টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি-টেস্ট ক্রিকেটে ৫১, ওয়ানডেতে ৪৯-আমাদের সাক্ষী রেখেই তাঁর অমর কীর্তি by মোস্তফা মামুন
আমরা খুব করে চাইছিলাম সেঞ্চুরির সেঞ্চুরিটা ঢাকাতেই হোক। আমরা একদমই চাইছিলাম না সেঞ্চুরির সেঞ্চুরিটা বাংলাদেশের বিপক্ষেই হোক। কিন্তু হলো দুটিই। কাল মিরপুরে শেষ বিকেলের আলোয় শচীনীয় রূপকথার সর্বশেষতম সংস্করণটি দেখতে দেখতে একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল।
লর্ডস-মেলবোর্ন-দিলি্ল পার হয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা আমাদের মাঠে, আমাদের সাক্ষী রেখে! কিন্তু আবার সেটা তো আমাদের বিপক্ষে; উপভোগ্যতায় তাই একটা কাঁটা বিঁধে থাকছেই। এ এমন এক সুখানুভূতি, যা ভাসিয়ে নিচ্ছে না, প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা লাগাম ধরে রাখছে। পুরো স্টেডিয়ামের দর্শক সেঞ্চুরি হওয়ার পর দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছে। কিন্তু এই দর্শকরাই তো আবার এতক্ষণ তাঁর সিঙ্গেল নিতে ব্যর্থতায় গর্জন করছিল। তারাও করণীয় সম্পর্কে সন্দিহান এবং দ্বিধাগ্রস্ত।
গত কয়েক দিন এশিয়া কাপের আবহসংগীতে শততম সেঞ্চুরির সুর এত বেশি বেজেছে যে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই সমীকরণ মেলানো হচ্ছিল, এশিয়া কাপে হবে কি না! হলে কার বিপক্ষে? প্রথম ম্যাচ শ্রীলঙ্কা, সেখানে না-ই হতে পারে যখন অস্ট্রেলিয়াতেও ওরা বেশ কয়েকবার টেন্ডুলকারকে বিফল করে সেঞ্চুরিবঞ্চিত রাখার ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এরপর বাংলাদেশ! সন্দেহজনক বোলিং শক্তি, বড় আসরে তালগোল পাকিয়ে ফেলার বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রতিপক্ষ। কিন্তু আবার এটাও তো ঠিক যে এ বাংলাদেশই তাঁকে আগের ১০ বারের চেষ্টায় সেঞ্চুরি করতে দেয়নি। বাংলাদেশ দলের কাছেও প্রশ্নটা ঘুরেফিরে গিয়েছে। টিম মিটিং করেই কিনা কে জানে, একটা কূটনৈতিক উত্তর তৈরি করে রাখা হয়েছিল। আর টেপরেকর্ডারের মতো সেটা বেজে গেছে অবিরাম, টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি আমরাও চাই; কিন্তু সেটা যেন আমাদের বিপক্ষে না হয়। সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর আনন্দ-বেদনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এই হাওয়াই কূটনীতিটারই বা মানে কী? বাংলাদেশের বিপক্ষে টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরিতে এমন কী ক্ষতি যখন গিলেস্পিরাও ডাবল সেঞ্চুরি করে গেছেন! এমন তো নয় যে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি না পেলে আর কেউ কখনো পাবেন না, এই কালও তিনি না করলে হয়তো সময়-সুযোগ পেয়ে অন্য কেউ করতেন, তাহলে আর অসুবিধা কী? আরেক দিক থেকে দেখলে তাঁর সেঞ্চুরির ফলেই সেঞ্চুরিজনিত সতর্কতার কারণে বরং রানটা একটু কম হয়েছে। কাজেই এ সেঞ্চুরি তো সব দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য লাভজনক। লাভজনক বাংলাদেশের ভাবীকালের ক্রিকেট রোমান্টিকতার জন্যও। ৫০ বছর পরও স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারব, টেন্ডুলকারকে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরির জন্য বাংলাদেশে আসতে হয়েছিল!
হয়তো কোনো তরুণ শ্রোতা জানতে চাইবে, বাংলাদেশে আসতে হয়েছিল কেন?
উত্তর হবে, অন্য কোথাও হচ্ছিল না। দেশে-বিদেশে কোথাও না। শেষে টেন্ডুলকার এলেন বাংলাদেশে, কাঁধে রাজ্যের চাপ। এরপর ১৬ মার্চ বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচে টস জিতে বাংলাদেশ তাঁকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানাল...। মিরপুর স্টেডিয়াম মহামঞ্চের মতো কীর্তিবরণে কী অপরূপ রূপে শোভিত! তাঁর দর্শকদের সবার হাতে যেন দেবতার জন্য অদৃশ্য ফুল। আর তিনি, দেবতা, ঐশ্বরিক ক্ষমতার আরেকটি বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে আরেকবার চূড়ায়। ক্রিকেট নামের খেলাটির বয়স কত বছর হয়ে গেল, কত প্রাপ্তির, কত অর্জনের, কত আনন্দের গল্প তাঁর থরে থরে সাজানো; কিন্তু কেউ কি কোনো দিন ভাবতে পেরেছিল বিংশ শতকের শেষভাগে এমন এক অতিক্রিকেটমানব আসবেন, যিনি সেঞ্চুরিরও সেঞ্চুরি করবেন! সেঞ্চুরি নামের ম্যাজিক ফিগার যাঁর হাতে হয়ে যাবে রোজদিনকার কারবার।
১৯৯৯ সাল। রাজনৈতিক উত্তেজনা, যুদ্ধ ইত্যাদির ডামাডোল পেরিয়ে বহু বছর পর ভারতে পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে বিদেশি সাংবাদিকরা আমন্ত্রিত। তখন প্রাক-টেস্ট যুগ, এর আগে টেন্ডুলকার এক-দুইবার মাত্র বাংলাদেশে এসেছেন। নানা কায়দায় একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হলেও তিনি তখনও দূরের তারা। সেই দূরের তারা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হাত বাড়ানো দূরত্বে। আর খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার নাছোড় মানসিকতার কারণেই সম্ভবত টেন্ডুলকারের এই সামান্য সাংবাদিকের কথা মনে ছিল। আড্ডার মেজাজে, কাছেই কিছু দুষ্টামি সেখানে টেন্ডুলকারের ব্যাকরণেও অনুমোদিত বোধ হয়। নির্দেশের স্বরে বললেন, 'নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকার চাও?'
অবশ্যই চাই।
তাহলে ওনার সাক্ষাৎকার নাও।
উনি বলতে অজিত ওয়াদেকার, ভারতের তখনকার ম্যানেজার।
খুব বিব্রতকর অবস্থা। আবার যিনি প্রায় দেবতাতুল্য, তাঁর সামান্য একটা অনুরোধ রাখা যাবে না। কাজেই কোনো রকমে সামাল দিতে ওয়াদেকারকে প্রশ্নটা করলাম, আপনার কি মনে হয় তিনি (টেন্ডুলকার) অবসর নেওয়ার আগে ৪০টি টেস্ট সেঞ্চুরি এবং ১৫ হাজার টেস্ট রান করতে পারবেন?
ওয়াদেকার কী উত্তর দিয়েছিলেন, তা আজ আর ঠিক মনে নেই। মনে আছে টেন্ডুলকারের আকর্ণবিস্তৃত হাসি। সেই হাসিতে কি অবিশ্বাস ছিল? নিজের সক্ষমতা কি নিজের কাছেও ঠিক স্পষ্ট ছিল না? কে জানে, হয়তো...। মানুষের নিজের ভেতরের এমন এক আমি থাকে, যার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে জীবনের কোনো একটা সময়। চ্যালেঞ্জের সময়। প্রয়োজনের সময়। টেন্ডুলকারের ভেতরের ক্ষমতার 'আমি'র সঙ্গে প্রয়োজনেরও একটা 'আমি' আছে, এই আমি সব সময় জিনিয়াসের সঙ্গে মানায় না, প্রতিভাবানের বিবর্ণ রূপটা সে দেখায়। কিন্তু এই আমিটাই কিন্তু আরো ১০ জন জিনিয়াস থেকে টেন্ডুলকারকে আলাদা করে সবচেয়ে উঁচু বেদিতে বসিয়েছে। এই আমি শিল্পীর সৌন্দর্য থেকে তাঁকে ঘর্মাক্ত শ্রমিকে নামিয়ে আনে কখনো কখনো। এমনিতে তাঁর স্বাভাবিক দ্যুতিতেই হয়ে যেতে পারত, যেমন হয়েছিল বিশ্বকাপের ৯৮ ও ৯৯তম সেঞ্চুরি। কিন্তু এরপর আর ঠিক হচ্ছিল না। হচ্ছিল না বলে পাওয়ার জন্য সুন্দরের সঙ্গে আপস করলেন, শিল্পিত রূপটা দূরীভূত হয়ে ঘামে ভেজা শ্রমিকের মতো শ্রম ঢেলে নিজেকে নিবেদন করলেন। বলের পর বল গেল। মেডেন দিলেন। তবু লক্ষ্যে অটুট। সেঞ্চুরির জন্য এমন মরিয়া চেষ্টা উচিত কি না এই প্রশ্ন তোলেন। এটা তাঁর একটা সমালোচনা। চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী লারার বিপক্ষে এ জন্যই তাঁকে কেউ কেউ নিচে রাখে যে লারা এমন কাজ কখনো করতেন না। কিন্তু শেষ বিচারে কি দরকারের সময় নিজের এই প্রয়োজনীয় সত্তার আবির্ভাব এবং তার প্রয়োগই তাঁকে অনন্য করে রাখে না! এ জন্যই লারা ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ বছরও তিনি দিব্যি ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করে চলেন। উন্নাসিকতায় কেউ কেউ মাইলফলক নিয়ে নাক সিঁটকাতে পারে, হতে পারে এটা শুধুই সংখ্যা; কিন্তু এই সংখ্যাগুলোতে কত বৈচিত্র্য। বেশির ভাগই তুলিতে আঁকা, সংগীতের মূর্ছনায় ভরপুর; কিন্তু মাঝেমধ্যে যে তাতে শ্রমিকের ঘামও লেগে আছে। আছে যোদ্ধার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। বীরের শক্তিগাথা। এমন বৈচিত্র্য আছে বলেই ঐশ্বরিক প্রতিভা, অতিপ্রাকৃত সামর্থ্যের সঙ্গে মানুষী শ্রম মিশে আছে বলেই না তিনি এতখানি আবেগ! ঈশ্বর তিনি আবার ততটাই মানুষ। স্বর্গীয় তিনি, আবার পার্থিবও তো!
তখন তারকাপতনের যুগ চলছে। গাভাস্কার-জহির আব্বাসরা গেছেন। হ্যাডলি-গাওয়াররাও যাই যাই করছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্ধর্ষ পেস চতুষ্টয়ের শরীরেও বয়সের ভার। সেই আশির দশকের শেষভাগে, আমাদের যাদের ক্রিকেট ভালোবাসার উন্মেষ, তাদের হাহাকারের দিনে এলেন তিনি। রূপকথা হয়ে। জাদুজাল নিয়ে। আমাদের সেই মরুজীবনে তৃপ্তির বর্ষণ বইয়ে। এরপর এক অনিঃশেষ, অসমাপ্ত রোমাঞ্চযাত্রা। তিনি চলেন স্বপ্নের পথে। আর আমরা সব যেন তাঁর স্বপ্নসঙ্গী।
আমরা বলি, আমরা টেন্ডুলকারের শুরু দেখেছি। টেন্ডুলকারকে বড় হতে দেখেছি। আমরা কী ভাগ্যবান!
আর কাল থেকে আমরা আরো ভাগ্যবান। আমরা যে তাঁর শততম সেঞ্চুরিটা চোখের সামনে দেখলাম!গত কয়েক দিন এশিয়া কাপের আবহসংগীতে শততম সেঞ্চুরির সুর এত বেশি বেজেছে যে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই সমীকরণ মেলানো হচ্ছিল, এশিয়া কাপে হবে কি না! হলে কার বিপক্ষে? প্রথম ম্যাচ শ্রীলঙ্কা, সেখানে না-ই হতে পারে যখন অস্ট্রেলিয়াতেও ওরা বেশ কয়েকবার টেন্ডুলকারকে বিফল করে সেঞ্চুরিবঞ্চিত রাখার ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এরপর বাংলাদেশ! সন্দেহজনক বোলিং শক্তি, বড় আসরে তালগোল পাকিয়ে ফেলার বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রতিপক্ষ। কিন্তু আবার এটাও তো ঠিক যে এ বাংলাদেশই তাঁকে আগের ১০ বারের চেষ্টায় সেঞ্চুরি করতে দেয়নি। বাংলাদেশ দলের কাছেও প্রশ্নটা ঘুরেফিরে গিয়েছে। টিম মিটিং করেই কিনা কে জানে, একটা কূটনৈতিক উত্তর তৈরি করে রাখা হয়েছিল। আর টেপরেকর্ডারের মতো সেটা বেজে গেছে অবিরাম, টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি আমরাও চাই; কিন্তু সেটা যেন আমাদের বিপক্ষে না হয়। সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর আনন্দ-বেদনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এই হাওয়াই কূটনীতিটারই বা মানে কী? বাংলাদেশের বিপক্ষে টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরিতে এমন কী ক্ষতি যখন গিলেস্পিরাও ডাবল সেঞ্চুরি করে গেছেন! এমন তো নয় যে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি না পেলে আর কেউ কখনো পাবেন না, এই কালও তিনি না করলে হয়তো সময়-সুযোগ পেয়ে অন্য কেউ করতেন, তাহলে আর অসুবিধা কী? আরেক দিক থেকে দেখলে তাঁর সেঞ্চুরির ফলেই সেঞ্চুরিজনিত সতর্কতার কারণে বরং রানটা একটু কম হয়েছে। কাজেই এ সেঞ্চুরি তো সব দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য লাভজনক। লাভজনক বাংলাদেশের ভাবীকালের ক্রিকেট রোমান্টিকতার জন্যও। ৫০ বছর পরও স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারব, টেন্ডুলকারকে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরির জন্য বাংলাদেশে আসতে হয়েছিল!
হয়তো কোনো তরুণ শ্রোতা জানতে চাইবে, বাংলাদেশে আসতে হয়েছিল কেন?
উত্তর হবে, অন্য কোথাও হচ্ছিল না। দেশে-বিদেশে কোথাও না। শেষে টেন্ডুলকার এলেন বাংলাদেশে, কাঁধে রাজ্যের চাপ। এরপর ১৬ মার্চ বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচে টস জিতে বাংলাদেশ তাঁকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানাল...। মিরপুর স্টেডিয়াম মহামঞ্চের মতো কীর্তিবরণে কী অপরূপ রূপে শোভিত! তাঁর দর্শকদের সবার হাতে যেন দেবতার জন্য অদৃশ্য ফুল। আর তিনি, দেবতা, ঐশ্বরিক ক্ষমতার আরেকটি বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে আরেকবার চূড়ায়। ক্রিকেট নামের খেলাটির বয়স কত বছর হয়ে গেল, কত প্রাপ্তির, কত অর্জনের, কত আনন্দের গল্প তাঁর থরে থরে সাজানো; কিন্তু কেউ কি কোনো দিন ভাবতে পেরেছিল বিংশ শতকের শেষভাগে এমন এক অতিক্রিকেটমানব আসবেন, যিনি সেঞ্চুরিরও সেঞ্চুরি করবেন! সেঞ্চুরি নামের ম্যাজিক ফিগার যাঁর হাতে হয়ে যাবে রোজদিনকার কারবার।
১৯৯৯ সাল। রাজনৈতিক উত্তেজনা, যুদ্ধ ইত্যাদির ডামাডোল পেরিয়ে বহু বছর পর ভারতে পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে বিদেশি সাংবাদিকরা আমন্ত্রিত। তখন প্রাক-টেস্ট যুগ, এর আগে টেন্ডুলকার এক-দুইবার মাত্র বাংলাদেশে এসেছেন। নানা কায়দায় একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হলেও তিনি তখনও দূরের তারা। সেই দূরের তারা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হাত বাড়ানো দূরত্বে। আর খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার নাছোড় মানসিকতার কারণেই সম্ভবত টেন্ডুলকারের এই সামান্য সাংবাদিকের কথা মনে ছিল। আড্ডার মেজাজে, কাছেই কিছু দুষ্টামি সেখানে টেন্ডুলকারের ব্যাকরণেও অনুমোদিত বোধ হয়। নির্দেশের স্বরে বললেন, 'নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকার চাও?'
অবশ্যই চাই।
তাহলে ওনার সাক্ষাৎকার নাও।
উনি বলতে অজিত ওয়াদেকার, ভারতের তখনকার ম্যানেজার।
খুব বিব্রতকর অবস্থা। আবার যিনি প্রায় দেবতাতুল্য, তাঁর সামান্য একটা অনুরোধ রাখা যাবে না। কাজেই কোনো রকমে সামাল দিতে ওয়াদেকারকে প্রশ্নটা করলাম, আপনার কি মনে হয় তিনি (টেন্ডুলকার) অবসর নেওয়ার আগে ৪০টি টেস্ট সেঞ্চুরি এবং ১৫ হাজার টেস্ট রান করতে পারবেন?
ওয়াদেকার কী উত্তর দিয়েছিলেন, তা আজ আর ঠিক মনে নেই। মনে আছে টেন্ডুলকারের আকর্ণবিস্তৃত হাসি। সেই হাসিতে কি অবিশ্বাস ছিল? নিজের সক্ষমতা কি নিজের কাছেও ঠিক স্পষ্ট ছিল না? কে জানে, হয়তো...। মানুষের নিজের ভেতরের এমন এক আমি থাকে, যার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে জীবনের কোনো একটা সময়। চ্যালেঞ্জের সময়। প্রয়োজনের সময়। টেন্ডুলকারের ভেতরের ক্ষমতার 'আমি'র সঙ্গে প্রয়োজনেরও একটা 'আমি' আছে, এই আমি সব সময় জিনিয়াসের সঙ্গে মানায় না, প্রতিভাবানের বিবর্ণ রূপটা সে দেখায়। কিন্তু এই আমিটাই কিন্তু আরো ১০ জন জিনিয়াস থেকে টেন্ডুলকারকে আলাদা করে সবচেয়ে উঁচু বেদিতে বসিয়েছে। এই আমি শিল্পীর সৌন্দর্য থেকে তাঁকে ঘর্মাক্ত শ্রমিকে নামিয়ে আনে কখনো কখনো। এমনিতে তাঁর স্বাভাবিক দ্যুতিতেই হয়ে যেতে পারত, যেমন হয়েছিল বিশ্বকাপের ৯৮ ও ৯৯তম সেঞ্চুরি। কিন্তু এরপর আর ঠিক হচ্ছিল না। হচ্ছিল না বলে পাওয়ার জন্য সুন্দরের সঙ্গে আপস করলেন, শিল্পিত রূপটা দূরীভূত হয়ে ঘামে ভেজা শ্রমিকের মতো শ্রম ঢেলে নিজেকে নিবেদন করলেন। বলের পর বল গেল। মেডেন দিলেন। তবু লক্ষ্যে অটুট। সেঞ্চুরির জন্য এমন মরিয়া চেষ্টা উচিত কি না এই প্রশ্ন তোলেন। এটা তাঁর একটা সমালোচনা। চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী লারার বিপক্ষে এ জন্যই তাঁকে কেউ কেউ নিচে রাখে যে লারা এমন কাজ কখনো করতেন না। কিন্তু শেষ বিচারে কি দরকারের সময় নিজের এই প্রয়োজনীয় সত্তার আবির্ভাব এবং তার প্রয়োগই তাঁকে অনন্য করে রাখে না! এ জন্যই লারা ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ বছরও তিনি দিব্যি ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করে চলেন। উন্নাসিকতায় কেউ কেউ মাইলফলক নিয়ে নাক সিঁটকাতে পারে, হতে পারে এটা শুধুই সংখ্যা; কিন্তু এই সংখ্যাগুলোতে কত বৈচিত্র্য। বেশির ভাগই তুলিতে আঁকা, সংগীতের মূর্ছনায় ভরপুর; কিন্তু মাঝেমধ্যে যে তাতে শ্রমিকের ঘামও লেগে আছে। আছে যোদ্ধার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। বীরের শক্তিগাথা। এমন বৈচিত্র্য আছে বলেই ঐশ্বরিক প্রতিভা, অতিপ্রাকৃত সামর্থ্যের সঙ্গে মানুষী শ্রম মিশে আছে বলেই না তিনি এতখানি আবেগ! ঈশ্বর তিনি আবার ততটাই মানুষ। স্বর্গীয় তিনি, আবার পার্থিবও তো!
তখন তারকাপতনের যুগ চলছে। গাভাস্কার-জহির আব্বাসরা গেছেন। হ্যাডলি-গাওয়াররাও যাই যাই করছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্ধর্ষ পেস চতুষ্টয়ের শরীরেও বয়সের ভার। সেই আশির দশকের শেষভাগে, আমাদের যাদের ক্রিকেট ভালোবাসার উন্মেষ, তাদের হাহাকারের দিনে এলেন তিনি। রূপকথা হয়ে। জাদুজাল নিয়ে। আমাদের সেই মরুজীবনে তৃপ্তির বর্ষণ বইয়ে। এরপর এক অনিঃশেষ, অসমাপ্ত রোমাঞ্চযাত্রা। তিনি চলেন স্বপ্নের পথে। আর আমরা সব যেন তাঁর স্বপ্নসঙ্গী।
আমরা বলি, আমরা টেন্ডুলকারের শুরু দেখেছি। টেন্ডুলকারকে বড় হতে দেখেছি। আমরা কী ভাগ্যবান!
No comments