সংবিধান-তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিড়ম্বনা by শাহ্দীন মালিক
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ে একটা দিক স্পষ্ট—তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক। তবে আদেশের অন্য অংশে আগামী এক বা দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তাতে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ ঘটনা হলো সংসদীয় কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, একাদশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাংবিধানিক ধ্যানধারণা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কম-বেশি পরিপন্থী ছিল। এই সংশোধনীগুলো রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনীপ্রধান, এমনকি বিচার বিভাগীয় কর্তাব্যক্তিরা মিলে মূলত নিজের ক্ষমতা ও পদের স্বার্থে করেছেন। এই সংশোধনীগুলোর প্রতিটিতেই এ দেশের সব ক্ষমতার মালিক যে জনগণ, সেই জনগণের অধিকার, স্বার্থ ও ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটা এখন সহজেই বলা যায়, দেরিতে হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি যে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টমের একাংশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনী অগ্রহণযোগ্য। আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী মামলার রিভিউ আদেশে একাদশ সংশোধনীও যে বাতিলযোগ্য হতে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে একটা ঐকমত্যে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু সেই ঐকমত্যে দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। যেভাবে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে যদিও সংসদ সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছিল, কিন্তু সেই বৈধতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাংবিধানিক ধ্যানধারণার প্রতিফলন ঘটেনি।
স্পষ্টত, অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অর্থাৎ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয়েছে। দেরিতে হলেও এখন আমরা সবাই স্বীকার করছি, এ সংশোধনগুলো ছিল আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তির পরিপন্থী। পঞ্চম, সপ্তম ও একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ভার যেভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের ওপর ন্যস্ত করাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল, সেই একই পন্থায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা শাসিত হয়েছি। অনির্বাচিত ব্যক্তি যতই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হোন না কেন, তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। একইভাবে সেনাপতিরা প্রচণ্ডভাবে দক্ষ ও পটু হতে পারেন। কিন্তু জনগণ তাঁদের নির্বাচন না করলে দেশ পরিচালনার জন্য তাঁদের কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত ভিত্তি বা অধিকার নেই। আমরা যদি অনির্বাচিত কিন্তু বিচক্ষণ ব্যক্তির সরকার মেনে নিতে পারি, তাহলে অন্য যেকোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিও দেশের শাসনভার দাবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা যুক্তি থাকবে না। আমাদের প্রধান সমস্যা ছিল, রাজনীতিবিদ ও অন্য ক্ষমতালিপ্সুরা সংবিধান মেনে অর্থাৎ জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশ পরিচালনা না করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে বৈধতা দিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, এ দেশের জনগণ কেবল তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। রাজনীতিবিদেরা যদি এটা নিশ্চিত করতে না পারেন, তবে সেটা হবে রাজনীতিবিদদের সমস্যা, দুর্বলতা ও হীনম্মন্যতা। এর দায়ভার জনগণ বা সংবিধান নিতে পারে না। বারবার রাজনীতিবিদেরা সংবিধানের আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে ব্যর্থ হয়ে সংশোধনীর নামে সংবিধান কাটাছেঁড়া করে আমাদের সংবিধানকে অন্ধকার গহ্বরের কাছে নিয়ে এসেছেন। আমাদের সংবিধানকে বারবার রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির খেসারত দিতে হয়েছে।
২.
নির্বাচন নিয়ে অস্বচ্ছতা, গোলমাল, গন্ডগোল, কারচুপি, মারামারি, মাথা ফাটাফাটি হয়নি—এমন দেশ তৃতীয় বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্বাধীনতা-উত্তর তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় গন্ডগোল হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক দেশ সে সমস্যা ও সংকটের সমাধান করেছে। অনেক দেশ সমাধানের চেষ্টা করছে। আর অনেক দেশই বাস্তবিক অর্থে চেষ্টা শুরু করেনি। শেষোক্ত দলে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব কটি দেশ। আর প্রথম দলে পড়বে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এবং ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও কিছু দেশ।
গত তিন-চার বছরের অভিজ্ঞতায় এটা স্পষ্ট, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কারণে নির্বাচনসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব-কলহ-কোন্দল-কারচুপি আমরা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা হলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। মাথাব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলা অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে একটা জোড়াতালি ও গোঁজামিলের তত্ত্বাবধায়ক-সমাধান আমাদের আবিষ্কার। এই আবিষ্কারটি অন্য কেউ গ্রহণ করেনি। আর এই আবিষ্কারের ফলে রাজনীতিবিদেরা দায়িত্বহীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন আর বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে। দেরিতে হলেও এই ভুলটা আমাদের মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার একমাত্র পন্থা হলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা আর রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল হওয়া। এর কোনো বিকল্প দুনিয়ার কোনো দেশ খুঁজে বের করতে পারেনি। আমাদের সামনেও অন্য কোনো বিকল্প নেই। গাছের গোড়া কেটে যতই পানি ঢালেন না কেন, গাছ বড় হবে না।
৩.
সব সমস্যারই একটা তাত্ত্বিক, আরেকটা প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক দিক আছে। আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতাই মুখ্য, সংবিধান গৌণ। নিজের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর বাগিবতণ্ডা হবে। আর আমাদের অসহনশীল রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে যুক্তিতর্ক ও বাগিবতণ্ডা সহজেই এবং অনেক ক্ষেত্রে অনায়াসে হানাহানি, মারামারি, খুন-জখম ও অস্থিতিশীলতায় পর্যবসিত হয়। আমাদের রাজনীতির বড় দুই পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে যদি তাদের আপাতত বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে সেটা দেশের জন্য যে ভয়াবহ হবে, তা এ দেশের গণতন্ত্রমনা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীও এখন বুঝতে পারে। এবং এই বুঝতে পারা থেকে অনড় ও হানাহানির রাজনৈতিক অবস্থান জনমনে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
১৯৯৬ সালে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ ধরে এগোতে গিয়ে আমরা ১৫ বছর পিছিয়ে গেছি। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের একটা সুষ্ঠু আইন করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে অনেক দেশই পারে। অতএব আমরাও পারব। আর দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময়টা অর্থাৎ, ৬০ দিনের জন্য বর্তমান আইনে ছোট দু-তিনটি পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে আরেকটু শক্তিশালী করলেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো কি মন্দ, তার প্রধান কোন ‘পতি’ হবেন, কোন দল এর পক্ষে, কোন দল বিপক্ষে—ইত্যাকার ক্ষমতালিপ্সু কুতর্ক বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে মনোনিবেশ করাই কাম্য।
আমি নিশ্চিত, একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলো দেরিতে হলেও এখন পরিপক্বতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় রাখবে। নির্বাচনী সমস্যা কোনো জটিল ব্যাপার নয়। অনেক দেশই এর সমাধান করেছে। আমরাও সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। বাকি পথ অতিক্রম করার গ্রহণযোগ্য সমাধানই এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আর হানাহানি ও অস্থিতিশীলতা চাই না।
শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, একাদশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাংবিধানিক ধ্যানধারণা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কম-বেশি পরিপন্থী ছিল। এই সংশোধনীগুলো রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনীপ্রধান, এমনকি বিচার বিভাগীয় কর্তাব্যক্তিরা মিলে মূলত নিজের ক্ষমতা ও পদের স্বার্থে করেছেন। এই সংশোধনীগুলোর প্রতিটিতেই এ দেশের সব ক্ষমতার মালিক যে জনগণ, সেই জনগণের অধিকার, স্বার্থ ও ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটা এখন সহজেই বলা যায়, দেরিতে হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি যে চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টমের একাংশ ও ত্রয়োদশ সংশোধনী অগ্রহণযোগ্য। আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী মামলার রিভিউ আদেশে একাদশ সংশোধনীও যে বাতিলযোগ্য হতে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে একটা ঐকমত্যে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু সেই ঐকমত্যে দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। যেভাবে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে যদিও সংসদ সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছিল, কিন্তু সেই বৈধতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাংবিধানিক ধ্যানধারণার প্রতিফলন ঘটেনি।
স্পষ্টত, অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অর্থাৎ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয়েছে। দেরিতে হলেও এখন আমরা সবাই স্বীকার করছি, এ সংশোধনগুলো ছিল আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তির পরিপন্থী। পঞ্চম, সপ্তম ও একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ভার যেভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের ওপর ন্যস্ত করাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল, সেই একই পন্থায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা শাসিত হয়েছি। অনির্বাচিত ব্যক্তি যতই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হোন না কেন, তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। একইভাবে সেনাপতিরা প্রচণ্ডভাবে দক্ষ ও পটু হতে পারেন। কিন্তু জনগণ তাঁদের নির্বাচন না করলে দেশ পরিচালনার জন্য তাঁদের কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত ভিত্তি বা অধিকার নেই। আমরা যদি অনির্বাচিত কিন্তু বিচক্ষণ ব্যক্তির সরকার মেনে নিতে পারি, তাহলে অন্য যেকোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিও দেশের শাসনভার দাবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা যুক্তি থাকবে না। আমাদের প্রধান সমস্যা ছিল, রাজনীতিবিদ ও অন্য ক্ষমতালিপ্সুরা সংবিধান মেনে অর্থাৎ জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশ পরিচালনা না করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে বৈধতা দিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, এ দেশের জনগণ কেবল তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। রাজনীতিবিদেরা যদি এটা নিশ্চিত করতে না পারেন, তবে সেটা হবে রাজনীতিবিদদের সমস্যা, দুর্বলতা ও হীনম্মন্যতা। এর দায়ভার জনগণ বা সংবিধান নিতে পারে না। বারবার রাজনীতিবিদেরা সংবিধানের আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে ব্যর্থ হয়ে সংশোধনীর নামে সংবিধান কাটাছেঁড়া করে আমাদের সংবিধানকে অন্ধকার গহ্বরের কাছে নিয়ে এসেছেন। আমাদের সংবিধানকে বারবার রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির খেসারত দিতে হয়েছে।
২.
নির্বাচন নিয়ে অস্বচ্ছতা, গোলমাল, গন্ডগোল, কারচুপি, মারামারি, মাথা ফাটাফাটি হয়নি—এমন দেশ তৃতীয় বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্বাধীনতা-উত্তর তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় গন্ডগোল হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক দেশ সে সমস্যা ও সংকটের সমাধান করেছে। অনেক দেশ সমাধানের চেষ্টা করছে। আর অনেক দেশই বাস্তবিক অর্থে চেষ্টা শুরু করেনি। শেষোক্ত দলে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব কটি দেশ। আর প্রথম দলে পড়বে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এবং ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও কিছু দেশ।
গত তিন-চার বছরের অভিজ্ঞতায় এটা স্পষ্ট, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কারণে নির্বাচনসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব-কলহ-কোন্দল-কারচুপি আমরা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের সব দেশ যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা হলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। মাথাব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলা অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে একটা জোড়াতালি ও গোঁজামিলের তত্ত্বাবধায়ক-সমাধান আমাদের আবিষ্কার। এই আবিষ্কারটি অন্য কেউ গ্রহণ করেনি। আর এই আবিষ্কারের ফলে রাজনীতিবিদেরা দায়িত্বহীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন আর বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে। দেরিতে হলেও এই ভুলটা আমাদের মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার একমাত্র পন্থা হলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা আর রাজনীতিবিদদের দায়িত্বশীল হওয়া। এর কোনো বিকল্প দুনিয়ার কোনো দেশ খুঁজে বের করতে পারেনি। আমাদের সামনেও অন্য কোনো বিকল্প নেই। গাছের গোড়া কেটে যতই পানি ঢালেন না কেন, গাছ বড় হবে না।
৩.
সব সমস্যারই একটা তাত্ত্বিক, আরেকটা প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক দিক আছে। আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতাই মুখ্য, সংবিধান গৌণ। নিজের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর বাগিবতণ্ডা হবে। আর আমাদের অসহনশীল রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে যুক্তিতর্ক ও বাগিবতণ্ডা সহজেই এবং অনেক ক্ষেত্রে অনায়াসে হানাহানি, মারামারি, খুন-জখম ও অস্থিতিশীলতায় পর্যবসিত হয়। আমাদের রাজনীতির বড় দুই পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে যদি তাদের আপাতত বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে সেটা দেশের জন্য যে ভয়াবহ হবে, তা এ দেশের গণতন্ত্রমনা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীও এখন বুঝতে পারে। এবং এই বুঝতে পারা থেকে অনড় ও হানাহানির রাজনৈতিক অবস্থান জনমনে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
১৯৯৬ সালে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ ধরে এগোতে গিয়ে আমরা ১৫ বছর পিছিয়ে গেছি। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের একটা সুষ্ঠু আইন করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে অনেক দেশই পারে। অতএব আমরাও পারব। আর দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময়টা অর্থাৎ, ৬০ দিনের জন্য বর্তমান আইনে ছোট দু-তিনটি পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে আরেকটু শক্তিশালী করলেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো কি মন্দ, তার প্রধান কোন ‘পতি’ হবেন, কোন দল এর পক্ষে, কোন দল বিপক্ষে—ইত্যাকার ক্ষমতালিপ্সু কুতর্ক বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে মনোনিবেশ করাই কাম্য।
আমি নিশ্চিত, একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলো দেরিতে হলেও এখন পরিপক্বতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় রাখবে। নির্বাচনী সমস্যা কোনো জটিল ব্যাপার নয়। অনেক দেশই এর সমাধান করেছে। আমরাও সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। বাকি পথ অতিক্রম করার গ্রহণযোগ্য সমাধানই এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আর হানাহানি ও অস্থিতিশীলতা চাই না।
শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
No comments