খোলা চোখে-আদিবাসী, আমাদের প্রথম মানব by হাসান ফেরদৌস
আদিবাসীদের এই নামে ডাকা হয়, কারণ তারাই পৃথিবীর আদি মানব। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে প্রথম যে মানবভূমি গড়ে ওঠে, তারা ছিল সেই অঞ্চলের প্রথম নাগরিক। সে জন্য ইংরেজিতে আদিবাসীদের অপর নাম ‘দ্য ফার্স্ট পিপল’।
যেমন—আমেরিকা মহাদেশে শ্বেতপ্রভুদের আগমনের অনেক আগে বাস ছিল ইন্ডিয়ানদের, অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাবরিজিনদের। অথবা আমাদের দেশে চাকমা, হাজং, মারমা বা সাঁওতালদের।
নিজের দেশের আদিতম বাসিন্দা, অথচ নিজ দেশে তারা পরবাসী। এই দৃশ্য পৃথিবীর সব দেশেই। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই আদিবাসীরা আমাদেরই দেশের নাগরিক, আমাদের প্রতিবেশী, একাত্তরে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে। অথচ তাদের অধিকাংশই আমাদের অপরিচিত। কী তাদের ভাষা, কী তাদের সংস্কৃতি—এসব ব্যাপারে আমাদের বড়জোর ভাসা ভাসা ধারণা রয়েছে। তাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে তো আমাদের উপেক্ষা আরও প্রবল।
সম্প্রতি জাতিসংঘে আদিবাসীদের দশম আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি এক পা এগিয়ে এমন ঘোষণা করে বসেন, সেখানে—অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো আদিবাসীই নেই। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন, বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক ‘এথনিক মাইনরিটি’—অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বাস করে। এদের দেখভালের জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তার সবই করেছে। কী কী করেছে, এর একটি ফিরিস্তিও সেই ভাষণে তালিকাভুক্ত হয়। যেমন—নতুন মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে, আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে, এমনকি একটি ভূমি সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়েছে। প্রতিনিধি ভদ্রলোক অবশ্য জানাননি, এসব গালভরা প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে আদতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না। আদিবাসীদের একজন প্রতিনিধি জানালেন, যা পরিবর্তন হয়েছে তার সুফল পাচ্ছে সেখানে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা।
অথচ ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন চারদিকে কী প্রবল আশার সঞ্চার হয়েছিল! ভাবা হয়েছিল, একটি অন্যায্য সামরিক অবরোধের অবসান হবে। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সামরিক সরকার সেখানে কার্যত একটি সেনা-নিয়ন্ত্রিত অবস্থা গড়ে তোলে। তিন পা এগোলেই একটি সামরিক ছাউনি। আরেক চেষ্টা ছিল—পাহাড়ি ও আদিবাসী এলাকায় সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের স্থানান্তর। অনেক আগে থেকেই এই ভূমিদখল চলছে, ১৯৭৫-এর পর সে প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। ফল দাঁড়াল এই, নিজ অধিকার আদায়ের দাবিতে সেখানে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শুরু হলো রীতিমতো গেরিলা যুদ্ধ। সামরিক কর্তাব্যক্তিরা ভাবলেন, আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতির বদলে বন্দুকের নলেই পাওয়া যাবে সমাধান।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের ঘরের লাগোয়া ঘরে যে রীতিমতো এক সামরিক অবরোধ চলছে, অধিকাংশ বাঙালি তার খবর জানত না; আর যারা জানত, তাদের মনোভাব ছিল ‘বেশ হয়েছে, আরও গুঁতোও’। মনে পড়ছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস। বাংলা একাডেমীতে এক আলোচনা সভায় তিনি উপস্থিত সুধীমণ্ডলীকে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আপনারা কি জানেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রীতিমতো ফ্যাসিবাদী কায়দায় সামরিক অভিযান চলছে, যার লক্ষ্য চাকমা আদিবাসীদের নির্মূল করা?’ আমরা কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি।
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি ছিল এই কথার স্বীকৃতি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে এত দিন যা চলেছে, তা অন্যায়। সামরিক উপায়ে নয়, একমাত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এই অন্যায়ের সংশোধন সম্ভব, আওয়ামী লীগ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সেদিন আমরা সবাই অভিনন্দিত করেছিলাম। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, পাহাড়ি জনগণের যে অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, এবার চেষ্টা হবে সে অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর একাংশ সে চুক্তি না মানলেও অধিকাংশই তাতে সমর্থন জানিয়েছিল, আশা করেছিল অল্পবিস্তর পরিবর্তন নিশ্চয় হবে। প্রায় ১৫ বছর পর সে চুক্তির একটি মূল্যায়ন করেছেন জাতিসংঘের একজন বিশেষ প্রতিবেদক লারস এন্দার্স-বায়ের। জাতিসংঘের আদিবাসী স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদনটি উপস্থিত করা হয়। তার মোদ্দা বক্তব্য: মুখে মুখে অনেক কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চুক্তিতে কথা ছিল, পার্বত্য জনগণের জন্য স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সামরিক সেনাছাউনি সরিয়ে নেওয়া হবে। জমির মালিকানা নিয়ে আদিবাসী ও বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের মধ্যে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। এসবের কোনোটাই হয়নি। সেনাকর্তারা এখনো দণ্ডমুণ্ডের মালিক। পাহাড়ি জনগণের মানবাধিকারের উন্নতির যে আশা ছিল, তাতেও গুড়েবালি। আদিবাসী এলাকায় সমতল থেকে বাঙালিদের অধিগ্রহণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ। এখন তা বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। লারস এন্দার্স-বায়ের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অনগ্রগতির ফলে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে সহিংস সংঘর্ষের আশঙ্কা। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, চুক্তিটি ভালো, কিন্তু সে চুক্তি যদি শুধু কাগজে-কলমে থাকে, তাতে লাভ কী?
এই চুক্তি নিয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের সঙ্গেও কথা হলো। তিনি রাজনৈতিক মানুষ, খুব ভেবেচিন্তে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য: অগ্রগতি কিছু হয়নি তা নয়, তবে আসল কাজের চেয়ে ঢাকের আওয়াজই বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতি তাঁর আস্থা আছে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় চুক্তির বাস্তবায়ন গতি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের নাম বদলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে অভিহিত করছে, এমনকি শাসনতান্ত্রিকভাবেও সে পরিবর্তন আনতে চাইছে। এটি তাঁর পছন্দ নয়। এর ফলে কে ক্ষুদ্র, কে ক্ষুদ্র নয়, এই অহেতুক বিতর্কে আমরা জড়িয়ে পড়ব। মূল কথা যদি হয় সব বাংলাদেশির নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ, তাহলে কাউকে ছোট বা বড় করে দেখানোর প্রয়োজন কোথায়?
লাতিন আমেরিকার দু-একটি দেশ ছাড়া আদিবাসীরা পৃথিবীর সর্বত্রই প্রান্তবর্তী মানুষ। বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ কেবল তাদের আদি বাসভূমি থেকে বহিষ্কার করে তা জবরদখল করেনি, তাদের সমাজের সবচেয়ে অনগ্রসর ও অধিকারহীন করে রেখেছে। আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের কথা ভাবুন, অথবা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনদের কথা, যাদের জন্য আলাদা ‘রিজার্ভেশন’ রয়েছে। যেন চকখড়ি দিয়ে দাগ কেটে বলা হয়েছে, এই যে চক্র আঁকা হলো, এর বাইরে এক পা-ও ফেলতে পারবে না। আমাদের দেশেও সে রকম একটি চক্র রয়েছে, অবশ্য সে চক্র প্রতিদিনই ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। আরও একটা লক্ষণীয় ব্যাপার, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যেমন, আমাদের দেশেও ভাবা হয় আদিবাসী মানেই কিম্ভূতকিমাকার একটা কিছু।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গারোদের নিয়ে একটি চমৎকার গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন এলেন ব্যাল, নাম দে আস্ক ইফ উই ইট ফ্রগস (ইনস্টিটিউট অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ, সিঙ্গাপুর, ২০০৭)। এক বছর বাংলাদেশে কাটিয়েছেন মহিলা। সে সময় তিনি দেখে অবাক হয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এমন গারো বা আদিবাসী ছেলেমেয়েদেরও ওই ‘ভিন্ন মানুষের’ চশমা সেঁটে দেখা হয়, ভাবা হয় তাঁরা জংলি, অসভ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের লেখা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এলেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস, আদিবাসীরা সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি এমন কিছু নেই, যা খায় না। প্রমাণ: অধ্যাপক সাহেব ৪০০ বছর আগে এক মোগল সেনাপতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘লোহা ছাড়া এমন কোনো দ্রব্য নেই, যা এরা খায় না।’
অধ্যাপকদের কথা আলাদা, তাঁরা হাতির দাঁতের বানানো মিনারে বাস করতে ভালোবাসেন। শুধু বই না পড়ে চোখ তুলে তাকানো যদি তাঁরা শিখতেন, তাহলে হয়তো দেখতে পেতেন, আসলে আদিবাসীরা আমাদের মতোই মানুষ। তারা গরিব ও অনগ্রসর, এ কথা ঠিক, কিন্তু সে তো আমাদের তথাকথিত অগ্রসর মানুষদের কারণে। আমরাই বন্দুক দিয়ে পাহারা বসিয়েছি, যাতে তারা এগোতে না পারে। অথচ সহজ সত্য হলো এই, সমান সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাও ঠিকই দু-দশ কদম এগিয়ে যেত। কয়েক শ বছর ধরে তারা বঞ্চনার শিকার। বাকি সবার সঙ্গে সমানতালে এগোনো তাদের জন্য কঠিন, এর জন্য চাই বাড়তি সহযোগিতা, যা একমাত্র রাষ্ট্রই পারে নিশ্চিত করতে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে সে সাহায্য-সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যেও চেষ্টার কমতি নেই। দশম আদিবাসী ফোরামে আমি যে কজন আদিবাসীর সাক্ষাৎ পেয়েছি, তাদের দেখে এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছি যে নিজেদের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ সচেতন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা এ দেশের অতীতের অংশীদার। এ দেশের ভবিষ্যতেরও অংশীদার হতে চায় তারা। কিন্তু তা কেবল সম্ভব নাগরিক হিসেবে পূর্ণ সমানাধিকার অর্জিত হলে।
এই ফোরামে একটা জিনিস দেখে খুব ভালো লেগেছে, আর তা হলো, নাগরিক অধিকারের জন্য তাদের এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র তরুণ-তরুণীরাও সমর্থনের হাত বাড়িয়েছে। ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই’ বলে সরকারি ঘোষণার জবাব দিতে ফোরামে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল, সে বাঙালি। স্পষ্ট ভাষায় সে জানাল, আদিবাসী নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সে গর্বিত। কিন্তু একই সঙ্গে সে লজ্জিত এই কারণে যে এখনো অনেক বাঙালি রয়েছে, যারা আদিবাসীদের অধিকার অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না।
গান্ধী বলেছিলেন, কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে, তার পরিমাপ জানা। সন্দেহ নেই, গান্ধীর এই মাপকাঠিতে আমরা তেমন সভ্য জাতি নই। সে অবস্থা বদলাতে পারে, যদি আমরাও হাত লাগাই। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য যে লড়াই, তা একা চাকমা বা গারোদের নয়; আমাদের সবার। ঠিক যেমন মেয়েদের সমানাধিকার আন্দোলন একা মেয়েদের নয়, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই, তা একা সংখ্যালঘুদের নয়। আদিবাসী ফোরামে বাঙালি মেয়েটির কথা শুনে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, এই সহজ সত্যটা অবশেষে আমাদের কেউ ধরতে পেরেছে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
নিজের দেশের আদিতম বাসিন্দা, অথচ নিজ দেশে তারা পরবাসী। এই দৃশ্য পৃথিবীর সব দেশেই। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই আদিবাসীরা আমাদেরই দেশের নাগরিক, আমাদের প্রতিবেশী, একাত্তরে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে। অথচ তাদের অধিকাংশই আমাদের অপরিচিত। কী তাদের ভাষা, কী তাদের সংস্কৃতি—এসব ব্যাপারে আমাদের বড়জোর ভাসা ভাসা ধারণা রয়েছে। তাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে তো আমাদের উপেক্ষা আরও প্রবল।
সম্প্রতি জাতিসংঘে আদিবাসীদের দশম আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি এক পা এগিয়ে এমন ঘোষণা করে বসেন, সেখানে—অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো আদিবাসীই নেই। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন, বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক ‘এথনিক মাইনরিটি’—অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বাস করে। এদের দেখভালের জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তার সবই করেছে। কী কী করেছে, এর একটি ফিরিস্তিও সেই ভাষণে তালিকাভুক্ত হয়। যেমন—নতুন মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে, আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে, এমনকি একটি ভূমি সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়েছে। প্রতিনিধি ভদ্রলোক অবশ্য জানাননি, এসব গালভরা প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে আদতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না। আদিবাসীদের একজন প্রতিনিধি জানালেন, যা পরিবর্তন হয়েছে তার সুফল পাচ্ছে সেখানে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা।
অথচ ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন চারদিকে কী প্রবল আশার সঞ্চার হয়েছিল! ভাবা হয়েছিল, একটি অন্যায্য সামরিক অবরোধের অবসান হবে। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সামরিক সরকার সেখানে কার্যত একটি সেনা-নিয়ন্ত্রিত অবস্থা গড়ে তোলে। তিন পা এগোলেই একটি সামরিক ছাউনি। আরেক চেষ্টা ছিল—পাহাড়ি ও আদিবাসী এলাকায় সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের স্থানান্তর। অনেক আগে থেকেই এই ভূমিদখল চলছে, ১৯৭৫-এর পর সে প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। ফল দাঁড়াল এই, নিজ অধিকার আদায়ের দাবিতে সেখানে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শুরু হলো রীতিমতো গেরিলা যুদ্ধ। সামরিক কর্তাব্যক্তিরা ভাবলেন, আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতির বদলে বন্দুকের নলেই পাওয়া যাবে সমাধান।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের ঘরের লাগোয়া ঘরে যে রীতিমতো এক সামরিক অবরোধ চলছে, অধিকাংশ বাঙালি তার খবর জানত না; আর যারা জানত, তাদের মনোভাব ছিল ‘বেশ হয়েছে, আরও গুঁতোও’। মনে পড়ছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস। বাংলা একাডেমীতে এক আলোচনা সভায় তিনি উপস্থিত সুধীমণ্ডলীকে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আপনারা কি জানেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রীতিমতো ফ্যাসিবাদী কায়দায় সামরিক অভিযান চলছে, যার লক্ষ্য চাকমা আদিবাসীদের নির্মূল করা?’ আমরা কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি।
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি ছিল এই কথার স্বীকৃতি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে এত দিন যা চলেছে, তা অন্যায়। সামরিক উপায়ে নয়, একমাত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এই অন্যায়ের সংশোধন সম্ভব, আওয়ামী লীগ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সেদিন আমরা সবাই অভিনন্দিত করেছিলাম। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, পাহাড়ি জনগণের যে অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, এবার চেষ্টা হবে সে অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর একাংশ সে চুক্তি না মানলেও অধিকাংশই তাতে সমর্থন জানিয়েছিল, আশা করেছিল অল্পবিস্তর পরিবর্তন নিশ্চয় হবে। প্রায় ১৫ বছর পর সে চুক্তির একটি মূল্যায়ন করেছেন জাতিসংঘের একজন বিশেষ প্রতিবেদক লারস এন্দার্স-বায়ের। জাতিসংঘের আদিবাসী স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদনটি উপস্থিত করা হয়। তার মোদ্দা বক্তব্য: মুখে মুখে অনেক কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চুক্তিতে কথা ছিল, পার্বত্য জনগণের জন্য স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সামরিক সেনাছাউনি সরিয়ে নেওয়া হবে। জমির মালিকানা নিয়ে আদিবাসী ও বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের মধ্যে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। এসবের কোনোটাই হয়নি। সেনাকর্তারা এখনো দণ্ডমুণ্ডের মালিক। পাহাড়ি জনগণের মানবাধিকারের উন্নতির যে আশা ছিল, তাতেও গুড়েবালি। আদিবাসী এলাকায় সমতল থেকে বাঙালিদের অধিগ্রহণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ। এখন তা বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। লারস এন্দার্স-বায়ের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অনগ্রগতির ফলে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে সহিংস সংঘর্ষের আশঙ্কা। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, চুক্তিটি ভালো, কিন্তু সে চুক্তি যদি শুধু কাগজে-কলমে থাকে, তাতে লাভ কী?
এই চুক্তি নিয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের সঙ্গেও কথা হলো। তিনি রাজনৈতিক মানুষ, খুব ভেবেচিন্তে কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য: অগ্রগতি কিছু হয়নি তা নয়, তবে আসল কাজের চেয়ে ঢাকের আওয়াজই বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতি তাঁর আস্থা আছে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় চুক্তির বাস্তবায়ন গতি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের নাম বদলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে অভিহিত করছে, এমনকি শাসনতান্ত্রিকভাবেও সে পরিবর্তন আনতে চাইছে। এটি তাঁর পছন্দ নয়। এর ফলে কে ক্ষুদ্র, কে ক্ষুদ্র নয়, এই অহেতুক বিতর্কে আমরা জড়িয়ে পড়ব। মূল কথা যদি হয় সব বাংলাদেশির নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ, তাহলে কাউকে ছোট বা বড় করে দেখানোর প্রয়োজন কোথায়?
লাতিন আমেরিকার দু-একটি দেশ ছাড়া আদিবাসীরা পৃথিবীর সর্বত্রই প্রান্তবর্তী মানুষ। বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ কেবল তাদের আদি বাসভূমি থেকে বহিষ্কার করে তা জবরদখল করেনি, তাদের সমাজের সবচেয়ে অনগ্রসর ও অধিকারহীন করে রেখেছে। আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের কথা ভাবুন, অথবা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনদের কথা, যাদের জন্য আলাদা ‘রিজার্ভেশন’ রয়েছে। যেন চকখড়ি দিয়ে দাগ কেটে বলা হয়েছে, এই যে চক্র আঁকা হলো, এর বাইরে এক পা-ও ফেলতে পারবে না। আমাদের দেশেও সে রকম একটি চক্র রয়েছে, অবশ্য সে চক্র প্রতিদিনই ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। আরও একটা লক্ষণীয় ব্যাপার, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যেমন, আমাদের দেশেও ভাবা হয় আদিবাসী মানেই কিম্ভূতকিমাকার একটা কিছু।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গারোদের নিয়ে একটি চমৎকার গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন এলেন ব্যাল, নাম দে আস্ক ইফ উই ইট ফ্রগস (ইনস্টিটিউট অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ, সিঙ্গাপুর, ২০০৭)। এক বছর বাংলাদেশে কাটিয়েছেন মহিলা। সে সময় তিনি দেখে অবাক হয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এমন গারো বা আদিবাসী ছেলেমেয়েদেরও ওই ‘ভিন্ন মানুষের’ চশমা সেঁটে দেখা হয়, ভাবা হয় তাঁরা জংলি, অসভ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের লেখা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এলেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস, আদিবাসীরা সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি এমন কিছু নেই, যা খায় না। প্রমাণ: অধ্যাপক সাহেব ৪০০ বছর আগে এক মোগল সেনাপতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘লোহা ছাড়া এমন কোনো দ্রব্য নেই, যা এরা খায় না।’
অধ্যাপকদের কথা আলাদা, তাঁরা হাতির দাঁতের বানানো মিনারে বাস করতে ভালোবাসেন। শুধু বই না পড়ে চোখ তুলে তাকানো যদি তাঁরা শিখতেন, তাহলে হয়তো দেখতে পেতেন, আসলে আদিবাসীরা আমাদের মতোই মানুষ। তারা গরিব ও অনগ্রসর, এ কথা ঠিক, কিন্তু সে তো আমাদের তথাকথিত অগ্রসর মানুষদের কারণে। আমরাই বন্দুক দিয়ে পাহারা বসিয়েছি, যাতে তারা এগোতে না পারে। অথচ সহজ সত্য হলো এই, সমান সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাও ঠিকই দু-দশ কদম এগিয়ে যেত। কয়েক শ বছর ধরে তারা বঞ্চনার শিকার। বাকি সবার সঙ্গে সমানতালে এগোনো তাদের জন্য কঠিন, এর জন্য চাই বাড়তি সহযোগিতা, যা একমাত্র রাষ্ট্রই পারে নিশ্চিত করতে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে সে সাহায্য-সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যেও চেষ্টার কমতি নেই। দশম আদিবাসী ফোরামে আমি যে কজন আদিবাসীর সাক্ষাৎ পেয়েছি, তাদের দেখে এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছি যে নিজেদের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ সচেতন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা এ দেশের অতীতের অংশীদার। এ দেশের ভবিষ্যতেরও অংশীদার হতে চায় তারা। কিন্তু তা কেবল সম্ভব নাগরিক হিসেবে পূর্ণ সমানাধিকার অর্জিত হলে।
এই ফোরামে একটা জিনিস দেখে খুব ভালো লেগেছে, আর তা হলো, নাগরিক অধিকারের জন্য তাদের এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের ‘মূলধারা’র তরুণ-তরুণীরাও সমর্থনের হাত বাড়িয়েছে। ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই’ বলে সরকারি ঘোষণার জবাব দিতে ফোরামে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল, সে বাঙালি। স্পষ্ট ভাষায় সে জানাল, আদিবাসী নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সে গর্বিত। কিন্তু একই সঙ্গে সে লজ্জিত এই কারণে যে এখনো অনেক বাঙালি রয়েছে, যারা আদিবাসীদের অধিকার অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না।
গান্ধী বলেছিলেন, কোন দেশ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা পথ হলো সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখা, তারা কতটুকু নাগরিক অধিকার ভোগ করে, তার পরিমাপ জানা। সন্দেহ নেই, গান্ধীর এই মাপকাঠিতে আমরা তেমন সভ্য জাতি নই। সে অবস্থা বদলাতে পারে, যদি আমরাও হাত লাগাই। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য যে লড়াই, তা একা চাকমা বা গারোদের নয়; আমাদের সবার। ঠিক যেমন মেয়েদের সমানাধিকার আন্দোলন একা মেয়েদের নয়, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই, তা একা সংখ্যালঘুদের নয়। আদিবাসী ফোরামে বাঙালি মেয়েটির কথা শুনে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, এই সহজ সত্যটা অবশেষে আমাদের কেউ ধরতে পেরেছে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments