বিজ্ঞানীর অভিলাষ-পাকিস্তানের পারমাণবিক গর্ব বনাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা by পারভেজ হুডবয়
পাকিস্তানের পরমাণুবিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান দাবি করেন, তিনিই পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার জনক। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বেশ কয়েক বছর তাঁকে একটি প্রাসাদোপম ভবনে গৃহবন্দী রেখেছে। সেখানে বসে সংবাদপত্রে কলাম লিখে তিনি দিন গুজরান করেন। এই বিজ্ঞানীর ধারণা, পারমাণবিক বোমাই পাকিস্তানের রক্ষক।
হালে তিনি দাবি করেছেন: ‘১৯৭১ সালে পারমাণবিক সামর্থ্য থাকলে আমাদের আর দেশের অর্ধেকটা—বর্তমানের বাংলাদেশ—লজ্জাজনক পরাজয়ের মাধ্যমে হারাতে হতো না।’
৩০ হাজার পারমাণবিক বোমার ভান্ডার নিয়েও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিলয় ও ভাঙন ঠেকাতে পারেনি। তাহলে কি সত্যিই বোমার গুণে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে জিততে পারত? এখনো কি পারবে?
চলুন, আবার ১৯৭১ সাল ঘুরে আসি। আমরা যারা সে সময়টায় বড় হয়েছি, তারা অন্তর থেকে জানি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক দেশ হলেও কখনোই এক জাতি ছিল না। আজকের তরুণ পাকিস্তানিরা কল্পনাও করতে পারবে না সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে কী পরিমাণ বাঙালি-বিদ্বেষ কিলবিল করত। আমি শরমিন্দা হয়ে স্বীকার করি, আমার মতো সামান্য এক বালকও আমাদের চেয়ে খাটো ও কালোমতো বাঙালিদের স্বজাতিভুক্ত ভাবতে বিরক্ত হতাম। আমরা ছিলাম এক বদ খোয়াবের শিকার। আমরা ভাবতাম, লম্বা, ফরসা আর চোস্ত উর্দু বলিয়েরাই সাচ্চা মুসলমান আর ভালো পাকিস্তানি। রেডিও পাকিস্তানের অদ্ভুত ভাষায় উচ্চারিত বাংলা খবর শুনে স্কুলের বন্ধুরা হাসাহাসি করত।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনে বাঙালিরা অনেক ভুগেছে। জিন্নাহ সাহেবের চাওয়ামতো উর্দু জবানের পূর্ব পাকিস্তানি হয়ে ওঠা নয়, তারা বিশ্বাস করত, বাংলা জবানের বাঙালি জাতি হয়ে ওঠাই তাদের ঐতিহাসিক নিয়তি। অন্য সব ব্যাপারেও পুবের মানুষের মন বিষিয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশই ছিল তারা, রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসত তাদের অবদানে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল, আমলা আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো রাজনীতিবিদদের ভয় ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হলে ক্ষমতা ও সম্পদ সব পুব দিকে চলে যাবে।
গণতন্ত্র ও ইনসাফ থেকে বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখত, পূর্ব পাকিস্তানের নগদ টাকা পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। সেই টাকায় এখানকার সরকার চলছে, কলকারখানা চলছে, বানানো হচ্ছে বিদ্যালয় ও বাঁধ। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভোলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মরে গেল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ জেনারেলরা কিছুই করলেন না।
চূড়ান্ত বিচ্ছেদ স্পষ্ট হয়ে উঠল সত্তরের নির্বাচনে। পাকিস্তানের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হাজির হলো আওয়ামী লীগ। ভুট্টো এবং জেনারেলরা কেউ-ই জনতার রায় মানতে চাইলেন না। অবশেষে স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালিদের উঠে দাঁড়ানোর দিন এল। তাদের দমাতে পাঠানো হলো সেনাবাহিনী। গণহত্যার পিঠে এল আরও গণহত্যা। রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সংগঠক ও ছাত্রদের কচুকাটা করা হলো। নালা দিয়ে বইতে লাগল মানুষের রক্ত, কোটি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একপর্যায়ে পুবের সমর্থনে ভারত হস্তক্ষেপ করে বসলে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল, জন্ম হলো বাংলাদেশের।
পাকিস্তানের কপাল ভালো, তখন আমাদের হাতে পারমাণবিক বোমা ছিল না। ভাবতে ভয় লাগে, কোন চিন্তা মনে রেখে কাদির খান বলেন যে পারমাণবিক বোমার জোরে পাকিস্তান বেঁচে যেত? এই বিজ্ঞানী কি তাহলে ঢাকার স্বাধীনতাকামী জনতার ওপর বোমা ফেলতেন? কিংবা কলকাতা ও দিল্লিকে ধ্বংস করার জন্য তা ব্যবহার করা হতো? এবং বিনিময়ে লাহোর ও করাচির ওপর ডেকে আনত ভারতীয় ধ্বংসলীলা? অথবা আমরা কি তখন পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়ে ভারতকে দূরে রাখতাম, যাতে বিনা বাধায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানিদের হত্যা করে যেতে পারি? এমনকি সেই ভয়াবহ বোমা ছাড়াই লাখে লাখে বাঙালিকে আমরা হত্যা করতে পেরেছিলাম। পারমাণবিক বোমা দিয়ে আর কত বেশি বাঙালি মেরে কাদির খান পাকিস্তানের ভাঙন ঠেকাতেন?
কারও কারও মনে হতে পারে, পাকিস্তান এক থাকলে মৃত্যু ও ধ্বংস সত্ত্বেও দীর্ঘ মেয়াদে বাঙালিদের ভালোই হতো। যাঁরা এমন ভাবেন, কিছু পরিসংখ্যান তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। লন্ডনভিত্তিক স্বাধীন চিন্তাকেন্দ্র লেগাটাম ইনস্টিটিউট ২০১০ সালে বিশ্বের ১১০টি দেশের একটি সমৃদ্ধির তালিকা তৈরি করেছে। সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পদের নিরিখে করা এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬তম। আর পাকিস্তান হয়েছে ১০৯তম। পূর্ব পাকিস্তানের এই উন্নতি তাদের স্বাধীনতারই অবদান। অন্যদিকে, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ হয়েছে ১৪৬তম, আর পাকিস্তান রয়েছে সামান্য ওপরে, ১৪১তম। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে বাংলাদেশ বড়জোর সামান্য এগোতে পারত।
কিন্তু পরিসংখ্যান সব সময় সত্যের পুরোটা দেখায় না। বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে গরিব কিন্তু বেশি আশাবাদী আর বেশি সুখী। তাদের সংস্কৃতি প্রাণবন্ত, শিক্ষা এগোচ্ছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সফল। এবং দেশটি প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমায় তছনছ হয় না। সেখানকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সামরিক বাহিনীও নিয়মিত হামলার শিকার নয়।
তাহলে পাকিস্তানের এই মহান বোমা বর্তমানে কী ফল দিচ্ছে? এটা না থাকলে কি ভারত পাকিস্তানকে গিলে খেত, উল্টিয়ে দিত ৪৭-এর দেশভাগ? এ রকম চিন্তা এক শ ভাগ খামখেয়াল। প্রথমত, ভারত দ্রুতবেগে বর্ধমান একটি অর্থনীতি এবং ১০২ কোটি জনসংখ্যার ভার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ভয়ানক গরিব। আরও ১৮ কোটি মানুষের ভার নেওয়া, তাদের খাওয়ানো-পরানোর দায় ভারত কেন নিতে যাবে? দ্বিতীয়ত, ভারত আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী হয়ে উঠলেও অসম যুদ্ধের কারণে কোনো এলাকা দখল ও তা ধরে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারি এবং কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারির দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার পর কমপক্ষে তিনবার ভারত আমাদের আক্রমণের ঝোঁক সামলে নিয়েছে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের কারগিল অনুপ্রবেশের পর পাকিস্তানে অবস্থিত জঙ্গিশিবিরে হামলার জন্য ভারতের ভেতরে ক্রুদ্ধ চাপ তৈরি হয়েছিল। ওই বছরেরই ১৩ ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদ ভবন আক্রান্ত হওয়ার পরও তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ আশঙ্কা তৈরি হয় মুম্বাইতে সন্ত্রাসী হামলার পর। কার্যত পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা এর জনগণকে নয়, এখানে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ছত্রচ্ছায়া হিসেবেই ব্যবহূত হয়। দুনিয়ায় যে-ই ইসলামের নামে বা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে, তার কাছেই পাকিস্তান হয়ে ওঠে এক লোভনীয় মিত্র। কারণটা সেই পারমাণবিক বোমা। আরব, চেচেন, উইঘুর, উজবেক এবং বিভিন্ন পশ্চিমা শক্তিও পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে চায় এ কারণেই। যত দূর জানা গেছে, পাকিস্তানই ছিল লাদেনের শেষ আশ্রয়।
একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে বেদনাদায়ক শিক্ষা নিতে হয়েছিল, এখন তা শিখতে হচ্ছে পাকিস্তানকেও। পারমাণবিক বোমা জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। বরং এর জন্যই পাকিস্তান আজ ভেতরে-বাইরে দুর্দশার কবলে পড়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ বোমা-দর্শন দিতে পারছে না।
আরও বেশি বোমা বানিয়ে আমরা আমাদের বাঁচাতে পারব না। আত্মরক্ষার খাতিরেই আমাদের দরকার জীবন্ত ও টেকসই গণতন্ত্র। যুদ্ধের অর্থনীতির বদলে দরকার শান্তির অর্থনীতি। দরকার এমন এক ফেডারেশন, যেখানে প্রদেশগুলোর বঞ্চনার ন্যায্য প্রতিকার করা হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো পাকিস্তানের সামন্তশাসনের অবসান ঘটিয়ে এমন এক সহনশীল সমাজ গঠন করা, যে সমাজের মানুষ আইনকে শ্রদ্ধা করবে।
পাকিস্তানের দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
পারভেজ হুডবয়: পাকিস্তানের পরমাণু পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।
৩০ হাজার পারমাণবিক বোমার ভান্ডার নিয়েও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিলয় ও ভাঙন ঠেকাতে পারেনি। তাহলে কি সত্যিই বোমার গুণে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে জিততে পারত? এখনো কি পারবে?
চলুন, আবার ১৯৭১ সাল ঘুরে আসি। আমরা যারা সে সময়টায় বড় হয়েছি, তারা অন্তর থেকে জানি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক দেশ হলেও কখনোই এক জাতি ছিল না। আজকের তরুণ পাকিস্তানিরা কল্পনাও করতে পারবে না সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে কী পরিমাণ বাঙালি-বিদ্বেষ কিলবিল করত। আমি শরমিন্দা হয়ে স্বীকার করি, আমার মতো সামান্য এক বালকও আমাদের চেয়ে খাটো ও কালোমতো বাঙালিদের স্বজাতিভুক্ত ভাবতে বিরক্ত হতাম। আমরা ছিলাম এক বদ খোয়াবের শিকার। আমরা ভাবতাম, লম্বা, ফরসা আর চোস্ত উর্দু বলিয়েরাই সাচ্চা মুসলমান আর ভালো পাকিস্তানি। রেডিও পাকিস্তানের অদ্ভুত ভাষায় উচ্চারিত বাংলা খবর শুনে স্কুলের বন্ধুরা হাসাহাসি করত।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনে বাঙালিরা অনেক ভুগেছে। জিন্নাহ সাহেবের চাওয়ামতো উর্দু জবানের পূর্ব পাকিস্তানি হয়ে ওঠা নয়, তারা বিশ্বাস করত, বাংলা জবানের বাঙালি জাতি হয়ে ওঠাই তাদের ঐতিহাসিক নিয়তি। অন্য সব ব্যাপারেও পুবের মানুষের মন বিষিয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশই ছিল তারা, রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসত তাদের অবদানে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল, আমলা আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো রাজনীতিবিদদের ভয় ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হলে ক্ষমতা ও সম্পদ সব পুব দিকে চলে যাবে।
গণতন্ত্র ও ইনসাফ থেকে বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখত, পূর্ব পাকিস্তানের নগদ টাকা পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। সেই টাকায় এখানকার সরকার চলছে, কলকারখানা চলছে, বানানো হচ্ছে বিদ্যালয় ও বাঁধ। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভোলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মরে গেল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ জেনারেলরা কিছুই করলেন না।
চূড়ান্ত বিচ্ছেদ স্পষ্ট হয়ে উঠল সত্তরের নির্বাচনে। পাকিস্তানের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হাজির হলো আওয়ামী লীগ। ভুট্টো এবং জেনারেলরা কেউ-ই জনতার রায় মানতে চাইলেন না। অবশেষে স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালিদের উঠে দাঁড়ানোর দিন এল। তাদের দমাতে পাঠানো হলো সেনাবাহিনী। গণহত্যার পিঠে এল আরও গণহত্যা। রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সংগঠক ও ছাত্রদের কচুকাটা করা হলো। নালা দিয়ে বইতে লাগল মানুষের রক্ত, কোটি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একপর্যায়ে পুবের সমর্থনে ভারত হস্তক্ষেপ করে বসলে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল, জন্ম হলো বাংলাদেশের।
পাকিস্তানের কপাল ভালো, তখন আমাদের হাতে পারমাণবিক বোমা ছিল না। ভাবতে ভয় লাগে, কোন চিন্তা মনে রেখে কাদির খান বলেন যে পারমাণবিক বোমার জোরে পাকিস্তান বেঁচে যেত? এই বিজ্ঞানী কি তাহলে ঢাকার স্বাধীনতাকামী জনতার ওপর বোমা ফেলতেন? কিংবা কলকাতা ও দিল্লিকে ধ্বংস করার জন্য তা ব্যবহার করা হতো? এবং বিনিময়ে লাহোর ও করাচির ওপর ডেকে আনত ভারতীয় ধ্বংসলীলা? অথবা আমরা কি তখন পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়ে ভারতকে দূরে রাখতাম, যাতে বিনা বাধায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানিদের হত্যা করে যেতে পারি? এমনকি সেই ভয়াবহ বোমা ছাড়াই লাখে লাখে বাঙালিকে আমরা হত্যা করতে পেরেছিলাম। পারমাণবিক বোমা দিয়ে আর কত বেশি বাঙালি মেরে কাদির খান পাকিস্তানের ভাঙন ঠেকাতেন?
কারও কারও মনে হতে পারে, পাকিস্তান এক থাকলে মৃত্যু ও ধ্বংস সত্ত্বেও দীর্ঘ মেয়াদে বাঙালিদের ভালোই হতো। যাঁরা এমন ভাবেন, কিছু পরিসংখ্যান তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। লন্ডনভিত্তিক স্বাধীন চিন্তাকেন্দ্র লেগাটাম ইনস্টিটিউট ২০১০ সালে বিশ্বের ১১০টি দেশের একটি সমৃদ্ধির তালিকা তৈরি করেছে। সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পদের নিরিখে করা এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬তম। আর পাকিস্তান হয়েছে ১০৯তম। পূর্ব পাকিস্তানের এই উন্নতি তাদের স্বাধীনতারই অবদান। অন্যদিকে, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ হয়েছে ১৪৬তম, আর পাকিস্তান রয়েছে সামান্য ওপরে, ১৪১তম। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে বাংলাদেশ বড়জোর সামান্য এগোতে পারত।
কিন্তু পরিসংখ্যান সব সময় সত্যের পুরোটা দেখায় না। বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে গরিব কিন্তু বেশি আশাবাদী আর বেশি সুখী। তাদের সংস্কৃতি প্রাণবন্ত, শিক্ষা এগোচ্ছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সফল। এবং দেশটি প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমায় তছনছ হয় না। সেখানকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সামরিক বাহিনীও নিয়মিত হামলার শিকার নয়।
তাহলে পাকিস্তানের এই মহান বোমা বর্তমানে কী ফল দিচ্ছে? এটা না থাকলে কি ভারত পাকিস্তানকে গিলে খেত, উল্টিয়ে দিত ৪৭-এর দেশভাগ? এ রকম চিন্তা এক শ ভাগ খামখেয়াল। প্রথমত, ভারত দ্রুতবেগে বর্ধমান একটি অর্থনীতি এবং ১০২ কোটি জনসংখ্যার ভার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ভয়ানক গরিব। আরও ১৮ কোটি মানুষের ভার নেওয়া, তাদের খাওয়ানো-পরানোর দায় ভারত কেন নিতে যাবে? দ্বিতীয়ত, ভারত আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী হয়ে উঠলেও অসম যুদ্ধের কারণে কোনো এলাকা দখল ও তা ধরে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারি এবং কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারির দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার পর কমপক্ষে তিনবার ভারত আমাদের আক্রমণের ঝোঁক সামলে নিয়েছে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের কারগিল অনুপ্রবেশের পর পাকিস্তানে অবস্থিত জঙ্গিশিবিরে হামলার জন্য ভারতের ভেতরে ক্রুদ্ধ চাপ তৈরি হয়েছিল। ওই বছরেরই ১৩ ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদ ভবন আক্রান্ত হওয়ার পরও তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ আশঙ্কা তৈরি হয় মুম্বাইতে সন্ত্রাসী হামলার পর। কার্যত পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা এর জনগণকে নয়, এখানে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ছত্রচ্ছায়া হিসেবেই ব্যবহূত হয়। দুনিয়ায় যে-ই ইসলামের নামে বা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে, তার কাছেই পাকিস্তান হয়ে ওঠে এক লোভনীয় মিত্র। কারণটা সেই পারমাণবিক বোমা। আরব, চেচেন, উইঘুর, উজবেক এবং বিভিন্ন পশ্চিমা শক্তিও পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে চায় এ কারণেই। যত দূর জানা গেছে, পাকিস্তানই ছিল লাদেনের শেষ আশ্রয়।
একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে বেদনাদায়ক শিক্ষা নিতে হয়েছিল, এখন তা শিখতে হচ্ছে পাকিস্তানকেও। পারমাণবিক বোমা জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। বরং এর জন্যই পাকিস্তান আজ ভেতরে-বাইরে দুর্দশার কবলে পড়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ বোমা-দর্শন দিতে পারছে না।
আরও বেশি বোমা বানিয়ে আমরা আমাদের বাঁচাতে পারব না। আত্মরক্ষার খাতিরেই আমাদের দরকার জীবন্ত ও টেকসই গণতন্ত্র। যুদ্ধের অর্থনীতির বদলে দরকার শান্তির অর্থনীতি। দরকার এমন এক ফেডারেশন, যেখানে প্রদেশগুলোর বঞ্চনার ন্যায্য প্রতিকার করা হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো পাকিস্তানের সামন্তশাসনের অবসান ঘটিয়ে এমন এক সহনশীল সমাজ গঠন করা, যে সমাজের মানুষ আইনকে শ্রদ্ধা করবে।
পাকিস্তানের দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
পারভেজ হুডবয়: পাকিস্তানের পরমাণু পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।
No comments