতে হতো।
আজ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মিত্র এবং সহায়ক শক্তি কোথায়? সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবির নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিবীর্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র ছিল যে প্রতিবেশী দেশ ভারত, তার সরকার আজ আমেরিকার কাছে নতজানু, তার সঙ্গে আধা-সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দিলি্লর মনোভাব মিত্রসুলভ নয়। দিলি্লতে মনমোহন সিংয়ের অরাজনৈতিক নেতৃত্বে এমন একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, যার চেয়ে দুর্বল সরকার আগে কখনও দিলি্লতে ক্ষমতায় বসেনি। রাজ্যগুলো কেন্দ্রের কথা শুনতে চায় না। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সম্ভবত বাহাদুর শাহই দিলি্লতে এ ধরনের একটি সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দিলি্ল পাকিস্তানকে বলছে, 'মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?' অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বাড়াতে চাচ্ছে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে আজ যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেঁচে থাকতেন, এমনকি ক্ষমতাতেও থাকতেন, তাহলে কী করতেন? দক্ষিণ এশিয়ায় এই সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্তে তিনি কি পারতেন শক্ত হাতে রাষ্ট্র-তরণীর হাল ধরতে, এই দুর্যোগ সমুদ্র পাড়ি দিতে? পারতেন পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের মদদপুষ্ট বিএনপি-জামায়াতের এই ক্রমাগত ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসের রাজনীতির মোকাবেলায় জাতিকে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ রেখে বাংলাদেশের স্বাধীন, সেক্যুলার চরিত্র রক্ষা করতে? তার মাথার ওপর অনবরত ঝুলত হত্যা চক্রান্তের হিংস্র তরবারি। পারতেন তাকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অনড় ও অবিচল থাকতে?
এতগুলো প্রশ্নের জবাবে আমার মতো এক নগণ্য কলামিস্ট যদি হ্যাঁ বলি, যদি বলি পারতেন, তাহলে অনেকে বিস্মিত হবেন। কিন্তু এটা শুধু আমার নয়, মুজিব চরিত্রের কোনো কোনো বিদেশি বিশ্লেষকেরও ধারণা। প্রয়াত ব্রিটিশ বাম বুদ্ধিজীবী জ্যাক ওয়াদিসের মতে, 'শেখ মুজিব ছিলেন অপরাজেয় রাজনৈতিক চরিত্রের নেতা। কিন্তু তিনি আত্মরক্ষার কৌশলটি সম্পর্কে ছিলেন উদাসীন। যদি উদাসীন না থাকতেন, তাহলে কাস্ত্রোর মতো সফল হতে পারতেন (নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ওয়াদিস বলেননি। ম্যান্ডেলার চূড়ান্ত সাফল্য দেখার আগেই তিনি মারা যান)। তার জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় শত্রুরা জানত, তাকে মধ্য বা শেষ রাতে আকস্মিকভাবে হত্যা করা ছাড়া নির্বাচনে বা কোনো রাজনৈতিক যুদ্ধে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব নয়। আর বাঙালির স্বাধীনতা এবং সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যাপারে তিনি কোনোভাবেই আপসরফায় যেতেন না।' জ্যাক ওয়াদিসের এই বিশ্লেষণ আরও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দ্বারা স্বীকৃতি পেয়েছে।
কুড়ি শতকের গোড়ায় প্রত্যন্ত বাংলায় একটি কৃষিনির্ভর সমাজে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশে শেখ মুজিবের জন্ম। যৌবনে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনেও অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক চরিত্রের বিকাশ বিস্ময়কর। বাংলা ভাগ হওয়ার আগেই তিনি ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস হারান এবং বাঙালির প্রাচীন লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই ঘোর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যুগে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে রূপান্তর করার কাজে মওলানা ভাসানীকে শক্তি ও সমর্থন জোগান। আন্দোলন দ্বারা ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক যুক্ত নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন ঘটান। পূর্ব পাকিস্তানকে আবার বাংলাদেশ নামে রূপান্তর করার প্রথম ঘোষণা তার।
বাংলাদেশকে স্বাধীন নেশন স্টেটে পরিণত করার প্রথম সূচক আন্দোলন_ 'দুই অর্থনীতির আন্দোলন', তারপর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ। প্রত্যেকটিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি তার রাজনৈতিক আন্দোলনকে দেশের আর্থসামাজিক বিবর্তনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। অন্য অনেক নেতা যেটা পারেননি।
তার দুর্জয় রাজনৈতিক সাহস লক্ষ্য করার মতো। তিনি প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে দেশের রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে অসাম্প্রদায়িক ধারায় এবং সব শেষে সমাজতান্ত্রিক ধারায় (বাকশাল গঠন দ্বারা) উত্তরণ ঘটানোর সাহস দেখিয়েছেন এবং নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে আত্মদান করেছেন। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন করে সফল হননি। কিন্তু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বর্বর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা সফল হয়েছিলেন। কারণ, নিরস্ত্র জনগণকে প্রস্তুত করে কখন অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে পরিণত করা যায়, সেই কৌশলটি তিনি জানতেন। এই কৌশলটি তিনি বর্তমানে বেঁচে থাকলে গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিস্ট জান্তার বিরুদ্ধেও হয়তো প্রয়োগ করতে চাইতেন।
এমএন রায়ের হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের এক ব্রিটিশ নেতা কিছুকাল আগে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি তার একটি ছোট পুস্তিকায় লিখেছেন, 'বিশ্বের মানবতাবিরোধী শক্তি এখন ভয়াবহ মারণাস্ত্রে সজ্জিত। শক্তি দ্বারা এই শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এই শক্তি দ্বারা শক্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে ভেঙে গেছে। নয়া চীন এখন চাচ্ছে এই সামরিক শক্তি দ্বারা মার্কিন সামরিক শক্তির মোকাবেলা করতে। কিন্তু সে তার নৈতিক শক্তির মূল কেন্দ্রটি থেকে সরে গেছে। সুতরাং চীনের পরিণতিও কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। এখন দরকার প্রয়াত গান্ধীর অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ এবং শান্তিকামী নেতাদের বিশ্বময় ঐক্য।'
এই নিবন্ধে অহিংস-অসহযোগের শক্তির উদাহরণ দেখাতে গিয়ে ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট নেতা বাংলাদেশের এবং বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'একটি নিরস্ত্র জাতির নেতা হিসেবে একটি সশস্ত্র সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথমে অহিংস-অসহযোগের আন্দোলনে নেমে সফল হওয়া বিশ্বে এই প্রথম। বর্তমানেও মানবতার শত্রু ভয়াবহ মারণাস্ত্রের অধিকারী বিশ্ব দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিপীড়িত বিশ্বের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হলে এবং প্রথমে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলে বিশ্বময় অহিংস-অসহযোগের ডাক দিলে এই দানবকে সার্থকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। বর্তমানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে বিশ্ব মানবতাকে রক্ষার এটাই একমাত্র পন্থা। কিন্তু সে জন্য প্রথমেই দরকার শেখ মুজিবের মতো দুর্জয় সাহসের অধিকারী একজন নেতা। শুধু একজন নয়, দরকার আরও কয়েকজন শেখ মুজিবের।'
আমারও ধারণা, বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আপসের পথে যেতেন না। বাংলাদেশকে কোনো কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও নব্য আধিপত্যবাদীদের হাতে তুলে দিতেন না। তিনি বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলোর নেতাদের সঙ্গে মিলিত হতেন, আবার অস্ত্রের মোকাবেলায় আন্দোলনের শক্তিকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করা যায় কি-না তার চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে আবার প্রাণ দিতেন, পিছু হটতেন না। প্রতি বছর ১৭ মার্চ তারিখটি এলেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে আরেকজন বঙ্গবন্ধু আবার কি জন্মাবেন?
লন্ডন, শুক্রবার, ১৬ মার্চ ২০১২
No comments