জন্মদিন-মুক্তির মন্দির সোপানতলে by রুবী রহমান
আজ ৩০ জুলাই। আমার স্বামী মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের জন্মদিন। অকালপ্রয়াত নুরুল ইসলাম গণতন্ত্রী পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি ছিলেন। আজ তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব। আমাদের মেয়েটি যে রাতে জন্ম নেয়, সেই রাতে আমার স্বামী হাসপাতালে সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
সকালে আমার ও মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ভালো জেনে তিনি একটি জরুরি কাজে বেরিয়ে গেলেন। তিনি তখন হাজারীবাগ ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। হাজারীবাগে একটি ট্যানারির শ্রমিকেরা তখন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট করছিলেন। তিন-চার রাত ধরে সেখানে কারফিউ দেওয়া হয়েছিল। সেখানকার সমস্যার সমাধান করে দুই দিন পর তিনি বর্তমান ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদকে সঙ্গে করে হাসপাতালে মেয়েকে দেখতে আসেন। সে সময় তাঁকে আমাদের মৃদু ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অপরাধী মুখে অমায়িক ভঙ্গিতেই তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু দায়িত্ব থেকে বিচলিত হননি।
সে সময়েই, মেয়েটির ১০ দিন বয়সে আরেক বিপদ হলো। আমাদের শিশুছেলে তমোহরের হাম হলো। হাম ছোঁয়াচে অসুখ বলে ছেলে আর মেয়েকে ভিন্ন ঘরে রাখা হলো। আমি নবজাতক মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার স্বামীই আমাদের ছেলের পরিচর্যা করছিলেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নেরও সভাপতি ছিলেন। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী সে বছর কমিশনার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কমিশনার নির্বাচিত হওয়া তখন বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য নুরুল ইসলাম এলাকায় চলে গেলেন। একা হাতে ছেলেমেয়ে দুটির পরিচর্যা করতে গিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। কিন্তু ১০ দিন পর রুস্তমকে নির্বাচনে বিজয়ী করে যখন তিনি ঘরে ফিরলেন, তখনকার সেই আনন্দ ছিল অতুলনীয়।
আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করি। এটি বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা। আমরা তখন শংকরের একটি ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় থাকি। একদিন বিকেলে দোতলার বারান্দায় ছেলেমেয়েসহ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সামনের রাস্তায় কয়েকটি ছেলে তুমুল মারপিট শুরু করল। দুটি ছেলেকে চার-পাঁচটি ছেলে বেদম পেটাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। মনে হলো, দুটি নিরীহ ছেলেকেই প্রভাবশালী কয়েকটি ছেলে মারছে। অল্প সময় পরে পুলিশ চলে এল। পুলিশ প্রহারোদ্যত ছেলেগুলোর সঙ্গে প্রহূত নিরীহ ছেলে দুটিকেও ভ্যানে তুলে নিল। উপস্থিত জনগণ চেষ্টা করেও প্রহূত ছেলে দুটিকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল না। পুলিশের ভ্যানটি যখন আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন নুরুল ইসলাম দোতলার বারান্দার রেলিং টপকে লাফ দিয়ে পুলিশের ভ্যানে নামলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ভ্যানটি গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবকিছুই এত আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে আমি ও আমাদের ছেলেমেয়ে দুটো শুধু হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। ঘণ্টা খানেক পর নুরুল ইসলাম নির্দোষ ছেলে দুটোকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে এলেন। ছেলেদের ফিরে পেয়ে ছেলে দুটোর মা-বাবা আর এলাকার জনগণের খুশি সেদিন আমাদের সব ভয়-বিফলতা দূর করে দিয়েছিল।
ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নুরুল ইসলাম তাঁর সারা জীবন এমন বর্ণনাযোগ্য ও অবর্ণনীয় নানা রকম প্রয়াশ করেছেন। তাঁর ও তাঁর ছেলে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আজ কে নেবে? এই দায়িত্ব কি শুধু আমার আর আমার মেয়ের? এই দায়িত্ব কি সবার নয়? স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৫ জুলাই মানববন্ধন ও আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এটি অত্যন্ত আশার কথা। গত আড়াই বছর নুরুল ইসলাম ও তমোহরের বন্ধু, সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনেরা এ ঘটনার তদন্ত ও সুবিচারের দাবি জানিয়েছেন। বিচারের আকাঙ্ক্ষা ও দাবি নিয়ে আমার মেয়ে মৌটুসী কাঙালের মতো, আক্ষরিক অর্থে, সবার দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়াচ্ছে। শোকে আমরা কাতর হয়েছি, পাথর হয়েছি। এই হতোদ্যম অবস্থায় মাননীয় মন্ত্রীর সহানুভূতিশীল ও আশাব্যঞ্জক আশ্বাসবাক্যগুলোতে সত্যিকার অর্থে ভরসা পেয়েছি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে এই হত্যার সুবিচারের আশাও দুরাশা হবে না বলে আশা করি।
আজ ৩০ জুলাই, নুরুল ইসলামের জন্মদিন। আজ আমাদের ৪০ বছরের সংসারের বাতি নির্বাপণেরও দিন। আজ খেলা ভাঙার খেলা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসেই অবশ্য সব লন্ডভন্ড হয়েছে, বাতি নির্বাপিত হয়েছে। ৪০ বছর ধরে যে সংসার সাজিয়ে রেখেছিলাম, আজ তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে। এত দিন পুলিশ তদন্তের জন্য সিলগালা করে রেখেছিল বলে আমাদের আসবাবপত্র, বইখাতা—সব ওই বাড়িতে তদন্তের স্বার্থে রক্ষিত ছিল। তদন্ত শেষ হয়েছে বলে পুলিশ জুলাই মাসের পর বাড়িটি বাড়িওয়ালার কাছে হস্তান্তর করবে। সম্প্রতি প্রকাশিত সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রতিবেদনে যে ভয়ংকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে—আর্সেনিক, অসমিয়াম ও লেড—এই আলামতগুলো যথাযথভাবে সুরক্ষিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে শঙ্কা হয়। সায়েন্স ল্যাবরেটরির (বিসিএসআইআর) এই প্রতিবেদনগুলো পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আলামতগুলো সুরক্ষা করার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান হওয়ার জন্য আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
সরকার ও তদন্তকারী সংস্থার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা এই তদন্ত ও সুবিচারকে ত্বরান্বিত করবে বলে আমি আশা করব। মুক্তির মন্দির সোপানতলে যত প্রাণ হলো বলিদান—তাঁদের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো সুস্পষ্ট হবে।
রুবী রহমান
সে সময়েই, মেয়েটির ১০ দিন বয়সে আরেক বিপদ হলো। আমাদের শিশুছেলে তমোহরের হাম হলো। হাম ছোঁয়াচে অসুখ বলে ছেলে আর মেয়েকে ভিন্ন ঘরে রাখা হলো। আমি নবজাতক মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার স্বামীই আমাদের ছেলের পরিচর্যা করছিলেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নেরও সভাপতি ছিলেন। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী সে বছর কমিশনার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কমিশনার নির্বাচিত হওয়া তখন বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য নুরুল ইসলাম এলাকায় চলে গেলেন। একা হাতে ছেলেমেয়ে দুটির পরিচর্যা করতে গিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। কিন্তু ১০ দিন পর রুস্তমকে নির্বাচনে বিজয়ী করে যখন তিনি ঘরে ফিরলেন, তখনকার সেই আনন্দ ছিল অতুলনীয়।
আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করি। এটি বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা। আমরা তখন শংকরের একটি ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় থাকি। একদিন বিকেলে দোতলার বারান্দায় ছেলেমেয়েসহ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সামনের রাস্তায় কয়েকটি ছেলে তুমুল মারপিট শুরু করল। দুটি ছেলেকে চার-পাঁচটি ছেলে বেদম পেটাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। মনে হলো, দুটি নিরীহ ছেলেকেই প্রভাবশালী কয়েকটি ছেলে মারছে। অল্প সময় পরে পুলিশ চলে এল। পুলিশ প্রহারোদ্যত ছেলেগুলোর সঙ্গে প্রহূত নিরীহ ছেলে দুটিকেও ভ্যানে তুলে নিল। উপস্থিত জনগণ চেষ্টা করেও প্রহূত ছেলে দুটিকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল না। পুলিশের ভ্যানটি যখন আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন নুরুল ইসলাম দোতলার বারান্দার রেলিং টপকে লাফ দিয়ে পুলিশের ভ্যানে নামলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ভ্যানটি গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবকিছুই এত আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে আমি ও আমাদের ছেলেমেয়ে দুটো শুধু হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। ঘণ্টা খানেক পর নুরুল ইসলাম নির্দোষ ছেলে দুটোকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে এলেন। ছেলেদের ফিরে পেয়ে ছেলে দুটোর মা-বাবা আর এলাকার জনগণের খুশি সেদিন আমাদের সব ভয়-বিফলতা দূর করে দিয়েছিল।
ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নুরুল ইসলাম তাঁর সারা জীবন এমন বর্ণনাযোগ্য ও অবর্ণনীয় নানা রকম প্রয়াশ করেছেন। তাঁর ও তাঁর ছেলে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আজ কে নেবে? এই দায়িত্ব কি শুধু আমার আর আমার মেয়ের? এই দায়িত্ব কি সবার নয়? স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৫ জুলাই মানববন্ধন ও আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। এটি অত্যন্ত আশার কথা। গত আড়াই বছর নুরুল ইসলাম ও তমোহরের বন্ধু, সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনেরা এ ঘটনার তদন্ত ও সুবিচারের দাবি জানিয়েছেন। বিচারের আকাঙ্ক্ষা ও দাবি নিয়ে আমার মেয়ে মৌটুসী কাঙালের মতো, আক্ষরিক অর্থে, সবার দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়াচ্ছে। শোকে আমরা কাতর হয়েছি, পাথর হয়েছি। এই হতোদ্যম অবস্থায় মাননীয় মন্ত্রীর সহানুভূতিশীল ও আশাব্যঞ্জক আশ্বাসবাক্যগুলোতে সত্যিকার অর্থে ভরসা পেয়েছি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে এই হত্যার সুবিচারের আশাও দুরাশা হবে না বলে আশা করি।
আজ ৩০ জুলাই, নুরুল ইসলামের জন্মদিন। আজ আমাদের ৪০ বছরের সংসারের বাতি নির্বাপণেরও দিন। আজ খেলা ভাঙার খেলা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসেই অবশ্য সব লন্ডভন্ড হয়েছে, বাতি নির্বাপিত হয়েছে। ৪০ বছর ধরে যে সংসার সাজিয়ে রেখেছিলাম, আজ তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে। এত দিন পুলিশ তদন্তের জন্য সিলগালা করে রেখেছিল বলে আমাদের আসবাবপত্র, বইখাতা—সব ওই বাড়িতে তদন্তের স্বার্থে রক্ষিত ছিল। তদন্ত শেষ হয়েছে বলে পুলিশ জুলাই মাসের পর বাড়িটি বাড়িওয়ালার কাছে হস্তান্তর করবে। সম্প্রতি প্রকাশিত সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রতিবেদনে যে ভয়ংকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে—আর্সেনিক, অসমিয়াম ও লেড—এই আলামতগুলো যথাযথভাবে সুরক্ষিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে শঙ্কা হয়। সায়েন্স ল্যাবরেটরির (বিসিএসআইআর) এই প্রতিবেদনগুলো পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আলামতগুলো সুরক্ষা করার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান হওয়ার জন্য আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
সরকার ও তদন্তকারী সংস্থার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা এই তদন্ত ও সুবিচারকে ত্বরান্বিত করবে বলে আমি আশা করব। মুক্তির মন্দির সোপানতলে যত প্রাণ হলো বলিদান—তাঁদের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো সুস্পষ্ট হবে।
রুবী রহমান
No comments